কেঁচো খুঁড়তে কেউটে

কেঁচো খুঁড়তে কেউটে || বিশ্ববিবেক বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)

পদার্থবিজ্ঞানে রিসার্চ করাটাকে সাধারণ মানুষ যতটা আশ্চর্য হয়ে দেখেন, আমার বন্ধুকে সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখে আমার ততটা লাগেনা। আমি বিদিত ব্যানার্জী, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে মাস্টার্স পাশ করে এখন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনির্বানের সঙ্গে প্রথম আলাপ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, তখন দুজনেরই মাস্টার্স চলছে। আমাদের গণিত বিভাগের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল। আমার হাতে গীটার দেখে সে হলঘরে ঢুকে এল, কিছুক্ষণ গীটার নিয়ে থিওরেটিক্যাল আলোচনার পর, কয়েকটা বেসিক কর্ড ধরে একটা গান শুনিয়েছিল। তারপর মাঝে-সাঝে মুখোমুখি এসে পড়লে সামান্য কথা হত।

অনির্বান সিংহরায়। রোগা ছিমছাম চেহারার বছর সাতাশের যুবক। মোটা ভ্রুর নীচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। মুখে সুন্দর করে ছাঁটা চাপ দাঁড়ি আর চোখে স্কয়ার ফ্রেমের চশমা। দেখে মনে হয় শান্তিপ্রিয়, ঝুটঝামেলা পছন্দ নয়। নিচু গলায় কথা বলা স্বভাব। পদার্থবিজ্ঞান ছাড়াও, মিউসিক আর মিউসিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের প্রতি অগাধ উৎসাহ।

অঙ্কে এম.এসসি ডিগ্রি নিয়ে হস্টেল ছেড়ে, যখন সগর্বে বেকারের তকমা লাগিয়ে একটি রুম ভাড়া নিয়ে মেস জীবন শুরু করতে চলেছি, তখন দেখি আমার রুমমেট স্বয়ং অনির্বান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণারত। সে তার মাস্টার্স থেকেই এই রুমে আছে। গত কয়েকমাস রুমমেটের অভাব চলছিল, আমি এসে তা পূরণ করলাম।

ছোট্ট ঘরটি কমদামী আসবাবে ঠাসা, ফাঁকা জায়গা সামান্য, তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একটি বড় পাঁচতলা বইয়ের র‍্যাক, একটি মাঝারি কাঠের টেবিল, একটি ছোট কম্পিউটার টেবিল, একটি প্লস্টিকের চেয়ার আর দুটি সিঙ্গেল খাট। একটিতে অনির্বানের বিছানা পাতা, অন্যটি আমার জন্যে খালি। টেবিলের ওপরে ছড়ানো ছেটানো নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, যত্নহীন ভাবে পড়ে আছে। চেয়ারের ওপরেও অগোছালো ভাবে শীতের জামাকাপড় জড়ো করে রাখা। তবে বইয়ের র‍্যাকে বইগুলি সুন্দর করে গোছানো। টেবিলের পাশে একটি স্ট্যান্ডের ওপর একটি গীটার রাখা।

অনির্বান কে বললাম, ‘চিনতে পারছো?’ (অচেনা সমবয়সীকে ‘তুমি’ বলে সম্মোধন শুরু করা অভ্যাস, কয়েকদিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়ে সেটা ‘তুই’ না হলে, আর হয়ে ওঠেনা। অনির্বানের ক্ষেত্রে সে সুযোগ হয়নি, তাই ‘তুমি’ টাই থেকে গেছে)

সে বলল, ‘ম্যাথের বিদিত।’

দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠল। মাস্টার্সের পর কয়েকমাস কেটে গেছে, বেশ অনেকটা সময় পর সাক্ষাৎ। তাই প্রথমে নিজেদের খবরাখবর নেওয়ার পর, এই পাড়ার পরিবেশ, মেসের অন্যান্যদের আচার আচরণ, এখানকার কিছু বিশেষ নিয়মকানুন এবং মেসের মালিকের সম্মন্ধে অনির্বানের কাছে জানলাম। সবশেষে, মেসের ম্যানেজারি আর হিসাবপত্রের দায়িত্ব অনির্বানের হাতেই আছে, এটা জেনে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। দুদিন আগে যখন রুম দেখার জন্যে প্রথম আসি, তখন অনির্বান রুমে ছিলনা। রুমটার ভেতরটা সেদিন দেখা হয়নি, তবে মালিকের কাছে শুনেছিলাম এই রুমে অনির্বান বলে একজন থাকে, মেসের খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য নিয়মের ব্যাপারে তার কাছেই সব জেনে নিতে হবে। নতুন জায়গায় এক অচেনা ছেলের তত্বাবধানে এসে পড়তে হবে, এই ভেবে সকাল থেকেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। যাক, সে চিন্তা গেল। আমার সঙ্গে আসবাব তেমন কিছু ছিলনা। বিছানা আর আমার বইপত্র নিয়েই রুমে ঢুকে পড়লাম। বইপত্র রাখার জন্য র‍্যাকের ফাঁকা অংশগুলো ব্যবহার করা যাবে।

অনির্বান সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, তারপর তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিয়ে ল্যাবে যায়। ফিরতে সন্ধ্যে হয়। আমি সারাদিন রুমে বসে পড়াশুনা করি, গান শুনি আর গান করি। তার গীটারটা আমার ভাল সঙ্গী হয়ে গেছে। আমাদের এই একঘেয়ে জীবনের বর্নণা করার উদ্দেশ্যে আমার লিখতে বসা নয়। গত কয়েকদিনে, একটি ঘটনাকে ঘিরে আমাদের এই একঘেয়ে জীবন হঠাৎ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল, তারই বর্নণা দিতে আমার লেখা শুরু।

(২)

এই গরমে সারাদিন দোতলার রুমে বসে কাটানো, এরপর সন্ধ্যেবেলা একটু না বেরোলে ভেতর টা হাঁসফাঁস করে।

যদিও নির্জনতা পছন্দ করি, তাও সান্ধ্যভ্রমণের জন্য অনির্বানের ফেরার অপেক্ষা করি। ও ফিরলে একসঙ্গে হাওয়া খেয়ে বেরোই। পাড়ার মোড় থেকে খানিকটা বড় রাস্তা দিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে একটা নির্জন রাস্তা, সেটা

দিয়ে আরো অনেকটা এগিয়ে যাই। আবার একই পথে ফিরে আসি। আসার পথে পাড়ার মোড়ে চা সেবন করে

তরতাজা মনে সোজা ঘরে ঢুকি।

এমনই একদিন সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকেছি। রাস্তাটি নির্জন এবং অন্ধকারাচ্ছন, কিন্তু প্রশস্ত। দুদিকে বাঁধানো ফুটপাথ, তার পাশে সারিবদ্ধভাবে চলেছে গাছপালা-ঝোপঝাড়। ফুটপাথের ওপর বেশ কিছুটা দূরে দূরে একটা করে বৈদ্যুতিক ল্যাম্পপোষ্ট ক্ষীণ আলো বিচ্ছুরণ করে রাস্তার পরিবেশটিকে মায়াবী করে তুলেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কেউ যেন আমাদের পিছনে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। আমরা দুজনেই ব্যাপার টা বুঝতে পারলাম, কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ইউটার্ন নিয়ে ফেরার সময় বুঝলাম, সে আর আমাদের পিছু পিছু আসছেনা। আমরা দুজনেই পেছন ফিরে তাকালাম। লোকটা দূরের অন্ধকারে উধাও হয়ে গেছে। অনির্বান বলল, আরেকবার পেলে লোকটাকে পাকড়াও করব। সুযোগও চলে এলো, পরেরদিন আবার একই ঘটনা। আজ আর অপেক্ষা না করে আমরা দুজনেই ঘুরে দাঁড়ালাম, মুখে দৃঢ় ভাব। দেখলাম একটি শীর্ণকায় বছর পঞ্চাশের লোক আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে, তার পরনে দামি ঢিলেঢালা প্যান্টশার্ট। পোশাকটি তার গায়ে মোটেই মানাচ্ছে না।

অনির্বান দৃঢ়কন্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আপনি রোজ আমাদের পিছু নিচ্ছেন কেন? কি মতলব?’

লোকটা আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোতে প্রথমে থতমত খেয়ে গেছল, প্রশ্ন শুনে স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে বলল, ‘পিছু নয় বাবু, আমি এই পথে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় একটু হাঁটতে বেরোয়। তবে এই দুদিন আপনাদের লক্ষ্য করছি বটে।’

আমরা কিছু বলার আগেই লোকটা ঢোক গিলে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘আমার এক ভাইপো ছিল, অবিকল এই বাবুর মত দেখতে। আজ থেকে দশ বছর আগে সে এক কঠিন রোগে মারা যায়, তার বয়স তখন পনেরো। আমার একমাত্র দোসর ছিল সে। তাই এই বাবুকে দেখে আমি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম, আমায় মাফ করবেন।’

বলতে বলতে তার চোখ জলে ভরে এলো। আমরা তার ওপর অহেতুক সন্দেহ করছিলাম ভেবে দুঃখ পেলাম এবং তার মন কে সান্ত্বনা দেবার জন্য কথা বলতে বলতে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কথাপ্রসঙ্গে, আমরা কি করি, কোথায় বাড়ি, এখানে কোথায় থাকি, সব বললাম। উনিও বললেন ওনার নাম রমানাথ মজুমদার, উনি একাই থাকেন, শহরের শেষ প্রান্তের একটা পাড়ায় ওনার বাড়ি। খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করেন।

সেদিন রুমে ফিরে এসে অনির্বান চিন্তিত মুখে খাটে বসে রইল। নিয়মমাফিক ল্যাপটপ নিয়ে বসার কথা, কিন্তু তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার বলতো? ওই লোকটার কথা ভাবছো?’

