মা, আমি এবং স্মার্টফোন
কলমে – রাজনন্দিনী
ছবি – জয়দেব ভট্টাচার্য
রাতের খাবার সেরে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছি, আসলে অপেক্ষা রাত বারোটা বাজার। এফবি, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাতে ঘোরাঘুরি করতে করতে ঘড়ির কাঁটা যখন রাত বারোটার জানান দিল, রঙিন কাগজের মোড়কে মোড়া ছোট্ট গিফ্ট বক্সটা হাতে নিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে আমি হাজির। মা ততক্ষণে তন্দ্রাচ্ছন্ন। আলতো হাতে মায়ের ঘুমন্ত শরীর স্পর্শ করে, কপালে একটা চুমু খেয়ে, কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, “মা, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।” ঘুম ঘুম চোখেই মা আমায় বুকের কাছে জাপটে নিয়ে বলল, “পাগল মেয়ে আমার, তুই এখনও জেগে আছিস!” মায়ের হাতে গিফ্ট বক্সটা দিয়ে বললাম, “এটা তোমার বার্থডে গিফ্ট মা।”
-“কি আছে রে এতে?”
-“খুলেই দেখো না।”
গিফ্ট বক্সটা খুলতেই মা অবাক!
-“এ কি রে! এটা তো একটা স্মার্টফোন। আমি তো স্মার্টফোনের কিছুই বুঝিনা। কেন শুধু শুধু কিনতে গেলি বনি?” মা কপট রাগ দেখাল।
-“ও হো! মা, আমি তোমায় সব শিখিয়ে দেব, তুমি অত ভেব না তো।”
আমার আশ্বাস বাণী শুনে, মায়ের মুখে হাসি ফুটল।
-“আচ্ছা ঠিক আছে, যা এবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হল।”
সকাল সকাল মায়ের নাম করে মন্দিরে পুজো দিয়ে, আইনক্সে সিনেমা, মায়ের পছন্দের লাঞ্চ সেরে সন্ধ্যে নাগাদ বাড়িতে ফিরলাম মা ও আমি। সারাটা দিন খুব আনন্দ করলাম আজ মায়ের সাথে।
টাচ্ ফোনে খানিকটা ইউজ্ড্ টু হয়েছে এই ক’দিনে আমার মা। কিছু দিন হল, একটা এফবি অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছি মাকে। এখন মায়ের অবসর সময়ে মা ফোন হাতে নিয়ে বসে পড়ে। কখনও এর ওর পোস্টে লাইক দেয়, কখনও কোনো ভালো রেসিপি রাঁধলে বা ছাদের টবে বাহারী ফুল ফুটলে ফটো তুলে আপলোড করে। সেদিন অফিসে বসে খুব মনোযোগ সহকারে একটা ফাইল স্টাডি করছি, হঠাৎ মায়ের ফোন।
-“বনি, একটু বলবি মা, ফেসবুকে ছবির চারপাশে নানা রকম নক্সা এঁকে ছবি কিভাবে দেয় রে সবাই?”
