মরচে ধরা রহস্য (পর্ব ১ )


মরচে ধরা রহস্য (পর্ব ১ )
লেখা : শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ : অনিন্দিতা রায় কর্মকার


পর্ব ১ – সেই মুখ

দেয়ালঘড়ির একটা ঘন্টাধনি সমস্ত নীরবতা ভঙ্গ করে কেঁপে কেঁপে বাতাসে মিশে গেল। কদিন থেকে রাত্রিতে ঘুমোতে পারছেন না সোমনীল বাবু। পুরনো সেই ভয়ংকর স্মৃতিটা বারবার মনকে নাড়া দিচ্ছে। কদিন থেকে রাতে যা দেখছেন সবকিছুই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সোমনীল বাবুর। আজ আসল জিনিসটা কি জানতেই হবে । মনে মনে উনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। অথচ গত কয়েক রাত্রির ঘটনা কাউকেই প্রকাশ করেননি সোমনীল বাবু।
আজ বাইরে বজ্রবিদ্যুতের উদ্ভাসন আর রুদ্র প্রকৃতির উদ্দাম নৃত্য একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতিতে জানলাগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার উড়ছে। স্তূপীকৃত করে রাখা গানের স্বরলিপিগুলো আর নিজের জায়গায় নেই ।
সোমনীল বাবু বিছানা ছেড়ে উঠে দপ করে গ্যাসলাইটটা জ্বালিয়ে ফেললেন। কিন্তু নিজেরই দীর্ঘনিঃশ্বাসে এক ঝলক জ্বলেই সেটা নিভে গেল। বাইরে হাওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। হঠাৎ টেলিফোনটা বেপরোয়া ভাবে বেজে উঠল। ওনার বুকটা একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। রিসিভারটা তুলে সামান্য কাঁপা গলায় ওনার আওয়াজ বেরিয়ে এল, “হ্যা, হ্যালো।” ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই ।
এবার সোমনীল বাবু ঘরের কাঁচের দরজার বাইরে আবছা এক নারীমূর্তিকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল চাপা অট্টহাসি। মুহূর্তের মধ্যে সোমনীল বাবুর হাত থেকে রিসিভারটা পিছলে গেল। টর্চলাইটটা ড্রয়ার থেকে বের করে জ্বেলে ফেললেন সোমনীল বাবু। চিৎকার করে উঠলেন, “কে, কে ওখানে? কে ওখানে? তু… তুমি কে?”
দরজা খুলে বাইরে এলেন। কেউ কোথাও নেই। বাইরে ঝড়ের দামামা কিছুটা কমেছে। চারদিকটা আলকাতরার মত অন্ধকার, যার মধ্যে দিয়ে টর্চের আলো ভেদ করে যেতে পারে না। দোতলার বারান্দা থেকে সোমনীল বাবুর দুটো সন্ধানী চোখ আর টর্চ লাইটের আলো ঠিকরে পড়ছে। হঠাৎ ওনার চোখটা সরে গেল নিচের আধভেজা অন্ধকার রাস্তার ওপর। স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেই নারীমূর্তিকে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। পনেরো বছর আগে সেই ভয়ংকর সেই রাতটার কথা কল্পনা করে সোমনীল বাবুর ডান হাতের টর্চটা সামান্য কেঁপে উঠল। এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, যা দেখছেন সত্যি তো? দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলেন উনি।
-“তুমি… তুমি কে? তু… তুমি তো… কি করে সম্ভব? সত্যি করে বলো তুমি কে?”
আবার অট্টহাসি। সোমনীল বাবু ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। হাত দশেক দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই নারীমূর্তি। আবার কাঁপা গলায় সোমনীলবাবুর একই প্রশ্ন। এবার সেই নারীমূর্তি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি পনেরো বছরের অতীত।”
সোমনীল বাবুর হাত থেকে টর্চটা ততক্ষনে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তার ওপর পড়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকার মেশানো আলোতে সেই পুরোনো মুখ চিনে নিতে এক মুহুর্তও সময় লাগল না সোমনীল বাবুর। চোখের সামনে রহস্যমাখা দৃশ্যপট একটু একটু করে আবছা হয়ে গেল ওনার। সিঁড়ির কাছে দেয়ালটা খামচে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন উনি। বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো আলোতে সেই রহস্যময়ী নারীমূর্তি তখন আঁধারের বুক চিরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চলবে …

Author: admin_plipi