রহস্যের নাম ক্রিকেট (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

রহস্যের নাম ক্রিকেট ( তৃতীয় ও শেষ পর্ব )

লেখা – শান্তনু দাস
ছবি – অরিজিৎ

(আগে যা ঘটেছে… ইন্দ্রদার সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে এসে ওর বন্ধু ক্রিকেটার সুমিতদার সঙ্গে দেখা। সেমিফাইনালে গোহারান হেরে সুমিতদার সন্দেহ ঐ টুর্নামেন্টে কিছু একটা কারচুপি চলছে। এদিকে বিকালে হাঁটতে গিয়ে এক পাগল গোছের লোক আমাদের সাবধান করল, স্টেডিয়ামে নাকি চোরাকারবার চলে! সবাই কথাটা উড়িয়ে দিলেও ইন্দ্রদা একবার ক্লাবঘরে গিয়ে তদন্ত করে এল। ফাইনাল ম্যাচ চলাকালীন সেই পাগলকে দেখা গেল ক্লাবঘরের গুদামঘরে কিছু খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। তারপর…

ওখান থেকে বেরিয়ে আমি আর ইন্দ্রদা ফুটপাথের একটা দোকান থেকে এক প্লেট মোমো কিনে ভাগাভাগি করে খেলাম। এরপর ইন্দ্রদা ওর বন্ধু সুমিতকে একটা ফোন করল। আধ ঘণ্টার মধ্যে সুমিতদা এসে পড়তেই আমরা শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলাম। আকাশের মেঘগুলো তখন হুঙ্কার ছাড়ছে। ভয়ংকর কিছু একটা হবার আভাস দিচ্ছে তারা। চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালা ছিল। ক্লাবের কাছাকাছি এসে দরজায় টোকা মারলাম। ভেতরে রয়েছেন গনেশ ঘোষ, তপেন গুহ, জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন সৌরভ নাগ আর ক্লাবের সেই ছেলে চারটে। ইন্দ্রদাকে দেখে সৌরভ নাগের মুখে হাসি ফুটল। ইন্দ্রদার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করতে করতে উনি বললেন, “আমাদের খেলা কেমন লাগল বলুন?”
ইন্দ্রদা প্রত্যুত্তরে জানাল, “দারুন। তবে কিছুটা মিসটিরিয়াস।”
কথাটা শুনে সৌরভ নাগের মুখটা এক ঝটকায় কালো হয়ে গেল। সুমিত বিশ্বাস সৌরভ নাগের সঙ্গে কোনো কথা বলছে না।
তপেন গুহ এবার বললেন, “আসুন আসুন, আপনাদের জন্যেই ওয়েট করছিলাম। আসুন একসঙ্গে ফাইন্যাল খেলাটা উপভোগ করি।”
-“যদিও উপভোগ্য নয়।” ইন্দ্রদা এরকম ঠোটকাটা কথা বলছিল কেন বুঝতে পারছিলাম না। আমরা চেয়ারে বসলাম। বড় প্রোজেক্টরের পর্দায় ভেসে উঠল ফাইন্যাল খেলা। প্রথমেই দেখা গেল ভি আই পি গেস্টের সিটগুলো। তারপর দেখলাম জয়পুর ক্লাবের বিপক্ষ টিমের প্লেয়াররা চেয়ারে বসে কফি আর টিফিন খাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা কথা… ইন্দ্রদা বলেছিল কফিতে নাকি বারবিটন মেশানো আছে, যদিও সেটা প্লেয়ারদের কফিতে নাও থাকতে পারে। কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারলাম না। এইজন্যই কি প্রত্যেক ম্যাচে জয়পুর জিতে যাচ্ছে? তার মানে কি জয়পুর টিমের কেউ জেনেশুনেই কফিতে বারবিটন মিশিয়েছে? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সামান্য একটু বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ার একদম খেলতেই পারবে না, সেটা কি করে হয়? নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রোজেক্টর স্ক্রিনের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল, খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছে। আম্পায়াররা চলে এসেছেন, ব্যাটসম্যানও নেমে গেছে।
