সে তবে কে ? [তৃতীয় পর্ব]

সে তবে কে ? [তৃতীয় পর্ব] লেখা – শান্তনু দাস

আগে যা হয়েছে…

ইন্সপেক্টর সমাদ্দারের কাছে আসা এক ফোনের সূত্র ধরে ইন্দ্রদা আর আমি হাজির হলাম স্কটিশচার্চ কলেজের হোস্টেলে। কিন্তু প্রায় আমাদের সামনে খুন হয়ে গেল কলেজ ছাত্র অলীক।‌ পরদিন নাইটগার্ড, হোস্টেলের রাঁধুনি আর প্রধান সন্দেহভাজন হীরা কে জেরা করেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। অলীকের ওয়াকম্যানটা নিয়ে আসা হল, দেখা যাক তা থেকে কিছু বেরোয় কি না! .…

( ৩ )
সত্যি কোনটা ?

-“এত মন দিয়ে কি ওয়াচ করছিলে ইন্দ্রদা?”
-“আয় বোস, সৌম্য। ফিঙ্গার প্রিন্টের ওপর লেখা ব্রিটিশ লেখকের একটা বই দেখছিলাম।”
এটা পরের দিন সকালের ঘটনা, ইন্দ্রদা তখন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ঐ বইটা পড়ছিল। টেবিলের উপর একটা ক্যাসেট রাখা ছিল। ইন্দ্রদা আমাকে ডেকে সোফায় বসতে বলল। ওয়াকম্যানে ক্যাসেটটা ভরতে ভরতে ও বলতে শুরু করল, “এবার মন দিয়ে শোন মৃত অলীক সেনের মৃত্যুর ঠিক আগের কথাগুলো। অলীক প্রথমে গান শুনছিল ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর ঠিক আগে সে বুঝতে পেরেছিল যে খুনি তাকে খুন করতে এসেছে। তাই বুদ্ধিমান অলীক ওয়াকম্যানের রেকর্ডিং সুইচ অন করে দিয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল খুনি একটা কথাও বলেনি যাতে করে তার গলার স্বর চেনা যায়। স্রেফ গুলি করে পালায়। নে এবার নিজের কানেই শোন।”
ইন্দ্রদা ক্যাসেটটা রিওয়াইণ্ড করে প্লে করে দিল। রেকর্ডিং এর শব্দ ভেসে এল… “দেখো তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, ভয় দেখিয়ে আমাকে তোমাদের দলে টেনে নিতে পারবে না। আমি আমার ইউনিয়নকে শ্রদ্ধা করি। সেখানে তোমাদের ঐ জঘন্য কাজকর্ম করা দলে আমি কোনোদিন যাব না। তুমি কি ভাবছো আমাকে খুন করলে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে? পুলিশের হাতে ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। সাহস থাকে তো সামনে এসো।” তারপর কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই। এবার অলীকের গলা শোনা গেল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ… “একি! তু… তুমি… সুমি… আঃ আঃ আঃ আঃ।” ইন্দ্রদা স্টপ করল।
আমি প্রশ্ন করলাম, “সুমি কি তাহলে কারোর নাম? তোমার কি মনে হয়?”
-“হ্যাঁ, তবে অলীক আসলে যে নামটা বলতে চেয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ হয়নি।”
-“মানে?”
-“সুমিলি। সুমিলি বলতে গিয়ে অলীক সুমি বলে আটকে যায়।”
-“সুমিলি?”
-“হ্যাঁ সৌম্য। আমি যখন হোস্টেলে অলীকের ড্রয়ারটা খুলি তখন ওখানে কতকগুলো গ্রিটিংস কার্ড পাই। তার মধ্যে একটাতে সুমিলি লেখা ছিল।”
-“সুমিলি অলীক সেনের কলেজ ফ্রেন্ড হতে পারে।”
-“একবার অলীকদের বাড়ি তমলুক যাব ভাবছি। ইন্সপেক্টর সমাদ্দার কি বলেন দেখি। আচ্ছা রেকর্ডিং শুনে তোর কি কমেন্ট সৌম্য?”
