বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ৭)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
সকালের নিউজ চ্যানেল চালিয়েছিল অমিয়। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। এরই মাঝে আরেক বিপদ দেশের আরেক প্রান্তে। কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস লিক হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে। এমনিতে লকডাউন, রাস্তায় মানুষ বেরোবার কথা নয়। তবুও দেখছে কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তায় দৌড়ে বেরোচ্ছে। যন্ত্রণায় রাস্তায় পড়ে ছটফট করছে। এত বিষাক্ত গ্যাস যে মানুষ শ্বাস নিতে পারছে না। দমবন্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে মারা যাচ্ছে। বছর ১২র দিদি জাপটে ধরে রয়েছে বোনকে। বোন আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য চোখে দেখা যাচ্ছে না। অমিয় টিভি বন্ধ করে দেয়। মানুষকে সত্যিই আজ কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। লড়াইটা যেন সুন্দর পৃথিবীর বুকে আঁকড়ে পড়ে থাকার লড়াই। এ যে যোগ্যতমের উদ্বর্তন। এতদিন যে জিনিসগুলো বইয়ের পাতায় দেখে এসেছে আজ বাস্তব পরিস্থিতি তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
আজ সকাল থেকে কোন কাজে ঠিক মন নেই পর্ণার। যতই নিজের মনকে সব কিছুর সংস্পর্শে এসেও শক্ত রাখার চেষ্টা করে, ততই যেন মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে উঠছে মন। হঠাৎ ব্যালকনি দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে চোখ যায় পর্ণার। দূরের পাহাড় আজ এত স্পষ্ট যে মনে হচ্ছে খুব কাছের। লকডাউন এ আজ দূষণমুক্ত পৃথিবী। তাই প্রকৃতিও যেন খুশিতে তার রূপের ডালি ছড়িয়ে বসেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ অপরূপ পাহাড়ের সৌন্দর্য, সাথে মুক্ত পাখির কিচির-মিচির পর্ণার মনটা আবার ভালো করে দেয়। হঠাৎ দরজায় নক এসময় তো কারও আসার কথা নয়। দরজা খুলে একটু অবাক হয়ে যায় পর্ণা, সামনে দাঁড়িয়ে রেনু।
-“কিরে কেমন আছিস তুই?”
রেনু হাসিমুখে বলে, “ভালো দিদি। দেখতে এলাম তুমি কেমন আছ? তোমার তো খুব কষ্ট হচ্ছে দিদি।”
-“হ্যাঁ, সে তো হচ্ছে, কিন্তু এসময় তোকেই বা কিভাবে আসতে বলি বল।”
রেনু বলে, “দিদি আজ যখন আসছি একটু করে দিয়ে যাই।” পর্ণা ওকে ঘরে ঢুকে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বলে।
মেয়েটির চেহারা এ কদিনে যেন কেমন ঝটকে গিয়েছে। বাড়িতে ঠিকমত খাওয়া জুটছে কিনা কে জানে? এখানে এলে তবুও পর্ণা কাজের শেষে খাইয়ে বাড়ি পাঠায়।
খুব দুঃখী মেয়ে। মেয়েটা যেদিন কাজে এসেছিল সেদিন শান্ত মেয়েটার আচরণ একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল পর্ণার। মেয়েটি এমনিতেই মুখ বুঝে কাজ করে, কিন্তু মাঝে মাঝে একা একাই কথা বলে, একাই হাসে। কয়েকদিনের মধ্যে পর্ণা বুঝে ছিল মেয়েটি পুরো স্বাভাবিক নয়। একদিন কানে এল মেয়েটিকে ওদের পাড়ার মানুষজন পাগলী বলেই জানে। পর্ণার অনুভব মেয়েটি অল্পবয়সেই জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। তাই একটু অসংলগ্ন আচরণ ওর, কিন্তু খুব মন দিয়ে কাজ করে মেয়েটি। কোন কিছুর প্রতি লোভ নেই এরকম ভালো কাজের মেয়ে পর্ণা অনেকদিন বাদে পেয়েছে। রেনুর ব্যবহারে পর্ণা ওর প্রতি একটা টান অনুভব করে।
-“দিদি ওরা মানুষ একদম ভালো না গো।” পর্নার চিন্তায় ছেদ পড়ে।
-“কাদের কথা বলছিস তুই? ওই যে আমার সাথে থাকা বুড়াবুড়ি।”
-”বুড়াবুড়ি আবার কে? তোর বাবা-মার কথা বলছিস?”
-“না, না, ওরা আমার নিজের না। নিজের হলে এমন করতে পারত? সেই যে সেদিন বোবা লোকটা সাথে আমার বিয়ে দিল, আমি তো চলে গিয়েছিলাম বরের বাড়ি। তারপর ওরা কি করল জান? এই বুড়া বুড়ির সাথে মিলে সবাই আমার ছোট বোনটাকে আবার ওই বরের সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে পাগলী বলল, আর ওদের কাছে নিয়ে আসল। আমি কি পাগলী, দিদি?”
-“না, না, তুই পাগলী হবি কেন? তুই একদম ঠিক আছিস। এখন আর কথা না বলে তাড়াতাড়ি কাজ করে বাড়ি চলে যা।”
পর্ণা রেনুর এসব কথা অনেকবার শুনেছে। কথাগুলো ও অসম্পূর্ণ বলে। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছে যে প্রথম বিয়ে টেঁকেনি, ওর সাথে কোন অন্যায় করা হয়েছে। তারপর আবার ওর বাবা-মা টাকার বিনিময়ে কোন মাতালের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়। ওই মাতাল ওকে ভীষণ অত্যাচার করে। সব সময় ওর সাথে থাকে না, মাঝে মাঝে আসে আর ওর উপর অমানুষিক অত্যাচার করে। দুটো বাচ্চা আছে ওর তাদের প্রতিও কোন দায়িত্ব নেই ওর মাতাল বরের। সত্যি আমাদের দেশে অধিকাংশ মেয়েরাই বড় অসহায় আর এই অসহায় তার কারণ শুধু পুরুষ সমাজ নয় এক শ্রেণীর নারী ও মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার সামিল। দীর্ঘদিন ধরে এই সমাজ যেন এভাবে করে উঠেছে মনটা মাঝে মাঝে খুব খারাপ হয়ে যায় পর্ণার। নারীদের ওপর এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিফলন সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
চলবে …