ফেব্রুয়ারি মাস পড়লেই দৈনন্দিন জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন হলুদ সর্ষে ক্ষেতে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ম্যান্ডলিনের সুরটা বেজে ওঠে। চারিদিকে প্রেম-প্রেম ভাব, লাল গোলাপের সমাগম। আমারও তাই প্রেম পেয়ে গেল। প্রেম নিয়ে দু-চার কথা।
প্রেম ও চরিত্র। শব্দ দুটো সাবলীল, নিজস্ব আত্মমর্যাদা রয়েছে এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু কোনো কারণে কোথাও কেস খেলে এরা একে অপরকে তুমুল তুলোধনা করতে একবিন্দু পিছপা হয়না। যেমন ধরুন নিখিলের কেস টা। ছোট থেকে বরাবর সে প্রেমকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, মেয়েদের সাথে কথা পর্যন্ত ঠিকঠাক বলেনি, আর অহেতুক বন্ধু-বান্ধব মদ-সিগারেট থেকে নিজেকে শত হস্ত দূরে রাখত। তা এই নিখিল বিয়ে করল এবং রক্তের স্বাদ পেল। তারপর বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম এ জড়িয়ে পড়ল। এবারে সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল চরিত্র বাবাজির উপর। আপনারাই বলুন, মাত্র একবছর আগেই নিখিলের চরিত্রই ছিল সমাজের আদর্শ, তা হঠাৎ কি হল? প্রেম দাদা প্রেম, বড়ই কঠিন বস্তু।
এই প্রেম কখন পিরিত হয়ে ওঠে? পিরিত প্রেমেরই একটি বিশেষ পর্যায় যা সবার দ্বারা হয়না। একটি কেস স্টাডি দেখুন। লোকাল ট্রেনে একজোড়া অবিবাহিত কাপল রয়েছে। তাদের গড় বয়স ও উচ্চতা প্রায় সমান। তা একটি কাপল সমানে জানু, সোনা, বাবু সহযোগে একে অপরের উপর ঝুঁকে-হেলে-ঢলে কথা বলে চলেছে। অন্য জোড়াটি কথা বলছে ঠিকই কিন্তু টা বেশ মার্জিত ও রুচিশীল। কামরার যাত্রীরা সকলেই প্রথম জোড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে, এক মাসিমা গোছের মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, “কি পিরিত বাপু মাইরি!”
অফিসে বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর কাজকর্ম কিছুটা লঘু হয়ে আসে। আমরা কিছু সমবয়সী ও অসমবয়সী কলিগরা মিলে ডেস্ক থেকে চেয়ারগুলো টেনে আড্ডা-আলোচনায় মশগুল হই। তা সেই আলোচনায় উঠে এল ‘প্রেমের বিভিন্ন প্রকারভেদ।’ খালি চোখে দেখলে, প্রেম সরাসরি দুই প্রকার, শারীরিক ও মানসিক। প্রথম পর্যায়ে সবই মানসিক থাকে যা ধীরে ধীরে সমাজের নিয়মে শারীরিক হয়ে ওঠে। আর মানসিক প্রেমের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো পিতা-মাতার সন্তান বাৎসল্য, যে প্রেমের কোনো তুলনা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আছে বলে আমার জানা নেই। এই মানসিক প্রেম নিয়ে ভাবতে বসলে রবিবাবু আর কাদম্বরী দেবীর কথা অনিবার্য ভাবে উঠে আসে, কিন্তু তা কি শুধুই প্লেটোনিক ছিল। থাক, বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। বরং এবারে অণুবীক্ষণ যন্ত্র টেনে নিয়ে প্রেম কে বিশ্লেষণ করা যাক।
ফেসবুক-হোয়াটসআপ-স্নাপচাট-টিন্ডার এর ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রেম অনিবার্য ভাবে শরীর খোঁজে আগে, মন সে না পেলেও চলবে। শরৎবাবু এ যুগে থাকলে ভারী সুন্দর কিছু উপন্যাস পেতাম আমরা। এই দেখুন না, তৃণা ও সুরজিতের কেসটা। দুজনেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। উইক এন্ডে সল্টলেকের এক পানশালায় বার-কাউন্টার এ দুজনের পরিচয়। ভালোবাসা ছিল কিনা জানা নেই, তবে শরীরের অমোঘ আকর্ষনের হাতছানিতে তৃণা কিছুদিন পর সন্তান-সম্ভবা হয়ে পড়ে। তখন ভ্রুণ হত্যা ছাড়া আর উপায় কি। এসব ঘটনাবলীর পর তৃণা বুঝতে পারে, কোথাও একটা ঠিক হচ্ছে না। সুরজিৎ যখন ধীরে ধীরে সম্পর্কে থিতু হচ্ছে, তৃণার জবাব আসে, “Look, it’s not happening between us. We should move on.” কি দাদা, প্রেম খুঁজছিলেন নাকি?
