না বলা কথা

 

দেবারতির মনে আজ একটা চাপা টেনশন কাজ করে চলেছে সারাদিন। স্কুলে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যেন চিন্তাটাকে চেষ্টা করেও ভুলতে পারছে না সে। টিফিন এর সময় পাপিয়াদি জিজ্ঞাসাও করলেন, “তোমার কি হয়েছে বল তো, দেবারতি? বাড়ীতে কোন অশান্তি?” “ক‌ই, কিছু না তো”, বলে এড়িয়ে গেল দেবারতি। কিন্তু কমনরুমের অনেকেই লক্ষ্য করেছে যে সে কদিন যাবদ যেন একটু বেশী চুপচাপ। নাতনীর জন্যে গোলাপী উলের মোজা বুনতে বুনতে মণীষাদি চশমার ওপর দিয়ে চেয়ে বললেন, “কিছু তো একটা হয়েছে, সে তুই না বলতে চাস অন্য কথা।” দেবারতি কথা বাড়াল না, সেভেন বি’র অ্যাটেন্ডেন্সের খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ক্লাসের দিকে, নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই।

 

কদিন ধরেই সন্দীপন দেবারতিকে চাপ দিচ্ছে বাড়ীতে জানানোর জন্য। সন্দীপন বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। এই শহরতলির অন্য একটা স্কুলে সেও শিক্ষকতা করে। বিএড করার সূত্রে দেবারতির সঙ্গে তার আলাপ বছর দু’য়েক আগে। এই দু’ বছরে নিজেদের অজান্তেই তারা কখন যে একে অপরের মনের এত কাছাকাছি এসে পড়েছিল হয়তো নিজেরাও বোঝে নি। দেবারতি অনেক দিন ভেবেছে বাড়ীতে বাবা-মাকে জানাবে কথাটা, কিন্তু বলি বলি করেও সাহস করে বলে উঠতে পারে নি। সন্দীপনের পক্ষেও তার মা’র অনুমতি পাওয়া খুব সহজ হয় নি। ভদ্রমহিলা প্রথম প্রথম একদমই রাজী ছিলেন না। খাওয়া দাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন দিন দু’য়েক। সন্দীপন সটান দেবারতিকে সেদিন নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়ীতে, মা’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে। তাকে দেখার পর এবং তার সাথে কথা বলার পর উনি অবশ্য আর আপত্তি করেননি। দেবারতির হাত থেকেই চা-বিস্কুট খেয়ে সেদিন অনশন ভেঙ্গেছিলেন তিনি। ওর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে।

 

লোকাল ট্রেনে জানালার ধারে বসে বাড়ী ফিরতে ফিরতে এইসব কথাগুলোই ভাবছিল দেবারতি। সবুজ দিগন্তের পারে টকটকে লাল সূর্যটা ডুবছিল আস্তে আস্তে। ট্রেনের এক হকারের কাছ থেকে আপেল আর বেদানা কিনল দেবারতি। বাবার শরীরটা আজকাল ভাল যাচ্ছে না, খাওয়ার তেমন রুচি নেই। ফলগুলো কেটে দিলে হয়তো একটু মুখ বদল হবে বৃদ্ধের। ডিসেম্বরের শেষে কয়েক দিন ছুটি আছে, ওই সময় একবার ভাল করে ডাক্তার দেখাতে হবে ওনাকে। সেই সকালে উঠে বেরোতে হয় তাকে ঘরের কাজ, টুকটাক রান্নাবান্না সেরে। ট্রেনে প্রায় দেড় ঘন্টা- তারপর টোটোতে আরো আধ ঘন্টাটাক। ফিরে গিয়ে আর শরীর চলতে চায় না। যা ভিড় হয় ট্রেনে আজকাল। তাছাড়া আজ লাইনে কাজ হচ্ছে, কাল অবরোধ- এসব তো লেগেই আছে। তাই এসব কাজের জন্য ছুটিছাটাই ভরসা।

 

বাড়ী এসে কলিং বেল বাজাল দেবারতি- বাজল না, কেটে গেছে বোধহয়। লেটার বক্সে উঁকি মেরে দেখে ইলেকট্রিকের বিল এসেছে- উপরে বাবার নাম লেখা, আনন্দময় বিশ্বাস।
দরজা ঠেলতেই খুলে গেল, ভেজানোই ছিল।
-“কি গো, দরজা বন্ধ করনি, মা?”
-“বেলটা খারাপ হয়ে গেছে বলেই খুলে রেখেছি”, সঙ্গে একগাল হাসি, “জানি তো তোর আসার সময় হল।”

 

