অবিনশ্বর গামছাওয়ালা ।। পলাশ সরকার
অবিনশ্বর চক্রবর্তী, ওরফে অবিনশ্বর গামছাওয়ালা, পিতা স্বর্গীয় বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী, বাসভূমি বামুনপাড়া, গোয়ালটুলী। পেশায় গোয়ালা।
আজ বামুনপাড়া গ্রামে পঞ্চায়েত বসেছে। প্রায় তিনশো গ্রামবাসীর জমায়েত হয়েছে। সবাই বেশ কৌতুহলী। আজ অবিনশ্বরের বিচার হবে। এখন শুধু পঞ্চায়েত প্রধানের আসার অপেক্ষা। সকলের মধ্যে বেশ গুঞ্জন চলছে, আজ অবিনশ্বরের উচিত শিক্ষা হবে। অন্তত গ্রামবাসীরা তো তাই ই চাইছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পঞ্চায়েত প্রধান এলেন। অবিনশ্বরের বিরুদ্ধে সকলে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করল। সকলের বক্তব্য শোনার পর পঞ্চায়েত প্রধান একবার অবিনশ্বরের দিকে তাকালেন। ভাবলেন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বে একবার অভিযুক্তের কথাও শোনা দরকার।
জন্মলগ্ন থেকে অবিনশ্বর মাতৃহারা। মাকে দেখা তো দূরের কথা মায়ের একটি ছবিও তার কাছে নেই। বাবার থেকেই মায়ের কথা শুনে শুনে বড় হয়েছে অবিনশ্বর। মনে মনে মায়ের এক কাল্পনিক চেহারা সে তৈরী করে ফেলেছে। বাবার কাছেই সে শুনেছিল বাবা মায়ের অমর প্রেমের কাহিনী। একদা মা ও বাবা দুজনেই একই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। মায়ের নাম কানন, মায়ের বাড়ি ছিল গ্রামের দক্ষিণে আর বাবার বাড়ি গ্রামের পূর্ব দিকে। বাবা পেশায় পুরোহিত।
বাবা একবার পৌরহিত্য করতে গিয়েছিল গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়, সেখানেই বাবা ও মায়ের প্রথম দেখা। তারপর গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে মা বেশ কয়েকবার লুকিয়ে দেখা করেছিল বাবার সাথে। মা নাকি অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। বাবা ব্রাহ্মণ কিন্তু মা ছিলেন শুদ্র। তাই সামাজিক বিয়েতে চরম সমস্যা দেখা দেয়। বিশ্বেশ্বর একবার চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু মেয়ে পক্ষের সম্মতি মেলেনি। উল্টে গ্রামের মানুষের কাছে তাকে ভৎসিত হতে হয়েছিল।
বিশ্বেশ্বর গ্রামের লোকের কথার কোনো গুরুত্ত্ব দেয়নি। সে ঠিক করে ওই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে। সেইমতো একদিন রাতের অন্ধকারে ওরা পালিয়ে যায় বামুনপাড়া গ্রামে। যেখানে ওদের কেউ চেনে না। সেখানে গিয়ে মন্দিরে বিয়ে করে। বামুনপাড়া গ্রামে সবকিছুই নতুন। নতুন বউ, নতুন ঘর, নতুন সংসার, নতুন মানুষজন। দিব্যি সুখে শান্তিতে ঘর করছিল ওরা। পৌরহিত্য করে বেশ দিন চলছিল। বাড়তি রোজগারের আশায় কিছু গরুও কিনেছে।
বিশ্বেশ্বর আর কাননের সুখী দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি হয় যেদিন অবিনশ্বরের জন্ম হয়। বিয়ের তিন বছর পর কানন সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। আনন্দে আত্মহারা বিশ্বেশ্বর বিশেষ ভাবে স্ত্রীর যত্ন নেওয়া শুরু করে। কাননের যেন যত্নের কোনো ত্রুটি না হয় সেটাই সে সর্বদা ভাবত। নিজে হাতে কাননের জন্য ওর পছন্দের খাওয়ার বানিয়ে খাওয়াত। কাননের মাথায় তেল দেওয়া চুল বেঁধে দেওয়া সব করত।
