ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (প্রথম পর্ব) মাকড়সার জাল

ব্লু ডায়মন্ড রহস্য
প্রথম পর্ব
মাকড়সার জাল

লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস
ছবি – অরিন্দম ঘোষ

ঝড়ের গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। জানলার বাইরে চোখ রেখে আছি। মাথার উপর কখন জ্বলন্ত সূর্য উঠেছে খেয়ালই হয়নি। গলানো গিনির মত রোদের বুকে সন্তরণরত শঙ্খচিলের ডানা। জল টলমলে খালগুলো জানালার বাইরে দিয়ে ছুটে চলেছে। হঠাৎ একটা ছুটন্ত ট্রেন বিশ্রী শব্দ করে প্রকৃতির বেনিয়াসহকলা মাড়িয়ে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল আমাদের ট্রেনটা অতিক্রম করে। পাশের সিটে ইন্দ্রদার দিকে চোখ ফেরালাম। দেখি তখনও ‘স্পাইডার নোট’ বইটা নিয়ে পড়ে আছে। তিনদিন আগে ইন্দ্রদার সঙ্গে দেখা করতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাঁরই গ্রামে আমরা আজ যাবার জন্য বেরিয়েছি। সরাইঘাট এক্সপ্রেসে রিজার্ভেশন পেতে অসুবিধে হয়নি। এর আগে অবশ্য আমি পৌষ মেলার সময় শান্তিনিকেতন এসেছি। আর তাছাড়া বীরভূমে সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল ইন্দ্রদার সঙ্গে মামাভাগ্নে পাহাড়ে। সোমনীল বাবুর মৃত্যু রহস্যের কিনারা করার পর ইন্দ্রদার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে তেমন কোনো কাজও ছিল না। আর আমার তো স্কুলের পরীক্ষার এক মাস আগে ছাড়া বাকি দিনগুলো ঝাড়া হাত পা। তাই রহস্যের কথা না ভেবেই অনেকটা লাল মাটির টানেই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। যাইহোক তিনদিন আগে সেই বিকেলটার কথা না বললে আজকের গল্পে ঢুকতেই পারব না।

ইন্দ্রদা ফোনে তখন ঝিলিকদির সাথে কথা বলছিল, আর আমি মিস ঝিলিক সেনগুপ্তের দিদি তকমাটা কবে বউদিতে রূপান্তরিত হবে সেটা ভাবতে ভাবতে জানলার বাইরে একটা মাকড়সার জাল বোনা দেখছিলাম। তখনই কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠল।

