দায়ী ।। লেখা : অনির্বাণ সরকার
আজ সকালে টিভিতে একটি খবর দেখে কৃশানুর মন-মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল !
সে রাজ্য সরকারের একটি সাধারণ যোগ্যতামূলক চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, যার ফল বেরনোর সম্ভাবনা ছিল এই সপ্তাহেই । কিন্তু আজ টিভিতে একটি খবরের চ্যানেলে সম্প্রচারিত হল যে, সেই পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার ।
খবরে আরও জানাল, গতবছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনও এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন যে, এইধরণের সরকারী চাকরিতে কেবলমাত্র অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদেরই যার যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে নিয়োগ করা হবে । অথচ পরবর্তীতে ঐ চাকরির বিজ্ঞাপন বের হয় শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ করে ; সেখানে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদের বিষয়ে কোনও কথা লেখা ছিল না । ফলে হাজার হাজার যুবক-যুবতীরা সেই চাকরির পরীক্ষায় বসে ।
খবরে যা বলল, সেই অনুযায়ী এর পরের ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক । কিছু অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকরা মিলে মুখ্যমন্ত্রীর ঐরকম ঘোষণার পরও উক্ত পরীক্ষাটির চয়নপদ্ধতি নিয়ে প্রথমে আর. টি. আই. এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টে কেস করে দিলেন ! কোর্টের নির্দেশানুসারে পরীক্ষা বাতিল হল, যার ফলস্বরূপ আজকের এই খবর ।
কৃশানুর এই চাকরিটার খুব দরকার ছিল ; আর বেশীদিন ‘বেকার’-এর তকমা লাগিয়ে বাড়িতে বসে থাকা যাচ্ছিল না । যোগ্যতা ও পরীক্ষা – দু’টোই অনুকূলও ছিল । কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষার পথে বাধ সাধল সেই আর. টি. আই. আর কোর্ট কেস ।
নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নকে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে তার সব রাগ ও ক্ষোভ গিয়ে পড়ল সমাজের সকল অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ ও প্রবীণ নাগরিক, অর্থাৎ রিটায়ার্ড সিনিয়র সিটিজ়েনদের উপর ! অবশ্য সেই রাগের ছিঁটেফোঁটাও বাড়িতে মা, বাবা ও বোনের উপরও পড়ল।
আজ তার একটি প্রয়োজনীয় বিশেষ কাজে গড়িয়াহাট যেতে হবে । এ-বেলায় গিয়েই সেরে আসবে ভেবে সে তিরিক্ষি মেজাজ ও একরাশ বিরক্তি নিয়েই বাড়ি থেকে রওনা হল ।
সন্তোষপুর জোড়া ব্রীজ বাসস্ট্যান্ড থেকে গড়িয়াহাটগামী একটি বাসে উঠে পড়ল কৃশানু । বাস মোটামুটি ফাঁকা, প্রাত্যহিক ঝঅফিস টাইম সবে শুরু হচ্ছে ; তবে সাধারণের বসার সীটগুলি ফাঁকা নেই । গন্তব্য খানিকটা দূরে বলে অবশেষে একটি খালি ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’-এর সীটেই বসে পড়ল সে ।
প্রাক-জমজমাট রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে চলতে বাসটি যাদবপুর এসে পৌঁছল । কিছু লোক নেমে গেল বাস থেকে আর বেশ কয়েকজন তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে এল । আগের যাত্রীরা নেমে যাওয়ায় যে সীটগুলি খালি হয়েছিল, মুহূর্তের মধ্যে নতুন যাত্রীতে ভরে গেল সেগুলো ! এই শহরের নিত্যদিনের ছবি এটা ।
ভিড়ে সকলের পিছনে ছিলেন আন্দাজ সত্তরোর্ধ্ব সম্ভ্রান্ত চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক । কোনওক্রমে ভিড় সামলে বাসে উঠলেন তিনি । তারপর অন্যান্য যাত্রীদের পা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নিজে সাবধানে পা ফেলে কৃশানুর সামনে এসে দাঁড়ালেন ।
কৃশানু সকাল থেকেই অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের উপর রেগে বসে আছে । ফলে ঐ বয়স্ক মানুষটি তার সামনে এসে দাঁড়ানোয় তার বিরক্তির মাত্রা বেশ ভালরকমই বেড়ে গেল ! কোনওরকম সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না সে, আপন খেয়ালে যেন তাঁকে দেখেইনি – এমন ভাব করে সেই ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’-এর সীটেই বসে রইল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ।
ওদিকে প্যাসেঞ্জার ওঠা-নামা সেরে বাস আবার চলতে আরম্ভ করল ।
জুন মাসের সকালের ক্রমবর্ধমান ভ্যাপসা গরমে ভিড় বাসে সকলেই কষ্ট পেতে শুরু করেছে ততক্ষণে । সেই বয়স্ক ভদ্রলোক ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আড়চোখে কৃশানুকে দেখেছেন । ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’-দের সীটগুলোয় পরপর সব বৃদ্ধরাই বসে আছেন, শুধুমাত্র সে ছাড়া । তাকে সীট ছাড়তে বলতে তাঁর বোধ হয় সঙ্কোচ হচ্ছে, তাই মুখে কিছু বলছেন না । এদিকে গরমে আর ভিড়ের চাপে তো দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল !
