অদ্ভুত ভালবাসা

 

 

মাধ্যমিকের  পর আজ প্রথম স্কুলে  যাব৷ নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা  কেমন হবে এসব ভাবতে ভাবতে কাল সারারাত ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি৷ প্রথম দিন স্কুলে এসে আমার নাজেহাল অবস্থা৷ এতবড় স্কুলে নিজের ক্লাসরুম খুঁজে পাচ্ছিলাম  না৷ যতক্ষণে পেলাম ততক্ষণে টিচার চলে এসেছেন৷ কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে অবশেষে ফাস্ট বেঞ্চে দুজন মেয়ের পাশে বসলাম৷ ওদের নাম জিজ্ঞাসা করলাম৷ একজনের নাম আরুহি অন্য জনের নাম শ্রেয়া৷ ওহো দেখেছেন তো এতক্ষণ ধরে বকবক করছি অথচ আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি৷ আমি হলাম সূর্য্য চৌধুরি৷ বাবা-মার একমাত্র সন্তান৷ বাড়ীর সকলের খুব আদরের৷ অারুহি আর শ্রেয়াও মা-বাবার একমাত্র সন্তান৷ ওদের আরো একজন বন্ধু আছে যে কলাবিভাগে ভরতি হয়েছে৷ ওর নাম শ্রেয়ান৷ ওর মা নেই, ছোট থেকেই হস্টেলে মানুষ হয়েছে৷ তবে খুব মিশুকে৷ আমরা তিনজন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ায় আমাদের রোজই দেখা হত, কথাও হত৷ শ্রেয়ানের সাথে কম দেখা হত৷ তাই আমরা সপ্তাহে একদিন সবাই মিলে দেখা করে খুব মজা করতাম, আড্ডা দিতাম৷ আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছিলাম৷ আমরা একে অন্যকে ছাড়া থাকতেই পারতাম না৷ একদিন আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম তখনই অারুহি এসে বলল স্কুল থেকে এবছর পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হবে৷ আমাদের তো শুনে বেশ ভালই লাগল৷ এই প্রথম একা একা কোথাও ঘুরতে যাব তাও আবার নিজের বন্ধুদের সাথে৷ আর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই আমাদের পিকনিক৷ নির্দিষ্ট দিনে সবাই রওনা দিলাম৷ জায়গাটা বেশ ভাল, গ্রাম্য পরিবেশ আছে, পাশে একটা ছোট খাট মাঠও আছে৷ ওখানে সবাই মিলে ক্রিকেট খেলা হল৷ তারপর আরও অনেক রকম খেলা হল৷ তারপর শ্রেয়ান  বলল Truth & dare খেলবে৷ প্রথমে সবাই না বললেও পরে সবাই খেলতে রাজি হল৷ খেলার শুরুতেই আমার পালা পড়ল। truth নেব নাকি dare নেব৷ আমি বললাম truth নেব৷ শ্রেয়ান বলল ও আমাকে প্রশ্ন করবে৷ তখন তো আর জানতাম না ও এরকম প্রশ্ন করবে৷ জানলে কখনো truth নিতাম না৷ ও আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কাকে ভালবাসি। শ্রেয়া নাকি অারুহি৷ এরকম একটা প্রশ্ন আমি আশা করিনি৷ অারুহি-কে মনে মনে পছন্দ করি ঠিকই কিন্তু একথাটা আমি ওকে ওর জন্মদিনের দিন বলতে চেয়ে ছিলাম৷ এখানে এইভাবে বলতে হবে ভাবিনি৷ শ্রেয়া আমার কাছে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই না৷ আমার বলা শেষ৷ এরপর আবার আর একজনের পালা৷ এভাবে খেলা এগিয়ে চলল৷ কখন যে খাওয়ার সময় এসে গেল বোঝাই গেল না৷ আমরা সবাই খেতে চলে এলাম৷ একটা ব্যাপার অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম যে শ্রেয়া হঠাৎ করেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে৷ রাতে ঠিক করে খেলো না৷ আমাদের একজন শিক্ষিকার বাড়ি কাছাকাছিই থাকায় আমরা সেই রাতটা তার বাড়িতেই রইলাম৷ পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ব৷ এরপর সবাই শুতে চলে গেলাম৷ ছেলেদের জন্য একটা ঘর আর মেয়েদের জন্য একটা ঘর দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর সকালবেলা সবাই ঘুম থেকে ওঠে মুখ ধুয়ে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম৷ এমন সময় শ্রেয়া এসে জিজ্ঞেস করল অারুহি কোথায়? আমি ওকে দেখেছি কিনা৷ আমি তো ভেবেছিলাম ও শ্রেয়ার সাথেই আছে কিন্তু শ্রেয়ার কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম৷ এই অচেনা জায়গায় কাউকে কিছু না বলে ও কোথায় গেল। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম শ্রেয়ানও নেই৷ ওই বা সাতসকালে কোথায় গেল৷ ওকেও কেউ সকাল থেকে দেখেনি৷ সবাই মিলে খুঁজতে শুরু করলাম৷ আশেপাশের লোকদের ওদের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেউ দেখেছে কিনা৷ কেউ কিছু বলতে পারল না৷
এইভাবে চার-পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষার পর ওরা ফিরে এল৷ সবাই মিলে জিজ্ঞেস করলাম এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে ওরা এতক্ষণ কোথায় ছিল৷ অারুহি কোনো উওর দিল না৷ শ্রেয়ান বলল ওরা সকালে হাটতে বেড়িয়ে ছিল৷ ফেরার সময় পথ হারিয়ে ফেলায় আসতে দেরি হল৷ এরপর আর কেউ কথা বাড়ালাম না৷ এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছিল তাই তাড়াতাড়ি সবাই বাসে উঠে পড়লাম৷ বাসে আবার গানের লড়াই খেলা শুরু হল৷ সবাই একে একে গান করল৷ টিচার্সরাও গলা মেলালেন আমাদের গানের সাথে৷ সব মিলিয়ে ভীষণ মজা হল৷ আমরা যেমন মজা করতে করতে এসে ছিলাম ওরকম আবার ফিরেও যাচ্ছি৷ এই পিকনিকটা সারাজীবন আমাদের কাছে একটা মধুর স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে৷ এরপর ফিরে এসে আমরা যে যার মত পড়াশুনোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম৷ কারণ সামনেই আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা ছিল৷ আড্ডাও আর দেওয়া হত না আগের মত, দেখাও কম হত৷ দেখতে দেখতে রেজাল্ট বেড়িয়ে গেল৷ আমরা সবাই মোটামুটি ভালই রেজাল্ট করেছিলাম৷ এরপর ক্লাস শুরু হয়ে গেল, সামনের বছর HS পরীক্ষা, তাই স্কুলেও কম আসতাম৷ শুধুমাএ প্র্যাকটিকালের দিনগুলো আসতাম৷ একটা ব্যাপার অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম যে শ্রেয়া আর আগের মত আমার সাথে কথা বলে না৷ অারুহি-কেও আজকাল শ্রেয়ানের সাথেই বেশী দেখা যায়৷ প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে পারিনি, পরে যখন নিজের চোখে দেখেছিলাম ওদের পার্কে হাত ধরাধরি করে বসে থাকতে তখন বুঝেছিলাম ওরা শুধু বন্ধু না তার থেকেও বেশী কিছু৷ আমাদের সেই বন্ধুত্বটা যে আর নেই সেটা ভালই বুঝতে পেরেছিলাম৷ নাহলে ওদের রিলেশনের  ব্যাপারটা আমাকে বলত৷ দেখতে দেখতে HS পরীক্ষাও দেওয়া হয়ে গেল৷