অনির্বান বলল, ‘লোকটা ওই পথে প্রতিদিন হাঁটতে বেরোয়, আমরাও ওই পথে হাঁটছি দু’তিন মাস হল। তাহলে গত দুদিন ধরেই ওর তোমাকে দেখে ভাইপোর কথা মনে পড়ল কেন? ও কি এতদিন আমাদিকে একবারো লক্ষ্য করেনি?’

প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলল, আমি একটু চিন্তা করে বললাম, ‘হুম। কিন্তু, আমারাও তো ওকে লক্ষ্য করিনি, হতেও তো পারে, গত পরশুই আমাদিকে প্রথম দেখেছে।’

‘তাই কি? আমরাও ওকে লক্ষ্য করিনি, এর মানে তো এও হতে পারে, লোকটা ওই পথে আসেই না। মিথ্যা বলছে আমাদিকে।’

আমি আবার চিন্তায় পড়লাম। ব্যাপারটা প্রথম থেকেই অতটা গুরুত্বপূর্ণ লাগছিলনা আমার। বললাম, ‘ছাড়ো তো। নিজের কাজে মন দাও।’

অনির্বান হেসে বলল, ‘ঠিকই।’

সেদিন ওই নিয়ে আর কোনো কথা হলনা। কিন্তু বুঝলাম, অনির্বানের মন পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হয়নি।

(৩)

পরদিন সন্ধ্যেয় হাঁটতে বেরিয়ে অত্যন্ত সতর্ক থেকেও যখন তার দেখা পেলাম না, তখন আমাদের দুজনের সন্দেহই আরো দৃঢ় হল। আমরা পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে লোকটির উল্লেখ করা খবরের কাগজের অফিসে গেলাম। তার চেহারার আর মুখের বিবরণ দিয়ে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে জানলাম, ওই রকম চেহারার এবং ওই নামের কোনো ব্যাক্তিই ওই অফিসে কাজ করেন না।

অনির্বানের মুখ রাগে কঠিন হয়ে এল। সে বলল, ‘লোকটার রহস্য উদঘাটন করে ছাড়ব।’

আমি তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম, ‘কি হবে তাতে! আমাদের সঙ্গে তো আর কোনো সম্পর্ক নেই। ওর কোনো মতলব ছিল, তাতে আমাদের ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না।’

কিন্তু ওকে বোঝানো গেলনা। অগত্যা আমিও ওর দলেই নাম লেখালাম। কিন্তু লোকটাকে পাব কোথায়। ও তো নিশ্চয় নাম আর অফিস সহ বাকি তথ্যও মিথ্যা বলেছে।

আমি বললাম, ‘আপাতত রুমে চলো। তোমাকেও ল্যাবে যেতে হবে, আমারও পড়া আছে।’

আমরা রুমে ফিরে এলাম। অনির্বান স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল। আমি বেলা করে স্নান করি। সেদিন, ও বেরিয়ে যাওয়ার পর, গীটারটা নিয়ে বসলাম। বার-কর্ড গুলো ধরা প্র্যাকটিস করছি বেশ কয়েকদিন ধরে। কিন্তু সেদিন কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারলাম না। কাল সন্ধ্যের ঘটনাটা বার বার চোখের সামনে চলে আসছে। জোর করে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেও লাভ হল না। ভাবতে লাগলাম, এমন কিছু লক্ষ্য করেছিলাম কিনা, যাতে করে লোকটার সন্ধান পেতে সুবিধা হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু মাথায় এলো না। সারাদিনটা এমনি করেই কেটে গেল।

ল্যাব থেকে ফিরেই অনির্বান উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘একটা ক্লু পাওয়া গেছে।’

আমি বললাম, ‘কি?’

‘লোকটার জামাটা লক্ষ্য করেছিলে?’

‘জামাটা ঢিলেঢালা আর চকচকে ছিলো, এটুকু দেখেছি।’

‘হুম, জামাটা নতুন ছিল, তার গায়ে ভাল বসেওনি। আর কলারের কাছে লেখা ছিল ‘ফিট টেলার্স, বর্ধমান’।’

‘তারমানে কি দাঁড়ালো?’

‘তারমানে আজ সান্ধ্যভ্রমণ বাতিল। গন্তব্য ফিট টেলার্স। রেডি হয়ে নাও।’

অনির্বানের যে এত প্রখর দৃষ্টি আমার জানা ছিলনা। যাইহোক, আমরা বাইকে চড়ে সন্ধ্যে ৮ টা নাগাদ ফিট টেলার্সে এসে পৌঁছালাম। দোকানের দর্জি কে অনুরোধ করে অনির্বান আমাদের সাহায্য করতে রাজি করালো। তার রেজিস্টার খাতার পাতায় পর পর খদ্দেরদের নাম এবং তাদের জামা প্যান্টের মাপ লেখা, পাশে একটি করে কাপড়ের টুকরো পিন দিয়ে আটকানো। বেশ কয়েক পাতা ওলটাতেই আমাদের পরিচিত ছিটের টুকরোটি বেরিয়ে পড়ল। নাম – অবিনাশ সমাদ্দার। দর্জির কাছে জানলাম এনার বাড়ি রেলস্টেশনের থেকে কিছুটা দূরে, পশ্চিমপাড়ায়। কিন্তু আমাদের রমানাথ মজুমদারের চেহারার বিবরণ শুনে দর্জি তার খদ্দের অবিনাশ বাবুর সাথে মিল পেলেন না। যাইহোক আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। যতটা উৎসাহ নিয়ে গেছলাম ততটা উৎসাহ রইল না। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, অনির্বান দমেনি মোটেই।

(৪)

ভাগ্যক্রমে পরের দিন টা ছিল শনিবার, অনির্বানের ছুটি। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু অলসভাবে বসে থাকার পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বড় রাস্তা ধরে বাইকে চড়ে স্টেশন পেরিয়ে সোজা পশ্চিমপাড়া। বড় রাস্তার ওপরেই একটা মোড়ে মোটামুটি বড় একটা চায়ের দোকান। দোকানের পাশে বাইক রেখে আমরা ভেতরে ঢুকে বসলাম। দোকানে সেই মুহুর্তে বিশেষ ভিড় থাকেনি। আমরা এক ভাঁড় করে চা সেবনের পর, আরো একবার করে চা এবং সঙ্গে কিছু বিস্কুট দিতে বললাম। দোকানের মালিক স্বভাবতই আমাদের ওপর খুশি হল। এই সুযোগে অনির্বান তার সঙ্গে ভাব জমালো। ওর এটা একটা বিশেষ গুণ, যেকোনো স্তরের মানুষের সাথে খুব সহজেই তাদের মত করে মিশে যেতে পারে। বিশেষ করে সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের ক্ষেত্রে তার এই দক্ষতাকে বিশেষভাবে কার্যকর হতে দেখেছি অনেকবার।

কয়েকটা কথার পর সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা দাদা, অবিনাশ সমাদ্দার বলে এই পাড়ায় কেউ থাকেন?’

লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। ওই তো, ওই হলুদ বাড়িটা ওনার।’

বলে লোকটি একটা বাড়ির দিকে আঙুল দেখালো। বাড়িটি রাস্তার অপর দিকে একটা গলিতে ঢুকে তিনটে বাড়ি ছেড়ে, হলুদ রঙের পুরোনো দোতলা বাড়ি। বাড়িটির নিচের অংশটি গলির ভিতর চাপা পড়ে আছে, কিন্তু ওপরের অংশটি চায়ের দোকান থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ব্যালকনি বলে কিছু নেই, ঘরের ওপর ঘর উঠে গেছে। দোকানের লোকটিকে আরো জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল – অবিনাশবাবু এই ঘরে একাই থাকেন, তবে তার সঙ্গে সর্বক্ষণ একটি চাকর থাকে। তাঁর তিনকূলে কেউ নেই। লোকটির অবস্থা এককালে খুব ভাল ছিল, এখন তেমনটা নেই। তবে লোকটির জমানো সম্পত্তি যথেষ্ট আছে বলেই লোকের ধারণা।

অনির্বান আরও জিজ্ঞেস করল, ‘তাঁর কোনো ভাইপো-ভাগ্নে তাঁর সঙ্গে থাকত কখোনো?’

‘না। লোকটি একাই থাকেন বহুবছর ধরে। তবে মনে হয় ছেলেপুলের অভাব বোধ করেন। বিয়ে করেননি তো।’

আমি বললাম, ‘ছেলেদিকে খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

‘ছেলেরাও ওকে খুব ভালোবাসে। আমার দোকানে চা খেতে এসে, রাস্তার ভিখারি ছেলেদের প্রায়ই বিস্কুট কিনে দেন। বাড়ি নিয়ে গিয়েও খাওয়ান, জামাকাপড় দেন। দানধ্যান করেন, তীর্থভ্রমণে যান। ধার্মিক মানুষ।’

বুঝলাম, যদি ঠিক বাড়িতে এসে থাকি, তাহলে চাকরটিই আমাদের রমানাথ মজুমদার। অনির্বান বলল, ‘চলো বিদিত।’

আমরা হেঁটে গলির ভেতরে প্রবেশ করলাম। গলিটি সরু, দুপাশের সারিবদ্ধ দোতলা বাড়িগুলি যেন গলিটিকে দুদিক থেকে চেপে আরো সরু করে দিতে চাইছে। অবিনাশবাবুর বাড়িটিও একেবারে গলির ওপরেই, উঠোন বলে কিছু নেই। সদর দরজাটি, রাস্তার একেবারে পাশের রুমটিরই দরজা।

বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করে অনির্বান বলল, ‘চলো, এখানে কিছু দেখার নেই।’

