দূরে কোথায় ।। লেখা : অতনু কর্মকার
“দূরে কোথায় দূরে দূরে,
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে!
দূরে কোথায় দূরে দূরে” ….
গানটা পাশের ঘর থেকে গ্রামোফোনে বাজছে, ঠাকুর্দার ওই একটি জিনিসই পিসি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে এখনও পর্যন্ত, বাকি সব জিনিস বাড়ির লোকেরা বিক্রিবাটা করে সাফ করে দিয়েছে। হৈমন্তীর চিলেকোঠার এই দুটো ঘর খুবই প্রিয়, তাই বাবা পিসির পাশের ঘরটাতে ওকে থাকতে দিয়েছে। যদিও ওর দোতলাতে নিজের সাজানো গোছানো একটা রুম আছে, কিন্তু এইটা ওর বেশি পছন্দের। এইটা সম্পূর্ণ নিজের আর কোনও হই-হল্লোড়, চিৎকার চেঁচামেচি নেই। পিসি বেশিরভাগ সময় নিচে রান্নাবান্না আর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, শুধু দুপুর আর রাতের বেলায় তাকে ঘরে পাওয়া যায়।
কবিগুরুর এই গানটাকে হৈমন্তী খুব ভয় পায়, বস্তুত না শোনারই চেষ্টা করে। গানের কথার থেকেও গানটাকে গাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটা শূন্যতা গ্রাস করে আসার অনুভূতি আছে। কেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চাশ বছরে বয়সে এসে এই গানটা লিখতে গেলেন? মন হারানো বা মনকে নিয়ে সমস্যা খুব একটা হয় না ওর। আজকালকার দিনে এই সব অনুভূতির জায়গা নেই এমন নয়, কিন্তু সমস্যা প্রচুর বলেই ওর ধারণা। আর তাছাড়া, একটা বয়সের পরে এই অনুভূতিগুলোর কোনও দাম থাকে না; প্রায়োরিটিগুলো পাল্টে যায় আর তার সাথে সাথে অনুভূতিগুলোও চাপা পড়ে যায়।
কলেজে হৈমন্তীর মেধাবী এবং স্মার্ট টিচার বলে সুনাম আছে আর তার সাথে একটা ছটফটে মনও আছে। সবার সাথে হৈমন্তী সমান ভাবে মিশতে পারে, কাউকে পছন্দ না করলেও তার সাথে অবলীলায় ঘন্টা খানেক গল্প করে আর সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিতে পারে। অনেকেই তাই ওকে কলেজে ইউনিয়ন রুমে জয়েনও করতেও বলেছে, কিন্তু ও এই সবে নেই। নজরকাড়া সুন্দরী নয়, কিন্তু একটা আলাদা অনুভূতি আছে ওর সাথে মেশার – সেটা ও জানে। সৌন্দর্যকে কি কোনও ছকবাঁধা সংজ্ঞায় ফেলা যায়? কবিগুরুও হয়তো উত্তরটা দিতে পারতেন।
হৈমন্তীর উড়নচন্ডী স্বভাবের জন্য স্বভাবতই ওর মা সব সময়ই বিরক্ত এবং বিব্রত থাকত, এখন বোধ হয় হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওর বাবা বেশিরভাগ সময়েই নিরপেক্ষ থেকে মা আর মেয়ের ডুয়াল টা উপভোগ করে, “মেয়ে বড় হয়েছে আর স্বাবলম্বীও, ওর নিজের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াটা আমাদের উচিত” – এইটা হল তার পেটেণ্ট ডায়ালগ। কিন্তু কিছু না বললেও ওর বিয়ে বা সেটল হয়ে নিয়ে একটা চাপা টেনশন যে দুজনের মধ্যেই আছে সেটা হৈমন্তী জানে, কিন্তু অতটা পাত্তা দেয় না।
হৈমন্তী হাসিখুশি স্বভাবের হলেও ওর সিরিয়াস কোনও ছেলে বন্ধু নেই, ন্যালাভোলা ছেলেদের ও দুচক্ষে দেখতে পারে না আর ওভারস্মার্টদের দেখলেই হাসি পায়। সেইদিনই তো পিয়া কে বলছিল, “গায়ে আর পায়ে পড়া স্বভাবের লোকেদের থেকে একা থাকা অনেক ভালো রে”। “তোর কিছু হওয়ার নয়, তোর সাথে মিশে মিশে আমার একই অবস্থা” – পিয়া ঠোঁট উল্টে উত্তর দিল। হৈমন্তী অবাক হয়ে উত্তর দিল “ও, তাই নাকি – তা গত দুই সপ্তাহে যে দুটো ব্লাইন্ড ডেটে গেলি! তার বেলায়?” “ধুরর, আমি ব্লাইন্ড হলেও ওই ডেট এর ফিউচার ছিল না, একটা কেলাস আরেকটা ওর থেকেও কেলাস। কোনও etiquate জানে না, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে স্ল্যাং ভাষা বেরিয়ে আসে – পাতে দেওয়ার অযোগ্য” – পিয়া এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করল। “তুই যদি আমার বোন হতিস, আমার মা এতদিনে নির্ঘাত পাগলা গারদে শিফট হয় যেত” – বলতে বলতে দুজন্যই সোফায় হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড়।
কিছুক্ষন হাসিঠাট্টা চলার পর পিয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল – “হ্যা রে, ওই যে গুবলু ছেলেটা তোদের বাড়িতে এসেছিল তার বাবার হাত ধরে, তারপর আর যোগাযোগ করেছিল?” হৈমন্তী বলল – “না রে! কেন তোর ফোন নম্বরটা দেব নাকি ছেলেটাকে? খুব মিস করছিস মনে হচ্ছে? ওর সাথেও পরের সপ্তাহে একটা ডেট ফিক্স করে নে। কিন্তু ওর পোশাক-আশাক দেখেছিস? ওটা একটা presentable লুক?”