-“একটা জিনিস তো জলের মত পরিষ্কার, ইন্দ্রদা। অলীকের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে যখন অলীক খুনিকে প্রথম দেখল তখন অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করেছিল। আবার কিছুক্ষণ পর যেহেতু ‘একি সুমি!’ বলল তাই বলা যেতে পারে, পর মুহূর্তে সে দেখতে পেয়েছিল আনএক্সপেক্টেড কাউকে। মানে বলতে চাইছি অলীক সেন প্রথমে খুনিকে চিনতে ভুল করেছিল। কাছে আসতেই সে বুঝতে পেরেছিল এ লোক অন্য।”
-“গুড। আর একটা কথা শবরের কথা শুনে কিছু বুঝলি?”
-“সবটা বিশ্বাস হল না।”
-“আমারও সিক্সথ সেন্স তাই বলছে, ও পুরোটা বলছে না।”
-“হুম, তাই মনে হয়, নাহলে অলীক সেন গুলি লাগার আগে এতগুলো কথা বলল অথচ পাশের ঘরে শুয়ে থাকা শবর কিছুই শুনতে পেল না।”
-“রাইট সমু।”
-“আচ্ছা, সুমি মানে কি সুমিলিই হতে হবে ইন্দ্রদা?”
-“তার আগে জানতে হবে সুমিলি মেয়েটা কে? তবে সুমি মানে আর একজনও হতে পারে… কিন্তু…”
ইন্দ্রদাকে থামতে হল কারন ওর মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে।
-“হ্যালো…”
-“হ্যালো ইন্দ্রবাবু। নতুন খবর দেবার আছে। আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসুন, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার ছেলে এই খুনের ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দেবে।”
-“আপনার ছেলে?”
-“হ্যাঁ, ও তো একই ডিপার্টমেন্টে অলীকের সাথে স্কটিশচার্চে পড়ত।”
-“আগে বলেন নি তো কালীচরণবাবু। বাই দা বাই, বিকেলে গেলে হয় না?”
-“না, ইন্দ্রজিৎবাবু আপনারা এখনই আসুন। এখানেই লাঞ্চ করবেন। বিকেলে একজনের বাড়ি যাবার প্ল্যান আছে।”
-“আবার খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা কেন? আমরা…”
-“ঝামেলার প্রশ্নই নেই। বরং আপনারা না এলেই আমার ওয়াইফ অসন্তুষ্ট হবে। আমার স্ত্রী সুচিত্রা আপনার আর সৌমাভর চরম ভক্ত। বীরভূমের ব্লু ডায়মন্ড কেসটা শোনার পর আপনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক আশা করে আছে।”
-“অল রাইট সমাদ্দার বাবু। আমরা রেডি হয়ে নিচ্ছি। উই মাস্ট কাম।”

সাড়ে ছটা নাগাদ কালীচরণ সমাদ্দারের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলাম। সুন্দর সুবিশাল ঘর। সুন্দর কারুকার্যের আরাম কেদারা আর দামি আসবাব। মেঝেতে মখমল কার্পেট বিছানো। জানলা থেকে ভেসে আসছে রজনীগন্ধার সৌরভ। ওনার স্ত্রী সুচিত্রাদেবীর সঙ্গে পরিচয়ে বুঝলাম ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সাদাসিধে, সরল, মিশুকে। ওনার চোখদুটো ভীষণ প্রাণবন্ত, হাসলে গালে টোল পড়ে, চিবুকের নিচে পড়ে ভাঁজ।
কালীচরণবাবু বাইরে বাজারে বেরিয়েছিলেন। ওনার ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। বাইরে থেকে এল বলে পরনে ছিল হলুদ রঙের একটা শার্ট, ডেনিম জিন্স, চোখে ফাস্ট্র্যাকের সানগ্লাস। সুন্দর করে ঘন চুলগুলো ছোট কপালের উপর সাজানো। মুখের মধ্যে উদাসীন ভাবটা দুচোখের আগ্রাসনে চাপা পড়ে গেছে। জিম করা পেটাই চেহারা।
-“আপনারা কতক্ষণ এলেন? আমি একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম বাবার সাথে, বাবার আসতে একটু দেরি হবে বলে আমাকে তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দিল। ডোন্ট মাইন্ড।”
-“ইটস ওকে, আপনার মায়ের রাজকীয় আপ্যায়নের পর মাইন্ড করার কোনো জায়গাই নেই। আপনিই তাহলে অলীকের ক্লাসমেট?”