আমি দরজা খুলতেই একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। বয়স ষাটের কাছাকাছি, ফরসা গায়ের রং, মসৃণ ত্বকে এতটুকু কুঞ্চন নেই, বিস্তৃত কপাল, গোল মুখ, কাঁচাপাকা চুল সযত্নে পেছনে ওলটানো, মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতরে ঝকঝকে চোখকে ঘিরে অলৌকিক ব্যাক্তিত্ব। আমি ঘরে ডেকে ওনাকে সোফায় বসতে দিলাম।
-“আমার নাম গুরুচরণ পাত্র। তুমিই নিশ্চয় ইন্দ্রজিৎ সান্যাল আর তুমি সৌম্য, তাই তো?”
-“হ্যাঁ সৌমাভ।”… আমি বললাম।
-“তোমাকে তুমিই বলছি, কিছু মনে কোরো না। আসলে তুমি যে এতটা ইয়ং ডিটেকটিভ জানতাম না। দার্জিলিঙে ক্রিকেট রহস্যের সমাধান হবার পর তোমার নাম আমি খবরের কাগজে দেখেছিলাম।”
-“আই ডোন্ট মাইন্ড। কিন্তু আপনি আমার কাছে…”
ভদ্রলোক আমার কাছে এক গ্লাস জল চেয়ে নিয়ে প্রায় পুরো জলটুকু শেষ করে বলতে শুরু করলেন, “দেখো আমি তোমার কাছে না এসে পুলিশে ইনফরম করতে পারতাম। কিন্তু আমার সমস্যাটা আপনার মত… মানে তোমার মত একজনই সমাধান করতে পারে। গত কয়েকদিন থেকে একজন আমাকে ফোনে হুমকি দিচ্ছে এই বলে যে আমার সেই মহামূল্যবান ব্লু ডায়মন্ডটা না দিলে আমাকে খুন করবে।”
-“ব্লু ডায়মন্ড?”… আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-“হ্যাঁ, আমার কাছে বহু পুরাতন বাদশাহি আমলের একটা নীল হীরে আছে। আমার প্রপিতামহ আমায় ওটা দিয়েছিলেন। সেই হীরেটার দাম আজকের বাজারে কয়েক লাখ টাকার মত। অনেকে এসেছেন ওটা কিনবার জন্য। আশি লাখ পর্যন্ত দিতে রাজি… তবুও আমি ওটা বিক্রি করিনি… আর কোনদিনও করব না। আমার মৃত্যুর আগে ওটা আমি মিউজিয়ামে দিয়ে যাব ভেবেছি।”
-“হীরেটা কি আপনার চুরি গেছে গুরুচরণ বাবু?”… আমি বললাম।
-“অ্যাঁ…”
-“বলা হচ্ছে যে হীরে চুরির জন্য আপনি এখানে এসেছেন? না আপনাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে?”… ইন্দ্রদা বলল।
-“হীরে আমার চুরি যায়নি ঠিকই ইন্দ্রজিৎ বাবু… কিন্তু কেউ যে আমার সঙ্গে মস্করা তামাসা করে হুমকি দিচ্ছে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”
-“আপনাদের বাড়ি কি বীরভূমের দিকে?”
-“কথাবার্তার টান শুনে মনে হচ্ছে তো? ঠিকই ধরেছো।”
-“আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে টেলিফোন নেই? মোবাইল?”
-“হ্যাঁ আছে। আমি ওসব ব্যবহার করিনা। তবে তোমার মনের প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছি। আমি তো তোমাকে ফোনে সব বলতে পারতাম, কেন এতদূর ছুটে এলাম, তাই তো? একটা কথা তোমার জানা দরকার, আমাকে যে ফোনে কেউ হুমকি দিচ্ছে বা আমি তোমার কাছে যে আজ এসেছি আমার বাড়ির লোক কেউ জানে না।”
-“বুঝলাম। আপনাদের ফ্যামিলিতে আর কে কে আছেন?”
-“আমার স্ত্রী এক বছর হল মারা গেছে। আছে আমার দুই ছেলে সূর্যকান্ত আর চন্দ্রকান্ত। ছোট ছেলে চন্দ্রর বিয়ে হয়নি। সূর্যর স্ত্রী নমিতা আর ওদের ন’ বছরের ছোট ছেলে বুবাই। তাছাড়া বাড়িতে গাড়ির ড্রাইভার আর কাজের লোক।”
ভদ্রলোক একটু থামলেন। পরনের হাই নেক পাঞ্জাবি থেকে পানের একটা ছোট প্লাস্টিক কৌটো বের করে একটা পান মুখে পুরে আবার বলতে শুরু করলেন…
-“দেখো, আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না, তাই আগে থাকতেই তোমার কাছে এসেছি। তোমরা আমাদের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন স্বচ্ছন্দে থাকতে পারো। সেখানে তেমন কিছু ঘটবে না এমন তো কোনো গ্যারান্টি নেই। তাছাড়া যে আমাকে হুমকি দিচ্ছে তাকে ধরতে পারলে আমি তোমাকে আমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করব না। ”
ইন্দ্রদা সোফা ছেড়ে জানলার দিকে উঠে গেছে… “পারিশ্রমিকটা বড় কথা নয়। তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে একটা অজানা রহস্য জাল বুনতে শুরু করেছে। গুরুচরণ বাবু আপনার এই তেমন কিছু ঘটবে না কথাটার মধ্যেই অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। আমি আপনার বাড়ি যেতে রাজি। তবে এখানে আমার অফিসে কিছু কাজ আছে… সেগুলো সেরে তিনদিন পর যেতে পারব। তবে আমার সঙ্গে আমার এই সহকর্মীটিও যাবে, আপনাদের লাল মাটির দেশে বেশ কিছুদিন ঘোরা যাবে।”
-“অনেক ধন্যবাদ। এই নাও আমার ঠিকানা। ডিটেলে লেখা আছে। স্টেশনে আমার গাড়ি অপেক্ষা করবে।” … ভদ্রলোকের মুখে পান ছিল বলে অস্পষ্ট লাগল কথাগুলো।
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমি বললাম,“ব্যাস, এত সুন্দর ঘুরতে যাবার একটা বড় সুযোগ এত সহজে চলে আসবে ভাবতেই পারিনি ইন্দ্রদা। তবে তুমি যাই বলো এই ধরনের কেসে রহস্যের চেয়ে ঘুরতে যাবার আনন্দটাই বড়।”
-“কিন্তু কেসটা আমার কাছে মোটেও সহজ মনে হচ্ছে না সৌম্য। ভদ্রলোক হীরেটা নিয়ে যে খুব উদ্বিগ্ন মুখ দেখলেই টের পাওয়া যায়। সবথেকে বড় কথা উনি বাড়ির কাউকে না বলেই এখানে এসেছেন। তার মানে ছেলেদের বা বৌমার প্রতি কি তাঁর একটুও বিশ্বাস নেই? নাকি অন্য কোনো কারনে এই গোপনতা? নাকি উনি বাড়ির কাউকে সন্দেহ করছেন?”
-“ভদ্রলোকের কাছে যে ডায়মন্ডটা সত্যি আছে কিনা সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না।”
-“আছে, আছে। আমার মন বলছে আছে। আর সেটা নিয়ে কিছু ঘটতে চলেছে। সেদিন লিসেস্তার হেমিংওয়ে নামে এক ফরেইন লেখকের ‘স্পাইডার নোট’ বইটা পড়ছিলাম।” ইন্দ্রদার দৃষ্টি জানালার বাইরে মাকড়সার জালটার দিকে। তখন দক্ষ কারিগরের মত মাকড়সাটা জাল অনেকটা বুনে ফেলেছে।
-“জানিস সৌম্য, মাকড়সার জাল ছিঁড়ে যাবার আগে নিজের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের পাঁচগুণ বড় হতে পারে। এই জালের আর এক নাম অর্ব। প্রথমে ঘাসের শিষ বা উঁচু বেড়ার ডগা থেকে একটা সুতো তৈরি করে এরা মুখের লালা দিয়ে। পরে ঐ সুতো থেকে অত্যন্ত টাইট সুতো লাগানো হয় যাকে জাম্পার বলে। এই সুতোতেই পোকামাকড় এসে আটকে পড়ে। জালটা থেকে সোজা আর একটা সুতো চলে যায় মাঝখানে মাকড়সার কাছে যার কাঁপুনিতে এরা বুঝতে পারে শিকার পড়েছে। আশ্চর্য! ভাবা যায় না সৌম্য। আমার গোয়েন্দা জীবনের হাজার রহস্যের থেকেও রহস্যময় এই মাকড়সার জাল। গুরুচরণ পাত্রের ব্লু ডায়মন্ড রহস্যটাও এবার ক্রমে ক্রমে জাল বুনছে… এখনও তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে।”

চলবে…

ব্লু ডায়মন্ড রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব ) একটা খুন

Author: admin_plipi