খেলা শুরু হবার প্রথম ওভারেই শোনা গেল জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের উল্লাস। প্রথম উইকেট হাতে এসে গেছে। সৌরভ নাগের দিকে একবার চোখ ফেরালাম। খেলার সময় যেমন উল্লসিত হচ্ছিলেন তেমনই তার মনে এখনও উল্লাস রয়েছে। গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছিল, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন সৌরভ নাগ। ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই ।
কয়েক ওভার শেষ হতেই আমার ভাল লাগছিল না বলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে সন্ধ্যে হয়ে যেতেই শীত ভাবটা একটু একটু করে বাড়ছিল। মাথায় একটা স্পোর্টস ক্যাপ ছিল। ভাবলাম মাফলারটা আনলে ভাল হত। ক্লাবের ঘড়িটা একটা বিচ্ছিরি ঢং ঢং শব্দ করে ছটা বাজিয়ে দিল। আমার সময় কাটছিল না, সুমিত বিশ্বাসকেও দেখলাম উশখুশ করছে। ইন্দ্রদা একমনে খেলা দেখে চলেছে। তবে সৌরভ নাগ লোকটা বেশ মজার। খেলার মাঝে মাঝেই উইকেট পতনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছিলেন। ইন্দ্রদা কিন্তু গম্ভীর, গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বুঝতে পারছিলাম সুমিত বিশ্বাসও বেশ অস্বস্তি ফিল করছে। ইন্দ্রদাকে বলে আমি আর সুমিতদা একটু বাইরে বেরোলাম।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে দার্জিলিং শহরের আলোগুলো সেই অন্ধকারকে মুছে দিয়েছে। শিবতলা স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটগুলো এখন না জ্বললেও স্টেডিয়ামের প্রত্যেকটি ব্লকে ব্লকে টিমটিম করে এল ই ডি লাইট দিপদিপ করছিল।
সুমিতদা বেশ বিরক্তির সুরেই বলল, “ডিসগাসটিং… ঐ সৌরভ নাগ লোকটার মধ্যে এতটুকু ক্যাপ্টেনসুলভ আচরণ নেই, শুধু পাগলার মত লাফাতেই জানে।”
-“তা যা বলেছো সুমিতদা।”
-“আচ্ছা তোমার কি মনে হয় সৌম্য, এই খেলার পেছনে কোনো রহস্যই নেই? তোমার ইন্দ্রদার তো কোনো সাড়াশব্দ দেখছি না।”
-“ইন্দ্রদা কি ভাবছে জানি না, তবে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার, ম্যাচ শুরু হবার আগে যে কমপ্লিমেনটারি ব্রেকফাস্ট বা এনারজি ড্রিঙ্কস দেওয়া হয় প্লেয়ারদের, সেই কফির মধ্যে বা ড্রিঙ্কসের মধ্যে বারবিটন নামক এক ওষুধ মেশানো থাকে।”
কথাটা শোনামাত্রই ইন্দ্রদার বন্ধু চমকে উঠল। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুমি কি করে জানলে?”