-“হ্যাঁ, আমি রজক সমাদ্দার। আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন ইন্দ্রজিৎ বাবু।”
-“থ্যাঙ্ক ইউ।” ইন্দ্রদা টেবিলের উপর রাখা একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে বলতে শুরু করল, “আচ্ছা রজক, অলীকের ব্যাপারে তুমি কিছু বলবে শুনলাম।”
শান্ত পরিষ্কার দৃঢ় কণ্ঠে রজক বলতে লাগল, “অলীক আর আমি একই ব্যাচের। ও আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল। অলীকও আমায় খুব ভালোবাসত। খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল অলীক। কোনোরকম অন্যায় যেমন করত না সেরকম কোনোরকম অন্যায়কে প্রশ্রয় দিত না।”
-“সুমিলি বলে কাউকে চেনো তুমি, রজক?”
-“হ্যাঁ, সুমিলিও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের, তবে সেকেন্ড ইয়ার। আমরা চারজন, আমি, অলীক, সুমিলি, সুমিত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলাম। কলেজ থেকে আমাদের বাড়ি একই দিকে মানে ডানলপের দিকে হওয়ায় আমরা একসঙ্গে ফিরতাম। অলীক অবশ্য কলেজ হোস্টেল পেয়েছিল, ওখানেই থাকত। ওর বাড়ি তমলুকে।”
-“আচ্ছা রজক, সুমিলির সঙ্গে কোনোদিন অলীকের ঝগড়া হয়েছিল?”
-“সে যেমন বন্ধুদের মধ্যে হয়, আপনি কি সুমিলিকে সন্দেহ করছেন?”
-“না, সেটা নয়। নাউ ডোন্ট মাইন্ড, আই উইল ডিসকাস অল ওপেনলি, সুমিলি আর অলীক কি শুধুই বন্ধু ছিল? আই মিন টু সে, এনি উইকনেস?”
-“নো, নো, নাথিং ইন্দ্রজিৎ বাবু, দে ওয়্যার ওনলি ফ্রেন্ডস, নট মোর দ্যান দ্যাট। তবে সুমিত আর সুমিলির মধ্যে… ”
-“এনি লাভ অ্যাফেয়ার? বলে ফেল, মাইন্ড ইট, ইটস আ কেস অফ মার্ডার।”
-“বলতে পারব না। ওদের দুজনের মধ্যে কোনো কিছু চললেও সেটা আমি আর অলীক কোনোদিন জানতে পারিনি।”
-“সুমিতের ফোন নম্বরটা আমাকে একটু দাও। আর কোনো ছবি থাকলে আমাকে একটু দেখাও”
রজক ওর মোবাইল থেকে সুমিতের নম্বরটা ইন্দ্রদাকে দিল। মোবাইলে ওদের চার বন্ধুর একটা গ্রুপ ফটো আমাদের দেখালো। ইন্দ্রদার ভ্রু কুঁচকে গেছে সুমিতের ছবি দেখে।
দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম, “চেনা চেনা লাগছে।” কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না।
-“আচ্ছা, এতক্ষন তো আমিই তোমাকে প্রশ্ন করতে থাকলাম, খুনের ব্যাপারে তুমি কিছু বলবে বলছিলে?”
-“হ্যাঁ, সেই জন্যই তো বাবা আপনাদের ডেকেছে।”
-“কাউকে সন্দেহ হয় তোমার?”
