বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ১১)

বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ১১)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার

সারা রাত ভালো করে ঘুম হয় না রামুর এক অজানা আতঙ্কে। বারবার উঠে উঠে নিজের গায়ে হাত রেখে দেখছে জ্বর আসলো না তো? মৃত্যুভয় যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে। আগে এত ভয় ছিলনা রামুর কিন্তু সন্ধ্যা মারা যাবার পর মনটা যেন বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে ওই একমাত্র ছেলেটির জন্য। ভোলা ডাকে রামু উঠে পড়ে। না শরীরটা ভালই লাগছে, কিছু হবে না আর। ভোলা কিন্তু নির্বিকার, ওর কোন কালে ভয় বলে কিছু নেই। কে ভেবেছিল যে ভোলাকে একসময় পাড়ার লোক দূর দূর করত, আজ সেই সবার পাশে দাঁড়াবে, সবার বিপদে ঝাপিয়ে পড়বে।
-“যাক রামু, তোর একটা হিল্লে হয়ে গেল। আজ থেকে তুই টোটো নিয়ে বাইরে বেরোতে পারবি। সকাল-সকাল স্নান করে মায়ের মন্দিরে একটু পুজো দিয়ে আজ থেকে শুরু করে দে তোর কাজ।”
রামু আবেগে ভোলার হাত দুটো ধরে ফেলে, “ভাই, তুই আমার ভগবান রে। আজ তুই না থাকলে ছেলে নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াতাম জানি না রে।” -“দুর দুর! আমি ভগবান ভগবান কিছু না রে। ওসব ছাড়, শুরু কর কাজ। আর ছেলেটাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিস কদিন পর, আর বেশি দেরি নেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর চিন্তা করিস না।”
-“হ্যাঁরে ছেলেটাকে পড়াব, জানিস ও পড়াশোনায় খুব ভালো। ওর মার খুব আশা ছিল ওকে নিয়ে।” দূরে বিশ্ব আপন মনে একটা খাতায় আঁকিবুকি করে চলেছে। আজ যেন রামু সত্যিই পায়ের তলার মাটি খুঁজে পেয়েছে, সন্ধ্যার স্বপ্ন সার্থক করতে ওকে যে হবেই। সকাল-সকাল স্নান করে নেয় রামু, ছেলেকে স্নান করে নিতে বলে, ছেলেকে সাথে নিয়ে টোটো বের করে বাড়ি থেকে। বেরোবার আগে মাসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে রামু। গ্রামের কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে ছেলেকে টোটোতে বসায় রামু। আজ বিশ্বকে নিয়ে বেরোবে, কতদিন ধরে ছেলেটা ঘরবন্দি। আজ বিশ্বকে দেখাবে রামু নিজের ছোটবেলাকার গ্রাম, গ্রামের পুরনো প্রাইমারি স্কুল, যেখানে রামু পড়াশোনা করেছে।
বিশ্ব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, কত সবুজ গাছপালা ধানক্ষেত চারদিকে। জন্মের পর থেকেই দিল্লির ঘিঞ্জি বস্তিতে বড় হয়েছে বিশ্ব এত সুন্দর সবুজে ঘেরা গ্রাম কখনো দেখেনি সে। -“বাবা এই স্কুলে পড়তে তুমি? প্রতিদিন স্কুলে যেতে?”
-“হ্যাঁ বাবা, না গেলে উপায় ছিল? তোমার ঠাকুমা যে আমাকে খেতে দিত না ইস্কুল না গেলে।”
বাবার কথায় বিশ্ব হেসে ফেলে।
-“তা বাবা, কেন তুমি অনেক অনেক পড়াশোনা কর নি?”
-“তখন পড়ার মর্ম বুঝি নি বাবা, যদি বুঝতাম তাহলে ফাঁকি দিতাম না। এইট পাশ দিয়েই পড়ার থেকে মন উঠে গেল, আর বাপটা ও মারা গেল। সংসারটা তো চালাতে হবে, তাই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দোকানে কাজে লেগে গেলাম। আজ বুঝি বাবা, পড়াশোনা জানলে আজ এত কষ্ট পেতে আমাদের হত না। তাই বলি, তোমাকে এখানে স্কুলে ভর্তি করে দেব, অনেক দূর পড়াশোনা করবে তুমি। আমার মত যেন লোকের দয়ায় তোমাকে বাঁচতে না হয় বাবা। মস্ত বড় মানুষ হবে তুমি, তখন আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না।” বিশ্ব বাবার কথার মানে এত বোঝে না, তবে এতটুকু বোঝে আবার তার স্কুলের জীবন শুরু হবে, অনেক বন্ধু হবে, অনেক খেলা হবে। আনন্দে মনটা ভরে ওঠে বিশ্বর। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের রাস্তায় ছুটছে টোটো, আজ আবার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে তার, আজ যদি মা ওর পাশে থাকত তবে কত মজাই না হত ওর।

চলবে …

Author: admin_plipi