রুমে ফিরে দেখলাম ন’টা বেজে গেছে। ফিরে এসেই অনির্বান বলল, ‘আমার একটা জরুরি কাজ আছে, বেরোচ্ছি একবার।’

ফিরে এসে একসাথে ভাত খাবে বলে সে বেরিয়ে গেল। আমি যদিও বুঝতে পারলাম না ‘জরুরি কাজ’ টা এই ব্যাপার সংক্রান্ত নাকি তার নিজস্ব কিছু, তবুও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

দুপুর ১টা নাগাদ সে ফিরে এলো। স্নান খাওয়া সেরে আমরা একটা লম্বা ঘুম দিলাম। দুদিন ধরে সকাল সকালে ওঠা হচ্ছে, তাই দুপুরের ঘুমটা জরুরি। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে অলসভাবে বেরলাম রাস্তায়। গতকাল হাঁটাও হয়নি। মস্তিষ্কের সাথে শরীরের চলাচলটাও সমান প্রয়োজনীয়। অবিনাশ সমাদ্দার কে নিয়ে যে অনুসন্ধান চলছিল, সেটা মনে হয় ঝিমিয়ে পড়ছে। যাক, ভালই হয়েছে। অযথা মাথার বোঝা বাড়ানো। আমিও আর অনির্বানকে ওই নিয়ে খোঁচালাম না। আবার আমাদের একঘেয়ে প্রত্যাশিত জীবন শুরু হল।

(৫) 

এইভাবে দিন পাঁচ-সাত কেটে গেল। এই ক’টা দিন, অনির্বান একটু বেশীই দেরি করে ল্যাব থেকে ফিরছিল, কাজের চাপ চলছে বোধহয়। তাই আমাদের সান্ধ্যভ্রমণেও ব্যাঘাত ঘটছিল। পরের শুক্রবার হঠাৎ অনির্বান বলল, ‘চলো বিদিত। আজ ছুটি, একটু বেরোনো যাক।’

দিনটা ছিল ১লা বৈশাখ। আমাদের মেসজীবনে ১লা বৈশাখও যা, সাধারণ দিনও তাই। তাই খেয়াল থাকেনা কখন কি। ঘুম থেকে দেরী করে ওঠা হয়েছে। এমনিতেই একটু বেলা হয়ে গেছে। অনির্বান তাড়া দিলো না, ধীরেসুস্থে রেডি হয়ে বেরলাম।

আমরা ছুটিরদিন মাঝে মাঝে বেরোই। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকটা করি, শপিংমলে ঘুরে বেড়াই অথবা স্টেশন বাজার থেকে মাছ-মাংস কিনে আনি রাতে খাবার জন্য। ইচ্ছে করলে রেস্টুরেন্টে ঢুকি বা সিনেমাহলে ভালো কিছু চললে দেখে আসি। মাঝে মাঝে আবার উদ্দেশ্যহীন ভাবে শহরের গন্ডী ছাড়িয়ে, হাইওয়ে ধরে কিছুটা ঘুরে আসি।

কিন্তু সেদিন আমরা প্রথমে কুশীলব থিয়েটার সেন্টারে গেলাম। অনির্বান কে বললাম, ‘কি ব্যাপার বলো দেখি বন্ধু? তোমার আবার থিয়েটার দেখার শখ হল নাকি?’

‘দেখার নয়, করার।’

‘সেকি!’

‘বেশী কৌতুহল ভাল নয় বিদিত। যা বলছি আপাতত করে যাও। আমরা আজ অ্যাডভেঞ্চারে যাব।’

আমার মনটা ধন্ধে ভরে উঠল, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সে, সেখানে উপস্থিত একটা ম্যানেজার গোছের লোকের সঙ্গে কিছু কথা বলল, আর কিছু টাকাও দিল। আমরা থিয়েটারে ভাঁড়া করা ছদ্মবেশ ধারণ করলাম। তারপর বাইকে চড়ে আবার চললাম। যেতে যেতে বুঝলাম, আমরা অবিনাশবাবুর বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। অনির্বান বলল, ‘অবিনাশবাবুর বাড়িতে ঢুকব। একটু সাবধানে থাকবে আর চুপচাপ থাকবে। আমরা এখন ইলেক্ট্রিক অফিসের লোক।’

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।

‘বল কি! আমরা বিজ্ঞানে মাস্টার্স করা দুজন ছাত্র, শেষে কিনা ছদ্মবেশে লোকের বাড়িতে ঢুকব! যদি ধরা পড়ি, লাইফ তো পুরো হেল হয়ে যাবে। চুরির দায়ে জেল। আবার কয়েক ঘা মারও পিঠে পড়ে যেতে পারে।’

‘কিচ্ছু হবেনা, সাহস রাখো। আর উত্তেজনার ভাব টা কমিয়ে, শান্ত থাকো।’

গিয়ে গলির মুখটায় দাঁড়ালাম। একে গ্রীষ্মের দুপুর, তার ওপর ১লা বৈশাখ, লোকে মাংস-ভাত খেয়ে জাঁকিয়ে ঘুম দিচ্ছে নিশ্চয়। কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই। অনির্বান ঠিক গলির মুখটায় বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি গলির প্রথম বাড়িটার দাওয়ায় একটু ছায়া দেখে গিয়ে বসলাম। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল এভাবে। আমরা কিসের জন্যে এই ভরদুপুরে মাথায় রোদ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা জিজ্ঞেস করব ভেবে অনির্বানের কাছে উঠে গেলাম। তখনই অনেক দূর থেকে বড় রাস্তার ওপরে একটা লোককে একটা রেঞ্জার সাইকেল নিয়ে আসতে দেখা গেল। অনির্বান আমার হাত টা টেনে বলল – রেঞ্জার সাইকেল। চলো।

আমরা চট করে গলির ভেতর ঢুকে পড়লাম। বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় টোকা মারল অনির্বান। ওর মধ্যে একটা তাড়াহুড়োর ভাব দেখা গেল। আমি বললাম লোকটা যদি ধরে ফেলে, তারপর পুলিশ ডাকে। অনির্বান বলল, ‘কর্তামশাই বাড়িতে নেই, চাকরটি আছে। চিন্তা করোনা, আমাদিকে চিনতে পারবেনা।’

চাকর মহাশয়, মানে আমাদের সেই রমানাথ মজুমদার দরজা খুলে দিল। আমরা ইলেক্ট্রিক মিটারের রিডিং নিতে এসেছি বলে ঢুকে পড়লাম, সে দরজা আবার বন্ধ করে দিলো। ছদ্মবেশটি খাসা হয়েছিল তা চাকরের মুখ দেখেই বোঝা গেল। তার মুখে, পূর্বপরিচিতদের নতুন করে দেখলে, যে ‘চেনা চেনা লাগছে’ নামক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়, তার কোনো ছাপ নেই। সে আমাদিকে মিটারটি দেখিয়ে দিল। দরজায় ঢুকেই ডানদিকে।

এই ঘরটি অনেকটা বৈঠকখানার মত, কিন্তু নোংরা, অন্ধকার আর আগোছালো। অনির্বান আমার হাতে একটা ছোটো টর্চ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখে বল কত হয়েছে।’

সে একটা নোটবুক বের করে রিডিং লেখার উপক্রম করল। এমন সময় গলির মধ্যে একটা সাইকেলের এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেল। অনির্বান চাকরটিকে বলল, ‘একটু জল খাওয়াতে পারেন?’

চাকরটি ঘাড় নেড়ে জল আনতে ভেতরে গেল। এমন সময় দেখলাম, দরজার তলা দিয়ে একটা খাম ঢুকে এল। তারপর আরো অবাক হয়ে দেখলাম, অনির্বান চট করে সেই খাম তুলে পকেটে চালান করল। আমার হাতের টর্চের আলো পড়েছিল মিটারের ওপর, কিন্তু আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম অনির্বানের দিকে। চাকর জল আনতেই আমার আচ্ছন্নতা কাটল। আমরা জল খেয়ে ধন্যবাদ বলে বিদায় নিলাম। আর কোথাও কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে ফিরে এলাম।

বাইকে করে ফিরলেও আমি যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। ছদ্মবেশটা ছেড়ে, জলের বোতলটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপারটা কি হল? চিঠিটাই বা কিসের?’

অনির্বান চিঠিটা খুলে একবার মনে মনে পড়ে মুচকি হাসল, তারপর বলল, ‘শোনো।’

সে পড়তে আরম্ভ করল। চিঠির বয়ান এইরকম – “এই শেষবাবের মত বলছি, কাল দুপুর আড়াইটেই সাহেবপাড়ার তিন নং গলিতে। এর পরে চিঠি লিখতে হলে, তা যাবে পুলিশের কাছে।”

বেনামী চিঠি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে হুমকি চিঠি, কেউ অবিনাশবাবুকে ব্ল্যাকমেল করছে। এটাও বোঝা গেল এর আগেও চিঠি লেখা হয়েছে এবং তাতেই হয়ত পুলিশের কাছে কি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে আর ব্ল্যাকমেলার তারবদলে অবিনাশবাবুর কাছে কি চায়, তার উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু কে ব্যাকমেল করছে সেটা জানতে গেলে, আগে অবিনাশবাবুর কাছে চিঠিটা পৌঁছানো দরকার। তা না হলে আগামীকাল তিনি সাহেব পাড়ার তিন নং গলিতে যাবেন কি করে?

অনির্বান চিঠিটা খামে পুরে বাইকের চাবি হাতে নিল। আমি বললাম, ‘চিঠি দিতে যাচ্ছো?’

সে বলল, ‘স্বাভাবিক।’

আমি বললাম, ‘হুম। সাবধানে।’

(৬) 

সেদিন বিকেলে হাঁটতে না বেরিয়ে বাইক নিয়ে বেরোনো হল। আমি অনির্বান কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছি?’