-“সেটাই আপনাদের বলব ইন্দ্রজিৎবাবু। অলীকের প্রধান বন্ধু বলতে আমরা তিনজনই ছিলাম। আমি, সুমিত আর সুমিলি। সুমিত একটু স্বার্থপর টাইপের, সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত আমার। খুন সুমিত করতেই পারে না কারন ঐদিন রাতে সুমিত মামার বাড়ি বর্ধমান চলে যায়। আমাকে সন্দেহ করা না করাটা আপনাদের ব্যাপার। সুমিলি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, এক ক্লাস জুনিয়ার আমাদের থেকে, সকলের প্রতি ওর যেমন সিমপ্যাথি আছে তেমনি সকলের ওর প্রতি। সুমিলি অলীককে খুন করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। খুন যদি কেউ করতে পারে, সে একজনই, সে হল হীরা।”
-“হীরা? মানে হিরণ্ময় রায়?” আমি বললাম।
-“হ্যাঁ, হিরণ্ময় রায়। একই কলেজে পড়ে। আমাদের থেকে দু বছরের সিনিয়ার। ফেল করতে করতে আমাদের ব্যাচে। প্রোফেসররা পর্যন্ত হীরাকে ভয় করে। জুনিয়ার টু সিনিয়ার কলেজের সবাই হীরাকে চেনে। একবার কি একটা যেন হয়েছিল যাতে কলেজ থেকে হীরাকে প্রায় টি.সি. দিয়ে দিত প্রিন্সিপ্যাল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি। হীরার ঐ অবস্থার জন্য দায়ী ছিল অলীক, ঐ প্রিন্সিপ্যালের কাছে কমপ্লেন করে। যাইহোক ঐ হিরণ্ময় রায় আর কয়েকজন ছেলে অলীককে শাসাচ্ছিল। অলীক তাতে একটুও দমে যায়নি। কিছুদিন আগে থেকে ওরা অলীককে হুমকি দিতে থাকে এই বলে যে ওদের দলে যোগ দিতে হবে। কিন্তু অলীক ঐ নোংরা দলে ঢুকে নোংরা কাজকর্ম করার দিকে এতটুকু উৎসাহ দেখায় নি।”
-“কিন্তু তুমি এতসব জানলে কি করে?”
-“আমরা যখন কলেজ ছুটির পর একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম তখন প্রায়দিনই হীরা দলবল নিয়ে অলীককে শাসাতো। অলীক পড়াশুনোতে ভাল ছিল, চেহারাতেও বেশ হিরোইজম ছিল। তাই ওরা অলীককে ওদের দলে টেনে নিতে চাইছিল। ঘটনাটা ইদানিং দশ বারোদিন থেকে চলছিল।”
-“তোমরা কমপ্লেন করোনি?”
-“বাধা দিতে গেলেও কি ওরা শুনবে? আর অলীকও ছিল একরোখা। হীরার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বেশ আনন্দই পেত। অলীক যেদিন রাতে খুন হল সেদিন অর্থাৎ পরশু বিকেলের ঘটনা… আমি, সুমিলি, অলীক হেদুয়া পার্কে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সুমিত সেদিন ছিল না। দেখি একটা রিক্সা করে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরের বিবাহিত ভদ্রমহিলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।”
অলীক বলে উঠল, “একি বৌদি, তুমি এখানে?”
