কলমে – মুক্তা নার্জিনারী
ছবি – শৌভিক সাহা
কলকাতার মায়া কিছুতেই কাটাতে পারল না মৈত্রেয়ী। সুহাস চলে যাবার পর মেয়ে খুব জোর করছিল সিডনিতে নিয়ে যেতে, কিন্তু নিজের হাত দিয়ে তিলে তিলে সাজানো ফ্ল্যাট ছেড়ে এক পাও সে নড়বে না কিছুতেই। যে ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেয়ালে, জানালার গ্রিলে, দরজার কোণে সুহাসের সাথে কাটানো পঁয়ত্রিশ বছরের নানান মুহূর্ত জড়িয়ে আছে, সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে সিডনি যেত কি করে মৈত্রেয়ী? রিনি ওর একমাত্র সন্তান, ওকে প্রাণভরে ভালোবাসে সে, ওকে বড় করে সফল করে তুলতে মৈত্রেয়ীর তো কম ত্যাগ স্বীকার ছিল না! কিন্তু সন্তানকে যথাসম্ভব ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করাটা তো সব মা-বাবারই মূল দায়িত্ব! তাই নিজের সর্বস্ব দিয়ে রিনিকে সুখী করার চেষ্টা করেছে মৈত্রেয়ী। রিনি আজ স্বনামধন্যা ডাক্তার, সিডনিতে তিন বছরের বছরের পুঁচকে ছেলে আর নামকরা সার্জেন বর দীপেশের সঙ্গে সফল জীবন কাটাচ্ছে।
কত কথা মনে পড়ে যায় মৈত্রেয়ীর… পঁয়ত্রিশ বছর আগে উত্তরবঙ্গ ছেড়ে কলকাতার যাদবপুর এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছিল একমাত্র মেয়ের পড়াশুনার জন্য। সুহাস মন থেকে কোনোদিন কলকাতায় সেটল্ করার কথা ভাবে নি, কিন্তু মেয়ের পড়াশুনার কথা ভেবে কলকাতা শহর ছেড়ে আর ফিরতেই পারলো না গ্রামের বাড়িতে। রিটায়ার করার পর মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে গেলেও ফিরে এসেছে মহানগরের টানে। আসলে মৈত্রেয়ীর টানটাই ছিল বেশি। গ্রামেই জন্ম, বড় হওয়া, স্কুলে পড়া সব গ্রামে হলেও কলকাতার প্রতিও এক অদ্ভুত টান অনুভব করে মৈত্রেয়ী। এ যেন শেকড়ের টানকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। এ আত্মার টান যে! সুহাস বৌয়ের সব দুর্বলতা জানত বলে সব আবদার মেনে নিত হাসিমুখে।
এখন সারাদিন অখণ্ড অবসর মৈত্রেয়ীর। রান্নার জন্য একজন বৌ আসে সকাল-সন্ধ্যে, আর বাজারহাট নিজেই করে। এখন ওর একমাত্র সঙ্গী তিলোত্তমা, আসলে কলকাতায় এসে কেমন করে আস্তে আস্তে শহরটাই যেন ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। যে কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না, নির্দ্বিধায় তিলোত্তমাকে বলতে পারে। বাষট্টি বছরের মৈত্রেয়ী একদিন কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ে ওর প্রিয় তিলোত্তমাকে চিঠি লিখতে…
প্রিয় তিলোত্তমা,
তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় বয়েসে, কিন্তু তুমিই যেন আমার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু এখন, সবচেয়ে প্রিয়জন হয়ে উঠেছ ধীরে ধীরে। আসলে সমান বয়সী হলেই যে বন্ধুত্ব হয়, তা সর্বৈব মিথ্যা। নইলে তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল কি করে, বল? যখন প্রথম তোমার সঙ্গে আলাপ হল, আমি তখন কিশোরীবেলার গ্রাম্য সারল্য পেরিয়ে সদ্য যুবতী, প্রথমবার শহরে পা রেখেছি। কলেজে পড়তে এসে তোমার সঙ্গে পরিচিতি হল, ক্রমশঃ বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিলে তুমি। শহুরে জীবনের জটিলতা, ব্যস্ততা, দূষণ সবকিছুই অজানা ছিল আমার। তোমার সঙ্গে থেকে সবকিছু জানা হল।
হোস্টেলের রুমে একা একা বাড়ির কথা ভেবে যখন জল নেমে আসত চোখের কোণে, তুমিই তো মুছে দিতে পরম আদরে। মনে পড়ে, যেদিন প্রথম বৃষ্টি হল আমার শহুরে জীবনে, ভিজে জবজবে হয়ে কাঁচা আম কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম দু’জনে মিলে! হোস্টেলের ওই আমগাছটা কি আজও আছে? কতদিন যাই নি আর ওই পথে! শুনেছিলাম, হোস্টেলের পুরনো বিল্ডিং ভেঙে নাকি নতুন তৈরি করা হয়েছে। পুরনো দারোয়ান আর রান্নার মাসিরা শুনেছি আর কেউ নাকি নেই, মানে এই পৃথিবীতেই নেই! তাই তো, বেলায় বেলায় আমারও তো কম বয়েস হয় নি, তেতাল্লিশ বছর হয়ে গেল তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব। হোস্টেল ছেড়েছি বছর একচল্লিশ আগে! এই বাহ্যিক পরিবর্তনগুলো তো বড্ড স্বাভাবিক, তাই না?
