প্রপোজ

pandulipi

প্রপোজ

লেখা ও প্রচ্ছদ – নিকোলাস

।। ১ ।।
সকাল সকাল সবে ঘুমটা বেশ একটু জড়িয়ে ধরেছে, বাড়ির বাইরে বেল এর আওয়াজ। আমার ঘরটা ছোট,
শুধু একটা খাট, টেবিল আর চেয়ারেই ঘরে নড়বার জায়গা নেই। মাথার কাছের ছোটো জানলাটা দিয়ে ঘরে রোদ ঢুকেছে, টেবিলে রাখা ঘড়িটায় দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে। ততক্ষনে ঘরে ঢুকে পড়েছে মধুসূদন। ও আমার ছোটো বেলার বন্ধু। একেবারে হরিহর আত্মা। ঘরে ঢুকে মধু খাটের উপর উঠে বসল। বলল, “চল সুবু, একটু বোলপুর থেকে ঘুরে আসি।” বোঝো ঠেলা! সবে চোখটা মেলেছি, এখনো মনে করতে পারছি না আজ কি বার, তারিখটা কত, আর উনি বলেন কি না বোলপুর যাবেন। আমি আড়মোড়া ভেঙে বললাম, “কেন মধু, রাতে কি রবি ঠাকুর স্বপ্নে এসেছিলেন?” ওর কোনো হেলদোল নেই। মার সাথে কথা বলতে সোজা রান্না ঘরে চলে গেল।

।। ২ ।।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্রাম এ উঠে পড়লাম দুজনে। ফাঁকা ট্রাম। বসে পড়ে বললাম, “বুঝলি মধু, আজ এই বোলপুরে ঘুরতে না গিয়ে একটু চাকরির খোঁজে বেরোলে ভালো হত না? কলেজ শেষ হবার পর মাস দুয়েক সব ঠিকঠাক ছিল, এখন আর টেকা যাচ্ছে না ভাই।” মধু নির্লিপ্ত ভাবে বলল, “ওসব কাল হবেখন।” এই মধুর এক দোষ। ওর সব কিছুই কাল হবে। লোকে ইয়ার্কি করে বলে মধু একটা আস্ত আবাল, বয়েস বাড়ে না। কিন্তু আমি জানি ও বড্ড সরল।
ট্রাম থেকে নেমেই একটা হাওড়ার বাসে উঠে পড়লাম। বাসের ভিড়ে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। কিন্তু মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর কোনো সমস্যাই হচ্ছে না, যেন বেশ ভালোই আছে। বাস থেকে নেমে শেষমেশ যখন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলাম, দেখি, ট্রেন প্রায় রওনা দিয়ে দিয়েছে। আমি মধুর হাতটা ধরে টানতে টানতে দৌড় দিলাম। কোনমতে প্রথম কামরাতে উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে ভেতরের দিকে ফাঁকা সিট দেখে ঢোকার চেষ্টা করছি, দেখি মাঝখানের একটা সিটে বসে আছে মিলি আর ওর বাবা, মা।

।। ৩ ।।
ট্রেন থেকে বোলপুরে নেমে আমরা পাঁচ জন একটা ভ্যান এ করে রওনা দিলাম শান্তিনিকেতনের দিকে। সকাল বেলা মধুর উপর রাগ হচ্ছিল বটে এখন মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। সবুজ গাছের সারি আর লাল মাটির রাস্তা আমার মনে একটা অন্যরকম ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করে।
ভ্যান থেকে নেমে আমরা হেঁটে হেঁটে ঘুরছি। মিলির বাবা মা গাছের ছায়া দেখে বসে পড়লেন। আমি, মিলি আর মধু হাঁটতে থাকলাম। বেশ নির্জন। মিলি খুব আস্তে করে বলল, “মধু, সামনের মাসে আমার বিয়ে। তোর সাথে খুব জরুরী কিছু কথা আছে। রাতে একবার দেখা করতে পারবি?” মধু একটা কদম গাছের পাতা দিয়ে একটা বাঁশি বানাবার চেষ্টা করছিল। মিলির কথা শুনে মধু ওই বাঁশি বানাবার চেষ্টা করতে করতেই বলল, “আজ রাতে? থাক না, ওসব কাল হবেখন।” মিলি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
মিলির মা দূর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, “মিলি চলে আয়। জ্যেঠু চলে এসেছে।” ওর জ্যেঠু এখানেই থাকেন। ওরা তিনজন জ্যেঠুর সাথে চলে গেল, আমাদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে।