সে বলল, ‘থানায়।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

‘সেকি ভাই! থানায় কেন?’

‘আরে বন্ধু ভয় পেয়োনা। আমরা অপরাধ কিছু করেছি কি?’

একটু ভয় পেয়েই বললাম, ‘না! তবুও…’

থানায় এসে উপস্থিত হলাম। মেন গেটে ঢুকে সামনেই সাজানো বিল্ডিং। ডান দিকে একটি ছোট্ট বিচ্ছিন্ন কামরা। আমরা সেই কামরার দিকেই এগিয়ে গেলাম। একটি ছোকরা অফিসার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে। তার পাশের একটি বেঞ্চিতে একটি বয়স্ক অধঃস্থন পুলিশ কর্মচারী। কয়েকটি লোক হাতে দরখাস্ত নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে। টেবিলের ওপর স্তুপীকৃত কাগজের তাড়া। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। এক এক করে দেখলাম, আমাদের সামনের তিনটি লোকেরই মোবাইল হ্যান্ডসেট হারিয়ে যাওয়ায় জেনারেল ডাইরির দরখাস্ত। আমাদের নম্বর আসতেই অফিসার অনির্বান কে দেখে বলে উঠলেন, ‘কিহে ছোকরা, আবার কেউ পিছু করলো নাকি?’

সে বলল, ‘না স্যার।’

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। সে স্পষ্টভাবেই বলল, ‘রমানাথ মজুমদার যে আমাদের পিছু নিয়েছিল, সে ঘটনা আমি স্যার কে এসে জানিয়ে গেছলাম।’

আমি অনির্বানের সাহস আর সতর্কতা দেখে অবাক হলাম। তারপর অনির্বান নির্ভয়ে বলল, ‘স্যার। আমি রমানাথ মজুমদারের সূত্র ধরেই বোধকরি আসল লোকের সন্ধান পেয়েছি। লোকটার নাম অবিনাশ সমাদ্দার, পশ্চিমপাড়ায় বাড়ি। সে বেশ কয়েক বছর ধরে এই শহরে ঘাপটি মেরে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরে পুলিশের সক্রিয়তায় তার কুকর্ম এখন বন্ধ, তাই লুকিয়ে থাকাটাও তার পক্ষে সহজ হয়েছে।’

‘তুমি কি করে জানলে?’

‘স্যার, রমানাথ মজুমদারের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে এই লোকটার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সম্প্রতি তাকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছে, তাকে দেওয়া একটি চিঠি আমার হাতে এসে পড়েছিল, সেখান থেকে অনুমান করা যায়।’

এই বলে, সে সেই চিঠির একটি ছবি নিজের ফোনে বের করে, অফিসারের হাতে দিল। আমার ভয়ে কাঁপুনি শুরু হবার উপক্রম হল। এবার বুঝি আমরা ফাঁসলাম। অফিসার চিঠিটি পড়ে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন, ‘এ চিঠি তুমি পেলে কোথায়?’

আমার রক্ত জল হয়ে এলো। এই প্রশ্নই আশা করছিলাম।

অনির্বান একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘লোকটা কি মতলবে আমাদের পিছু নিয়েছিল, সেটা জানবার জন্য তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম আমরা। আজ দুপুরের ঘটনা, তার বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে আসছি তখন দেখি একটা আন্দাজ সতেরো-আঠারো বছর বয়েসের ছেলে, একটা সাইকেলে করে এল এবং তার বাড়ির দরজার তলা দিয়ে একটা খাম ঢুকিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে গলির অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু কৌতুহল বসত আবার দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম খামটা ভাল করে ঢোকেনি। মাফ করবেন স্যার, একবার ওটা খুলে চিঠিটার একটা ছবি নিয়ে আবার যেমন ছিল সেইভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছি।’

বেমালুম মিথ্যাকথা গুলো অনির্বান গড়গড় করে বলে গেল। নিজে তো ফাঁসলই, সঙ্গে আমাকেও ফাঁসালো। অফিসারের মুখ কঠিন হয়ে এলো। এই বুঝি লোকের চিঠি দেখার অপরাধে আমাদিকে জেলে পুরলেন। কিন্তু পর মুহুর্তেই নরম হলেন। আমার মনে হয় চিঠির বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝে তিনি আমাদের কৌতুহলী অপরাধ কে অনেকটা লঘু করে দেখলেন। তিনি বললেন, ‘এটা ঠিক যে তোমার গল্পের অবিনাশ সমাদ্দার যদি আমাদের অপরাধী হয় তাহলে তোমার কাজ প্রশংসনীয়। কিন্তু তবুও ওভাবে গোয়েন্দাগিরি করতে যাওয়া তোমাদের মোটেই উচিৎ হয়নি। বিপদ হতে পারত।’

সেসব কথা অনির্বান আর আমি শুনলাম, তারপর সুবোধ বালকের মত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। কিন্তু আমি বুঝলাম না, কোন অপরাধীর কথা হচ্ছে। তারপর অনির্বান আবার শুরু করল, ‘স্যার, একবারটি যদি কাল দুপুর আড়াইটেয় সাহেবপাড়ার ওই গলিতে গোপনে যাওয়া যায়, তাহলে লোকটাকে পাকড়াও করা যাবে। কে তাকে ব্ল্যাকমেল করছে সেটাও জানা যাবে। যদিও অন্যায় আবদার, তবুও স্যার…’

অফিসার তাড়াহুড়ো করে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে দেখি। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও। আর চিঠির ছবিটা আমার মোবাইলে সেন্ড করো। আমি তোমাকে কাল সকালে জানিয়ে দেব।’

অনির্বান ফোন নাম্বার একটা কাগজে লিখে, ছবিটি ব্লুটুথে শেয়ার করে উঠে দাঁড়ালো। আমরা একসঙ্গে ‘ আসছি স্যার’ বলে পিছনে ফিরলাম। দেখলাম লাইন অনেক লম্বা হয়ে গেছে।

(৭) 

বাড়ি ফিরে এসে আমার কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব লাগল। প্রথমবার থানায় ঢুকলাম, পুলিশের সঙ্গে এভাবে আলাপ হল, তার ওপর তাঁরা আমাদের কথা মনযোগ সহকারে শুনলেন এবং কোনো এক অপরাধীকে ধরার পেছনে আমাদের অবদান থাকতে পারে সেটাও তাঁদের ভাবভঙ্গীতে বোঝা গেল। আমরা যে আসলে কে, ভেবে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সাধারণ ছাত্রজীবন থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে কোন এক রোমাঞ্চকর জীবনে ঢুকে পড়েছি, যেন ধরতেই পারিনি। এবার এর অবসান দরকার, আমার আর রহস্য সহ্য হচ্ছে না।

অবিনাশ সমাদ্দার আসলে কে? পুলিশ তাকে কোন অপরাধীর সঙ্গে তুলনা করছে? অনির্বানই বা কেমন করে তা জানতে পারল? – এসব প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কিন্তু অনির্বান কে জিজ্ঞেস করব ভেবেও করলাম না। তাকে প্রচন্ড অন্যমনষ্ক আর চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সে বোধহয় ভাবছে, পুলিশ তার প্রস্তাব মেনে কাল সাহেবপাড়ায় যাবে কিনা। কারণ পুলিশের সাহায্য ছাড়া, আমাদের পক্ষে কাল ওখানে গিয়ে হাতেনাতে কিছু করা সম্ভব নয়। পুলিশ না গেলে হয়ত চোখের সামনে দেখতে পাওয়া একটা অপরাধীকে প্রমাণসহ ধরার সুযোগ টা হাতছাড়া হয়ে যাবে – এই ভাবনা তাকে যেন পাগল করে দিচ্ছে। তার এইরূপ আচরণ অবশ্য যুক্তিসংত। কারণ আমার মনে হয়, এই পর্যন্ত সে অনেক বুদ্ধিখাটিয়ে আর পরিশ্রম করে জালটাকে প্রায় গুটিয়েই এনেছে, এই অবস্থায় শেষটুকু তার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা সহ্য করা সত্যিই কঠিন। আমি বেশি কথা না বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল পুলিশ আসবে বলে মনে হচ্ছে?’

অনির্বান চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘মনে তো হয়।’

খেয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুম আসছিলনা। অনির্বানও জেগে রয়েছে বুঝতে পারছিলাম। পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। সকালে অনির্বানের ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে আটটা। অনির্বান বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা ১২টা নাগাদ থানায় পৌঁছে যাব।’

আমাকে তাড়া দিয়ে উঠিয়ে সে বলল, ‘ওঠো বিদিত, পুলিশ রাজি হয়ে গেছে। আমরা আজ একসঙ্গে নাটকের শেষ অংশে উপস্থিত থাকব।’

আমি বললাম, ‘সাবাস। তোমার ধৈর্যের ফল।’

(৮) 

নির্দিষ্ট সময়ে থানায় পৌঁছালাম। একটু আগের থেকেই চিঠিতে উক্ত সাহেবপাড়ার তিন নং গলিতে উপস্থিত হলাম। আগের দিন থানায় যাঁকে দেখেছিলাম, সেই অফিসার, ইন্সপেক্টর সমীর অধিকারী, নিজেই এসেছেন। সঙ্গে দুজন কন্সটবল আর আমরা। দূরে গাড়ি আর বাইক রেখে আমরা খুব সন্তর্পণে হেঁটে এসে গলির সামনের দিকেই একটা ভাঙা ঘরে লুকিয়ে রইলাম। ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে বারোটা। আড়াইটা বাজতে এখনো ঢের দেরি। অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু উত্তেজনার একটুও অভাব হলনা।