-“ইন্দ্রদা বলেছে।”
-“ওহ মাই গড! সেই জন্যই খেলার সময় মাঠে নেমে শরীরটা ঝিমঝিম লাগে। মনে হয় যেন চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি নিজে ব্যাটিং করার সময় ফিল করেছি। আর মাঝে মাঝে চোখের সামনে বিদ্যুতের মত রোদ খেলে যায় বলে মনে হয়।”
-“এফেক্ট অফ বারবিটন সুমিতদা।”
এরপর আর ওসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি। মার্কেটে কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন ক্লাবে ফিরে এলাম তখন ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা। ক্লাবের দরজার কাছাকাছি আসতেই চমকে যেতে হল, সেই পাগলাটা নিপুণ কৌশলে ক্লাবের দরজায় উঁকি মারছে। আজ ওর মাথায় টুপি নেই। আমরা চুপি চুপি পাগলটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সুমিত বিশ্বাস ওর কাঁধে হাত দিতেই পাগলটা চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, “না ছেড়ে দাও, আমি কিছু করিনি, আমি কিছু করিনি।”
ততক্ষনে চেঁচামেচিতে ক্লাবের ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। ইন্দ্রদাই এসে পাগলটার হাত ধরে টেনে তুলে ওকে গণধোলাইয়ের থেকে বাঁচাল।
-“হাই, মিস্টার চোরাকারবার। ধন্যবাদ তোমার সেদিনের ইনফরমেশনের জন্য। তবে আমি আজ এখানে উপস্থিত না থাকলে তোমার গণধোলাই কেউ আটকাতে পারত না। পরের বার এরকম কাজ করার আগে ভেবেচিন্তে করবে।”
ইন্দ্রদার নির্দেশে পাগলটাকে ছেড়ে দেওয়া হল। ক্লাবে আর ঢোকা হল না। ইন্দ্রদা বলল, “কাল সকালে আপনারা সবাই থাকছেন তো? সুমিত তুইও চলে আসিস? একটা নাটকের যবনিকাপাত হতে চলেছে।”
-“হ্যাঁ, আমরা সবাই থাকব। পরশু দিনে ফাইন্যাল কাপ দেওয়া হবে তাই একটা মিটিং ও আছে।”
সৌরভ নাগের দিকে তাকালাম। মুখে দেখলাম গর্বের হাসি। কিন্তু হাসিটা কেমন যেন নৃশংস মনে হল।
ইন্দ্রদা বলল, “একবার ফাইন্যালের সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে যেতে পারি কি?”
কেউ আপত্তি করল না। হোটেলে ফিরে এলাম। টাইটান ইন্দ্রদার কথা মত সিডি প্লেয়ার সঠিক সময়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেছে। নটা পনেরো নাগাদ ইন্দ্রদা একবার বাইরে বেরোল। আধ ঘণ্টা কেটে গেল। আমি সি ডি ক্যাসেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। ওপরে একটা হলুদ কাগজ সাঁটা রয়েছে, লেখা ছিল ‘ফাইন্যাল ব্যাটেল’। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা, হোটেল রুমের ভেতরে থেকেও তা টের পাচ্ছিলাম। ইন্দ্রদা প্রায় এক ঘণ্টা পর কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় গিয়েছিলে?”
-“এখন শুধু জেনে রাখ, পুলিশ স্টেশন।”
-“এখন কি তাহলে আবার খেলা দেখা শুরু করবে?”
-“ঠিক তাই।”
-“ডিনার করার পর?”
-“হুম।”
-“কিছু কি সন্দেহজনক মনে হচ্ছে?”
-“হ্যাঁ।” এই ছোট উত্তরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার চলে এল। খাবার পর ঠিক এগারোটায় ইন্দ্রদা সিডি টা চালাল। একই খেলা বারবার দেখার কোনো মানে হয় না। আমি পাঁচ মিনিট দেখার পরই শুয়ে পড়লাম। ঘুম কিন্তু আসতে চাইছিল না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে কাল সকালেই ক্লাবে ইন্দ্রদা ক্রিকেট রহস্য ফাঁস করবে। কে হতে পারে এই রহস্যের নাটের গুরু? কিই বা তার উদ্দেশ্য? ঘুম আসার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম ইন্দ্রদা খেলা দেখে চলেছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে, “শুধুমাত্র বারবিটন খেয়ে যে এটা হতে পারে না সেটা বুঝতে এতটা দেরি হয়ে গেল… ”

-“কিছুই দেরি হয়নি সৌরভ বাবু, আসুন। আমিও এই পনেরো মিনিট হল এসেছি।” ইন্দ্রদা সৌরভ নাগের উদ্দেশ্যে বলল।
পরের দিন সকাল নটার মধ্যে আমরা ক্লাবঘরে পৌঁছে গেলাম। তবে ভেতরে না ঢুকে আমরা বাইরে একটা দেবদারু গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলাম সবাই। কালকের তুলনায় আজকে ঠাণ্ডা অনেকটা কম ছিল, কুয়াশাও ছিল বেশ। আমাদের প্রত্যেকের হাতে মাটির ভাঁড়ে ছিল গরম গরম দার্জিলিং চা। ইন্দ্রদা সি ডি ক্যাসেটটা ফেরত দিয়ে বলতে শুরু করল, “সুমিতকে দেখছি না তো?”