।। ৪ ।।
আমরা দুজন একটা গাছের নীচে শুয়ে পড়লাম। মধুসূদন বাঁশিটা বানাতে পারেনি। এখন অন্য কি একটা গাছের পাতা দিয়ে চেষ্টা করছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “মধু, এবার মিলিকে প্রপোজটা করে ফেল। সেই বারো ক্লাস থেকে ও তোকে ভালবাসে। সামনে আবার বিয়ে বলছে।” মধুসূদন ওর কাজ করতে লাগল। একটু বাদে বলল, “তাহলে প্রপোজটা করেই ফেলি। কি বলিস?” আমি তড়াক করে উঠে বসে বললাম, “আলবাৎ করবি। আমরা তো রাত আটটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব। তারপর ওদের বাড়ি চলে যাবি। কিছু একটা গল্প বানিয়ে দেবখন।” মিলির বাড়ি আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। আর সবসময় যাতায়াত লেগেই থাকে।
মধু এবার ওর বাঁশিটা ঠোঁটে লাগিয়ে একটা বড় ফুঁ দিল। সত্যি সত্যি বাঁশিটা একটা বিকট শব্দে বেজে উঠল। একদম বাচ্চাদের মত খিল খিল করে হাসতে হাসতে মধুসূদন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল সুবু, কিছু খাই।” আমিও উঠে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে রাতে যাবি তো?”
মধুসূদন বাঁশিটা দুবার পিঁ পিঁ করে বাজিয়ে বলল, “প্রপোজ তো? আরে ওসব কাল হবেখন।”

।। ৫ ।।
খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর মধুসূদন প্যান্ডেলের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। মধু পকেট থেকে এক পাতা ওষুধ বের করে বলল,”একটু জল লাগত যে রে।”
বললাম, “এটা কিসের ওষুধ?”
এমন সময় প্যান্ডেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলেন মিলির শান্তিনিকেতনের জ্যেঠু। আমাদের দেখে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, “এই তোমরা দুই বন্ধু ঠিক করে খেয়েছ তো?”
আমি কিছু বলবার আগেই মধু ওই ওষুধের পাতাটা জ্যেঠুর দিকে নাড়াতে নাড়াতে বলল, “জ্যেঠু, এমন খেয়েছি এখন অ্যান্টাসিড খেতে হচ্ছে।”
“হা হা হা। বেশ করেছ, বেশ করেছ।” হাসতে হাসতে বললেন জ্যেঠু। আরেকটু কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুঝলে ভাইটি, কয়দিন ধরে যা যাচ্ছে, কাল বিকেলে মিলি আর ওর বরকে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা করিয়ে তবে একটু নিশ্চিন্তি।”
প্যান্ডেলের বাইরে ভিড় অনেক বেড়ে গিয়েছে। চারিদিকে রকমারি আলোর বন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েকশো দামী জামা, শাড়ি আর গয়না। ভিড়ের মৃদু গুঞ্জন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেন বলছে, “বর খুব ভালো হয়েছে… “, “উফ, যা খেলাম!” কিন্তু ছাদনা তলায় বসে, লাল বেনারসি পরে মিলি কি ভাবছে, সেটা আর জানা হল না।