ভ্রাতৃপ্রেমে যে বেঞ্চমার্ক লক্ষণ ভাই সেট করেছেন, তা ডিঙোয় কার সাধ্যি ! নিজের স্ত্রী-পরিবার রাজপ্রাসাদের সুখ ছেড়ে দাদা-বৌদির সাথে বেমালুম বনবাসে চলে গেলেন। আজকাল নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ, সহোদর-সহোদরা প্রতি ভালোবাসাটাও তাই সীমিত হয়ে গেছে।
এবারে আসি অভিমান ও বিরহের পর্যায়ে। জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ায় স্যারের কাছ থেকে ফিজিক্স পড়ে বেরোচ্ছি, সন্ধ্যে পার হয়ে রাত ঘনিয়ে এসেছে। ছেলেটি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে, মেয়েটি ছেলেটির বুকের কাছে শার্টটা খামচে ধরে বলছে, “এতই যখন অপছন্দ, তাহলে ছেড়ে দিলেই পার।” এটা মনে হয় অভিমান। আর বিরহ দেখেছি দু-ধরনের, যেখানে প্রেমে ধোঁকার ছ্যাকা খাওয়ার পরদিন থেকে শুরু হয়, প্রেমিক-প্রেমিকার নামে কটূক্তি। বড় অপরূপ সে দৃশ্য। ‘কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে’র বিপরীত টাইপ। দুদিন আগেও যে ছিল জীবনের অন্যতম প্রধান একটি স্পৃহা, আজ সে Conjuring খ্যাত চুড়েল। আমি চিরকাল প্রেমের প্রতিকূলে সাঁতার কেটেছি, তাই এসব হেব্বি লাগে দেখতে। আর দ্বিতীয় প্রকার বিরহ একটু করুন ও বিরক্তিকর। “ভাই, আমি পারছি না থাকতে”, “আমার সব শেষ”, “জানিস, এখন কোনো কিছুই আর ভালো লাগেনা রে”, “ও চলে যাওয়ার পর থেকে, আমার পটি বন্ধ হয়ে গেছে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে আমি এই যে এত একাকিত্বের আগ্রাসন দেখাই, কোথাও যেন একটা সেতারের সুর মাঝে মধ্যেই বেজে ওঠার চেষ্টা করে। এই যেমন এবার সরস্বতী পুজোর দিন, মালবাজার পার্কে বিলা ভীড় টা দেখে মনে হলো, বয়স থাকতে এসব যদি একবার শিকেয় ছিঁড়ত।
আর কদিন পর বসন্ত আসছে, আরো একটা বসন্ত। আরো প্রেম আসুক, সফল প্রেম, দৃঢ় প্রেম। সে প্রেম যেন পিঁপড়ের এক কামড়েই কাহিল হয়ে না পড়ে। দ্রাবিড়ীয় ভঙ্গিমায় সে যেন অফ-স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিতে সক্ষম হয়, বুক চিতিয়ে একটি ভালোবাসার অমর দেওয়াল গড়ে তোলে।
কলমে – সুপ্রতিম
ছবি – কুণাল