যোগদিবস ও প্রাচীন ভারত

JogDiboshOPrachinBharat-by-Arup-Kumar-Pal-at-Pandulipi.net

লেখা: অরূপ কুমার পাল | ছবি: আদিরূপ সমাজদার

শুরুতেই সকলকে আন্তর্জাতদিক যোগ দিবসের অনেক শুভেচ্ছা। ‘যোগ’ বলতে আজকে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ যোগাসন, প্রাচীন ভারতের পাতা উল্টালে যোগ কথার মূল অর্থ এটা দাঁড়ায় না। তাহলে চলুন জেনে নিই যোগ আসলে কি বা প্রাচীন ভারতের মূলে যোগের প্রাসঙ্গিকতাটাই বা কি? আর যেহেতু আজ যোগ দিবস তাই এই অন্বেষণের দিন হিসেবে আজকের দিনটা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্কৃতে প্রতিটি শব্দই তৈরি হয় তার একটি মূল অর্থাৎ ধাতু থেকে। যেমন জগত কথাটি এসেছে √গম ধাতু থেকে, আর গম কথার অর্থ হল গমন করা, তাই জগৎ শব্দের অর্থ করলে দাঁড়ায় যার গমন আছে এমন কিছু। তেমনি যোগ কথাটি এসেছে √যুজ ধাতু থেকে। বৈদিক শব্দগুলির অর্থ নির্ধারনে পাণিনির ব্যাকরণ ও শব্দার্থ সম্ভার সবচেয়ে বেশি উপযোগী এবং পুরাতনও। পাণিনির শব্দার্থ অনুযায়ী যুজ শব্দটির প্রধান দুটি অর্থ বেরোয়, ১. যুক্ত হওয়া ও ২. একাগ্র (to concentrate ) হওয়া। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন বই বিভিন্ন সময়ে এই দুটি অর্থের যেকোনো একটিকে যোগ কথার অর্থ হিসেবে নিয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত অর্থ যেটা দাঁড়ায় সেটা হলো যুক্ত হওয়া। এবার প্রশ্ন হল কার সাথে যুক্ত হওয়া? এক্ষেত্রে ওনারা একটি বিশেষ উপায় অবলম্বন করতেন, যেমন যার সাথে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হবে সেটিকে যোগ এর আগে ব্যবহার করা, যেমন জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ইত্যাদি (এই শব্দগুলোর ব্যবহার আমাদের প্রায় সবারই পরিচিত)। তবে সমস্ত কিছুর যদি সারাংশ বার করবার চেষ্টা করি, তাহলে পাওয়া যায় যোগ শব্দটি ব্যবহার করা হতো জুড়ে যাবার জন্য, কখনো সেটা এই ক্ষুদ্র শরীরের সমগ্র প্রকৃতির সাথে জুড়ে যাওয়া, কখনো বা শরীরের চেতন তত্ত্বকে জগতের মহাচেতন এর সাথে যুক্ত হওয়া। যদি আমরা প্রাচীন ভারতের মূলে ঢোকার চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাব প্রায় এর সব দর্শন তথা সমস্ত সাহিত্যেই কোথাও না কোথাও এই সৃষ্টির সমগ্রের সাথে নিজেকে একাত্ম করবার এক বিপুল প্রচেষ্টা ছিল ও এই প্রচেষ্টায় সর্ব দুঃখ নিবারণের উপায় ছিল। এই চেষ্টা যদি জ্ঞানার্জনের মাধ্যম দিয়ে হতো তাহলে বলা হতো তাকে জ্ঞানযোগ, যদি প্রকৃত কর্মকৌশল অর্জনের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা হতো তাকে বলা হতো কর্মযোগ, বিপুল ভক্তি যদি এই চেষ্টার মূল হতো তখন তাকে বলা হতো ভক্তিযোগ ইত্যাদি।

তবে যোগ শব্দের স্বাধীন ব্যবহারও প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায়, ভারতীয় দর্শন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যে ছয়টি আস্তিক ভারতীয় দর্শন আছে তার মধ্যে যোগদর্শন হল অন্যতম। মহর্ষি পতঞ্জলি রচিত ‘যোগসুত্র’ এই যোগ দর্শনের মূল গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। মহর্ষি পতঞ্জলি তার যোগসূত্রে আটটি প্রধান যোগ ক্রিয়ার কথা বলেছেন তার মধ্যে প্রাণায়াম হল একটি, যা বর্তমানে যোগ বলতে যা বুঝি তার সাথে মিল আছে। বাকি সাতটি মূলত পূর্বোক্ত একাত্ম হওয়ার প্রক্রিয়া বিশেষ।

বর্তমানে যোগ বলতে যা বুঝি অর্থাৎ যোগাসন তার সরাসরি মিল পাওয়া যায় হটযোগ নামক শাস্ত্রের মাধ্যমে। সংস্কৃতে ‘হঠ’ কথার অর্থ হল ‘বল'(force)আর এখানে বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়াগুলিকে যোগের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়েছে। এই হটযোগ ক্রিয়া মূলত নাথ সম্প্রদায় ভারতের পরম্পরা ক্রমে বয়ে নিয়ে আসছেন, তবে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং জৈন সম্প্রদায়ের এক বড় অংশ এই হঠযোগের সাথে যুক্ত ।

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের খুব স্বল্প অধ্যায়নের মাধ্যমে যেটুকু বুঝেছি, যোগকে উনারা কেবলমাত্র মানসিক সমৃদ্ধির কারণ হিসেবে তুলে ধরেন নি সাথে সাথে শারীরিক উৎকৃষ্টতাকেও সমানভাবে জোর দিয়েছেন দুঃখ মুক্তির উপায় হিসেবে।

Author: admin_plipi