।। ৬ ।।
ফেরার পথে মধুসূদন বলল রাতে আমাদের বাড়িতেই শুয়ে পড়বে। রাতে শীতটা আরো জমিয়ে পড়েছে। গরম কিছু পরে আসা উচিত ছিল। নিস্তব্ধ রাস্তা দিয়ে আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে ফিরছি, দুজনেই চুপ। মধুও হঠাৎ চুপ মেরে গিয়েছে।
মাঝরাতে মধু ধাক্কা দিতে লাগল। কাঁচা ঘুম থেকে তুলে বলল, “বুঝলি সুবু, মনে হয় মিলি কে প্রপোজ না করে ভুল করে ফেলেছি।” কি আর বলি এই বদ্ধ উন্মাদকে। চোখটা না খুলেই বললাম, “না ভাই, কাজটা খারাপ করিস নি। মিলির জীবনটা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছিস। এবার শুয়ে পড়। আর জ্বালাস না।”
এবার খাট থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নীচে নেমে গেল মধুসূদন। “সুবু তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না। এখনই একবার মিলির সাথে দেখা করা দরকার। আমাকে প্রপোজটা করতেই হবে। তুই ঘুমা, আমি চললাম।”
বুঝলাম ব্যাপার বেগতিক। মধু ক্ষেপে গেছে। এই ওর আরেক দোষ। যেটা একবার মাথায় ঢুকবে সেটা না করে নিস্তার নেই। বললাম, “নিশ্চয়ই করবি। কিন্তু বাবা বাইরের দরজাটায় তালা দিয়ে দিয়েছে। তাই এখুনি না গিয়ে কাল যাবিখন। আমি তোকে সুন্দর লাল গোলাপ এনে দেব। মিলিকে দিস।” বলেই আমি ঘুমানোর ভান করে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম আর আড় চোখে দেখলাম, মধু খাটের পাশের চেয়ারে বসে পড়েছে কিন্তু বড্ড আনচান করছে।

।। ৭ ।।
সকাল সকাল মার হুকুম, “সুবু মাছ নিয়ে আয়।” সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেই মাত্র উঠতে যাব, পেছন থেকে মধু ফিস ফিস করে বলল, “সুবু, লাল গোলাপ।” বুঝলাম রাতের ভূত এখনও বিদেয় হয়নি। কিছু না বলেই রওনা দিলাম বাজারের দিকে।
বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি মধু কাল রাতের কোট প্যান্ট পরে বসে আছে। বড্ড হাসি পেল কিন্তু যথা সম্ভব গম্ভীর থেকে এক গোছা লাল গোলাপ মধুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “যা ভাই, বেস্ট অফ লাক।” মধু আমার সাইকেল নিয়ে রওনা দিল মিলির বাড়ির দিকে। আমি জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম, মনে মনে ভাবলাম যা একটা সিনেমা হতে চলেছে, দেখতে পেলে বেশ হত। মধু পেছন ফিরে আমাকে দেখে একবার হাত নাড়ল। ধীরে ধীরে রাস্তার বাঁকে মধুসূদন মিলিয়ে যাবার আগে দেখলাম ক্যারিয়ারের পেছনে সেই এক গোছা লাল গোলাপ।