গণেশ ঘোষ বললেন, “এখনই এসে পড়বেন।”
তপেন গুহ জিজ্ঞেস করলেন, “খেলা কেমন দেখলেন ইন্দ্রজিৎ বাবু? আমার তো বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-“খেলাটা দেখলাম বটে কিন্তু মনের মত হল না। মনে হচ্ছিল মাঝে একটু আকাশ মেঘলা থাকলে ভাল হত বা বৃষ্টি হলে খেলাটা আরো জমে যেত। তাই নয় কি সৌরভ বাবু?”
সৌরভ নাগের ডান পা টা সামান্য কেঁপে উঠল।
গনেশ ঘোষ বললেন, “তা আপনি কি বলতে চাইছেন খোলসা করে একটু বলুন তো?”
-“আমি কি বলতে চাইছি সেটা সৌরভ বাবু ভালই বুঝতে পারছেন।”
দেবদারু গাছটার পেছনে একটা চেনা গলা শুনতে পেলাম। সুমিত বিশ্বাস চলে এসেছে। একটি অবাঙালি ছেলে সবাইকে মাটির ভাঁড়ে আবার একবার করে চা দিয়ে গেল।
ইন্দ্রদা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল, “সৌরভ নাগ আপনি ভেবেছিলেন সবার চোখে ধুলো দিয়ে ফাইন্যাল কাপ নেবেন? কিন্তু সে আশায় যে আমি জল ঢালতে বাধ্য হচ্ছি সৌরভ বাবু।”
সৌরভ নাগের হাতে চায়ের ভাঁড়টা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।
-“আপনি কি বলতে চাইছেন ইন্দ্রজিৎবাবু?”
-“আপনি এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? আমি জানি আপনার একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়।”
চারপাশে একটি পাহাড়ি ময়নার ডাক ছাড়া একদম পিন পড়া নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। তার ফলে ইন্দ্রদার গলার স্বর পাথরের মত কঠিন। সুমিত বিশ্বাসও ফ্যাকাসে মেরে গেছে।
-“সৌরভ বাবু আপনি ভেবেছিলেন প্লেয়ারদের কফিতে আর এনার্জি ড্রিঙ্কসে বারবিটন মিশিয়ে দেবেন, আর কেউ সেটা জানতেও পারবে না?”
-“আ… আমি কিন্তু… ”
-“আপনি একটা ভুল করেছেন কফিটা আমাকে খেতে দিয়ে। তা না হলে হয়তো এই রহস্যের সমাধান এতটা তাড়াতাড়ি হত না। বারবিটন এমনই একটা ড্রাগস যেটা খেলে যে কোনো শক্তিশালী মানুষ নিমেষের মধ্যে অলস ও অবসন্ন হয়ে পড়ে উইদআউট এনি আদার সাইড এফেক্ট।”
-“আর আপনি বলতে চাইছেন তার জন্যই প্রত্যেকটা ম্যাচ জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব জিতে যাচ্ছে? আপনি পারেনও মশাই।” হা হা হা করে হেসে উঠলেন তপেনবাবু ও গনেশবাবু।
সুমিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও রাগে ফুঁসছে। ইন্দ্রদার পরের কথাগুলো সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল, “ঠিকই বলেছেন আপনারা, একটুখানি বারবিটন খেয়ে কোনো প্লেয়ারকে অবসন্ন করা যায়, কিন্তু একেবারে না খেলার যোগ্য করে দেওয়া যায় না। তাই আমিও চিন্তায় পড়ে যাই কিভাবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাব, মানে সৌরভ বাবুর টিম অত সহজে প্রত্যেকটা ম্যাচ জিতে যাচ্ছে। আর সেটার কারনও বুঝতে পারি ভিডিও ক্যাসেটটা দেখে। আমি প্রথম দিনই ম্যাচের দুজন