টাকা

 

 

কলেজ থেকে ফিরেই ইশা সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।   অন্যদিন যে মেয়ে কলেজ থেকে বাড়ি এলেই খিদে পেয়েছে বলে সারা বাড়ি মাথায় তোলে সে আজ চুপচাপ কিছু না বলেই নিজের ঘরে চলে গেল, এরকমটা তো আগে কখনো হয়নি৷ এসব ভাবতে ভাবতে রান্না ঘরে চলে গেলেন ইশার মা আশাদেবী৷ কিছুক্ষণ পর মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখলেন মেয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে৷ এরপর আসতে করে মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে৷ ইশা চোখ মুছে উঠে বসে৷ বলে কিছু হয়নি৷ আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি, তুমি খেতে দাও৷ আশাদেবী ভাবলেন থাক মেয়ের যখন ইচ্ছে হবে তখন বলবে, বেশী জোর করে লাভ নেই৷ তারপর মা-মেয়ে মিলে একসাথে খেতে বসে৷ আজ ইশার পছন্দের খাবার রান্না করেছেন৷ ফ্রায়েড রাইস, চিলি পনির আর টম্যাটোর চাটনি ইশা খুব ভালবাসে খেতে৷ রাতে শুয়ে শুয়ে ইশা ভাবে, প্রীতম ওর সাথে কেন করল এরকম৷ ওদের এতদিনের সম্পর্ক, এত ভালবাসা, এত প্রতিশ্রুতি সব কি তাহলে মিথ্যে৷ প্রীতম এই সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল শুধুমাএ সুমিতার বাবার অনেক টাকা আছে তাই৷ আশাদেবীর চোখেও আজ ঘুম নেই৷ মেয়ের জন্য ভাবছেন৷ আসলে নিজে অনেক কষ্ট করে মেয়েকে বড়ো করেছেন তো তাই হয়তো মেয়ের কষ্ট উনি সহ্য করতে পারেন না৷ সেই কবে ইশার বাবা মারা গেছে। তবে থেকে আজ অবধি একা হাতে সংসার সামলে মেয়েকে মানুষ করেছেন৷ এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন নিজেই জানেন না৷ পরেরদিন সকালে মেয়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন –কলেজ যাবি না? অনেক বেলা তো হল, তাড়াতাড়ি রেডি হ৷
–আজকে কলেজ যাব না, ভালো লাগছে না৷
–ভালো না লাগার কারণটা আমায় বলা যায়?
–হ্যাঁ, অবশ্যই যায় ৷তুমি ছাড়া আর কাকেই বা বলব মা৷
এরপর পুরো ঘটনা সব বলতে শুরু করল ইশা৷ সবটা শোনার পর আশাদেবী বললেন–যা হয়েছে সব ভুলে যা৷ একবারে ভুলতে না পারলে আসতে আসতে ভোলার চেষ্টা কর৷ ও যদি সব ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে তুই কেন পারবি না৷ তুইও নিজেকে এমনভাবে তৈরী কর যাতে কেউ কখনো তোকে কষ্ট দিতে না পারে৷

 