পাড়ার নাম থেকে অনুমান করা যায়, শহরের এই অংশে একসময় ইংরেজদের বসবাস ছিল। এই জায়গাটা শহরের একপ্রান্তে। বাড়িগুলো অনেক পুরোনো হলেও এককালে সুদৃশ্য ছিল বোঝা যায়। গলিটি একটু নিচু, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দুধাপ করে সিঁড়ি, তারপর বারান্দা। সেখান থেকে রুমে যাওয়ার দরজা।  বহুদিন মানুষের বাস নেই বোঝা যাচ্ছে। বেশীরভাগেরই ছাদ ধসে পড়েছে, দেওয়ালও যেন খসে পড়ছে, ভেতরে আগাছার ঝোপ। সাপখোপের বসবাসের আদর্শ জায়গা। সাধারণ মানুষ এদিকে খুব একটা আসেনা। এই গরমের দুপুরে নির্জনতা যেন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে।

আড়াইটা বেজে পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল, কিছু ঘটলনা। আমরা অনুরোধ করে পুলিশ কে ডেকে এনে এই গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছি, এই অবস্থায় যদি কিছু না ঘটে তাহলে ওনারা আমাদের সঙ্গে কি করবেন সেই ভেবে খুব অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলাম, সঙ্গে ভয়ও হল। এমন সময় গলির ঢোকার মুখে বুট জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। আমরা সতর্ক হয়ে গেলাম। একটা আন্দাজ মাঝবয়েসি লোক ভালো প্যান্টশার্ট আর সু পরে গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি বাঁ হাতে একটি বড় কালো ছাতা মেলে ধরে আছেন, তাই তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছেনা। তাঁর ডান হাতে একটি মাঝারি কাপড়ের ব্যাগ। লোকটি গলির একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন। দূর থেকে দেখলাম, তিনি ব্যাগটি একটি ভাঙা ঘরের দরজার ভেতর হাত বাড়িয়ে রেখে পেছনে ফিরতেই একটা ‘ধাতুর ওপর কাঠ ঠোকার মত’ আওয়াজ হল আর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

এ দৃশ্য দেখব কল্পনাও করিনি। সমীরবাবু দুজন কন্সটেবলের সঙ্গে গলিতে নেমে পড়লেন। গলির অপর প্রান্তের আরেকটা পোড়ো বাড়ি থেকে গুলিটা করা হয়েছে। আমরা ভাঙা বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম ব্যাপারটা। তারপর সমীরবাবুর রিভলভার থেকে দুবার ফায়ারিং হল, বিকট তার শব্দ। উল্টোদিকের ওই বাড়িটার ভেতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ এলো। সমীরবাবু খুব সন্তর্পণে বন্দুক বাগিয়ে, দুজন কন্সটেবল কে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। দেখলাম কন্সটেবল দুজন বাড়িটার ভেতরে থেকে একটা বিশ-বাইশ বছরের যুবককে দুদিক থেকে ধরে বাইরে আনছেন, যুবকের পায়ে গুলি লেগেছে। অনির্বাণ ততক্ষণে গলিতে নেমে পড়েছে। সমীরবাবু ভাঙা দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন কন্সটেবলকে ভেতরে আসতে বলে অপরজনকে নির্দেশ দিলেন ছেলেটিকে শক্ত করে ধরে রাখার জন্যে। তারপর ভেতর থেকে অনির্বানের নাম ধরে ডাকলেন, আর সে খানিকটা ছুটেই ঘরটায় প্রবেশ করল। আমি ততক্ষণে গলিতে নেমে ঘটনাস্থলের দিকে খানিকটা এগিয়ে যুবকটির পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সে মাটিতে বসে রয়েছে, তার পা সামনের দিকে ছড়ানো। গুলিবিদ্ধ পা থেকে রক্ত ঝরছে। পুলিশের কন্সটেবল ছেলেটিকে দুহাতে করে ধরে রয়েছেন। একটু দূরেই অবিনাশবাবুর নিথর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

দেখলাম ওরা তিনজন মিলে আরেকটা বেশ ভারী মৃতদেহ অনেক কষ্ট করে বাইরে আনছে। ব্যাপারটা কি! এতগুলো খুন, ফারারিং, রক্ত – আমার মাথা ধরে এলো। অনির্বান দেখালো, ওই পোড়ো বাড়ির ভেতর থেকে একটা সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার পাওয়া গেছে। অবিনাশবাবুর খুনের অস্ত্র।

সবাই এসে উপস্থিত হওয়ার পর আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করে আমি আবার বিস্মিত হলাম। অপরাধী যুবকটি অবিকল আমার মত দেখতে। অনির্বান বলল, ‘কি বিদিত! তোমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছ?’

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলম না।

ফোন করে আরো পুলিশ বাহিনীকে ঘটনাস্থলে আসার নির্দেশ দিয়ে সমীরবাবু বললেন, ‘এই দ্বিতীয় লোকটির মৃত্যু তো অপ্রত্যাশিত।’

কথাটা যেন অনির্বানের কানে গেল না। সে হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে, অবিনাশবাবুর মৃতদেহর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘সমীরবাবু। দেহটাকে একবার সোজা করুন।’

দেহ সোজা করতেই দেখলাম আমাদের রমানাথ মজুমদার।

আহত ছোট্টুর আর্তনাদে চারদিক ফেটে পড়ল, ‘আঃ… অপূর্ব ঘোষ, তুই আমার হাতে থেকে পার পেয়ে গেলি…!’

অনির্বান তৎক্ষণাৎ প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘সমীরবাবু, একদল পুলিশকে এখুনি পশ্চিমপাড়ার মোড়ে পাঠানোর ব্যাবস্থা করুন দয়া করে। আসল লোক নিজে আসেনি, দেরী হলে পালাতে পারে।’

এখানে এখনো অনেক কাজ বাকি। আরো পুলিশ আসছে সাহায্যের জন্য। দুটো লাশকে হাসপাতালে চালান করতে হবে, তার সঙ্গে অপরাধীকে থানায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।

অনির্বান আমার দিকে বাইকের চাবিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘বিদিত, তুমি পশ্চিমপাড়ার মোড়ে চলে যাও। পুলিশ পৌঁছোলে বাড়িটা দেখিয়ে দিও। সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।’

আমি ছুটে গলি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাইকে করে পশ্চিমপাড়া পৌঁছোতেই দূর থেকে দেখলাম অবিনাশবাবুর গলির মোড়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। স্পীড বাড়ালাম। পুলিশও প্রায় আমার সঙ্গেই এসে পড়ল। আমার মনে হল বড়বাবু স্বয়ং এসেছেন। আমি বাড়িটা দেখিয়ে দেবার জন্য, সবাইকে নিয়ে গলিতে ঢুকলাম। দেখলাম একটা বছর পঞ্চান্নর লোক, রমানাথ মজুমদারের সেই চকচকে জামাটা পরে ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িটা থেকে বেরোচ্ছে। চিনতে অসুবিধা হলনা, অবিনাশ সমাদ্দার।

চেঁচিয়ে বললাম, ‘ওই যে!’

পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে লোকটাকে পাকড়াও করল। তিনি বোধহয় আবার তীর্থভ্রমণে বেরোচ্ছিলেন। তাঁরা অবিনাশবাবুকে জিপে তুললেন। বড়বাবু আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘তুমিই বিদিত?’

আমি আপ্লুত হয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার।’ 

তিনি আমার হাতটা আরেকবার ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্কস, এবার থানায় চলো।’

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘চলুন স্যার।’

জিপের সামনে বাইক নিয়ে থানায় আসতে আসতে নিজেকে গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তা মনে হচ্ছিল। পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে একটা অপরাধী কে পাকড়াও করালাম, তাকে নিয়ে থানায় যাচ্ছি। আনন্দ মিশ্রিত রোমাঞ্চে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ভাগ্যিস লোকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ফেলিনি – ‘অ্যারেস্ট হিম’!

(৯)

থানায় এসে বড়বাবুর পেছন পেছন মেন বিল্ডিং এর অফিসরুমে ঢুকলাম। এবারে থানায় ঢুকতে প্রথমবারের মত ভয় করলনা। গত কয়েক ঘন্টায় যে বীভৎস অপরাধের সম্মুখীন হয়েছি তাতে মনের জোর অনেকটা বেড়ে গেছে। সমীরবাবু আর অনির্বান সেখানে বসেই কথা বলছিল। বড়বাবু ঢুকতেই তারা উঠে দাঁড়ালো। সমীরবাবু আমাদের সঙ্গে বড়বাবুর পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বললেন, ‘এই যে স্যার, আপনাকে যার কথা বলেছিলাম। অনির্বান সিংহরায়। আর বিদিতের সঙ্গে তো নিশ্চয় পরিচয় হয়েছে ইতিমধ্যে। আর ইনি হচ্ছেন আমাদের থানার ও.সি. ইন্সপেক্টর সহদেব সরকার।’

বড়বাবু অনির্বানের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘ব্র্যাভো! ইয়াং ম্যান।’

অনির্বান বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার।’

বড়বাবুর পেছন পেছন সমীরবাবুও ভেতরে ঢুকলেন।

অনির্বান উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘তুমি তো ভাই আসল অপরাধীকেই পাকড়াও করে আনলে। সাবাস।’

আমি তার কথায় ফুলেফেঁপে না উঠে বললাম, ‘ব্যাগটায় কি ছিল?’

‘কি থাকতে পারে?’

‘অর্থ?’