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির চার নম্বর গেট পেরনোর পর আর ঐ অসহনীয় অবস্থায় থাকতে না পেরে শেষে বাধ্য হয়েই সেই বৃদ্ধ মানুষটি কৃশানুকে সামান্য আর্তকণ্ঠে বললেন, “ভাই, তুমি যে সীটে বসে রয়েছ, সেটা সিনিয়র সিটিজ়েনদের জন্য । আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, ভিড় ও গরমে কষ্ট করছি, তা সত্ত্বেও তুমি এমন ভাব করছ যেন আমায় দেখতেই পাওনি ! দয়া করে সীটটা একটু ছাড়বে ? আমি ধর্মতলা যাব ।”
কৃশানুর মনের ভিতর জমে থাকা অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদের উপর সমস্ত ক্ষোভ যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত বেরিয়ে এল, “সবসময় সরকারী নিয়ম-কানুনের সুবিধা ভোগ করতে খুব ভাল লাগে না আপনাদের ? যেখানে যান, সেখানেই কনসেশন আর ভর্তুকি পান । বাসে একই ভাড়া দিয়ে সীটের সুবিধা, ট্রেনে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়ায় সকলের সমান সুবিধে, হসপিটাল, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, বাজার, এল. পি. জি. – সর্বত্র আপনাদের ছাড় !”
তার এই আকস্মিক বিস্ফোরণে সেই বৃদ্ধ একেবারে স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে গেলেন । আশপাশের যাত্রীরাও কৃশানুর আচমকা এভাবে অপ্রাসঙ্গিক ক্ষোভে ফেটে পড়াতে সম্পূর্ণ হতবাক । কারও মুখে কথা সরছে না ।
ওদিকে কৃশানুর তিরস্কার প্রবল হতে হতে চরমে পৌঁছেছে, “রিটায়ারমেন্টের পর সমাজে কোনও অবদান নেই, শুধু কন্সেশনের ধান্দা ! গভর্ণমেন্টের স্কীম আর ভর্তুকির ফিকির খুঁজে কেবলমাত্র নিজের সুযোগ-সুবিধাটুকু বুঝে নেওয়া চাই । সেখানে সামান্য কমতি হলেই চললেন বাবু আর. টি. আই. করতে বা কোর্টে কেস করতে । কাজ-কাম কিছু নেই, ঘন ঘন ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে গিয়ে অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স চেক করা, সকাল-সন্ধ্যা পার্কে হাঁটা, আর, সরকারের এবং ইয়ং জেনারেশনের নিন্দা করা – এ-ই তো পারেন !”
বৃদ্ধ এখনও সামলে উঠতে পারেননি, ফ্যালফ্যাল করে কৃশানুর দিকে তাকিয়ে আছেন নির্বাক দৃষ্টিতে । যাত্রীদের অধিকাংশই স্বভাবসিদ্ধ ব্যস্ততা নিয়ে নিজের নিজের মোবাইল ফোন ঘাঁটছে আর, বাকিদের কেউ কেউ সকালবেলায় এই নাটকের দৃশ্য উপভোগ করছে, আবার কেউ-বা বিরক্তি বিড়ম্বনা মনে করে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে । বাসের কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে ব্যস্ত । কেউই কিন্তু ওদের ব্যাপারে ঢুকছে না বা সর্বসমক্ষে কৃশানুকে কিছু বলতে সাহস করছে না !
পরিশেষে কৃশানু নিজেই এই নাটকের দৃশ্যের যবনিকা টানল । ক্ষোভের একেবারে শেষটুকু সে উগরে দিল সেই বয়স্ক মানুষটির উপরে, “আপনি ও আপনাদের মত সব রিটায়ার্ড সিনিয়র সিটিজ়েনরা এই সমাজের বোঝা, জঞ্জাল ! বুঝেছেন ? আপনারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সেই সরকারেরই নিন্দা করেন । ইয়ং জেনারেশনকে মনে করেন ‘গুড ফর নাথিং’ ! কিন্তু জেনে রাখুন, এই ইয়ং জেনারেশন আসলে ‘বেটার ফর এভ্রিথিং’ । সারাজীবনই তো চাকরি-বাকরি করলেন, এবার আমাদেরও একটু সুযোগ দিন ! সেখানেও তো ভাগ বসাচ্ছেন আপনারা । লজ্জা করে না হাজার হাজার বেকার ছেলে-মেয়েদের পেটে লাথি মারতে ?”