হঠাৎ করে পিয়ালির ডাকে ইশা অতীতের স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে আসে৷ পিয়ালি ওর পি.এ৷ মেয়েটা বেশ কাজের আর  ইশাকে খুব ভালোও বাসে৷ তাই ইশা যেখানেই যায় ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়৷ পিয়ালি বলে–ম্যাডাম, আমরা এসে গেছি৷ ইশা বাইরে তাকিয়ে দেখে গেটের সামনে বড় বড় করে লেখা “আশানীড়”৷ আজকে ওর মায়ের মৃত্যুদিন৷ প্রতি বছর ও এইদিনটায় এখানে আসে৷ সারাদিন এখানকার মানুষের সাথে কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে যায়৷ এই মানুষগুলোর জন্য ফল-মিষ্টি-জামাকাপড় সব নিয়ে আসে৷ এই মানুষগুলোর মুখের হাসি ওকে এক অনাবিল আনন্দ দেয়৷ মা মারা যাওয়ার পর ও এই বৃদ্ধাশ্রমটা বানিয়েছে৷ মনে মনে ভাবতে থাকে সেদিন যদি মা ওভাবে পাশে থেকে সাহস আর ভরসা দুটোই না জোগাত তাহলে ও আজ এই জায়গায় পৌছাতে পারত না৷ আজ ও একটা বড় কোম্পানীর ম্যানেজার৷ ওর কাছে এখন অনেক টাকা৷ যে টাকার জন্য একদিন ওর ভালবাসার মানুষটা ওকে ছেড়ে চলে গেছিল এই কবছর ধরে ও শুধু সেই জিনিসটাকেই উপার্জন করেছে৷ এসব ভাবতে ভাবতে ভেতরে আসে, দেখে মানুষগুলো অধীর আগ্রহে ওর অপেক্ষায় বসে আছে৷ কীভাবে যে সারাদিন কেটে যায় আজও ও বুঝে উঠতে পারে না৷ এবার বাড়ি ফেরার পালা৷ কাল থেকে আবার সেই রুটিনমাফিক জীবন৷ এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসল ইশা৷
“লাগ যা গালে কি ফির ইয়ে হাসিন রাত হো না হো
শ্যায়াদ ফির ইস জানাম মে মুলাকাত হো না হো”
এফ.এম–এ এই গানটা শুনে ইশার অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল৷ এই গানটা গেয়েই তো প্রীতম ওর রাগ ভাঙাত৷ হঠাৎ করে জোরে ব্রেক কষায় ইশা জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে৷ ড্রাইভার বলে–সামনে একটা লোক এসে পড়েছিল৷ ইশা ড্রাইভারকে বলে তাড়াতাড়ি লোকটাকে দেখতে, ওনার কোথাও লেগেছে কিনা৷
–ম্যাডাম, লোকটা তো অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ কী করব?
–ওনাকে তাড়াতাড়ি গাড়িতে তোলো আর হাসপাতালে চলো৷ হাসপাতালে ওনাকে ভরতি করে সমস্ত কাজ মিটিয়ে ইশা বাড়ি চলে আসে৷ পরেরদিন সকালে পিয়ালি এসে একটা মানিব্যাগ দিয়ে বলে এটা মনে হয় ওই লোকটার হবে৷ কালকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে গেছে হয়তো৷
–ঠিক আছে, টেবিলের ওপর রেখে দে৷ আমি দেখছি৷ হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় ইশা গিয়ে ধরে৷
–হ্যালো, বলুন৷
–ম্যাডাম, হাসপাতাল থেকে বলছি৷ কালকে যে লোকটিকে আপনি ভরতি করেছিলেন উনি একবার আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন৷
–ঠিক আছে, আমি আসব৷ ওনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে ওটা ফেরত দিতে হবে৷
–ধন্যবাদ, ম্যাডাম৷
ফোনটা রেখে ইশা ভাবতে থাকে লোকটা কে, কেনই বা তার সাথে দেখা করতে চাইছে৷ তারপর ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ অফিসে গিয়েও কাজে মন দিতে পারে না৷ বারবার ওই লোকটির কথাই মাথায় আসতে থাকে৷ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য৷ রাস্তায় এত মিছিল কেন কে জানে, যেদিন কোথাও যাওয়ার তাড়া থাকবে সেদিনই দেরী হবে, নিজের মনেই বলে ওঠে ইশা৷ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত ইশা জানত না ওর জন্য কি চমক অপেক্ষা করে আছে৷ হাসপাতালে এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারে লোকটির নাম প্রীতম সেন৷ হঠাৎ করে এতদিন পর ওই নামটা শুনে ও প্রথমে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে৷ একই নাম অনেকের হতে পারে এই ভেবে দরজা ঠেলে ঢুকে যাকে দেখল তাকে ওইভাবে দেখবে ও আশাও করে নি৷ যে মানুষটা একসময় ওর স্বপ্নের নায়ক ছিল আজ তার এই কুৎসিত চেহারা দেখে ও স্তম্ভিত৷ ও আর বেশীক্ষণ ওখানে দাঁড়াতে পারে না, বাইরে বেড়িয়ে আসে৷ ডাক্তারবাবু      বলে–ওনার একটা কিডনি অলরেডি নষ্ট হয়ে গেছে আর একটার অবস্থা ভালো না৷ খুব তাড়াতাড়ি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট না করলে ওনাকে বাঁচানো যাবে না৷ সব শোনার পর ইশা ধীরে ধীরে প্রীতমের কাছে গিয়ে বসে৷ ওকে দেখে প্রীতম বলে ওঠে–ভাল আছো তো?…
