মরচে ধরা রহস্য (পর্ব ৩ )
লেখা : শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ : অনিন্দিতা রায় কর্মকার
আগে যা ঘটেছে
বিপিন চ্যাটার্জির বাবা সোমনীল বাবু এক নারীকে দেখে অজানা আতঙ্কে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন। তাঁর শেষ কথাগুলো, ‘জুল, হার, ক্ষমা, গুপ্তধন’ কি অসংলগ্ন কথা? সোমনীলের ঘরে চোর আসা আর ইন্দ্রদার ঘরে মার্টিনা ক্যাম্পবেলের আবির্ভাব এবং গুপ্তধনের ধাঁধা সমাধানের জন্য শাঁসানোর পর তা আর মনে হয় না। তারপর…
পর্ব ৩ – অনুসন্ধান
-“না, থাকবে কেন? এখনি বলো কে ফোন করেছিল?”
সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইন্দ্রদাকে প্রশ্নটা করলাম। ও বলল ইন্সপেক্টর হাজরার ছিল। ইন্দ্রদাকে একবার সোমনীলবাবুর ঘরটা সার্চ করে দেখতে হবে কোনো ক্লু যদি মেলে, যা দিয়ে জানা যেতে পারে নিশীথ রাতের ওই আগন্তুক মেয়েটি কে ছিল? ইন্দ্রদা অবশ্য পুলিশকে কাল রাতে মার্টিনার আসার ঘটনাটা জানায়নি। বিপিনবাবু এখন বন্ধুর বাড়িতেই আছেন। তদন্তের জন্য পুলিশ ওনার বাড়ির চাবি থানায় রেখেছে। ফোন আসার পর আমাদের দুজনের রেডি হতে কয়েক মিনিট সময় লেগেছিল মাত্র।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে স্টার থিয়েটার ক্রস করে গেলাম। অনেকক্ষন থেকেই খালি ট্যাক্সির জন্য ওয়েট করছি। পাশে একটা বটবৃক্ষের নীচে সূর্যের গোল গোল প্রতিবিম্বগুলো নড়াচড়া করছে। দু চারটে বাস আর ট্রাম পেরিয়ে গেল। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে থেকে খুব বিরক্ত লাগছিল। কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে একটা মৌমাছি উড়ে গেল। ইন্দ্রদা গোল্ড ফ্লেকটা ধরিয়ে উপর দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়তেই গাছের ডালে চড়ুইগুলো কিচির মিচির করে উড়ে গেল। ধোঁয়ার জন্য নয়, একটা লাল টাটা সুমো অসম্ভব জোরে ব্রেক কষে আমাদের সামনে দাঁড়াল, আর তাতেই পাখিগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। এবার টাটা সুমোর নীল কাঁচটা নেমে এল।
ড্রাইভার এক মাঝবয়সী পাঞ্জাবী, চোখে টাইটানের সানগ্লাস, পুরু কালো দাড়ি গোঁফ, ঠোঁটটা সামান্য নড়তেই বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে কিছু বলছে, “যাবেন?” ইন্দ্রদা হাত দেখিয়ে বলল, “অফ কোর্স, শ্যামবাজার থানা চলুন।” উঠে পড়লাম। ভিড় সত্ত্বেও পাঁচ মিনিট লাগল যেতে। ইন্দ্রদা ড্রাইভারকে ওয়েট করতে বলে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে থানায় সোমনীলবাবুদের বাড়ির চাবি আনতে গেল। কেন জানি না আমার ভয়ে বুক ধুকধুক করছিল। সামনের আয়নায় ড্রাইভারকে দেখছিলাম। মাথায় একটা বিশাল পাগড়ি। ইন্দ্রদা চলে যেতেই একটা ইংরেজি গানের মিউজিক বাজিয়ে দিল। কান আমার ঝাঁ ঝাঁ করছে। দু ফোঁটা ঘাম কপাল থেকে টপটপ করে পায়ে পড়ল। ড্রাইভার সামনের বাক্স থেকে একটা চকচকে ছোরা বের করে ঘাড়ের কাছে নিজের ঘামগুলো চাঁছতে শুরু করল। আমি ঘনঘন ঢোক গিলছিলাম। এবার আমার হাতে একটা জলের বোতল ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বলল, “জল, মিনারেল ওয়াটার।”
গলাটা অদ্ভুত রকম, চাপা স্বরে যেন কথাগুলো বলছে। ততক্ষনে ইন্দ্রদা চলে এসেছে।
-“চলুন মেনরোড ধরে।”
ড্রাইভার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে হাতের ঘাম মুছে গাড়িতে স্টার্ট দিল। আরো আধঘন্টা লাগল সোমনীলবাবুর বাড়ি পৌঁছতে। ইন্দ্রদাকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। তবে ড্রাইভারকে দেখে আমার কেন জানি না সন্দেহ হল। কোনো মতলব নিয়ে আসেনি তো?