‘না রে, ছেলেটার চোখগুলো কিন্তু শার্প, ইন্টেলিজেন্ট মনে হয়।” – পিয়া বলল।
“আমার মনে হয় ব্লাইন্ড ডেট করে করে তুই ব্লাইন্ডই হয়ে যাচ্ছিস, আমি আর তুই তো দু’ মিনিটের বেশি ওই রুম এ ছিলামই না – তাতেই তুই ফিদা হয়ে গেলি? Shame on You!” – হৈমন্তী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই উত্তরটা দিল।
“আরে, আমি তো ভাবছিলাম যে ছেলেটাকে চোখ মারব কি না? তারপর ভাবলাম তোদের গেস্ট, ছেলেটা যদি আমাকে তুই আর তোকে আমি ভেবে বসত তাহলে তোর বাজে চাপ হয় যেত, তাই শেষ মুহূর্তে দুটো চোখই বন্ধ করে দিয়েছিলাম, না হলে কেলেঙ্কারি হয় যেত।” বলাই বাহুল্য যে পিয়ার এই অকপট স্বীকারোক্তি পর আর এক প্রস্থ হাসির ফোয়ারা শুরু হল।
আরও কিছুটা সময়ে কাটিয়ে হৈমন্তী ওদের বাড়ি থেকে বেরোল উবের ক্যাবে বাড়ির উদ্যেশে, কলেজের কিছু হোমওয়ার্ক শেষ করার তারা ছিল ওর। সেদিনের ছেলেটার নাম স্পন্দন, ব্যবহার আর কথাবার্তায় একটা ছন্দ আছে। এমন নয় যে সেটা ইম্প্রেসিভ কিছু, কিন্তু কোথাও যেন একটা জোর করে ইমপ্রেস না করার চেষ্টা আছে, সেটা বেশ বোঝা যায়। ওর বাবা বলে “হৈমন্তী, একটা সূক্ষ্ম ফারাক আছে – শিক্ষা আর দীক্ষার মধ্যে, না হলে দুটো আলাদা শব্দ কেন থাকবে বাংলা সাহিত্য কোষাগারে? তুই তো টিচার, কিন্তু তাও দেখবি তোর আশেপাশে শিক্ষিতও লোকজনই বেশি; দীক্ষার অভাবটা খুবই প্রকট।”
পিয়া অনেককিছুই জানে না, যেমন স্পন্দন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ওকে খুঁজে বার করেছে আর ওরা এখন প্রায়ই কথাবার্তা বলে। এমন নয় যে সেটা রোজ, কখনো হৈমন্তী নিজেও ইনিশিয়েটিভ নিয়ে শুরু করে। দুটো অচেনা লোক পরস্পরকে প্রবাহিত না করেও যে গল্প করে যেতে পারে – সেটা দুজনেই উপভোগ করে। কিন্তু পিয়ার বাড়ি যাওয়ার একটা কারণ ছিল, যেটা পিয়া কে বলে উঠতে পারল না, সংকোচে না অন্য কারণে সেটা ও জানে না! ঘটনাটা হল – গতকাল স্পন্দন সরাসরি ফোন করেছিল ওকে। হৈমন্তী কিছুদিন আগে মেসেজ করতে গিয়ে বলেছিল কলকাতা হল ওর প্রিয় শহর, এখন থেকে চলে যাওয়ার কথা বা অন্য কোথাও গিয়ে সেটল হওয়ার কথা ও ভাবতেই পারে না! বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্ট থেকে দুজনের কথোপকথন অনেকটা এই ধরণের ছিল –
“হৈমন্তী, আমি বেঙ্গালুরু থেকে ফিরে আসছি কলকাতায়। এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না।“
“কত দিনের ছুটি দিল অফিস? সফটওয়্যার এর লোকদের তো ধারণা ওদের ছাড়া অফিস অচল।“
“না না ছুটি না, আমি চাকরি ছেড়ে নতুন কোম্পানি জয়েনও করব কলকাতায়।“
“সেকি, হাই-টেক শহর ছেড়ে পুরোনো শহরে পা দিচ্ছেন? বেশি পয়সা দিচ্ছে নাকি?”