যেদিন অবিনশ্বর জন্ম নিল সেদিন কাননের মৃত্যু হয়। কাননের মৃত্যুর সাথে সাথে বিশ্বেশ্বরও যেন সেদিন একপ্রকার মৃতপ্রায় হয়ে যায়। বেঁচে ছিলো শুধু ওর শরীরটা। সদ্যোজাত অবিনশ্বরকে প্রথম রেখেছিল চার হাত দৈর্ঘের একটা লাল রঙের গামছায়। এই গামছা তাদের ভালোবাসার প্রতীক। গ্রামের হাটে দ্বিতীয়বার যখন কাননের সাথে দেখা হয়েছিল বিশ্বেশ্বর কাননকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। ঠিক একসপ্তাহ পর কানন তার জমানো কিছু পয়সা দিয়ে গামছা কেনে, আর নিজে হাতে কিছু বাতাসা বানায়। গামছায় মুড়ে সেই বাতাসা তুলে দিয়েছিল বিশ্বেশ্বর এর হাতে। একবার মৃদু হেসে জানিয়ে ছিল তার সম্মতি। এই গামছা ছিল ভালোবাসার মূর্তমান প্রতীক। বিশ্বেশ্বর এই গামছাকে কোনোদিন মাটি স্পর্শ করতে দেয়নি। যখনি সে পৌরহিত্য করতে বাইরে যেত গামছা সে মাথায় বেঁধে রাখত। অবিনশ্বর এই গামছায় মায়ের স্নেহ অনুভব করত। তাই সে মাঝে মাঝে বাবার থেকে নিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরত।
একবার বামুনপাড়া গ্রামে প্রবল বন্যা হয়। বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভেসে যায়। অবিনশ্বরদের বাড়িও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । অবিনশ্বর সেদিন দেখে যে বাবা গামছাটি কে আকড়ে ধরে এক উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন অবিনশ্বর বুঝতে পারে বাবার কাছে ঘরবাড়ির থেকেও তাদের ভালোবাসার প্রতীক অনেক বেশি মূল্যবান। কিছুদিন পর বন্যা পরিস্থিতি ঠিক হল কিন্তু দেখা দিল মারণ রোগ কলেরা। সে এক মহামারীর রূপ নিল। গ্রামের অনেকে প্রাণ হারাল, তাদের মধ্যে একজন বিশ্বেশ্বর।
বাবার আকস্মিক মৃত্যু অবিনশ্বরকে পাথর বানিয়ে দেয়। সে দিনে দিনে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। লোকজনের সাথে কথা কম বলে। গ্রামের অনেকে অবিনশ্বরকে পাগল ভাবতে শুরু করে। বাবার রেখে যাওয়া গরুগুলোর পরিচর্যা করে, আর গরুর দুধ গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। এভাবেই তার দিন চলে যায়। এই গামছায় আগে মাকে অনুভব করত এখন মা বাবা দুজনকেই খুঁজে পায়। যতদিন বাঁচবে এই গামছা সে অক্ষত রাখবে। গামছার কোনো অসম্মান হতে দেবে না।
মাঝে মাঝে দুধ বিক্রি কম হলে অবিনশ্বর তা দিয়ে ক্ষীরের নাড়ু বানিয়ে গ্রামের হাটে বিক্রি করে। গ্রামের অনেকে ওকে পাগল ভাবলেও সবাই জানে ও খুব সৎ, দুধে জল মেশায় না।
সারাক্ষণ মাথায় গামছা বাঁধা, তাই গ্রামের লোক নাম রেখেছে অবিনশ্বর গামছাওয়ালা। কে কি নামে ডাকল তা নিয়ে কোনো হেলদোল নেই অবিনশ্বরের। কিন্ত কেউ গামছা ধরে টানাটানি করলে তার রক্ষা নেই। অবিনশ্বর তেড়ে যায় মারতে। এমন ঘটনা অনেকবার হয়েছে যেখানে অবিনশ্বর লোকের মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছে।তাই সহসা কেউ ওকে বিরক্ত করেনা। কিন্তু গ্রামের লোক ভেবে অবাক হয় যে এই গামছায় এমন কি আছে যার জন্য কেউ এতটা হিংস্র হয়ে ওঠে।