বাস এতক্ষণে যাদবপুর থানার সিগন্যালে এসে দাঁড়িয়েছে । কৃশানু নিজের শেষ কথাগুলো বলে নিয়ে লক্ষ্য করল, অন্যান্য যাত্রীরা এবার তাদের দিকে তাকিয়েছে । সে বুঝল, একটা পলিটিক্যাল কমেন্ট করে ফেলেছে সে ! কাজেই, এই বাসে তার আর যাওয়া ঠিক হবে না । একটু শান্ত হল সে, তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই সেই বৃদ্ধের উপর ঝেড়ে দিল তার বাকি রাগটুকু, “নিজেদের অধিকারবোধটা বজায় রাখতে খুব পটু আপনারা, তাতে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হোক বা লোকেরা জাহান্নামে যাক – আপনাদের কিস্যু এসে যায় না । নিন, বসুন । আপনার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সমাজের অপরাধী হয়ে থাকতে পারব না ।” কথাগুলি সেই সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েই সকলের হতভম্বতার মাঝখানে কৃশানু কোনওদিকে না তাকিয়ে ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে এল রাস্তায় ।
গড়িয়াহাটের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কৃশানুর বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেল । ইতিমধ্যে তার মন ভাল হওয়ার মত ঘটনাও ঘটে গিয়েছে । সকালে যাবার সময় তার মন যতটা ক্ষুব্ধ ছিল, বাড়ি ফেরার সময় ঠিক ততটাই প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে !
সকালে যে পরীক্ষার পুরো পদ্ধতি বাতিল হওয়ার খবর শুনে তার এত রাগ আর ক্ষোভ, দুপুর নাগাদ খবর এল যে, সেই পরীক্ষা এবং আরও অন্যান্য যেসব পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গিয়েছে সরকারের তরফে, সেগুলো বাতিল করা হবে না এবছরের মত ; সেইসব পরীক্ষা ও তৎপরবর্তী পর্যায়গুলি বহাল রাখছে সরকার । আগামী দিনে ঐ ধরণের যেসব পরীক্ষা হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণা বলবৎ করা হবে, অর্থাৎ, ভবিষ্যতে যেকোনও অনুরূপ সরকারী চাকরিতে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদেরকে নিয়োগ করবে সরকার । সরকারের এই সিদ্ধান্ত আগামী সপ্তাহের মধ্যেই রাজ্যপালের সমর্থন এবং হাইকোর্টের অনুমোদন পেয়ে যাবে ।
টিভিতে খবরের চ্যানেলগুলো সরকারের ঐ সিদ্ধান্তের কথা এবং দুপুরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সের ভিডিও ফুটেজ বারবার দেখাচ্ছে । কৃশানু ও তার বাড়ির লোক ভীষণ খুশী ! খাবার টেবলে বসে ডিনার করতে করতে পুরো পরিবার একসঙ্গে সেই খবর দেখল ।
প্রধান খবর দেখানো শেষ হলে এবার শুরু হল সংবাদমাধ্যমের সার্কাস ! সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের সদস্যরা সরকারের ঐ সিদ্ধান্তকে মানুষের হিতের পক্ষে বলে দাবি করলেন । বিরোধী দলগুলির সদস্যরা এই ঘটনাকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার রসদ হিসেবে প্রচার করলেন ।
এদিকে, শহরের সিনিয়র সিটিজ়েনদের অ্যাসোসিয়েশন সেই একই জিনিসকে তাঁদেরই নৈতিক জয় বলে মান্যতা দিলেন । অন্যদিকে, বেশ কিছু যুবক-যুবতী গোটা ব্যাপারটাকে একটা রাজনৈতিক প্রহসনরূপে দেখছে । তাদের মধ্যে যারা চাকরিজীবী বা বিভিন্নরকম কাজে নিযুক্ত, তারা বলল যে এতে বেকারত্ব গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়বে । যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে কিংবা স্বনির্ভরভাবে কাজ করে, তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারে থাকা দলটি একাধারে চাকরিজীবীদের আর অন্যদিকে প্রবীণ নাগরিকদের ভোট নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে এল, কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করল না ! আর, যারা বেকার তারা বলল যে তাদের প্রতি ঘোর অন্যায় হয়েছে বলে তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবে ।
আবার, কিছু মানুষের মনে হয়েছে, সরকার শুধুমাত্র সমাজের বরিষ্ঠ নাগরিক এবং চাকরিজীবীদের নিয়েই ভাবে, ‘সাধারণ মানুষ’-এর জন্য কিছু করে না ! এতে বোঝা গেল, আমাদের সমাজে ‘সাধারণ মানুষ’ বলে আরেকটি প্রজাতি রয়েছে । তবে এদেরকে কেউ চিহ্নিত করতে পারে না ।
এরপর আরম্ভ হল লাইভ টক শো, যেখানে গোটা বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে স্বপক্ষে-বিপক্ষে-উভয়পক্ষে চলল রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের বাক-বিতণ্ডা । সেই শো-তে কেউ কেউ চরম আত্মবিশ্বাসের সাথে অনর্গল ভুল বলতে থাকে ! এর পরে একটু বিরতি ।
কৃশানুর ঘুম ধরে এসেছিল । কিন্তু, বিরতির পরে হঠাৎ একটি খবর দেখাতে লাগল সংবাদমাধ্যমটি । খবরটির শিরোনাম হল ‘যুবকের ভর্ৎসনায় প্রৌঢ়ের মৃত্যু’, সাথে ইনসেটে একটি নীল-হলুদ রঙের বাসের বাঁদিকের সামনের চাকায় হেলান দিয়ে বসে থাকা এক বয়স্ক মানুষের মৃতদেহ, আর তাঁকে ঘিরে জনতার জটলা !