“আরে ওইটাই তো সমস্যা , স্যালারি কমে গেল আর লোকে আওয়াজ দিচ্ছে! “
“তা এই সবের কারণ কী? একাডেমী অফ ফাইন আর্টস এ নাটক করবেন?”
“ওখানে তো পেইন্টিং এর এক্সিবিশন হয় জানতাম!”
“নাটকও হয়। খবর নিয়ে দেখবেন।“
“হয়তো ঠিকই বলেছেন, আসলে পড়াশুনো করতে করতে শহরটাকে ঠিক চেনা হয়নি, আর সেটা আরও বেশি বুঝতে পেরেছি হৈমন্তী আপনার সাথে কথা বলতে বলতে!“
“ও আর সেই কারণে সটান এখানে পদার্পন করছেন। তারপর বাড়িতে বলবেন যে আমি হৈমন্তীর কথায় কলকাতা চলে এলাম, আমার আর আপনার ফ্যামিলি ভাববে আমরা এইটা প্ল্যান করে করেছি আর তারপর অবভিয়াস জিনিসগুলো শুরু হয় যাবে – তাই না?”
“তুমি করেই বলছি – হৈমন্তী, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়! তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু তারমানে এই নয় যে এর মধ্যে কিছু এক্সপেকটেশন আছে বা থাকবে। তুমি uncomfortable ফীল করলে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারো, আমি কিছু মাইন্ড করব না। তা ছাড়াও মা আর বাবা বেঙ্গালুরু এ থাকবে না, তাই ভাবলাম বেসটাকে শিফট করিয়ে লাভ নেই।“
“আমার বাবা জানে যে আপনি ফিরছেন?”
“পাগল? আমার বাবা জানেই না যে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি।“
“যাক, একটা ভালো কাজ করেছেন! তো আমি এখন কী করবো? আপনি ফিরবেন, ছেলের দায়িত্ব পালন করবেন – খুব ভালো কথা। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে কেন বলছেন? মেসেজও তো করতে পারতেন? পড়ে নিতাম!”
“মেসেজ করেছিলাম দু’দিন আগে, কিন্তু আপনি দেখেননি। আমি ও তারপরে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, ফোন করার কথা মাথায় আসেনি। সেই ভাবনাটি একটু আগে মাথায় এল।“
“বুঝেছি, Have a safe journey! আমার প্রচুর কাজ আছে কলেজের, এই চাকরি গেলে আর একটা পাব না।“
কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি হৈমন্তী, না সেটা আনন্দে হয়তো না। একটা দ্বন্দ্ব ভেতরে ভেতরে চলছে! এবার কী হবে? মেসেজ আপে নজর গেল, স্পন্দন কিছু একটা লিখছে আর বারবার মুছে দিচ্ছে। দ্বন্দ্ব কি শুধু একদিকেই! আজকের হোমওয়ার্ক তা মনে হয় গেল, যেটা সারা জীবন এড়িয়ে চলতে চেয়েছে সেই সব চিন্তা এখন কেন মাথায় আসছে। আপ ক্যাবকে মাঝ রাস্তায় বিদায় দিল, ড্রাইভারটা মনে মনে গালি দিল নিশ্চয়ই। ওর এখন ফ্রেশ এয়ার এর খুব দরকার, ব্রেইনে অক্সিজেন কমে গেছে মনে হচ্ছে।
রাতে আবার সেই চিলেকোঠার ঘরে ঠাঁই নিয়েছে হৈমন্তী। নিচের টিভি আর কলিং বেলের আওয়াজ আজ আর সহ্য হচ্ছে না, পিসির ঘরের দিকে একঝলক তাকাল। হৈমন্তিকে দেখে পিসি মৃদু হেসে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর নিজের হাতে গ্রামোফোনটি চালু করল। পিসি কি কিছু আন্দাজ করেছে? তাহলে এই গানটি কেন চালাল পিসি?
“কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।“ ………