বিশাল গোলাপি কালারের বাড়িটা। সকালের মিষ্টি রোদ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সিমেন্ট বাঁধানো একটা রাস্তা চলে গেছে ঘরের দরজা পর্যন্ত। দুধারে মখমলি ঘাস সবুজের বান ডেকেছে। টবের গাছগুলোতে রংবেরঙের ফুলের সমারোহ। কতকগুলো ঝাউগাছ আছে, তাছাড়া আম কাঁঠালের শাখা প্রশাখায় দোলা হাওয়া, সবমিলিয়ে পরিবেশটা মনের মত। চারপাশে বিশাল ইঁটের প্রাচীর থাকলেও এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়া খুব কঠিন নয়।
প্রথমে বাগানটা ঘুরে দেখা স্থির করলাম। ইন্দ্রদা একটা অর্কিড গাছের কাছে এসে বসে পড়ল। আমিও বসতেই মনে হল ঝোপঝাড়ের মধ্যে ডুবে গেছি। ইন্দ্রদার দৃষ্টি দুটো ছোট ছোট গর্তের দিকে। হাতে তৈরি গর্ত নয় সেটা দেখলেই মনে হয়। এবার আমি পাশেই পরে থাকা একটা কৌটো তুলে নিয়ে ইন্দ্রদার হাতে দিলাম। কৌটোটা নাকের কাছে নিয়ে এসে ইন্দ্রদা বলল, “ওডোমস।”
আমি বললাম, “তার মানে কেউ এখানে অপেক্ষা করছিল। রাতে মশার হাত থেকে বাঁচতে স্কিনে ওডোমস লাগাতে ভোলেনি। আর অনেকক্ষন ধরে এক জায়গায় দুপায়ে ভর দিয়ে বসেছিল বলে বড় বড় দুটো ঢালু গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, কারণ তখন বৃষ্টি হচ্ছিল।”
সামনে পাতাবাহার গাছের গুঁড়ির ঠিক পাশে এবার বেশ চওড়া একটা গর্ত নজরে এল। আমি না বলে পারলাম না, “এখানে এত বড় একটা গর্ত কেন বলোতো ইন্দ্রদা, গুপ্তধন এখানে নেই তো?” ইন্দ্রদা হা হা করে হেসে উঠল। আবার পরমুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল। ও কিছু একটা দেখেছে। ঝাউগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের আলোয় চকচক করছে একটা সানগ্লাস। গলা নামিয়ে আমি বললাম, “কেউ বোধহয় আমাদের ফলো করছে, ইন্দ্রদা।”
আমরা সাদা মোজাইক করা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা সরু বারান্দার মত অংশ। রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেকটা নিচু। একটা চিল বিকট আওয়াজ করে অনেকটা উপর দিয়ে উড়ে গেল। পেছনে তাকাতেই দেখি ইন্দ্রদা নেই। এবার ওপাশ থেকে ইন্দ্রদার গলা শোনা গেল।
-“আমি রুমের তালা খুলছি। সমু, তুই বাইরেটা একটু দ্যাখ, কিছু পাস কিনা।”
মনের মত কিছু না পেয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর কেমন যেন ভ্যাপসা গরম। আমি গিয়ে জানালাগুলো খুলে দিলাম। ইন্দ্রদা তখন একটা ডায়রি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রুমটা বেশ বড়, বোঝাই যাচ্ছে এটা সোমনীলবাবুর ঘর। ডাইনিংটা সাজানো গোছানো, ঘরের দেওয়ালে প্রয়াত স্ত্রীর ছবি, এককোণে টেবিলে হারমোনিয়াম তবলা ভেলভেটের ক্লথ দিয়ে ঢাকা। অনেকগুলো স্বরলিপি আর গানের বই মিলল। থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ শুনেছি সোমনীলবাবু বেশ ভাল গায়ক ছিলেন। টিভিতে বেশ কয়েকবার গানও করেছেন। একপাশে একটা সিঙ্গেল খাট, আলমারি, আলনা, সোফা। কাঁচের আলমারিগুলোতে অনেক বই সাজানো। বেশ কয়েকটা ইংরেজি বইও রয়েছে।
পাশের রুমটা বিপিনবাবুর। বেশ অগোছালো, একটা টিভি রয়েছে। রিমোটটা বিছানার উপর পড়ে আছে। টেবিলের ওপর একগাদা কাগজপত্রের জঞ্জাল, একটা ডেলের ল্যাপটপ আধখোলা অবস্থায় পড়ে আছে।
এবার জানলার ধারে ফুরফুরে বাতাসে এলাম। ইন্দ্রদা খাটের তলাগুলো, ক্যালেন্ডারের পেছনগুলো, গান করার সরঞ্জামগুলো নেড়েচেড়ে পর্যবেক্ষণ করছে। এত বড় চৌহদ্দির মধ্যে গুপ্তধন কোথায় আছে কে জানে। জানলা দিয়ে মেঘমাখা রৌদ্রস্নাত বাগানটাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। সেই চিলটা ক্রমশ ছোট হতে হতে আকাশে মিলিয়ে গেল। দুটো সবুজ ঝাউগাছের আলিঙ্গনের ঠিক ওপর থেকে সাদা ধোঁয়া দেখতে দেখতে কাল রাতের কথা মনে আসছিল। সচেতন হলাম পাতার ফাঁকে একটা কালো সানগ্লাস দেখে। দেখলাম সেই ড্রাইভারটা ঝাউগাছের পেছনে দাঁড়িয়ে। ইন্দ্রদার সঙ্গে জানলায় চোখে চোখ পড়তেই টাটা সুমোটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ড্রয়ারের মধ্যে কিছু আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলাম। পাওয়া গেল একটা কৌটো, আর তার মধ্যে অদ্ভুত দেখতে একটা রুপোর হার। সোমনীলবাবুর লাস্ট ওয়ার্ডগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল… গুপ্তধন, জুল, হার… হার।
ইন্দ্রদা বলল, “চল, যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। আর কিছু দেখার নেই এখানে। এখন গুপ্তধন পেতে গেলে সন্ধান পেতে হবে গাধার।”
চলবে …