‘মোটা পরিমাণে।’

মিনিট কুড়ি পরে সমীরবাবু এসে, চেয়ার টেনে বসে অনির্বান কে বললেন, ‘তুমি তো বিরাট বিস্ফোরণ ঘটালে হে। আমরা সাসপেক্ট করছি, ধৃত ব্যক্তিই হল বছর দশ-বারো আগে শহর কাঁপানো ছেলে-পাচারচক্রের মূল পান্ডা।  সেই সময় লোকটিকে পুলিশ বাগে আনতে পারেনি। লোকটি বুদ্ধিমান ছিল, পুলিশের তৎপরতা দেখে সে ওই ব্যবসা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিল। কয়েকদিন বেপাত্তা ছিল, তারপর চুপচাপ এসে তার বাড়িতে বসবাস শুরু করে। তখন ছেলে-পাচারচক্রের সব আগুন নিভে গেছে। সে অনেক টাকা জমিয়ে ছিল, নিজেকে সংযত করে সেই রসদ খরচ করেই দিন চালাচ্ছিল। তবে লোকটির আসল নাম অবিনাশ সমাদ্দার নাকি অপূর্ব ঘোষ, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।

‘কিন্তু ছেলেটি যে কে, লোকটির চাকর ওখানে টাকা নিয়ে কেন গেছলো, কেন ছেলেটি তাকে খুন করল আর অন্য মৃত লোকটাই বা কে, সে বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে যাচ্ছে। সবার জেরা সম্পূর্ণ হলে সব কিছু জানা যাবে। ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমরা ওকে কড়া ভাবে জেরাও করতে পারবনা। তুমি এইসব ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করো, আমি জানি তুমি সবটা বুঝেছো।’

এই বলে তিনি অনির্বানের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

অনির্বান লজ্জিত ভাবে বলল, ‘রহস্যের অনুসন্ধান করা আমার কাজ নয় স্যার, আপনারা তাতে অনেক বেশী পারদর্শী। তবে এই ব্যাপারে প্রথম থেকে আমার যে খটকাটা লেগেছিল, আমি জাস্ট তার পেছনেই ছুটেছি। আর তাতে করেই যেটুকু জানবার জেনেছি।’

সে বলতে আরম্ভ করল, ‘অবিনাশবাবুর চাকরটি যখন প্রথম আমাদের পিছু নিতে শুরু করে, তখন আমার প্রথম খটকা লাগল। লোকটা দুদিন পরপর আমাদের পিছু নিলো, আর যখন সামনাসামনি হলাম সব মিথ্যে বলল। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথমে আমার শুধু জেদ চেপেছিল যে লোকটার সত্যি টা খুঁজে বের করব। কিন্তু পরেপরে যখন অপরাধের গন্ধ পেলাম তখন ব্যাপারটায় আগ্রহ জাগল। পরে ওকে খুঁজতে গিয়ে সামনে এলো অবিনাশ সমাদ্দার। বুঝলাম এই লোকটিই ওকে পাঠিয়েছিল। কারণ একটা চাকরের, দামী জামাকাপড় পরে ইভিনিং ওয়াকে বেরোনোটা এ শহরের কালচার নয়। তখন থেকে আমি অবিনাশ সমাদ্দারের পেছনে পড়লাম।

‘গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যের পর থেকে আমি ওনাকে ফলো করছি। লোকটি স্টেশনের সামনে হয়ে হাঁটতে বেরোন, ফেরার পথে স্টেশনের সব্জি বাজারে কিছু বাজার করে বাড়ি ফেরেন। একই রুটিন চলতে লাগল দুদিন। কিন্তু গত মঙ্গলবার রাতে একটা নতুন ঘটনা ঘটল। স্টেশন বাজারের কোনার দিকে কতগুলো ঘুপচি ঘর আছে। ঘরগুলোর প্রায় দরজা পর্যন্ত সব্জি বাজার বিস্তৃত। ঘরগুলোর মাকিলানা কার জানা নেই, তবে বাজারে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওখানে স্টেশনের কয়েকটা হকার রাত কাটায়। অবাক হয়ে দেখলাম সেদিন অবিনাশবাবু বাজার করা সেরে এদিক ওদিক তাকিয়ে, হঠাৎ করে একটা ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমি তাড়াতাড়ি করে ঘরটির সবচেয়ে কাছের সব্জিওয়ালার পসরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাগ্যক্রমে সেখানে একটা ছোটো জানলা ছিল, সেটা বন্ধ থাকলেও আমি ওটার কাছাকাছি দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। বাজারের কোলাহল থেকে যতটা সম্ভব মন কে সরিয়ে ঘরের ভেতরে মনঃসংযোগ করলাম। বুঝলাম ভেতরে একটি অবাঙালী মোটা কন্ঠস্বরের লোকের সঙ্গে অবিনাশবাবুর কথা হচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে না পেলেও, কথোপোকথন টা এই রকম –

– নমস্তে সাব। বাহুতদিন বাদ।

– তোর সঙ্গে কে হাত মিলিয়েছে সত্যি করে বল।

– (কাল্লু আকাশ থেকে পড়ে বলল) ক্যা বাত হ্যা সাব।

– চুপকর বেয়াদপ! ছোট্টু কে কোন দলের কাছে দিয়ে এসেছিলি?

– কৌন ছোট্টু সাব।

– আমার সঙ্গে চালাকি করবিনা। আমি জানি আমার দলের কোনো লোকের সাহায্য ছাড়া, তার পক্ষে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। আর তুই’ই এখন এই শহরে আমার একমাত্র পুরোনো লোক।

– সে তো ধরেন দশ-বারো বচ্ছর আগের কথা। তখন তো হারিয়ানা মে কাম হত, মানোহর পান্ডের দল।

– মনোহর পান্ডে? (কিচ্ছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন) তোর সঙ্গে কেউ সন্দেহজনক যোগাযোগ করলে আমাকে তৎক্ষণাৎ জানাবি।

– সচ বোলতা হ্যা সাব, আমার সঙ্গে কারো বাত হয় নাই। হলে জারুর জানাবে।

‘গজগজ করে আরো কিছু কথা বলার পর অবিনাশবাবু বেরিয়ে পড়লেন। আমি আর তাঁর পিছু নিলাম না। শুনলাম ভেতর থেকে হকার মশায়ের গলা আবার পাওয়া গেল, তবে এবার সে ফোনে কথা বলছে। ফোনের অপর প্রান্তের কথা গুলি না শুনতে পেলেও অনুমান করলে কথাগুলি এইরকম দাঁড়ায়।

– সাব। কাল্লু বলছি।

– বল।

– বুড়ো আভি এসেছিল আপনার খোঁজে।

– ব্যাটা আমার কথা জানল কি করে?

– জানিনা সাব। তবে আমার সাথে আপনার যোগ আছে বুড়ো আন্দাজ করেছে।

– এবার ব্যাটাকে ছাড়বনা।

– মাথা গরম করবেন না সাব। প্যায়সাটা য্যাদা জরুরি।

– আচ্ছা। শেষবারের মত ওকে চিঠি দেব।

– আপনি পাঠিয়েদিন সাব, শুক্রবার দোপেহেরে ওর কাছে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার ইন্তেজাম করে দেব। বুড়ো সেদিন বাড়িতে থাকবেনা, নয়া সালের পেহলা দিন, ব্যাটা পুজো দিতে যাবে।

‘’খ্যাক খ্যাক’ করে একটা শয়তানী হাসির বিকট আওয়াজ কানে এলো।

‘’আমার দলের লোক’ – কথাটা শুনে বুঝেছিলাম ও কোনো একটা অপরাধমূলক কাজের সূত্রে কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত। আন্দাজ করা গেল দলটি একটি ছেলে-পাচারের দল। আর দশ-বারো বছর আগের কোনো ঘটনায় জড়িত ছোট্টু নামের কেউ অবিনাশবাবুর পেছনে লেগেছে এবং সে কাল্লুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজটা করছে। সেদিন স্টেশন থেকে সোজা আপনার কাছে আসি, কিন্তু সব কথা না বলে শুধু রমানাথের আমাদের পিছু নেওয়ার কথাটা বলি – আমরা সে ঘটনায় ভয় পেয়েছি তাই আপনাকে জানাতে এসেছি। স্বাভাবিক ভাবেই আপনি আমাদিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন আর পরে কিছু হলে যোগাযোগ করতে বলেন।’

এরপর অনির্বান আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যেহেতু আমি আন্দাজ করেছিলাম ব্যাপারটা ছেলে-পাচারের ঘটনা সম্পর্কিত, তাই কথা প্রসঙ্গে সেদিন স্যারের কাছে জানতে চাই এই শহরে কোনো ছেলে-পাচারচক্র সক্রিয় আছে বা ছিল কিনা। গত কয়েক বছর ধরে কোনো ঘটনা ঘটেনি, তাই সমীরবাবু সে ব্যাপারে আলোকপাত করতে না পারলেও সেদিন ওনার পাশে থাকা এক বয়স্ক কন্সটেবল বলে ওঠেন আজ থেকে আট-দশ বছর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল, বছর তিনেক ধরে ক্রমাগত। তারপর থেকে বন্ধ। দলের আসল লোককে এই শহরের কোথায় কিভাবে খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল এবং পুলিশ কতটা এগিয়েছিল তাও তিনি সেদিন বলেছিলেন।’

তারপর সে আবার সমীরবাবুর দিকে ফিরে বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি নিশ্চিত বুঝলাম, যার পেছনে লেগেছি সে ওই চক্রেরই একজন। লোকটি দশ-বারো বছর আগে ছোট্টু নামের একটি ছেলেকে পাচার করিয়েছিল, ওই হকার কাল্লুর মারফত। বুঝলাম ছেলেটির মধ্যে জেদ আর প্রতিহিংসার আগুন ছিল, তাই সে পাচারের ঘটনা মনে রেখেছিল আর অবিনাশবাবুকে চিনে রেখেছিল। বড় হয়ে বেশ কয়েক বছর পর ফিরে এসে, সে তারই পাচারকারী কাল্লু হকার কে হাত করল। কাল্লুকে ছাড়া অবিনাশবাবুর সন্ধান পাওয়া বা তার সঙ্গে যোগাযোগ করা শক্ত, তাই এই রাস্তা। স্টেশনের অন্যান্য হকারদের কাছে কাল্লুর সন্ধান সহজেই পাওয়া গেল। কাল্লুর ওপর তার যে রাগ ছিলনা তা নয়, তবে ছেলেটি বুদ্ধিমান, সে জানত এই অপরাধের মাস্টারমাইন্ড অবিনাশবাবু। তাই তাকে শাস্তি দেওয়াটাই ছেলেটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তবে তার মনে যে আরো এত কিছু ছিল, আর সে যে কাল্লুর জন্যেও সমান শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছিল, তা আমি বুঝতে পারিনি।