দেখতে দেখতে অবিনশ্বর এর বয়েস হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ, গরুর সংখ্যাও বেড়েছে, বেড়েছে দুধের পরিমাণ। এখন আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে দুধ বিক্রি সম্ভব না। তাই অবিনশ্বর এখন বাজারে বসে। ওই একই গ্রামের ঘোষ বাড়ির দুই ছেলেও আসে দুধ বিক্রি করতে। প্রতিযোগিতায় ঘোষরা টিঁকতে পারেনা। সবাই জানে অবিনশ্বর দুধে জল মেশায় না। তাই ওর কাছেই সবাই ভিড় জমায়। ঘোষ ভ্রাতৃদ্বয় অনেক রকম কৌশল খাটায় কিন্তু কাজ হয়না। অবিনশ্বরকে ওরা বাজারে আসতে মানা করে। অবিনশ্বর একরোখা, ও কারো কথা শোনেনা, কাউকে ভয় ও পায়না। ঘোষরা দু একবার প্রাণ নাশের হুমকিও দেয়। কোনোকিছুর কোনো প্রভাব অবিনশ্বর এর ওপর পড়েনা। ঘোষরা বুঝেগেছে অবিনশ্বর আটকানো কঠিন ব্যাপার। কিন্তু ব্যবসা যে ওদের লাটে উঠতে বসেছে। কিছু তো একটা করতেই হবে।
শেষমেষ একদিন ওরা বাজারে যায়, অবিনশ্বর তখন দুধ নিয়ে বসে আছে। এক দু কথাতে বচসা বাঁধে। উত্তেজিত হয়ে এক ভাই বাঁশ দিয়ে অবিনশ্বর এর মাথায় আঘাত করে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে, ভেজা গামছা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে দুধের পাত্রে। দুধের রং লাল হয়ে যায়। অবিনশ্বর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে নুইয়ে পড়ে। ঘোষের ছোটো ভাই অবিনশ্বর এর রক্ত ভেজা গামছা নিয়ে ফেলে দেয় শূকরের খাটালে। গ্রামের হাসপাতালে যখন অবিনশ্বরের জ্ঞান ফেরে, প্রথমেই ও গামছার খোঁজ করে।
মাথায় গামছা না পেয়ে দৌড়ে যায় বাজারের দিকে। গিয়ে দেখে দুধের পাত্রগুলো উল্টে পড়ে আছে। এদিক ওদিক পয়সা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু গামছা নেই। পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। অনেককে জিজ্ঞেস করে। কেউ মুখ খোলে না। শেষে একটা বাচ্চা মেয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে খাটাল এর দিকে। অবিনশ্বর ছুটে যায়। গিয়ে দেখে রক্তে ভেজা ওর গামছা কতগুলো শূকর ছিঁড়ে খাচ্ছে।
অবিনশ্বর তখন উন্মাদ। ছুটে যায় ঘোষ বাড়ির দিকে। ঘোষ বাড়ির উঠোনে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে। বেরিয়ে আসে এক ভাই। ওকে মাটিতে ফেলে বড় এক পাথর দিয়ে থেঁতো থেঁতো করে ওর মাথা। ওই দেখে পেছনের দরজা ফিয়ে পালায় আরেক ভাই।
পঞ্চায়েত সভায় সব শুনে পঞ্চায়েত প্রধান আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরাও চুপ। কিন্তু হত্যাকারীকে ছেড়ে দেওয়া যায়না। প্রধান আর একবার অবিনশ্বরকে জিজ্ঞেস করে ওর শেষ ইচ্ছা। অবিনশ্বর বলে, “আমি মৃত্যুদণ্ড চাই। ওই গামছার মৃত্যুর সাথে সাথেই আমারও মৃত্যু হয়েছে। আমার শেষ আবদার ওই খাটালে আছে আমার মা বাবার ভালোবাসার চিহ্ন। ওটা পরিস্কার করে মা বাবার স্মৃতি স্মারক বানানো হোক।” প্রধান তাতে সম্মতি দেয়।
বহু বছর কেটে গেছে। সেই স্মৃতিস্মারক গ্রামে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আজও ভালোবাসা দিবসে প্রেমিক প্রেমিকারা সেখানে গামছা চড়ায়।