আবিষ্কারের নেশায়

 

 

 

ছোটবেলা থেকেই দাদার আর আমার অজানাকে জানার অদম্য আগ্রহ ও ইচ্ছে ছিল। ১৯৭৭ সাল- বাবা তখন দার্জিলিং তাগদার রেঞ্জ অফিসার ছিলেন। ’৭৭ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত বাবা ছিলেন দার্জিলিং এ।  দার্জিলিং জোড়বাংলো থেকে ১৬ কি.মি. ভেতরে আরও উপরে তাগদাবাজার। তাগদা যেতে প্রথমে পড়বে তাগদা অর্কিড সেন্টার, তারপর বাঁদিকে রেঞ্জ অফিস, আর একটু এগিয়ে তাগদাবাজার। দুধারে ঘন পাইন গাছের সারি, মাঝে সরু পাকা রাস্তা- তখন শুধু ল্যান্ডরোভার গাড়ি যেত।

 

গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা বাবার কাছে গিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে জোড়বাংলো পৌঁছলাম, জীবনে সেই প্রথম পাহাড়ে চড়া। গাড়ি থেকে নামতেই দলে দলে মেঘ এসে গায়ের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। আমিও ইচ্ছেডানা মেলে দিয়ে, মেঘের ভেলায় ভাসতে লাগলাম। অদ্ভূত এক অনুভূতি, কোনোদিন ভুলব না! এক নেপালী ঠিকাদার খুব যত্ন করে আমাদের ওর রেষ্টোরেন্ট এ নিয়ে গেলেন। কনকনে ঠান্ডায়, ধোঁয়া-ওঠা পেয়ালায় দার্জিলিং চায়ের স্বাদ অনবদ্য, তারপর গরম গরম মোমো ও ঝাল চাটনি আর কিছু স্ন্যাকস। খেতে খেতে মনে হচ্ছিল মেঘের রাজ্যে একটা কাঁচের ঘরে বসে আছি, অপূর্ব অনুভূতি।

একমাসে দাদা আর আমার অনেক কীর্তি আছে, আজ একদিনের কথা বলব। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মা বিশ্রাম নিতে গেলে, আমি দাদা বেরিয়ে পড়তাম আবিষ্কারের নেশায়। একদিন ঠিক করলাম, আমাদের বাংলোর পিছনে একটা সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে, কেউ যাতায়াত করে না, জানতে হবে ওইদিকে কি আছে। দুজনে হাঁটতে লাগলাম- সরু পাহাড়ী রাস্তা, দুধারে ঘন জঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা, কনকনে হিমেল হাওয়া, কেউ কোথাও নেই। ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলাম।

 

অনেকদূর ওঠার পর একটা মস্ত বড় ভাঙা গেট আবিষ্কার করলাম। আমরা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, সামনে একটা বিশাল ভাঙা বাড়ি, যার ভেতরে মোটা মোটা গাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ ঘন জঙ্গলে ঘেরা, মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। হঠাৎ মনে হল পা দুটো যেন মাটির সাথে আটকে গেছে, একপাও এগোতে পারছিনা। কোনো এক অজানা জগতে এসে পড়েছি- যেখানে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। শিরশিরে ভয়ে শরীরটা ফুলে যাচ্ছে, কথা বলতে পারছিনা। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম জানিনা, সম্বিত ফিরতেই মনে হল পালাতে হবে। চেঁচিয়ে দাদাকে বললাম, “দাদা! পালা…” বলেই গেট পেরিয়ে প্রাণপনে দিলাম ছুট।

 

ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দৌড়ে বাংলোর কাছাকাছি এসে মনে হল প্রাণ ফিরে পেলাম। পরে শুনেছিলাম ওটা শোনপুর মহারাজার বহুপুরোনো ভাঙাবাড়ি, যা এখন বড়বড় গাছ, ঘাস, জঙ্গল বা আরও অন্য কিছুর অধিকারে আছে যা অনুভব করা যায়, বোঝানো যায় না।

 

 

কলমে – শুচিতা

ছবি – দেব

 

Abiskarer Neshay    |    Suchita    |    Deb   |    https://pandulipi.net    |    Travelogue   |    Bengali    |    Horor    |    Story

Author: admin_plipi