।। ৮ ।।
ঘন্টা দুয়েক বাদে বাড়ির বাইরে সাইকেলের বেলের শব্দ। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, মধুসূদন। সবার আগে চোখ চলে গেল পেছনের দিকটায়। ক্যারিয়ার ফাঁকা। আমার মনের ভেতরের চরম উত্তেজনাকে চেপে রেখে বললাম, “আয়, ভেতরে আয়।”
ঘরে ঢুকে আমি আমার খাটে বসলাম আর মধু চেয়ারে বসতে বসতেই বলল, “বুঝলি ভাই, প্রপোজটা করেই ফেললাম।”। আমি বললাম, “আরে খুলেই বল না।”
মধুসূদন বলতে লাগল, “যখন মিলির বাড়ি পৌঁছলাম, তখন ওদের শ্বশুরবাড়ি ফেরার তোড়জোড় চলছে। বাড়িতে লোকের ভিড়। মিলিকে ঘিরেই জটলা। বেশ থমথমে পরিবেশ। আমি খুঁজে খুঁজে একটা ফাঁকা ঘর দেখে চুপ করে বসলাম। দেখি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসল মিলির বর।” আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, “তারপর?” মধু আরেকটু গুছিয়ে বসে বলতে লাগল, “বুঝলি, ছেলেটা বড্ড ভাল। অনেক গল্প করল। বলল আমার আর তোর কথা নাকি মিলি ওকে অনেক বলেছে। ওদের বাড়ি যেতেও বলল। যাই হোক, কথার মাঝখানেই ঘরে ঢুকল বীথি। মিলির বরকে নাকি সবাই খুঁজছে। শুনেই ছেলেটা তাড়াতাড়ি করে চলে গেল।” এই অব্দি বলে মধুসূদন জল খেতে গেল। বীথি মিলির ছোটো বোন। মাত্র দু বছরের ছোট। অবিকল মিলির মত দেখতে। দেখা হলেই আমার সাথে অনেক গল্প করে। মনে পড়ল এই সপ্তাহ খানেক আগেই একদিন বলছিল, “আচ্ছা, মধু দাদা কি পাগল? নাহলে, দিদি যখন লজ্জার মাথা খেয়ে মধুদাকে প্রপোজ করল, তখন বলে কিনা, ওসব পরে হবেখন!”
আমি আর কি বলি, ব্যাপারটাকে হালকা করতে বলেছিলাম “মধুর কথা ছাড় তো, ওর মাথায় ছিট আছে।”
মধুসূদন জল খেয়ে ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
“তারপর, বীথি আমার সাথে ওই ঘরে বসে অনেকক্ষণ গল্প করল। ওর সাথে গল্প করতে করতেই আমার মাথায় আসলো যে, মিলির তো ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়েই গেছে, ওকে আর প্রপোজ করে কি লাভ। তার চেয়ে বরং বীথিই ভালো। আর ওকে তো অবিকল মিলির মতই দেখতে। তাই প্রপোজটা করেই ফেললাম।”
আমি চোখ ছানাবড়া করে বললাম, “বীথিকে?”
মধুসূদন মুখটা লাজুক লাজুক করে বলল, “হ্যাঁ রে।”
আমি প্রথমে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তারপর বললাম, “তোকে ঠাঁটিয়ে চড় মারলো না?”
মধুসূদন হাসতে হাসতে বলল, “এই তো ভাই তুইও আমার মত ভুল ভাবলি। আমিও তো প্রথমে বীথির মুখের হাবভাব দেখে ভেবেছিলাম, এই বুঝি মারে নাকি? মুখ চোখ পুরো লাল হয়ে গেছিল রে। রেগে গন গন করছিল। কিন্তু একটু বাদেই হাসতে লাগল…”
এই অবধি বলে মধু ওর জিনিসপত্র ব্যাগ এ গুছাতে লাগল। আমি চেয়ে আছি ওর মুখের দিকে, বাকিটা শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু মধু আপন মনে কাজ করতে লাগল আর তারপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘরের থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “সুবু, আমার একটু তাড়া আছে রে। তোর সাইকেলটা নিয়ে গেলাম, কাল দিয়ে যাব।” আমি কিছু বলবার আগেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আমার সাইকেল এ চড়ে বসল মধু। আমিও ছুটে গেলাম বারান্দায় ততক্ষণে মধু রওনা দিয়েছে। একটু চেঁচিয়েই বললাম, “বীথি কি বলল সেটা তো বলে যা।”
মধু একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও হ্যাঁ, বীথি হাসতে হাসতে বলল, ওসব পরে হবেখন!”
বলেই মধুসূদন মহানন্দে সাইকেলের প্যাডেল এ জোরে একটা চাপ দিল। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম… আর ও দূরে মিলিয়ে গেল। মিলি যাকে ভালবেসেছিল বীথি তাকে আপন করে নেবে এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না, কিন্তু যাই হোক, পাগলাটাও তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রেমের মর্ম বুঝতে পারল।

Author: admin_plipi