তবে সময়ের সাথে সাথে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে, নইলে বাকি অনেক সম্পর্কই তো কেমন যেন আলগা কিংবা নিস্পৃহ হয়ে গেল! শহরে এসেই তো প্রথম প্রেম এল জীবনে, আবার সময়ের মায়াজালে কেটেও গেল সেই প্রেম। এখন সে কোথায় আছে কোনোদিন খোঁজ নেবার প্রয়োজনই হয় নি। আমার তো আবার ফেসবুক -টুইটার নেই যে খুঁজে বেড়াব। শুধু মেয়ে নাতির সাথে ভিডিও কলে কথা হয় বলে হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল ডুয়ো এসব আছে। তাছাড়া সুহাস আমায় সবসময়ই আগলে আগলে রেখেছে, ঠিক তোমার মতই। জীবনে ঝড় এলেও কাটিয়ে উঠেছি সুহাসের যত্নে, তোমার স্পর্শে।
আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সুহাস, ওর সঙ্গেও কিন্তু প্রথম আলাপ এই শহরে এসেই। প্রথম যেদিন ওর সাথে দেখা করতে গেলাম প্রিন্সেপ ঘাটে… সে কি দুরুদুরু বুক… সেদিনও অভয় দিয়েছিলে তুমি। তারপর, বিয়ের পর কয়েকটা বছর উত্তরবঙ্গে নিজের জেলা শহরে কাটিয়ে ফের আবার শহরে ফিরে এলাম। তোমাকে কাছে ফিরে পেয়ে আমার যে কি শান্তি! অথচ দেখো, এই শহর আমার কাছ থেকে কত কিছু কেড়েও নিয়েছে, বল? রিনির ভাইকে কেড়ে নিল! সেদিন কি তুমুল বৃষ্টি শহরে, আমার চোখের জল যেন তোমার চোখ থেকেই ঝরে পড়ছিল সেদিন। সেদিন প্রথমবার সুহাসের বুকে মুখ রেখে বলেছিলাম, “চল, এই শহর ছেড়ে চলে যাব।” কিন্তু পারলাম না… আমার ছেলে যে তোমার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে… ওকে ছেড়ে যেতে পারলাম কোথায়? এমনি করেই কত বছর কাটিয়ে দিলাম তোমার সঙ্গে। রিনি খুব জেদ করছিল সিডনি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে, তুনুর স্মৃতি ছেড়ে, সুহাসের ছোঁয়া ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে মন আমার কেঁদে উঠত যে।
আর যে ক’টাদিন দিন আছি তোমার সঙ্গেই থাকব তিলোত্তমা। যেদিন থাকবো না, তোমার কোলেই জায়গা দিও আমাকে। রিনিকে আমি বলেছি, ওসব নিমতলা- কেওড়াতলা যেন না নিয়ে যায় আমাকে, আমাকে যেন কবর দেয়। তোমাকে ছুঁয়ে থাকাতেই যে আমার শান্তি।
আজ রাখছি গো, কোনো একদিন আবার তোমাকে লিখব’খন।
ভালো থেকো।
মৈত্রেয়ী ।