-“হ্যাঁ রে, অনেকদিন বাবার এখানে আসা হয়নি তাই এসেছি।”
-“দাদা এসেছে নাকি? আমাকে একবারও জানালে না বৌদি…”
-“না, আমি একাই এলাম, হঠাৎ করেই। এখনই তমলুক ফিরব। তোদের তো আজই ছুটি পড়ল। একসঙ্গে চল যাই, আমি ওয়েট করছি।”
-“না বৌদি, আমাকে হোস্টেলে ফিরে কতকগুলো নোটস লিখতে হবে, মাকে বোলো কাল সকালে আমি যাচ্ছি।”
-“কিন্তু কলেজে ছুটি পড়ে গেলে তো তোদের হোস্টেলে কেউ থাকে না।”
-“তাতে কি! হোস্টেলে রাতে রাঁধুনি থাকে।”
-“তারপর শুনুন ইন্দ্রজিৎ বাবু, অলীক তখন আমার আর সুমিলির সঙ্গে বৌদির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এমন সময় হীরা ও তার চারজন বন্ধু এসে অলীককে হুমকি দিতে লাগল যে ওদের দলে না এলে ওরা অলীককে শেষ করে দেবে। বৌদি তখন পাশেই ছিল। হীরাকে আমি ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমার কথা তো শুনলই না উল্টে বৌদিকে যা নয় তাই বলে অপমান করতে লাগল। অলীক আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, বৌদিকে ও মায়ের মতই ভালোবাসত। হীরার সঙ্গে মারপিট শুরু করে দিল। আমি, সুমিলি, পাশাপাশি দোকানের কয়েকজন মিলে ওদের কোনোমতে আলাদা করলাম। হীরার নাক দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ও অলীককে শাসিয়ে গেল যে সেদিন রাতেই ওকে দেখে নেবে। ঠিক হলও তাই। সেই রাতেই অলীক খুন হল।” রজক মাথা নিচু করল।
ইন্দ্রদা টেবিলের ওপর হাতে ধরা ম্যাগাজিনটা ফেলে বলল, “তারপর?”
-“তারপর আর কি? বৌদি অত করে বলল যে রাতে আর হোস্টেলে থেকে কাজ নেই। বৌদির সঙ্গে অলীক ঘর চলুক। কিন্তু অলীক গেল না। আমি আর সুমিলি কত বোঝালাম। আসলে একরোখা অলীকের মৃত্যুটা ভাগ্যে লেখা ছিল ইন্দ্রজিৎবাবু। আমার তরফ থেকে যতটুকু জানানোর আমি বললাম ইন্দ্রজিৎ বাবু। আমরা সবাই চাই অলীকের খুনি তাড়াতাড়ি ধরা পড়ুক।”
-“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ রজক, তোমার ইনফরমেশন আমার ভাবনার নতুন দিক খুলে দিয়েছে।”
আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে সুচিত্রাদেবী দুবার ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ দিয়ে গেছেন। দুপুরে বিশাল একটা ভুরিভোজের পর হালকা ঘুম দরকার ছিল। সেটা অবশ্য দমিয়ে রাখতে হয়েছিল বাড়িতে ছিলাম না বলে। বিকেলে কালীচরণবাবুর প্ল্যানই ছিল সুমিলির বাড়ি যাওয়া। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল রজক। রজক অবশ্য আমাদের সাথে আসে নি।
ইনস্পেক্টর সমাদ্দার কলিংবেল টিপতেই এক সুবেশী অল্পবয়স্কা তরুণী দরজা খুলে দিল আর সেই যে সুমিলি বুঝতে অসুবিধে হল না। কোমর অব্দি এক ঢাল চুল, আঙ্গুলের স্পর্শে বেরিয়ে আসা চুলে ঢাকা কান, পাকা গমের মত গায়ের রং, নাক আর ঠোট যেন কেউ যত্ন করে এঁকে দিয়েছে, পরনে কুসুম কালারের সালোয়ার, হাতে ব্রেসলেট।
আমরা ঘরে ঢুকলাম। আমি আর ইনস্পেক্টর একটা সোফায় আর ইন্দ্রদা অন্য একটা সোফায় উপবেশন করল, সামনে চেয়ারে বসল সুমিলি। কালীচরণবাবুই প্রথম শুরু করলেন,“ তোমার বাবা মা…”
-“ওনারা আমার মামার বাড়ি গেছেন।”
-“তুমি তাহলে একাই আছ?”
-“হ্যাঁ।”
-“কদিন থেকে?”
-“পাঁচদিন হল। কিন্তু আপনারা এসব প্রশ্ন আমাকে…”
-“আমরা অলীক সেনের খুনের তদন্ত করছি। আমার পাশে ইনি প্রখ্যাত ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর সৌমাভ, ওনার সহকর্মী।”
-“আপনার পুরো নাম?” ইন্দ্রদা প্রশ্ন করল।
-“সুমিলি দত্ত।”
-“অলীকের মৃত্যুর খবরটা আপনি কখন শুনলেন মিস সুমিলি?”