‘কাল্লুকে হাত করতে ছোট্টু কে বেশী বেগ পেতে হয়নি। অনেকদিন ধরে এই অপরাধের ব্যবসা বন্ধ। হাতে তখন যেটুকু টাকা আসত তার অভাব সে এখন ভাল রকমই অনুভব করছিল। ছোট্টুর ব্ল্যাকমেলের প্ল্যান টা শুনে সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। এর পেছনে আরো একটা কারণও থাকতে পারে। অবিনাশবাবু তাকে দিয়ে অনেক কুকর্ম করিয়েছেন এককালে, নিজে অনেক টাকা করেছেন, তাকে বঞ্চিত করেছেন। এই রাগও কাল্লুর মধ্যে ছিল। তাই অবিনাশবাবুর টাকা খসিয়ে নিজের পকেট ভরাতে তার আপত্তি হলনা।

‘ভেবে দেখলে মনে হয় কাজটা কাল্লু একাই করতে পারত। কিন্তু তার মোটা মাথায় এত বুদ্ধি আর সাহস থাকেনি যে সে এই রকম একটা প্ল্যান করে সেটাকে বাস্তবায়িত করবে। ছোট্টুর ভূমিকাটা এখানেই।

‘ছোট্টু, কাল্লুকে দিয়ে অবিনাশবাবুকে পরপর কয়েকবার চিঠি দিল, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেলনা। অবিনাশবাবু আতঙ্কিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু, আমার মনে হয়, অতগুলো টাকা না দিয়ে যদি অন্যকোনো রকমে পরিত্রান পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারে ভাববার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। তিনি হয়ত বুঝেছিলেন, ব্ল্যাকমেল টা ক্ষণস্থায়ী হবেনা। সেটা ক্ষেপে ক্ষেপে চলতে থাকবে, সারাজীবনের যন্ত্রনা। আবার প্রাণহানির আশঙ্কাও থাকতে পারে। তাই একবার টাকা দিয়েই পার পেয়ে যাওয়ার সহজ থিওরিতে তাঁর মন বসছিলনা। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন, চিঠিগুলোর সূত্র ধরে যদি পত্রদাতার সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে তাকে সাবাড় করে তিনি সব সমস্যার সমাধান করবেন।

‘আর, পুলিশের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠছেনা। কারণ চিঠি গুলি তাঁর অপরাধের বৃত্তান্ত বর্নণা করে লেখা, তার ওপর তিনি নিজে দাগী আসামী।

‘এই অবস্থায় একটা সমাপতন ঘটল। আমার বিশ্বাস, তিনি রাস্তাঘাটে কোথাও বিদিত কে দেখেছিলেন। তাঁর মনে ছোট্টুর ছবি টা পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই বিদিত কে দেখা মাত্রই তিনি পিছু নিলেন। এ যদি সত্যিই ছোট্টু হয়, তাহলে এর ভবলীলা সাঙ্গ করে তিনি অর্থক্ষয় ও প্রাণহানির ভয় থেকে মুক্তি পাবেন – এই ছিল তাঁর প্রাথমিক প্ল্যান।

‘তাঁর ভয় ছিল, তিনি নিজে যাচাই করতে এলে ছেলেটির মুখোমুখি পড়তে পারেন। আর সে যদি আসল ছেলে হয়, তাহলে তাঁকে চিনে ফেলে তৎক্ষণাৎ একটা কান্ড ঘটাতে পারে। তাই নিজে না এসে, চাকরকে ভদ্রসভ্য সাজিয়ে পাঠালেন। কার্যসিদ্ধি হল, কিন্তু তার ফল মিষ্টি হলনা। লোকটি জানলেন বিদিত একটি সাধারণ ছাত্র, এই শহরে অনেক বছর ধরে রয়েছে, গ্রামের বাড়ি মেদিনীপুরে। অতয়েব তাঁর পরিত্রান পাওয়ার সমস্ত আশা ভেস্তে গেল। তিনি কাল্লুর ওপর সন্দেহ করে একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কাল্লুকে ভাঙা গেল না। তিনি হয়ত পরে ভেবেছিলেন – যে শত্রু তাঁর ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে তাঁর পেছনে লেগেছে, সে যে কাল্লুকেও ছেড়ে কথা বলবেনা, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ কাল্লু আর তিনি সমান অপরাধে অপরাধী। তাই তিনি কাল্লুর ওপর সন্দেহ টিকিয়ে রাখতে পারলেন না।

‘কিন্তু কাল্লুর মুখে মনোহর পান্ডের নাম শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মনে আছে স্যার, সেদিন যখন রমানাথের ব্যাপারে আপনাকে প্রথম জানাতে আসি, তখন এ শহরের পাচারচক্র ছাড়াও আমি আপনাদের কাছে হরিয়ানার মনোহর পান্ডে নামে অপরাধীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন মাসকয়েক আগে সে খুন হয়েছে। সে ছিল ওখানের ক্রিমিনাল গ্রুপের মাথা, ডাকাতি আর রাহাজানির দল ছিল তার।

‘অবিনাশবাবু মনোহর পান্ডের খুনের খবরটা জানতেন। তিনি বুঝলেন এবার হয়ত তাঁর পালা। কিন্তু ব্ল্যাকমেলের শর্তটা না পূরণ করে পালাতেও পারলেন না। কারণ সেক্ষেত্রে পুলিশের কাছে তাঁর বিবরণ পৌঁছে যাবে, পুলিশ তাঁর বাড়ি কব্জা করবে। সে অবস্থায় তাঁর পক্ষে বেশীদিন পালিয়ে বেড়ানোটা সম্ভব হয়ে উঠবেনা। আমার বিশ্বাস, কাল্লু মনোহর পান্ডের খুনের ব্যাপার টা জানত না, জানলে সে ছোট্টু কে ভয় পেয়ে অবিনাশবাবুর শরণাপন্ন হত।

‘ইতিমধ্যে শেষ চিঠিও এসে পড়ল। অগত্যা তাঁকে, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে, ছোট্টুর ফাঁদে পা দিতে হল। তবে তিনি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় খামতি রাখলেন না। নিজে না গিয়ে, চাকরটির কাছে মৃত্যুভয়ের কথা গোপন করে, তাকে পাঠালেন টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এবং কোনও রাস্তা না থাকায় জমানো টাকাকড়ি নিয়ে বাড়ি ছাড়ার প্ল্যান করলেন। তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন এতে করে সম্যসার স্থায়ী সমধান হবেনা। ছোট্টু যদি টাকাটা নিয়েই শান্ত হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু সে যদি সত্যি করেই তাঁকে হত্যা করার মতলব নিয়ে এসেছে, তাহলে তাঁকে না পেয়ে তার আক্রোশ আরও বেড়ে যাবে। তারপর সে আবার তাঁর খোঁজ শুরু করবে, অথবা তাঁর সমস্ত বৃতান্ত পুলিশের কাছে ফাঁস করবে। কিন্তু এসব জেনেও তিনি সরাসরি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ঝুঁকি নিতে পারলেন না। চাকরটি নিশ্চই তাঁর খুব অনুগত ছিল এবং তিনি ভালোরকম মাইনে দিয়ে তাকে বশে রেখেছিলেন।

‘তারপরের সব ঘটনা তো আমাদের চোখের সামনেই হল। বোঝা যাচ্ছে অপর মৃত লোকটাই কাল্লু হকার। ছোট্টু বার বার ব্ল্যাকলেম করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল, তার কৈশোর নষ্ট করে দেওয়া লোক দুটোকে খুন করার। পরে হয়ত সে ভেবেছিল, এই সুযোগে কিছু টাকা পকেটে ঢুকলে মন্দ কি!’

আমরা সবাই কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হব হব। সমীরবাবুর সঙ্গে আরো দুচারটে সাধারণ কথা বলে আমরা বিদায় নিলাম। আমার কিন্তু তখনো কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছলো। ভাবলাম বাড়ি ফিরে আলোচনা করা যাবে। আমরা বাইকে চড়ে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

(১০) 

ফেরার পথে চা পানের জন্য আমাদের পরিচিত দোকানে দাঁড়ালাম। অনির্বান আমার সন্ধিৎসু মুখ দেখে বলল, ‘এখনো কিছু খটকা রয়ে গেছে বোধহয়।’

আমি অনির্বানকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, চিঠি উদ্ধার অভিযানটা যেভাবে ঘটল, সেটা কি তোমার প্ল্যানমাফিক? আর রেঞ্জার সাইকেলের ব্যাপারটাই বা কি?’

