নাবিক হব আমি ।। লেখা ও ছবি : নিকোলাস
রমেনের ডাক্তার হবার খুব শখ। কেন কে জানে। ও যখন একদম ছোট্ট ছিল, ওর মা ওকে গ্রামের সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। তখন ওর ইচ্ছে করত একদিন ফুটবলার হবে। সারাদিন ফুটবল খেলবে, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু যেদিন ওর বাবা ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, হাসপাতালের পাশে ওদের চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দিল, সেদিন থেকে ওর ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে। রমেনের বাবা চা বানায় আর ও সবাইকে ট্রেতে করে দিয়ে আসে। মাঝে মাঝে হাসপাতালের ডাক্তার বাবুকে গিয়ে চা দিয়ে আসে। রমেন চা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ডাক্তার বাবু কি মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখেন। ওনার ষাটের কাছাকাছি বয়স কিন্তু কি ভীষণ ধৈর্য্য। আর রোগীরা যেন সাক্ষাৎ ভগবান দেখছে, এমন ভাবে চারিদিকে বসে থাকে। রমেন ভাবে ডাক্তার বাবুকে ডেকে বলবে, তাঁকে ডাক্তার হওয়া শিখিয়ে দিতে। কিন্তু বলে উঠতে পারে না। উনি যে কখনো চোখ তুলে রমেনের দিকে তাকিয়ে দেখেনই না। রমেন তাড়াতাড়ি করে ওর বাবার কাছে ফিরে যায়, পরে আবার কখনো বলা যাবেখন।
একদিন হাসপাতালে হৈ- হট্টগোল শুনে ছুট্টে ভেতরে গেল রমেন। প্রায় পঞ্চাশজন লোক ডাক্তার বাবুকে ঘিরে ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। রমেন অবাক হয়ে দেখতে লাগল, এই সেই একই ডাক্তার, যাকে মানুষ ভগবানের মত শ্রদ্ধা করত, আজ তাঁর সাথেই কি অসভ্য ব্যবহার। নাহ, ও আর ডাক্তার হবে না। ইতিমধ্যে কিছু লোক ডাক্তার বাবুকে মারতে উদ্যত হল। কি যে হল রমেনের, ওইটুকু একটা পুঁচকে ছেলে, দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার বাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “কেউ মারবে না ডাক্তার বাবুকে, কেউ না!”
এর পর একদিন রমেন আর রমেনের বাবা সবে দোকানটা খুলেছে, দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, বুড়ো ডাক্তার। রমেনকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি বাবা?” রমেন একটু লাজুক মুখে নিজের নাম বলল।
-“তুমি পড়াশোনা করো না?” ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
-“না তো।”
-“তাহলে তুমি আমার সাথে কলকাতা চলো। ওখানে একটা ভালো স্কুলে পড়বে। আমার বাড়িতে থাকবে। কি হতে ইচ্ছে করে তোমার?” এক নিঃশ্বাসে বললেন ডাক্তারবাবু।
কি বলবে রমেন? ওর এখন আর ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করে না। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছেটাও চলে গেছে। মানুষ মানুষকে ভগবান বানায় আবার প্রয়োজনে শয়তান। রমেন এইসব প্যাঁচে থাকতে চায় না। ও ঘুরে বেড়াবে সারা দুনিয়া। একা একা। কত সুন্দর সুন্দর দেশ আছে, শহর আছে। সবুজ পাহাড় আছে আর তার মাঝখানে আছে একটা নীল ঝরনা। একটা সমুদ্রের যেই দিকে দু চোখ যায় আছে শুধু সবুজ জল আর জল, তার মাঝখানে ছোট্ট একটা ডিঙ্গীতে ভেসে বেড়াবে রমেন।
রমেন যেন হঠাৎ কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলল। মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “ডাক্তার কাকু, আমি নাবিক হব।”
ডাক্তার বাবু প্রাণ খোলা একটা বিশাল হাসি দিলেন। বললেন, “বেশ বাবা, তুমি নাবিকই হবে। তবে স্কুলে যাওয়া চাই কিন্তু। এই নাও এগুলো তোমার জন্য।” ডাক্তারবাবু রমেনের হাতে দিলেন অনেকগুলো চকোলেট, আর একটা বই। রমেনের বাবাকে নমস্কার করে ডাক্তারবাবু দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে বসলেন। গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল শহরের দিকে।
রমেন চকোলেট গুলো রেখে বইটাকে দেখতে লাগল। ওপরে বড় বড় হরফে লেখা ‘সিন্দাবাদের সমুদ্র যাত্রা’। এই তো কি সুন্দর সমুদ্রের ছবি, একটা বিশাল জাহাজ। রমেনের চোখটা আনন্দে চিক চিক করে উঠল। ও বইটাকে বুকে চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলল, “আমি ঠিক নাবিক হব, নাবিক হবই একদিন।”