নৈশ অভিযান
কলমে – শুচিতা
ছবি – নিকোলাস
আমার বাবা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন, সে কারণে এক-দুবছর বাদে বাদে বদলি হতেন। আমাদের ছোটবেলাটা তাই খুব মজার ছিল। কখনো পাহাড়ে, কখনো সমুদ্রে, আবার কখনো অভয়ারণ্যে, বাঁকুড়া-পুরুলিয়া, শুশুনিয়া পাহাড়, বেলিয়াতোড়, বড়জোরা- সব নিয়ে বড় হওয়া। খুব বৈচিত্র্যময় ছিল ছোটবেলাটা আমাদের।
নতুন জায়গা, নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস, নতুন বন্ধু- ভারী মজা লাগত। তবে কষ্টও ছিল সব ছেড়ে আসার। স্কুল ছাড়া বাইরের কোনো বন্ধু আমাদের ছিল না। ভাইবোনেরাই আমরা খেলার সাথী ছিলাম। খেলা মানে সাইকেল রেস, পুতুল বিয়ে, রান্না বাটি, মাকে না বলে জঙ্গলে ঘোরা, পোষা হাতীর বাচ্চার সাথে পাথর ছুঁড়ে খেলা। আর সাথী ছিল পাখি, হরিণ, বানর, এরা। একবার কোয়ার্টারের পেছন থেকে তুলে এনেছিলাম বাঘের বাচ্চা, পুষবো বলে। বাঘের বাচ্চার গল্পটা বেশ মজার, অন্য সময় বলবো। আজ বলবো অভয়ারণ্যে এক রাতের ভয়ানক অভিযানের কথা, যা আজও ভুলতে পারি নি।
বাবা তখন জলদাপাড়া রিজার্ভ ফরেষ্টে আছেন। মা আমাদের নিয়ে বেলাকোবায় থাকেন। ওখানকার স্কুলে ভর্তি হয়েছি। অপেক্ষা করছি কবে গরমের ছুটি পড়বে আর বাবার কাছে যাব। খবর এলো ছুটিতে তোমরা কেউ এখানে আসবে না, কারণ বাবা জলদাপাড়া থেকে ১৮কিমি দূরে একটা স্পেশাল ডিউটিতে আছেন। ওটা জলদাপাড়ার অংশ, নাম বিজনবাড়ি।
খবর পেয়ে সবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আসলে গ্রামে থাকতে আমাদের ভাল লাগত না। মা বললেন, “বাবার কাছে যাবি?” সবার আগে আমি চেঁচিয়ে বললাম, “যাব যাব। কিন্তু বাবা যে মানা করেছেন!” মা বললেন, “তোর বাবাকে আমরা সারপ্রাইজ দেব।” দিদি বললো, “মা, অচেনা জায়গা, অজানা রাস্তা, আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?” মা বললেন, “খুব পারবো।” তারপর নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি রিজার্ভ করে মা আমাদের নিয়ে রওনা হলেন।
রওনা হতে আমাদের দেরী হয়ে গেল। ফালাকাটা থেকে জলদাপাড়ার রাস্তার যখন মাঝামাঝি পৌঁছে গেছি, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। রাস্তার পাশে একজন নেপালী ভদ্রলোক বসে ছিলেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন রাস্তা থেকে ঐ দূরের জঙ্গলটাই হচ্ছে বিজনবাড়ি ফরেস্ট। বাবার নাম বলাতে চিনলেন, বললেন, “বড়বাবু তো নতুন এসেছেন।” মা পরিচয় দিলেন। নেপালী ভদ্রলোক আমাদের ওখানেই নামতে বললেন। ওনার বাড়ি রাস্তার পাশেই। আমাদের বসতে দিয়ে বললেন, “আপনারা কি করে এখন যাবেন, অন্ধকারে জঙ্গল দিয়ে? মা বললেন, “পারবো, আপনি সাথে দু’এক জন লোক দিন।” ভদ্রলোক ওখানকার আদিবাসী চারজন লোক ঠিক করে দিলেন। ওরা মশাল জ্বালিয়ে আমাদের ব্যাগপত্র পিঠে নিয়ে নিল। যখন সবাই রওনা হলাম তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভদ্রলোক বললেন, “বড়রাস্তা দিয়ে এখন যাওয়া যাবে না।” আদিবাসী লোকেরা বললো ওরা একটা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে। তবে এখানেও হাফ কিমি মত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। খুব সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গলে ঢোকার মুখে ঐ চারজন মশাল নিয়ে চারদিকে দাঁড়াল আর আমাদের বললো, “তোমরা আগুনের মাঝখানে থাকবে।”
আমাদের সেই ভয়ানক অভিযান শুরু হল। জঙ্গলে ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠলো। কি ঘন অন্ধকার- কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না! মনে হল আমরা কোনো অন্ধকার গুহায় ঢুকে যাচ্ছি। শুধু মশালের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পথ দেখা যাচ্ছে, সেটা ধরে ওদের সাথে হাঁটতে লাগলাম। ঝিমধরা ঝিঁঝিঁপোকার একটানা ডাক, কতরকম পশু পাখির আওয়াজ শুনতে শুনতে এগোচ্ছি। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি হাজারো জোনাকি জ্বলছে নিভছে। ভয়ে ভয়ে মনে হল ওর মধ্যে কোনোটা বাঘের চোখ নয় তো? লোকগুলো শুধু তাড়া করছে, “মাঈজী, তাড়াতাড়ি জঙ্গল পার হতে হবে।” ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ওদের সাথে আমরাও ছুটতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল মশালের আলোর পেছনে ঠিক যেন বাঘ ওৎ পেতে আছে, যেকোন মুহূর্তে আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। বাবার কাছে আসতে গিয়ে বাঘের পেটে যাব নাকি? বাবাকে জানিয়ে এলে তো বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এই বাঘ-হাতীর জঙ্গলে রাতে কেউ ঢোকে! এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। লোকগুলো চেঁচিয়ে বললো, “ঐ যে, বড়বাবুর অফিস।” সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আর ভাবলাম এযাত্রায় তবে বেঁচে গেলাম।
মার এই দুঃসাহসের কবলে শুধু আমরা না, বাবাকেও অনেকবার পড়তে হয়েছে। তাই তো এক এক সময় মাকে মনে হত, মা নয়তো যেন ঝাঁসীর রানী!