‘চিঠিটা কোনোরকমে দেখতে হবে, এটা ছিল উদ্দেশ। জানতাম দুপুর নাগাদ চিঠিটা আসবে, কাল্লুর কোনও সাকরেদ মারফত। রেঞ্জার সাইকেলটা আগেরদিন কাল্লুর রুমের বাইরে চাবি লাগানো অবস্থায় দেখেছিলাম। তবে কোনও ক্লু না থাকলেও, ছেলেটাকে আসতে দেখেই আমাদিকে ভেতরে ঢুকতে হত। বাকি পুরো ব্যাপারটা যে একদম প্ল্যানমাফিক হয়ে যাবে ভাবিনি।’

‘বটে। কি রিস্কে সেদিন ফেলেছিলে তাহলে ভাবো।’

অনির্বান চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুক দিয়ে সেটাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘সে তো ভাই এসব কাজে একটু ঝুঁকি নিতেই হবে। তবে শেষপর্যন্ত দুর্ঘটনা তো কিছু ঘটেনি, আমরা তো অক্ষত আছি নাকি?’

আমি এই প্রশ্নের কি উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে রাগে কটমট করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, ‘আরে ছাড়ো ছাড়ো, ওটা নিয়ে আর ভেবোনা। আরেক ভাঁড় করে হবে নাকি?’

অনির্বানের এই এক স্বভাব। পরপর দুবার চা পান। অবশ্য আমারও মাথা ধরে আছে, আরেকটা করে হলে ভালই হয়। আমি দুটো বড় মালাই-চা অর্ডার দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, অবিনাশবাবুর তো আমার ইতিহাস জানার উদ্দেশ্য ছিল। চাকরটাকেও নিশ্চয় সেই নির্দেশ দিয়েই আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাহলে সে নিজের কাজ না করে আমারদের পিছু পিছু ঘুরছিল কেন?’

‘আমার ধারণা, যেহেতু সে ছিল সাধারণ চাকর, তার পক্ষে অতসহজে আমাদের সম্মুখীন হয়ে কতগুলো প্রশ্ন করা এবং নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখে মিথ্যা বলে অভিনয় করাটা কঠিন। সে হয়ত কথা বলতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পেরে উঠছিলনা।’

‘হুম, বুঝলাম। আর যদি আমি সত্যি করেই ছোট্টু হতাম, তাহলে তো, আমরা কি করি কোথায় থাকি জানতে চাওয়ার পর রমানাথের ওপর সন্দেহ করে তাকে আক্রমন করতাম। সে ব্যাপারে কি অবিনাশবাবু সতর্ক হননি?’

‘এই ব্যাপারটায় ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। আমার মনে হয় অবিনাশবাবু যে গোছের লোক, সতর্ক হওয়াটায় স্বাভাবিক। তোমার কি মনে হয়? সতর্ক হয়ে তাঁর কি করা উচিৎ ছিল?’

আমি একটু ভেবে বললাম, ‘হয় তিনি নিজে সেই নির্জন রাস্তার পাশের কোনও ঝোপে লুকিয়ে ছিলেন। চাকরটার ইঙ্গিত পেলেই সুযোগ বুঝে আমাদের ওপর আক্রমণ করতেন। অথবা চাকরটার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল, সে ঠিকঠাক বুঝলে আমাদের কাম তামাম করে দিত। তবে দ্বিতীয়টার আশা ক্ষীণ।’

‘কেন কেন?’

‘কারণ, তুমি পাশে ছিলে সেকথা যদি ছেড়েও দি, ওই লিকপিকে লোকটা আমার সঙ্গে পেরে উঠতনা। এক ঘুষিতে ওকে ধরাশায়ী করতাম।’

এই বলে আমি আমার হাতের খালি ভাঁড় টা টিপে ভেঙ্গে ফেললাম।

অনির্বান প্রথমে শব্দ করে হেসে, তারপর মৃদুহাসি মুখে হাত মুঠো করে দৃঢ়কন্ঠে বলল, ‘আমি ভয়ানক, আমি ভীম।’

আমরা রুমে ফিরে এলাম। যেন মনে হল ঝড় থেমে গেছে। গতকাল আর আজ মিলে যে ঘটনাবহুল জীবন কাটল তার রেশ কাটাতে সময় লাগবে। অনেক নৃশংস অপরাধের সম্মুখীন হওয়ার ফলে মনে অনেক কালো দাগ পড়েছিল বটে, কিন্তু সেসব আমাদের উজ্জ্বল কর্মকান্ডের কাছে ম্লান হয়ে গেল। মনটা যেন যুদ্ধজয়সম আনন্দে ভরে উঠল।

সেদিন রাতে অনির্বান কে একটাই প্রশ্ন করলাম।

‘আচ্ছা অনির্বান, অবিনাশবাবু কাল্লুর কাছে কেন গেলেন, সেটা নাহয় বুঝতে পারলাম। কিন্তু তিনি ছোট্টুকেই প্রথম থেকে সন্দেহ করছিলেন কেন? এমনকি আমার সঙ্গে ছোট্টুর কোনো মিল নেই জেনেও তিনি কাল্লুর কাছে তারই নাম নিলেন!’

সে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এই ব্যাপারটা আমিও ঠিকঠাক বুঝিনি। তবে আমার অনুমান, আগের চিঠিগুলোয় এমন কিছু ইঙ্গিত ছিল, যেটা থেকে অবিনাশবাবুর ধারণা স্পষ্ট হয়েছিল যে ছেলেটা ছোট্টু। তাছাড়া এও হতে পারে, দশ-বারো বছর আগে যখন ছোট্টুর সঙ্গে অন্যায় হয়েছিল, তখন সে এমন কোনো কান্ড ঘটিয়েছিল বা এমন কিছু বলেছিল, যাতে করে অবিনাশবাবু বুঝেছিলেন এই ছেলেটি ভবিষ্যতে তাঁর অনিষ্ট করতে পারে। সেই কারণেই হয়ত তাঁর ছেলেটিকে মনে ছিল।’

আমরা দুজনই বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে রইলাম। তারপর অনির্বান একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খাট থেকে হাত বাড়িয়ে তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে ল্যাপটপ বের করলো। এতকিছুর পরেও ওর যেন কোনো তাপউত্তাপ নেই। আমি বললাম, ‘কাজ নিয়ে বসলে নাকি?’

‘কয়েকদিন ভালই ফাঁকি মারা হয়ে গেছে। কোডটা লেখা হয়ে পড়ে আছে। চালিয়ে গ্রাফ গুলো জেনারেট করে সোমবার স্যার কে দেখাতে হবে। তুমিও বোসো।’

পড়াশোনা সংক্রান্ত আরো কিছু কথা বলতে বলতে আমিও বইখাতা নিয়ে বসলাম।

(১১) 

পরদিন রবিবার। সকালে উঠে দেখি অনির্বান খবরের কাগজ পড়ছে। রান্নার মাসি রান্না করতে এসেছে। আমি উঠলাম দেখে অনির্বান মাসিকে চা করতে বলল। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে বসলাম। মাসি দুকাপ চা আমাদের টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেল। আমি চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে খাটে বসলাম। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখলাম ভেতরের পাতায় কালকের ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে ছেপেছে। বললাম, ‘খবরটা পড়লে?’

অনির্বান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘পড়লাম। তুমি পড়ো।’

আমি গুনগুন করে পড়তে পড়তে হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘দেখেছো!’

বলে গলা ঝেড়ে জোরে পড়তে আরম্ভ করলাম, ‘স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর, মিঃ সমীর অধিকারী মহাশয় বলেছেন – আততায়ীর পায়ে গুলি লেগেছিল। সে এখন সুস্থ এবং আমাদের হেফাজতে। ঘটনাস্থল থেকে একটি সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক এবং পাঁচলক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে। নিহত লোকদুটির একটি, বেশ কয়েক বছর আগে এ শহরের ছেলে-পাচারচক্রের অন্যতম সদস্য ছিল আর আরেকটি ওই চক্রের মূল পাণ্ডার কাজের লোক ছিল। কালই আমরা এই আসল লোকটিকে  তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছি। ছেলে-পাচারচক্রের পুরো ব্যাপারটায় ধামাচাপা পড়ে গেছল। তবে ইদানীং কিছু ঘটনা আর অনির্বান সিংহরায় ও বিদিত ব্যানার্জী নামে দুটি ছেলের তৎপরতায় সব ব্যাপারটা পুলিশে হাতের মুঠোয় এলো। ওরা এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের দুই ছাত্র, ওদিকে পুলিশের তরফ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ।’

অনির্বান মুচকি হেসে বলল, ‘পেপারে সগৌরবে নাম বেরোলো তাহলে!’

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘তাও আবার এতবড় একটা অপরাধী পাকড়াও এর ঘটনায় সাহায্য করার জন্য পুলিশের মুখে সুনাম, তার সঙ্গে আবার ‘বিশেষ ধন্যবাদ’। ভাবা যায়!’

‘এ ঘটনা তুমি লিখে ফেলো বিদিত। আমার মনে হয়, তুমি বেশ গুছিয়ে লিখতে পারবে। ল্যাংগুয়েজের ওপর দখলটা তোমার ভালই আছে।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘ল্যাংগুয়েজ! আমি তো ভাই অঙ্কের ছাত্র!’

‘আরে! ম্যাথামেটিক্স ইজ দ্যা ল্যাংগুয়েজ অফ ফিজিক্স! হা হা হা…’

আমার অঙ্ককে শুধু ল্যাংগুয়েজ বলায় আমার একটু রাগ হল। কিন্তু পর মুহুর্তেই তার কথায় আমি প্রসন্ন হলাম।

সে গীটারটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘তবে, দি মোস্ট পাওয়ারফুল এন্ড রিলায়েবল ল্যাংগুয়েজ ভায়া। এ ল্যাংগুয়েজ ছাড়া ফিজিক্স বোবা।’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘ঠিকই বলেছো। তবে যেভাবে সখ্যতা দেখিয়ে নাম উচ্চারণ করেছেন, আমার মনে হয়, বন্ধুমহলে এবার বেশ খাতিরযত্ন পাওয়া যাবে। কি বল?’

অনির্বানের গীটারে সুর বেজে উঠল, ‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ…।’

Author: admin_plipi