মরচে ধরা রহস্য (সপ্তম ও শেষ পর্ব )
লেখা : শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ : অনিন্দিতা রায় কর্মকার
আগে যা ঘটেছে
সোমনীল বাবুর মৃত্যু এবং মার্টিনা ক্যাম্পবেলের আবির্ভাবকে ছাপিয়ে যে প্রশ্নটা ইন্দ্রদাকে ভাবাচ্ছে তা হল ওনার সঙ্গে মার্টিনার যোগসূত্র। গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েও মার্টিনা তা নেয় না। হোটেল পর্যন্ত ধাওয়া করে জানা যায় মার্টিনা আসলে একজন ডিটেকটিভ। বাকিটা তার ডাইরি পড়লে জানা যাবে। তারপর…
৭)
মার্টিনার ডায়রি
-“ডায়রি?”
-“হ্যাঁ সৌম্য, ডায়রিটাই সব রহস্য সমাধানের মূলে।”
চারদিন পরে ইন্দ্রদার মুখে সব শুনে মরচে ধরা রহস্যটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হল। আমরা তখন ঘরের ছাদে। অমাবস্যার থিকথিকে ঘন অন্ধকারে শহরটার প্রায় কিছুই দেখা যায় না। কালো কুচকুচে দেবদাসী শাড়ির গায়ে চুমকির মত ফ্ল্যাটগুলোর আলো জ্বলছে। রাত তখন সাড়ে বারোটা। পাশাপাশি বড় বাড়িগুলো তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। ইন্দ্রদা একটা গোল্ড ফ্লেক বের করে দুই ঠোঁটের আড়ালে বেশ কায়দা করে রাখল। লাইটার জ্বেলে দুহাতের আড়ালে অদ্ভুত ওয়েস্টার্ন কায়দায় হাওয়া বাঁচিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে বলতে শুরু করল, “সোমনীল বাবু ছিলেন খুব বিখ্যাত গায়ক। একটা ইংলিশ সিনেমার গানের প্রোমোর জন্য ওনাকে আমেরিকা যেতে হয়। সেখানে জুলিয়া বলে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয় ওনার। ওনার মৃত্যুকালীন ‘জুল’ শব্দটা জুলিয়াকেই বোঝানো হয়েছে। আমেরিকাতেই ঐ জুলিয়ার সাথে বিবাহ হয় সোমনীলবাবুর। দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক দিকগুলোতে সুখের অন্ত ছিল না। ওনার এক কন্যাসন্তান হয় যার নাম রাখেন বিদেশী নামেই ‘মার্টিনা’।”
-“তার মানে সোমনীলবাবুর মেয়ে মার্টিনা?”
-“হ্যাঁ। মার্টিনা বড় হতে থাকে। তার সঙ্গে মায়ের মুখের হুবহু মিল ছিল। মার্টিনার বয়স যখন ছ বছর তখনই সুখের সংসার হয়ে যায় ওলোটপালোট। সোমনীল বাবু স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে ইণ্ডিয়া চলে আসতে চান। কিন্তু স্ত্রী জুলিয়া তা মানতে নারাজ। জুলিয়া ছিল বেশ উগ্র ওয়েস্টার্ন কালচারের মহিলা। রাত করে বাড়ি ফিরত। অসম্ভব ড্রিঙ্ক করত। মোটামুটি হাজার চেষ্টা করেও সোমনীল বাবু ওনার বেপরোয়া স্ত্রীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন না। সেদিনটা ছিল এমনই এক গভীর রাত। সোমনীল বাবু ওনার মেয়ে মার্টিনাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছেন। হঠাৎ দরজা ঠেলে জুলিয়া ঘরে ঢুকল প্রায় টলতে টলতে। নেশার ঘোরে সোমনীল বাবুকে যা তা বলতে শুরু করল নিজের মেয়ের সামনেই। হৃদপিণ্ডটা তখন ওনার লাগামছাড়া ঘোড়ার মত লাফাচ্ছিল। ভেতরের অসম্ভব রক্তচাপে মাথার শিরাগুলো টনটন করে উঠছিল। উনি আর সহ্য করতে পারেন নি। ড্রয়ার থেকে রিভলবারটা বের করে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। জুলিয়া তখন পেছোতে পেছোতে বারান্দার