আম্পায়ার মানে আপনাদের হাতে বিশেষ বড় বড় ঘড়ি লক্ষ্য করেছিলাম। সূর্যের আলো পড়ে ঘড়ির ওপরের মিরর প্লেটগুলো চকচক করছিল। তখন কিছু বুঝতে পারিনি। পরে যখন ভিডিও দেখলাম তখন আমি ম্যাচের দুজন আম্পায়ারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম। জয়পুর টিমের বোলার বল করার সাথে সাথেই আম্পায়ার ঘড়ির ওপর সূর্যের আলোর ছটা প্রতিফলন করে ব্যাটসম্যানের চোখে ফেলছেন। আর বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা তখন বারবিটন খেয়ে নেশাগ্রস্ত। নেশাগ্রস্ত চোখকে ফাঁকি দেওয়া আপনাদের পক্ষে কঠিন ব্যাপার ছিল না গণেশ বাবু ও তপেন বাবু।”
তাচ্ছিল্যের সুরে তপেন বাবু বলে উঠলেন, “বলে যান, বলে যান, ইন্দ্রজিৎ বাবু। আমরাও খুব এনজয় করছি গল্পটা।”
হঠাৎ সুমিত বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে গণেশ ঘোষ, তপেন গুহ, সৌরভ নাগকে কঠোরভাবে গালাগালি দিতে শুরু করল। ইন্দ্রদাই সুমিতদাকে সামলালো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসার পর ইন্দ্রদা আবার কথা বলা শুরু করল, “আমার প্রথম সন্দেহ তখন জাগে যখন আমি ম্যাচের লিস্টটা দেখি। লক্ষ্য করেছিলাম জয়পুর টিমের সঙ্গে প্রত্যেকটা ম্যাচ দিনের বেলায় হয়েছে কারন সূর্যকে তো কাজে লাগাতে হবে। সূর্যদেবই আপনাদের মত ভীরু কাপুরুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন কারন আকাশ মেঘলা থাকলে আম্পায়ারের হাতের ঘড়ি থেকে আলো প্রতিফলন করা সম্ভব হত না।”
সৌরভ নাগের মুখ নিচু। ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন, “আমার ভুল হয়ে গেছে। ফাইন্যাল কাপ জিতে হ্যাটট্রিক করার আশায় টাকা দিয়ে এনাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কথা দিচ্ছি আবার নতুন করে টুর্নামেন্ট হবে।”
-“সে তো আপনাকে প্রেস কনফারেন্স করে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু সৌরভ বাবু আপনাকে ক্ষমা করা গেলেও গনেশবাবু ও তপেনবাবুকে ক্ষমা করা যাবে না। কারন আইনের চোখে এনারা আরো অপরাধী।”
তপেন গুহ হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন, “আপনি কি আমাদের পুলিশে দেবেন নাকি মশাই?”
ইন্দ্রদার গলার স্বর আরো ধারালো হয়ে গেছে, “দরকার হলে তাই করব।”
গণেশ ঘোষ আবার হেসে উঠলেন … “ কেন, আমরা কি খুন করেছি, না চুরি করেছি যে আমাদের পুলিশে দেবেন?”
কঠোর গলায় ইন্দ্রদার উত্তর এল, “আপনারা খুনও করেননি, চুরিও করেননি, কিন্তু করেছেন চোরাই মালের ব্যবসা।”
-“আপনার কাছে কি প্রমান আছে তার?”
-“শুধু আমার কাছেই নয়, পুলিশের কাছেও প্রমান আছে। আপনার গুদাম ঘরের মধ্যেই রয়েছে চোরাই মাল। খুব সম্ভবত সেগুলো কর্কের বলের মধ্যেই রয়েছে।”
দুজনেই এবার চমকে উঠলেন। অস্ফুটে কথা বেরোল গণেশ ঘোষের মুখ থেকে, “আপনি জানলেন কিভাবে?”
