বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ১২)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
আজ অখিল এসেছিল। পর্ণা ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল কিছু বই দেবে বলে। যাক মনটা ভালো লাগছে ওর কাছে শুনে যে ওর দাদা বাড়ি ফিরে এসেছে। অখিলের মা শয্যাশায়ী, দাদার জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল। আট বছর ধরে নিখোঁজ ছিল দাদা, অভাবের সংসার ছেড়ে একদিন বন্ধুর সাথে বাড়িতে না জানিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। হরিয়ানার কোন হোটেলে কাজ পেয়েছিল, বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। লকডাউন শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছে হারানো ছেলেকে। কাজ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা পথে রওনা হয়েছিল। পথে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত ঘরের ঠিকানা পায় সে। যে লকডাউন অসংখ্য মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে, সেই লকডাউন আবার অসুস্থ মায়ের কাছে ছেলেকে ফিরিয়ে দিল।
পর্ণা অখিলকে বই খাতা কলম আর কিছু টাকা হাতে দেয়। ছেলেটি লাজুক তাই টাকা নিতে লজ্জা পায়।
-“না না ম্যাম, বাবার দোকান এখন ভালোই চলছে এখন আর অসুবিধা নেই।”
-“তা হোক, রেখে দে তোর কাছে, কাজে লাগবে। আর যেটা বলছিলাম… পড়াশোনায় ঢিল দিস না একদম, এবছর ফাঁকি দিলে জীবনে উন্নতির রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি সব মিলিয়ে মন অস্থির হচ্ছে, কিন্তু তবুও মাথা ঠাণ্ডা রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে অবশ্যই আমাকে ফোন করবি।”
অখিল সম্মতি জানিয়ে চলে যায়।
আজ অখিলের মতো অসংখ্য ছেলেমেয়ের মনের অবস্থা একই। একেক জনের পরিবারের একেক সমস্যা আর দেশের এই পরিস্থিতি। হতাশা ক্রমশ গ্ৰাস করছে এই ছেলেমেয়েগুলোকে। এদের পাশে টিচার অভিভাবক সবাইকে দাঁড়াতে হবে। সময় কখনো একই থাকে না, পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে, কিন্তু এই হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান সময় আর ফিরে পাবে না এই ছেলেমেয়েরা। তবুও স্বস্তির খবর যে সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে কমেছে, সরকার ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে। ভাবতেই ভালো লাগছে যে আবার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হবে। তবে দীর্ঘ কাল ঘর বন্দি অবস্থায় মানুষ অনেক শিক্ষা পেয়েছে প্রকৃতি মায়ের কাছ থেকে। এরপর মানুষের জীবনযাত্রা অনেক পাল্টে যাবে, মানুষ নিশ্চয়ই অনেক বেশি সজাগ ও সচেতন হবে আগের থেকে। এ যেন বসুন্ধরার নবজাগরণ।
ওদিকে মেহেরের জ্বরটা কমেছে, আকবর সন্ধ্যায় ডাক্তার-খানা থেকে ফিরে আসে। এই দুরবস্থার মধ্যে আর একটা চিন্তা মনে খচখচ করছিল। মেয়েটার রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল আজ। শাবানা তো সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছে। যাক, আল্লাহর কৃপায় মেয়েটার করোনা টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। ঝড়ে বিধ্বস্ত গ্রামে তিন দিন লোডশেডিং ছিল, আজ পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। ঝড় যেন তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে শুধু গ্রামটাকেই নয়, গ্রামের মানুষের মন গুলোকেও। এর মধ্যেও আকবরের মনটা একটু ভালো লাগছে মেহেরের জ্বরটা কমে যাওয়াতে। আজ অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধু রামুর সাথে ফোনে কথা হয়েছে। রামু কাজ পেয়েছে তাই ও খুব খুশি। রামুর খুশিতে আকবরের মনটাও খুশিতে ভরে যায় কবে আবার বন্ধুর সাথে দেখা হবে জানা নেই, তবুও একটু শান্তি লাগছে এই ভেবে যে রামু পায়ের তলায় মাটি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে। অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি আকবর শাবানা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শাবানা বলে, “আম্মার মনটা খুব খারাপ গো, বলছিল ওই ঘরে তার অনেক পুরনো স্মৃতি ছিল। খুব কাঁদছিল আম্মা।” আকবর শাবানার হাতদুটো ধরে বলে, “ঘর দুটো আবার নতুন করে গড়ে তুলব শাবানা, দেখে নিও তুমি। নতুন করে শুরু করব আমরা এখানে আমাদের জীবন। কাল খুশির ঈদ, আমাদের নতুন জীবনে একটু সময় লাগবে। কিন্তু আম্মার মুখে হাসি আমি ফোটাব এই আমার প্রতিজ্ঞা। তুমি দেখে নিও।”
দীর্ঘ লকডাউনের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে মানুষের জীবন। চেনা মুখ চেনা হাসি আবার যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। আজ অমিয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে ঘুরতে। পর্ণাকেও যেতে বলেছিল, কিন্তু ও যায় নি নিজের কিছু কাজ গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। কাল থেকে স্কুল আবার শুরু হবে। অনেকদিন পর দেখা হবে সবার সাথে, মনটা বেশ ভালো লাগছে। পর্ণার ব্যালকনি থেকে দূরের পাহাড়টা আজ আবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতি যেন কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। মনের গুমোট ভাবটা কেটে আজ খুব ফুরফুরে লাগছে। একা থাকার মধ্যে, নিজের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মধ্যে যেন আজকে পর্ণা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে পর্ণা। সুন্দর ভাবনা ঘিরে রেখেছে মনটাকে, নতুন সূর্য নতুন দিন অপেক্ষা করছে কালকের জন্য। পর্ণা ঘরের সব জানালা খুলে দেয়, একরাশ মিষ্টি আলো ঘরটাকে ভরিয়ে দেয় মুহূর্তে।
-“মা, ও মা!”
অঙ্কিত আর তোর্ষার ডাকে ঘুরে দাঁড়ায় পর্ণা। ছেলে মেয়ে দুটো অনেকদিন পর আজ খুব খুশি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আজ ওরা মুক্ত। ভয়ের মেঘ কেটে গিয়েছে। সুন্দর পৃথিবী অপেক্ষা করছে আগামী প্রজন্মের জন্য প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রত্যাশায়।
সমাপ্ত