এরপর আমার জয়েণ্টের পরীক্ষা থাকায় আমার আর কারোর সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি৷ রেজাল্ট বেরোনোর পর সবাই যে যার মত কলেজে ভরতি হয়ে গেল আর আমি জয়েণ্টে সুযোগ পেয়ে বাইরে চলে গেলাম ডাক্তারি পড়তে৷ কিভাবে যে পাঁচ বছর কেটে গেল বুঝতেই পারিনি৷ ফিরে এসে দেখলাম আশপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে৷ এখানে এসে একটা হসপিটাল জয়েন করলাম৷ একদিন বাড়ী ফেরার সময় রাস্তায় হঠাৎ শ্রেয়ার সাথে দেখা৷ ও তো এত বছর পর আমাকে দেখে চিনতেই পারেনি৷ তারপর দুজনে একটা কফিশপে বসে অনেকক্ষণ কথা বললাম৷ পুরনো বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করলাম৷ শ্রেয়ান আর অারুহির কথা জিজ্ঞেস করলাম৷ ও বলল B.sc করার পর অারুহির বাবা-মা ওর বিয়ে দিতে চাইলে ও বাড়ীতে শ্রেয়ানের কথা বলে। ওর বাবা-মা মেনেও নেয়৷ সবকিছু ঠিকই ছিল যদি না সেদিন ওই ফোনটা আসত৷ সেদিন অনেক দেরী হয়ে যাওয়ায় শ্রেয়ার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা আর জানা হয়নি৷ পরে একদিন দেখা করব বলে একে অন্যের ফোন নম্বর নিয়ে বাড়ি চলে এসে ছিলাম৷ এর মধ্যে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আর দেখা করা হয়ে ওঠেনি৷ কাজের চাপ কমতেই শ্রেয়াকে ফোন করে দেখা করতে বলি৷ নিদিষ্ট দিনে চলেও যাই কফিশপে দেখা করতে৷ আমি গিয়ে দেখলাম ও আমার আগেই এসে গেছে৷ দুটো কফি অডার্র দিয়ে কথা শুরু করলাম৷ ওকে বললাম “আগের দিন ফোনকলের ব্যাপারে কি যেন বলছিলিস”৷ ও যা বলল সেটা শুনব বলে আমি আশাই করিনি৷ সেদিন সবাই মিলে শপিং করার পর ওরা ঠিক করে বাইকে করে ফিরবে৷ ওদের এই প্রস্তাবে অারুহির বাবা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হন৷ কিন্তু ওনারা  ফিরে এলেও ওদের আসতে দেরী হওয়ায় ফোন করেন৷ প্রথমে ফোন না ধরলেও পরে ফোন ধরে৷ কিন্তু সেটা অন্য কেউ৷ ওর বাবা প্রথমে বুঝতে পারেননি৷ পরে বুঝতে পারেন কত বড় বিপদ হয়েছে৷ আমাদের কথার মাঝে ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল৷ শ্রেয়া এক চুমুক কফি খেয়েই আবার বলতে শুরু করল৷ ও বোধহয় আমার ভেতরের অস্থিরতাটা বুঝতে পেরেছিল তাই কফি শেষ না করেই বলতে লাগল৷ সেদিন যে লোকটা ওদের ফোন ধরেছিল সেই ওনাদেরকে বলে যে ওদের বাইক-কে একটা লরি ধাক্কা মেরেছে৷ আর ওদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ ওনারাও তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসেন৷ কিন্তু ডাক্তার বলেন শ্রেয়ানের অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে আর অারুহির মাথায় খুব গুরুতর চোট লেগেছে৷ ও যেন কোনভাবেই এই মৃত্যুর খবরটা না জানতে পারে তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ ওর আর ঘটনাটা জানা হয়নি কারণ মাথায় এতটাই চোট লেগেছিল যে ও কোমায় চলে গেছিল৷ আজও