পিতৃত্বের স্বাদ ।। লেখা – দেবলীনা দে
নার্সিং হোমের করিডোরের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন রাত বারোটা। বাইরে গেটের সামনে গুটিকতক কুকুর থেকে থেকে ডেকে উঠছে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ… কেবল ওই কুকুরগুলোর ডাক থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে। করিডোরে চেয়ারে হেলান দিয়ে সুমিত ভাবছে আজ একটু রিলিফ, গত কয়দিন মা এর শরীর নিয়ে যেভাবে যমে মানুষে টানাটানি চলছিল, আজ তার থেকে রেহাই। তবে মনের ঘরে এখনো যে আতঙ্কের মেঘ কাটে নি। হঠাৎ এক নার্স কাছে এসে বললেন, “মিঃ বসু, আজ আপনার মা বেশ ভালো আছেন। আপনি গেস্ট রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। দরকার হলে আমরা আপনাকে ডেকে নেব।” সুমিত হালকা হেসে বললেন, “আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, ঠিক আছি। মা ঠিক আছেন তো?”
-“হ্যাঁ, উনি একদম ঠিক আছেন, ঘুমোচ্ছেন” উত্তর দিলেন নার্স।
একটু আলো ফুটতেই চিৎকার শুনে চমকে উঠলেন সুমিত, চোখ লেগে গিয়েছিল। সামনে চোখ যেতেই কেবিনে দেখতে পেলেন একজন মাঝ বয়সি মহিলা ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন আর তার কোল ঘেঁষে একটি ফুটফুটে মেয়ে সে খুব জোরে কাঁদছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল সুমিত, কার আবার বিপদ হ’ল। নার্স এবং ডাক্তার সবাই সান্তনা দিতে দিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, “এই অল্প বয়সে বিধবা, তার মধ্যে ছয় মাস যেতে না যেতেই বাবা চলে গেলেন। এখন মা এবং কোলের বাচ্চাকে নিয়ে উনি যে কি করে সব সামলাবেন সেটা ভাবতেই ভয় লাগছে।” সুমিত খানিকটা অনুমান করতে পারল। কারণ গত দুদিন যাবৎ তার সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলা এই করিডোরে চেয়ারে বসে কাটিয়েছেন। কেবল সকাল হলে ওনার মা ছোট্ট মেয়েটির হাত ধরে আসতেন, তখন উনি বাড়ি যেতেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে সুমিতের টুকটাক কথা… মানে এই সৌজন্যমূলক। মাঝে মাঝে চা খেতেন একসঙ্গে, এটুকুই তবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন কখনও নয়।
কেবিনে গিয়ে মাকে দেখে তার একটু ভালো লাগল। আজ বেশ আস্তে আস্তে কথা বলছে, চা খেয়েছেন। মায়ের হাত ধরে সুমিত অনুভব করল প্রাণের টান, মা তার মুখের দিকে তাকিয়ে। প্রশান্তির হাসি হাসল সুমিত, তারপর বলল, “মা এবার একটু বিশ্রাম নাও, আমি বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি।” -“আয় বাবা, তোর তো আমার জন্য কয় রাত ঘুম হয় নি।এখন বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম করে বিকেলের দিকে আয়, আমি এখন ভালো আছি।”
কেবিন থেকে বেরিয়ে মনে হ’ল একবার পাশের কেবিনে যাওয়া উচিত, উনি ও তো তার বাবা কে হারিয়েছেন। সান্তনা দেওয়া যায় না, তবে পাশে তো থাকা যেতেই পারে। কেবিনের বাইরে কিছু আত্মীয় ভিড় করে আছেন। সীমা দেবী রিসেপশন থেকে সব বিলপত্র চুকিয়ে এদিকে আসছেন। এক রাতে তাঁর চেহারাটা কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। সুমিত এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, “মাসিমা ভালো আছেন?” সুমিত ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল। পাল্টা কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময় দিয়া এসে তার হাত ধরে বলতে লাগল, “আঙ্কেল, দাদাই দেখো চোখ বন্ধ করে আছে কিছু বলছে না। তবে কে আমাকে চোকো দেবে, গল্প বলবে? তুমি একটু দাদাইকে বলবে চোখ খুলতে, আমি দুস্টুমি করব না।” সুমিত দিয়াকে কোলে তুলে নিল, ওর কাছে যে দিয়াকে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর নেই। সীমার চোখের কোল ছলছল করছে।
-“বলছি যে আমি কি আপনাদের কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি? দেখুন আত্মীয়-পরিজন যারা এসেছেন বেশ বয়স্ক, তাই বলছি যে আমি যদি মেসোমশাইকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি… শেষ যাত্রায়।”