-“দৃষ্টিশক্তি। দৃষ্টিশক্তি থাকলে সবকিছুই বোঝা সম্ভব। আমি যেদিন গুদামঘরটা দেখতে ঢুকি সেদিনই লক্ষ্য করি বস্তার বলগুলো, কয়েকটার গায়ে এইচ লেখা। তবে সব বলগুলোতে ছিল না। তখন অতটা মাথায় আসেনি। কিন্তু পরে যখন একটা পাগলাকে আপনাদের ক্লাবঘরে ঢুকতে দেখলাম… ”
তপেন গুহ চেঁচিয়ে উঠলেন, “কি! পাগলাটা আমাদের ক্লাবঘরে ঢুকেছিল? ঐ ব্যাটা আপনাকে সব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। আর একটা পাগলের কথা বিশ্বাস করে আপনি কিনা… ”
ইন্দ্রদা কথাটা শেষ হতে না দিয়েই বলল, “ সাট আপ মিস্টার গুহ। যাই হোক যেটা বলছিলাম, পাগলটা ক্লাবঘরের ভেতরে একটা বলকে ছুরি দিয়ে কাটল। টর্চের আলোয় দেখলাম বল থেকে বেরিয়ে এল সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ। আমি নিশ্চিত হলাম ওটা হেরোইন ছাড়া কিছু হতে পারে না।”
এবার সুমিত বিশ্বাসের প্রশ্ন, “কিন্তু পাগলটা ক্লাবঘরে কেন ঢুকতে গেল?”
-“চোরাই মালের ব্যবসা সত্যিই আছে কিনা দেখবার জন্য। যে বলগুলোর গায়ে এইচ লেখা ছিল সেগুলোতেই কেবলমাত্র হেরোইন ভর্তি ছিল। হেরোইন ভর্তি বলগুলোকে আপনারা এইচ অক্ষর দিয়ে সনাক্ত করতেন, তাই নয় কি? তা কোথায় কোথায় আপনাদের শাখা প্রশাখা গজিয়ে উঠেছে এবার ঠাণ্ডা ঘরে গিয়েই জবাব দেবেন চলুন।”
ইন্দ্রদা বারবারই আড়চোখে দেবদারু গাছটার পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল। এবার বাঁ হাতটা তুলে ইশারা করে বলল, “বিপ্লববাবু এবারে ভেতরে আসুন। হাতকড়া এনেছেন তো?”
আমাদের সামনে এবার যে আসল তার চেহারা দেখে তো আমার চোখ কপালে উঠে গেল। এ যে সেই পাগলটা, সম্পূর্ণ পুলিশ অফিসারের ড্রেসে।
ইন্দ্রদা বলল, “পাগল নয়। ইনি দার্জিলিং পুলিশ স্টেশনের ওসি বিপ্লব সান্যাল। সত্যিই চোরাই মালের ব্যবসা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য এনাকে পাগলার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল।”
বিপ্লববাবু গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহর হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে বললেন, “বাঃ! মানিকজোড়কে ভালই মানিয়েছে তো হাতে গয়না পরে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ বাবু আপনি বুঝলেন কি করে আমি পুলিশের লোক? আমি তো প্রথম দিন আপনার সাথে দেখা করে আমার পরিচয় আত্মগোপন করেছিলাম আপনাকে ভড়কে দেবার জন্যই।”
ইন্দ্রদা বলল, “সেদিন আপনি ক্লাবঘরে যখন ছিলেন তখন আপনাকে একটা ছোট্ট ডায়রি ও পেন বের করতে দেখেছিলাম। তাতে লেখা ছিল দার্জিলিং পি এস। পি এস আসলে পুলিশ স্টেশন। এরপর আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি?”
মানিকজোড়কে জিপে তুলে দিয়ে শিবতলা স্টেডিয়াম পেছনে ফেলে আমরা হোটেল মঞ্জুষার দিকে পা বাড়ালাম। কুয়াশার চাদরে ঢাকা দার্জিলিং শহর তখন অনেকটা স্নিগ্ধ ও সতেজ।

Author: admin_plipi