ফ্রেশ হয়ে নিতে নিতে দেবারতি মনস্থির করল রাতে খাওয়ার সময় কথাটা পাড়বে। রাতে একসাথে খেতে বসা এবাড়ীর রীতি, চিরদিন‌ই তা হয়ে এসেছে। ফিরে এসে দেবারতি চা-বিস্কুটের সাথে একটু মুড়ি বা চিঁড়ে ভাজা খায়। আজ‌ও চা-মুড়ি নিয়ে বসতে মা এসে বললেন, “ওই ঠোঙায় একটা সিঙাড়া আছে, মুড়ি দিয়ে খেয়ে নাও।”
-“হঠাৎ? সিঙাড়া কে আনল মা?”
-“ও বাড়ীর পিন্টুকে দিয়ে আনিয়েছিলাম, আমি খেয়েছি একটু আগে।”
– “বাবা?”
– “না না, ও খায় নি।”
খেতে খেতে টিভিটা খুলে বিছানার উপর পা তুলে গাটা একটু এলিয়ে দেয় দেবারতি। মা অন্যদিন এই সময়টা টিভি দেখেন, আজ রান্নাঘরে কি খুটখাট করছেন।
-“মা, তুমি আজ সিরিয়াল দেখবে না? কি করছ?”
-“তুমি এখন দেখ না, তোমার যা ইচ্ছে। আজকাল ওটা ভাল হচ্ছে না”, রান্নাঘর থেকে জবাব আসে।
টিভিতে নিউজ চ্যানেলে কি ডিবেট হচ্ছে- যুযুধান দুই পক্ষ একে অপরের ওপর কথার বাণ চালাচ্ছে। ভল্যুমটা কমিয়ে দেয় দেবারতি- নীরবে ঝগড়া চলতে থাকে টিভির পর্দায়।

 

টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল দেবারতি, হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। ও মা! রুটি করতে হবে, একটা তরকারিও। দ্রুত রান্নাঘরে যায় সে।
-“একি! মা! তুমি রুটি করছ কেন? আমায় ডাকবে তো!”
-“তাতে কি হয়েছে? তুই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিস দেখে আর ডাকিনি।‌ আমার সব তৈরী করা হয়ে গেছে, ওকে ডাক। রোজ তুই দিস, আজ আমি খেতে দেব তোকে।”
মা যখন খুব খুশি থাকেন তখন‌ই দেবারতিকে তুই করে ডাকেন, এটা দেবারতি জানে। কিন্তু এত খুশির কি কারণ সেটা বুঝতে পারল না।

 

রুটি আর ছোলার ডাল, অল্প মিষ্টি মিষ্টি।
-“ওমা! ছোলার ডাল করেছ? আমার ফেভারিট।”
-“তাই তো বানালাম রে। আজ আমাদের দু’জনের মনটাই খুব ভাল।”
-“আজ আমার‌ও তোমাদের একটা কথা বলার আছে মা”, ইতস্তত করে বলে দেবারতি।
-“বল, কি বলবে?” আনন্দময়ের যেন উৎসাহ ধরে না। কিন্তু ওনাদের খুশীটাই যেন আরো বাধা দিল দেবারতিকে। এতদিন পর কোন অজানা কারণে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এত খুশী। দেবারতি কথাটা বলার পর ওনাদের মনের কি অবস্থা হবে সেটা ভেবে সে যেন সিঁটিয়ে যায়। ক্যান্সারে অমৃত মারা গেল যখন, দেবারতির বয়স মাত্র আঠাশ। সেই থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার একমাত্র আশ্রয় বৌমা দেবারতি। কমপ্যাশনেট গ্ৰাউন্ডে চাকরিটা পেয়েছিল সে- শুধু সেই কৃতজ্ঞতায় নয়, বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল এই অসহায় বৃদ্ধ দম্পতির ওপর। তার নিজের বাবা-মা নেই, দাদা-বৌদিও যেন দূরে সরে গিয়েছে হঠাৎ করে। তাই এই বাবা-মাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা সে ভাবতে পারেনি স্বপ্নেও। আনন্দময়দের উজ্জ্বল মুখ দু’টো দেখে যেন জিভ অসাড় হয়ে আসে তার।
-“থাক মা আজ, তোমরা এত খুশী কেন সেটা তো বল আগে”, কথাটা ঘোরাবার চেষ্টা করে দেবারতি। আনন্দময় বলেন, “আমাদের আবার আলাদা করে কি আনন্দ? তোমার খুশীতেই আমাদের খুশী।”
-“দেখ, আজ তোর জন্যে সুজির পায়েস‌ও বানিয়েছি।” বাটিটা এগিয়ে দিতে দিতে বলেন দেবারতির শাশুড়ি মা। এনাদের ভালবাসায় চোখে জল এসে যায় দেবারতির।

 

বিছানায় গিয়ে মোবাইলটা খুলে হোয়াটসঅ্যাপের টেক্সটগুলো পড়তে থাকে দেবারতি। সন্দীপনের একটা বড়সড় মেসেজে চোখটা আটকে যায় তার। “আমি জানতাম মা-বাবাকে বলার ক্ষমতা তোমার হবে না। তোমার এই গুণটার জন্যেই তোমায় আমি এত ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। তুমি ওনাদের‌ই মেয়ে। তাই আমি নিজে আজ তোমার মা-বাবার কাছে গিয়ে তোমাকে ভিক্ষা চেয়েছি ওনাদের থেকে। যে কথা তুমি ওনাদের বলতে পারোনি, সে কথা ওনারাও কোনদিন বলতে পারেননি হয়তো তোমায়। কিন্তু আমার হাতদুটো হাতে ধরে ওনাদের চোখে যে খুশীর অশ্রু দেখেছি…”, আর পড়তে পারল না দেবারতি। তার দু’চোখ তখন ঝাপসা। পাশের ঘরে বৃদ্ধ আনন্দময় দম্পতি প্রথমবার মেয়ের বিয়ে দেবার আনন্দে নিদ্রাবিহীন।

 

লেখা: অরিন্দম
ছবি : অনিন্দিতা

Author: admin_plipi