দৃশ্যটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ! এইভাবে মহানগর কলকাতার বুকে একজন বয়স্ক মানুষ রাস্তায় পড়ে মারা যাবেন, আর তাঁর মৃতদেহকে ঘিরে সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষের ভিড় – বড্ড মর্মান্তিক এ-ঘটনা ।
সংবাদমাধ্যমে ঘোষিকা বলে চলেছেন ঘটনার পর্যায়ক্রম, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বাসটি যাদবপুর এইট. বি. বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ার কিছু পরই বসার সীট নিয়ে একজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের সাথে ঐ প্রৌঢ়ের বচসা বাধে । যাদবপুর থানার সিগন্যালে বাস থামলে সেই অজ্ঞাতপরিচয় যুবক বচসা ছেড়ে অকস্মাৎ বাস থেকে নেমে যায় । এরপরই সেই প্রৌঢ়ের হঠাৎ হৃদ যন্ত্রণা শুরু হয় এবং কিছুক্ষণ পর তিনিও বাস থেকে নেমে যান । তারপর বাসের চাকায় হেলান দিয়ে ঐরকমভাবে বসেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায় অনুমান করা হচ্ছে, সেই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের সাথে বচসার জেরেই প্রৌঢ়ের মৃত্যু হয়েছে !’
খবরটা দেখে কৃশানুর বাবা ভীষণ আফশোস করলেন এই প্রজন্মের নীতিগত অবক্ষয় দেখে । তার মা-ও খুব মর্মাহত হয়ে বলে ফেললেন, “সেই যুবকও একদিন প্রবীণ নাগরিক হবে, সেদিন তাকেও এমনই ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হবে !” তার বোন কৃত্তিকা তো ঐ বৃদ্ধের এমন পরিণতি দেখে নিঃশব্দে কেঁদেই ফেলল ।
কেবলমাত্র কৃশানু নির্বিকার, তার ঘুম একেবারে উবে গেছে ততক্ষণে ।
নির্বিকার না হয়ে তার তো অন্য কোনও উপায়ও নেই । সে যে চিনতে পেরেছে ঐ মৃত প্রৌঢ়কে, ঐ নীল-হলুদ বাসটিকে, এমনকি, ভিড়ের কিছু কিছু মুখও যে তার চেনা !
সে চেনে না শুধু এই কৃশানুকে, যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের দাবিকে অন্যায় ও অন্যায্য মনে করে তাঁদের পুরো প্রজন্মকেই প্রবল ভর্ৎসনা করে ফেলেছে ! যে কৃশানু কেবলমাত্র একটি খবর শুনেই ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল’ ভেবে সমাজের সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গকে অপমান করেছে, সেই কৃশানুও তার অচেনা ! সরকারী অনুদান কিংবা যানবাহনে বিশেষ ছাড় যে এই সমাজের প্রবীণদেরকে একরকম সম্মানজ্ঞাপন করা, তাঁদের উপর দয়া বা করুণা করা নয়, সে-সম্পর্কে অবুঝ কৃশানুও তার কাছে অপরিচিত !
সেই বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক না কেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী একমাত্র কৃশানু । এই দায়ের পাষাণভার নিয়েই তাকে সারাজীবন চলতে হবে ।
কোনও মন্তব্য না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরপায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল কৃশানু ।
ওদিকে টিভিতে নিউজ় রিপোর্টার বলে চলেছে, ‘এই সেই বাস,… এই হল সেই সামনের চাকা,… তিনি ঠিক এইভাবেই বসে ছিলেন মারা যাবার সময়,… আপনারা দেখতে পাচ্ছেন,…’ ।