রেলিঙের ধারে চলে এসেছে। নিজের উপর ভারসাম্য হারিয়ে সোমনীল বাবুর রিভলবারের গুলিটা বের হবার আগেই রেলিং থেকে পড়ে যায় জুলিয়া। সঙ্গে সঙ্গে স্পট ডেড। নাবালিকা মার্টিনা চিৎকার করে ওঠে। সেই রাতেই ভারতে ফিরে আসেন সোমনীল বাবু। আর স্বার্থপরের মত ভুলে যান ফুটফুটে কন্যা মার্টিনার কথা। অনাথ মার্টিনার কথা আদালত বিশ্বাস করে না। জুলিয়ার মৃত্যু সুইসাইড হিসেবেই আদালতে চাপা পড়ে যায়। ছোট্ট মার্টিনা যখন একদিকে অনাথ আশ্রমে জীবনের উন্নতির সাথে পাঞ্জা লড়ছে তখন একদিকে ভারতে সোমনীল বাবু দ্বিতীয় বিবাহ করেন আর এক পুত্রসন্তান বিপিনের জন্ম দেন। কেটে যায় কয়েকটা বছর। মার্টিনা যুবতী হয়। আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেয় সে উপযুক্ত যোগ্যতার সাথে। কিন্তু মনে মনে তার ছিল যে, সে একদিন বাবার অপরাধের প্রতিশোধ ঠিক নেবে। তাই ভারতে চলে আসে মার্টিনা। যুবতী মার্টিনা তখন জুলিয়ার মত অবিকল একই দেখতে। সেই রাতে তাই জুলিয়া সেজে সোমনীলবাবুকে ভয় দেখাতে যায় মার্টিনা। কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি সে কল্পনা করতে পারেনি। হাজার হোক নিজের বাবা তো। মার্টিনা আমার কাছে গুপ্তধনের লোভে এসেছিল তা নয়। আসলে সে সব ভারতীয়কেই ঘৃণার চোখে দেখত। আমি গুপ্তধনের সংকেত সমাধান করতে পারব কিনা তা পরখ করে দেখতে চেয়েছিল মার্টিনা।”
-“কিন্তু ইন্দ্রদা, এ সবই কি ঐ ডায়রির তথ্য?”
-“বললাম না, আমার অনুমানের সাথে বাস্তবটা এমন খাপ খাবে বুঝতে পারিনি। মিস মার্টিনা যে একজন ডিটেকটিভ সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, যেদিন ও রিভলবার নিয়ে প্রথম আমাদের ঘরে আসে। কিন্তু আমেরিকা থেকে ভারতে আসার কারণটা তখন মগজে আসেনি। ও যখন সাইড ব্যাগ থেকে গুপ্তধনের সংকেতটা বের করছিল তখন একটা প্যাডের মত ডায়রি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। আমি সেটা কুড়িয়ে ওর হাতে দিয়েছিলাম। তোর নজর এড়ালেও প্যাডের ওপর একটা ছোট্ট লেখা ‘আমেরিকান ক্রাইম ব্রাঞ্চ’ আমার নজরে এসেছিল। তলায় লেখা ছিল একটা ফোন নম্বর। নাম্বারটা তোকে নোট করতে বলেছিলাম। পরে ঐ নাম্বারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মার্টিনা আসলে একজন ডিটেকটিভ। সোমনীল বাবুর হারমোনিয়ামের গুপ্ত জায়গায় যে ফটোটা পেয়েছিলাম ওটা ছিল মিস জুলিয়ার যার নাকে দুল ছিল। কিন্তু মার্টিনার নাকে সেরকম কোনো চিহ্নই পাইনি।”
-“আর ইন্দ্রদা, মার্টিনাই যে পাঞ্জাবী ড্রাইভার সেজে এসেছিল তা বুঝলে কি করে?”
-“সেটা বুঝেছিলাম ওর হাতের রুমাল দেখে। সেদিন গাড়িতে যখন হাতের ঘাম মুছছিল তখন রুমালের এককোণে মার্টিনার নামের প্রথম অক্ষর ‘এম’ লেখা দেখেছিলাম। এরকম রুমাল আমি আগেও দেখেছিলাম নার্সিং হোমের পর্দার আড়ালে, যখন মার্টিনা ছদ্মবেশে গিয়ে রুমাল দিয়ে চোখের জল মোছার ভান করছিল।”
মরচে ধরা রহস্যের সমাধান হতেই মাথার উপর আকাশটা দ্রুত মুড়ে গেল। নিকষ কালো ভয়ংকর আকাশটাকে আড়াআড়ি চিরে ঝিলিক দিয়ে গেল বিদ্যুৎ। আমরা ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম।
সমাপ্ত