-“কাল সকালের নিউজপেপারে। দেখেই আমি চমকে যাই। যা ভেবেছিলাম তাই হল। রাতে এত করে বারণ করা সত্ত্বেও অলীক একাই থেকে গেল হোস্টেলে।”
-“আমরা রজকের কাছে শুনেছি সব।”
ইন্দ্রদা কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সারা ঘরটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। জানলার পর্দাগুলো এসির হাওয়াতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পর্দার ফাঁকে পড়ন্ত বিকেলের লালিমা। কালীচরণবাবু দেখলাম কিছু একটা ভাবতে ভাবতে আঙ্গুল মটকাচ্ছে।
এবার ইনস্পেক্টর প্রশ্ন করলেন, “অলীক যে রাতে খুন হয়, সেইসময় তুমি কোথায় ছিলে?”
-“কেন? আমার ঘরে।”
-“তুমি তখন জেগেছিলে, তাই না?”
-“হোয়াট? কি বলছেন আপনি ইনস্পেক্টর?”
-“খুনের ঠিক আগে থানায় একটা ফোন এসেছিল, আর সেই ফোনটা করেছিল একটা মেয়ে।”
-“হোয়াট ডু ইউ মিন?” এসির হাওয়ার মধ্যে থেকেও সুমিলির কপালে টিপটিপ ঘাম জমে গেছে।
-“আর সেই মহিলার গলা যে তোমার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
-“আর ইউ ম্যাড? আপনারা কি ভাবছেন আমিই অলীককে খুন করেছি?”
-“তা তো উনি বলেননি, মিস সুমিলি। এমনও তো হতে পারে খুনটা আপনি করেননি, কিন্তু করিয়েছেন।” ইন্দ্রদা মুখ খুলল।
-“হোয়াট ননসেন্স! আমি?”
-“মে বি সুমিলি… ইটস নট ইম্পসিবল।”
-“হাউ ইজ্ ইট পসিবল? আমি কেন? আপনারা আমাকে কিসের ভিত্তিতেই বা সন্দেহ করছেন?”
-“আপনার ফেবারিট টপিক ফ্লুয়িড মেকানিক্স তাই না?”
সুমিলি অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।
-“অলীকের বিছানা থেকে একটা ফ্লুয়িড মেকানিক্সের বই পাওয়া গেছে, সেকেন্ড ইয়ারের। অলীকের তো থার্ড ইয়ার তাই না মিস সুমিলি?”
-“হ্যাঁ বইটা আমার। অলীক নিয়েছিল আমার কাছে। আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দের।”
-“অলীককে কে খুন করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
-“আমি জানি না, আমি কিছু জানি না। আমি খুন করিনি ইন্দ্রজিৎবাবু। আই লাভড্ হিম, রিয়েলি লাভড্ হিম। ও জানত না আমি ওকে কতটা…”
সুমিলি কেঁদে ফেলল। ওর কানের লতি, নাকের দুপাশ, লাল হয়ে গেছে।
-“রিল্যাক্স, জাস্ট রিল্যাক্স, মিস সুমিলি। আমরা আর আপনাকে বিরক্ত করব না। তবে আপনি আমাদের কাছে কিছু লুকোচ্ছেন। সব খুলে বললে হয়তো ভাল করতেন।”
সুমিলি দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বলল, “আমি কিছু জানি না, কিছু না।” চোখ দিয়ে ওর টপটপ করে জল পড়ছে।
-“মিস সুমিলি, আপনার ব্রেসলেটে এস সি লেখাটার অর্থটা ঠিক বুঝলাম না। এস ডি হলেও সুমিলি দত্ত ধরে নেওয়া যেত। চলুন, ইনস্পেক্টর সমাদ্দার, তবে আপনি ডিসাইড করুন আমাদের সব খুলে বলবেন কিনা মিস সুমিলি?”

চলবে…

Author: admin_plipi