একটু পরেই একটা মিটিং আছে। আর ঠিক এমন সময় মায়ের এমন আব্দারে বেশ রাগ হলো! রাগটা কন্ট্রোল করে বললাম, “মা আমি অফিস থেকে ফিরে তোমায় শিখিয়ে দেব।” মা বাধ্য ছাত্রীর মতো আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে ফোন কেটে দিল।
গত পরশু ফ্রেন্ডদের সাথে সিনেমায় গিয়েছি, মায়ের ফোন, “হ্যালো বনি, তোর মিতু কাকীমার সাথে তুই যে ফটোটা তুলে দিলি না সেদিন, সেই ফটোটা দু’জনেই আপলোড করেছি। মিতু আর আমার দু’জনের ছবিতেই ৩৪টা লাইক এসেছে। তুই একটা দিয়ে দে না মা। তবে আমার ৩৫টা লাইক হয়ে যাবে।”
-“উফ্ফ্ফ্, মা! তুমিও না পারো, সত্যি! আচ্ছা করে দেব।”
ডিনার সেরে গল্পের একটা বই নিয়ে শুয়েছি, মা ফোন হাতে ঘরে ঢুকে এসে আমার পাশে বসে। একটা শপিং সাইট দেখিয়ে বলে, “বনি দেখ, কত সুন্দর সুন্দর টপসগুলো! ভাবছি তোর জন্য দু-একটা কিনব। কিন্তু কিভাবে কিনব কিছুতেই বুঝতে পারছি না! একটু দেখিয়ে দিবি রে?” রাত দুপুরে এমন জ্বালাতন আর ভাল্লাগছে না! প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে একরকম জোরেই বলে উঠলাম, “মা, এসব কি ছেলেমানুষি হচ্ছে বলো তো! সকাল নেই, বিকেল নেই, যখন তখন তোমার এটা জিজ্ঞেস করা, ওটা জিজ্ঞেস করা! জাস্ট আর ভালো লাগছে না!” আমার এমন ব্যবহারের জন্য মা ঠিক প্রস্তুত ছিল না। খানিকক্ষণ আমার পাশেই চুপ করে বসে থেকে, হঠাৎ উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। গল্পের বইয়ে আর মন বসল না আমারও। লাইট অফ্ করে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছি, এমন সময় শুনতে পেলাম, মা পাশের বাড়ির ক্লাস ইলেভেনের বুবলাইকে খুব আস্তে আস্তে বলছে, “ফেসবুক কি করে ডিলিট করতে হয়, একটু করে দিস তো বাবা আমাকে।” কথাটা শুনে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ করে মনের মধ্যে একটা কষ্ট খোঁচা দিয়ে উঠলো যেন। মনে পড়ে গেল, সেই ছোট্টবেলায় হাত ধরে হাঁটতে শেখানো থেকে শুরু করে জুতোর ফিতে বাঁধতে শেখানো, আরও কত কিছু! এমনকি এখনও কোনো দিন কোনো রান্না করতে গিয়ে না পারলে, মা আমাকে কত যত্ন করে, পরম আদর দিয়ে, একটুও বিরক্তি প্রকাশ না করে, বারবার শিখিয়ে দিয়েছে কোন রান্নায় কতটা মশলা, নুন, ফোড়ন দিতে হবে। অথচ, সামান্য কয়েক দিনের জন্য কিছু জিনিস মাকে শেখাতে গিয়ে আমরা বিরক্ত বোধ করি, অসহ্য বোধ হয় আমাদের, ছেলেমানুষি মনে হয় মায়েদের জিজ্ঞাসাগুলো! নিজের অজান্তেই চোখের কোণ আমার কখন ভিজে উঠেছে টেরই পাইনি। দৌড়ে গিয়ে মাকে জাপটে ধরে নিজের ভুলের ক্ষমা চাইতে চাইতে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ফেলি। আমার কান্না দেখে মাও কাঁদছে।
-“তুমি এফবি বন্ধ করবে না মা, আমি খুব সরি, খুব বাজে বিহেভ করেছি গতরাতে তোমার সাথে। আমাকে বকো মা, খুব বকা দাও ছোট্টবেলার মতো।… আমি প্রমিস করছি, তোমাকে আমি সব শিখিয়ে দেব, যা যা তুমি শিখতে চাইবে। কিন্তু আমার ওপর রাগ করে এফবি বন্ধ করে দিও না।… হয়তো তোমাকে বলা হয়ে ওঠে না, কিন্তু তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি মা। আমায় ক্ষমা করে দাও, আমার অন্যায়ের জন্য।”
আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলল, “এমন করে কাঁদে না মা। চোখের জল মোছ, এই দ্যাখ আমিও আর কাঁদছি না।” বলে নিজেই আমার ভেজা চোখ দুটো মুছিয়ে দিল।
-“অফিস থেকে ফিরে এসে আজ তোমাকে এফবির অনেক কিছু শিখিয়ে দেবো মা।” বলে মাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।