বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ৯)
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায় রামুর ভোলার আশ্রয়ে। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে এই মা-মরা ছেলেটিকে নিয়ে। সন্ধ্যার যে বড় ইচ্ছে ছিল বিশ্বকে একদিন বড় মানুষ করবে। কিন্তু হায়! এখন ওর যা পরিস্থিতি, মানুষের দয়ায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে। রামু ভেবেছিল ভিন রাজ্য থেকে ফিরে নিজ গ্রামে পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাবে সে। কিন্তু তার ছিটেফোঁটা আশাও আর দেখতে পাচ্ছে না। এমনিতে স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির ছেলে রামু, এই অবস্থায় ক্ষমতাও নেই নিজের অধিকার কেড়ে নেওয়ার। যদি আজ সন্ধ্যা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো কিছুটা জোর পেত সে। ভোলার প্রতি কৃতজ্ঞতার চোখে জল আসে রামুর। এই দুর্দিনে ছেলেবেলার বন্ধু ওকে আশ্রয় দিয়েছে। আবার কিছুদিন গোয়ালঘরে থাকার পর ঠাঁই মিলেছে ভোলার পাশের ঘরটিতে। ছেলেটা বড় চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, সব সময় মনমরা হয়ে বসে থাকে। খুব একা হয়ে গেছে বিশ্ব। দুপুরে খাবার পর ভোলা রামুকে নিয়ে ওদের ক্লাবে যায়। আজ ক্লাব থেকে গ্রামের গরিবদের কিছু ত্রাণ দেওয়া হবে। রামু ভোলার সাথে কাজে হাত লাগায়। এ যে অনেক পুন্যের কাজ… এই বিপদের দিনে মানুষই তো মানুষের জন্য করবে।
ভোলা রামু কে আশ্বাস দিয়েছে, ছোট ভাইয়ের মত যদি রামু ওর কাছে থেকে যায় কোন অসুবিধা নেই। সংসারে তো ঐ এক বুড়ি মা আর বুড়ো বাবা ছাড়া ওর আর কেউ নেই তাই রামু যদি ওর ভাইয়ের মতো ওর সাথে থেকে ওর সাথে কাজ করে ভোলার কোন আপত্তি নেই ।
ভোলার আন্তরিকতায় রামু মনের জোর পায়। ভোলার কাছে থেকেই ওকে কাজের চেষ্টা করতে হবে যাতে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারে। তারপরে অসুখ কমে গেলে ছেলেটার জন্য ওকে কিছু ব্যবস্থা করতে হবেই। মৃত্যুশয্যায় সন্ধ্যাকে কথা দিয়েছে রামুকে মানুষ করবে বড় মানুষ। তার জন্য ভেঙ্গে পড়লে চলবে না ওকে। উঠে দাঁড়াতে হবে। ভোলা বলছিল ওর একটা টোটো পড়ে আছে, তেমন ব্যবহার হয় না কারণ ওকে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয় ক্লাবের কাজে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রামু সেটা চালাতে পারবে। রামুর অবশ্য অভ্যাস আছে অটো চালানোর। দিল্লিতে যে মালিকের কাছে ওদের কাজ ছিল সে দু-একবার প্রয়োজনে রামুকে নিজের অটো চালাতে অনুমতি দিয়েছিল। সে সময় রামুর হাতে খড়ি হয়েছে। তাই রামু মনে মনে ঠিক করে ভোলার টোটো চালিয়ে ওকে কিছু কাজ করতে হবেই। কিন্তু লকডাউন তো বেড়েই চলেছে দিন দিন। কবে পারবে টোটো নিয়ে রাস্তায় বেরোতে, চিন্তায় ঘুম আসেনা রামুর।
বিশ্ব বাবার মতো শান্ত, যে যা বলে সব কথা শোনে। তাই ভোলার মা কিছুদিনের মধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছে এই মা-মরা ছেলেটিকে। ঠাকুমার হাতে হাতে অনেক কাজ করে দেয় বিশ্ব। ভোলার মায়ের মায়া পড়ে গিয়েছে ছেলেটির উপর। সেদিন বারান্দায় বসে সবজি কাটছিল ভোলার মা আর বিশ্ব আপন মনে খেলছিল। এমন সময় পাশের বাড়ির বউ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “খুড়িমা জানো, ওদিকে ক্লাবে খুব গোল শুরু হয়েছে ভোলাদা কি ক্লাবে গেছে?”
-“হ্যাঁ, মা এই তো কিছুক্ষণ আগেই ওরা গেল। কদিন ধরেই যাচ্ছে। কি হলো আবার?”
-“দিদা, আমি এক দৌড়ে দেখে আসব?”
-“না না বাছা, তোর এর মধ্যে যাবার দরকার নেই। বাচ্চা ছেলে তুই, আমি দেখি।”
ওদিকে ভোলারা যখন গরিবদের হাতে ত্রাণ তুলে দিচ্ছিল ওই দলে পাশের গ্রামের হরিও ছিল। ও দুদিন আগে মধ্যপ্রদেশ থেকে ফিরেছে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে। গায়ে জ্বর নিয়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। ও করোনা নিয়ে এসেছি এই আতঙ্কে লাইনে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তার থেকেই হাতাহাতি গণ্ডগোলের সূত্রপাত। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে হরিকে তুলে নিয়ে যায় কোয়ারেনটিন সেন্টারে। যারা সেখানে ছিল সবাইকে বাড়ি ফিরে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয় পুলিশ। রামুরা আবার ফিরে আসে। হরির যদি করোনা ধরা পড়ে তবে ওদের সবারই ভয় থাকছে এ রোগের। রামুর মুখ শুকিয়ে যায়। রামু তুলে দিয়েছিল হরির হাতে খাবার। ভোলা অবশ্য ব্যাপারটা তেমন আমল দেয় না।
-“আরে ভাই, আমাদের কিছু হবে না। এত চিন্তা করিস না।”
ভোলা বরাবরই খুব সাহসী, কিন্তু রামুর বুক দুরুদুরু করে। যদি কিছু হয় তবে ছেলেটাকে তো অনাথ হয়ে যেতে হবে।
চলবে …