ও হাসপাতালে জ্যান্ত লাশের মত শুয়ে আছে৷ সেদিনের সেই ঘটনা অারুহির জীবনটা এক লহমায় পুরোটা বদলে দিয়ে ছিল৷ সব শোনার পর বললাম একবার ওকে দেখতে চাই৷ শ্রেয়া বলল ও আমাকে নিয়ে যাবে৷ সেদিনের পর থেকে নিজের কাজে আর মন বসাতেই পারছিলাম না৷ বারবার শুধু অারুহির কথাই মনে পড়ছিল৷ এরপর একদিন শ্রেয়ার সাথে অারুহিকে দেখতে গেলাম৷ ওকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল৷ কোনোদিন ভাবিনি নিজের ভালবাসার মানুষটাকে এইভাবে দেখব৷ বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারিনি ,ছুটে বেড়িয়ে এসেছিলাম৷ এরপর থেকে মাঝে মাঝে আমি আর শ্রেয়া গিয়ে হাসপাতালে ওকে দেখে আসতাম৷ একদিন শ্রেয়া আমাকে জোর করে ওর বাড়ী নিয়ে গেল৷ আমাকে ওর ঘরে বসতে বলে নীচে চলে গেল৷ আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম৷এভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হঠাৎ করে টেবিলের ওপর ওর ডাইরি দেখতে পেলাম৷ ভাবলাম পড়ে দেখি যদি ওর ব্যাপারে কিছু জানা যায়৷ এমনিতেও কোনোদিন ওর ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি৷ তারপর ভাবলাম যদি কিছু মনে করে ওকে না জানিয়ে পড়েছি বলে৷ শেষমেষ ঠিক করলাম পড়েই ফেলি৷ পড়তে পড়তে খেয়াল করিনি ও কখন চলে এসেছে৷ ও আসতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম আমাকে যদি এতই ভালবাসত তাহলে কোনদিন বলেনি কেন৷ ও বলল “কি হত তোকে বললে, তুই তো অন্য কাউকে ভালবাসতিস৷ আমি তো তোর কাছে শুধুই বন্ধু, আর তো কিছু না৷ “এতবছর পর বুঝতে পারলাম পিকনিকে আমার উওর শোনার পর কেন ও চুপচাপ হয়ে গেছিল৷ ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বললাম, “তখন কি করতাম জানি না কিন্তু আজ কি করব জানি৷” ওকে জিজ্ঞেস করলাম কোনদিন তো তোর প্রেমিক হওয়ার সুযোগ দিলি না, তোর স্বামী হওয়ার সুযোগ দিবি? ও লজ্জা পেয়ে নীচে চলে গেল৷ আমিও তারপর বাড়ি এসে বাবা-মাকে বললাম যে আমি শ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাই৷ রাতে বসে বসে ভাবছিলাম সত্যিই ভালবাসা বড়ই অদ্ভুত জিনিস৷ আমি এতদিন অারুহি-কে ভালবাসতাম অথচ ও কোনোদিনই আমাকে ভালবাসে নি৷ আর অারুহি যাকে ভালবাসল সেই ওর জীবনে এল ক্ষণিকের অতিথি  হয়ে৷ আর অন্যদিকে শ্রেয়া যে আমাকে এত ভালবাসে সেটাই কখনো বুঝতে পারিনি৷ সব শুনে বাবা-মা তো ভীষণ খুশী৷ পরের দিনই বাবা-মা শ্রেয়ার বাবা-মার সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ ঠিক করে এলেন৷ একটা শুভ দিনে আমাদের চার হাত এক হয়ে গেল৷ এইভাবেই শুরু হল নতুন আর এক ভালবাসার গল্প৷

 

লেখাঃ সুদেষ্ণা

ছবিঃ কুণাল

 

Advut Bhalobasa    |     Sudeshna     |    Kunal    |     www.pandulipi.net     |    Emotional     |     Bengali     |     Stories     |      Love Story

Author: admin_plipi