–তুমি পাশে থাকলে তো আমি এমনিই ভাল থাকি৷ আজ আর এই কথাটা বলতে ইচ্ছা হল না, শুধু তাকিয়ে থাকল৷
–ওই পাগলী, তুমি কি আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছ??
–না, আমি কেন কষ্ট পেতে যাব৷আমি তোমার কে যে কষ্ট পাব৷
–হুম, ঠিক বলেছ৷ যার কষ্ট পাওয়ার কথা সে যখন পায়নি, তখন যাকে আমি কষ্ট দিয়েছি সে কেন আমার জন্য কষ্ট পেতে যাবে৷ আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই আর নেই৷
–তোমার বাজে বকা শেষ হলে আমি কিছু বলতে পারি৷ তোমার চিকিৎসা আমি করাব৷ তুমি আবার আগের মত ভালো হয়ে যাবে৷ আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলব৷ তারপর ও বেরিয়ে এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাড়ি চলে আসে৷ একসপ্তাহ পরেও ডোনার না  পাওয়ায় প্রীতমের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে৷ প্রত্যেকদিনের মত আজকেও ইশা দেখা করতে এসেছে প্রীতমের সাথে৷ কিছুক্ষণ বসে তারপর ও বাড়ি চলে আসে৷ দুদিন পর সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে যে প্রীতমের সাথে ম্যাচিং ব্লাড গ্রুপের কিডনি পাওয়া গেছে৷
–আমি এখুনি আসছি৷
ও.টি তে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রীতম ইশাকে বলে –তোমার এই ঋন আমি কীভাবে শোধ করব জানি না৷
–এখন ওসব কথা ছাড়ো৷ আগে তুমি ভাল হয়ে ওঠো তারপর এসব কথা ভাববে৷ সুষ্ঠুভাবে অপারেশন হয়ে গেলে ইশা বাড়ি চলে আসে৷ এরপর বেশ কয়েকদিন ইশা আর হাসপাতালে যেতে পারে নি কাজের চাপ থাকায়৷ কাজের চাপ কমলে ইশা হাসপাতালে যায় প্রীতমকে দেখতে৷ ও এখন আগের থেকে অনেকটা ভাল আছে৷
–আরে তুমি এসেছ? আমি তো ভাবলাম তুমি আর আসবে না৷ তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল৷
–আসলে কাজের চাপ ছিল তাই আসতে পারিনি৷ কী বলবে বলো৷
–বলছিলাম…আমার অপারেশনের জন্য কত টাকা লেগেছে যদি বলতে তাহলে আমার তোমাকে ফেরত দিতে সুবিধা হত৷ এখন দিতে পারব না৷ তবে আসতে আসতে শোধ করে দেব৷
–ওহ, এই কথা৷ আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বলবে পুরোনো সব কথা ভুলে গিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে৷ আমিই ভুল ছিলাম৷ তুমি তো টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝই না৷ সেদিন যেমন আমার ভালবাসা বুঝতে পারনি তো আজ তোমার কাছ থেকে বন্ধুত্ব আশা করা তো বোকামির  পরিচয় দেওয়া৷ পার্স থেকে “আশানীড়”–এর একটা কার্ড বের করে প্রীতমকে দিয়ে বলল টাকা আমি চাই না৷ তবে তুমি ফেরত দিতে চাইলে কার্ডে দেওয়া এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও৷ আর একটা কথা, কোনো মানুষকে কখনো টাকা দিয়ে বিচার করো না৷ আমি চললাম, ভাল থেকো৷
–তোমার ঠিকানাটা…
–সেটা জানার কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না৷ আর আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে এখান থেকে৷ চলি, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে৷ প্রীতমের উওরের অপেক্ষা না করেই ইশা বেরিয়ে যায়৷ ইশা ইচ্ছা করেই ওর ট্রান্সফারটা অনেক দূরে নিয়েছিলো৷ যেখানে ওর কোনো চেনাশুনা মানুষ থাকবে না৷ সবার থেকে দূরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও “আশানীড়”–এর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ইশা৷ আসলে কিছু সম্পর্ক বোধহয় এমনও হয় যেগুলো টাকা দিয়ে কখনো বিচার করা যায় না৷

লেখাঃ সুদেষ্ণা

ছবিঃ সঙ্কেত

 

Author: admin_plipi