সীমা ভাবল এই অবস্থায় উনি থাকলে একটু ভালো হয়, কারণ মাকে আর দিয়াকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া তার পক্ষে অতটা সহজ নয়। এই সময় নিজেকে শক্ত থাকতে হবে। নার্সিংহোম থেকে বাড়ি নিয়ে যেতেই কান্নার রোল উঠল। সেই সঙ্গে পরিচিত মহলে আলোচনা শুনতে পেলেন, “বড় ভালো মানুষ ছিলেন। এখন সীমাকে সব কিছু সামলাতে হবে।” সুমিত এই সব শুনতে শুনতে সীমাকে বলে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি রওনা দিল। আসার সময় সীমা কৃতজ্ঞতা করতে ভোলেন নি। তবে তা নিয়ে সুমিতের ভাবনা নেই কারণ তিনি একজন আর্মি অফিসার আর তার কর্তব্য একজন এক্স আর্মি কে সম্মান জানানো।
বিকেল হতেই সুমিত তার মাকে দেখতে গেল। সারা রাস্তা কেবল দিয়ার মুখটা মনে পড়ছিল। কেবিনে ঢুকতেই মা এর হাসি মুখটা দেখে সুমিতের মনের কোনে ভালোলাগার রেশ। বেডের পাশে বসল, তারপর মায়ের হাত ধরে বলল, “এখন কেমন আছো মা?” তাঁর মা স্মিত হেসে বললেন, “ভালো আছি বাবা, আগের তুলনায় অনেকটা ভালো।”
-“আমি যা ভয় পেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে সেটা তোমাকে কি বলবো! একা থাকো, নিজের একদম যত্ন নাও না, খুব বুঝতে পারছি।” মা হেসে বললেন, “আমার শরীর ঠিক ছিল, ওই হঠাৎ করে কি যে হল। আসলে তোকে একটা কথা বলব ভাবছি কিন্তু ফোনে আর বলা হয় না।”
-“কি কথা মা? আর কোথাও অসুবিধে হচ্ছে কি? আমি ছুটি বাড়িয়েছি, তুমি বল কি অসুবিধে?”
এবার মা ধীরে ধীরে বললেন, “দেখ আর কদিন বাঁচবো, আমার এই একাকিত্বের একজন সঙ্গী যদি পেতাম দুটো মনের কথা বলতে পারতাম। তোর কোয়ার্টার এ গিয়েও থাকতে কেন ভালো লাগে না বলতো, সেখানেও তুই অফিস করিস আমি একা। তাই বলছিলাম যে এবার নিজে একটা পছন্দ করে বিয়েটা সেরে নে। আমিও বন্ধু পাই আর তোর সংসারটা সাজানো হয়।”
মায়ের সব কথা শুনল সুমিত, কোন উত্তর দিল না। এই চুপ করে থাকার সময় আবার তার দিয়ার মুখটা মনে পড়ল। ভিজিটিং আওয়ার শেষ। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সুমিত কেবিন থেকে বেরিয়ে ডক্টরের চেম্বারের সামনে অপেক্ষা করতেই কিছুক্ষনের মধ্যে ডক্টর এলেন, আর তিনি জানালেন তার মা এখন প্রায় সুস্থ। দুদিনের মধ্যে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। তবে যেটা লক্ষ্য রাখতে বললেন সুমিত কে তা হলো ওর মা ভীষণ মনের দিক থেকে একা আর তারজন্যই শারীরিক দিক থেকে অসুস্থ সেটা খেয়াল রাখতে বললেন।
আজ এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা-ঘাট কেমন যেন ফাঁকা, তেমন যানজট নেই। একবার মনে হলো দিয়াকে দেখে যাই, পরমুহূর্তে মনে হল আজ যাওয়াটা ঠিক নয়। সকাল থেকে প্রচুর ধকল গেছে ওই পরিবারটার উপর দিয়ে এখন হয়তো বিশ্রাম করছে। থাক, কাল সকালে না হয় একবার ফোন করে নেবে।
সুমিত বাড়ি ঢুকে সোফায় বসে, কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন চোখ খুলতেই দেখে স্ক্রিনে মিসেস সীমা দত্ত নাম ভেসে উঠেছে। তাড়াতাড়ি করে ফোন রিসিভ করতেই ওপর থেকে সীমা বলে উঠলেন, “মিঃ বসু, আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম কি?”
-“না না, বিরক্ত কেন? আপনারা ঠিক আছেন তো?”
-“হুম সব ঠিক আছে, আসলে দিয়া হঠাৎ জেদ করছে আপনার সঙ্গে কথা বলবে। আমি অনেক বারণ করা সত্ত্বেও কিছুতেই শুনছে না। তখন মা বললেন আপনাকে একটা ফোন করতে। আমার যে কি খারাপ লাগছে।” পাশ থেকে অনর্গল দিয়া কিছু বলে চলেছে সেটা সুমিতের কানে আসছে।
-“আচ্ছা আপনি তো বিকেলে মাসিমার কাছে গিয়েছিলেন কেমন আছেন উনি?’”
-“আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো। আসলে মা এর এখন সমস্যা হ’ল একাকীত্ব, ডক্টর তাই বললেন। আমার কাছে গিয়েও থাকতে চায় না, আর আমিও খুব একটা ছুটি নিতে পারি না। এইসব মিলিয়ে এখন বেশ চিন্তায় আছি জানেন তো।”
-“তুমি সব কথা বলবে আঙ্কেলের সঙ্গে, আমি কখন বলব বল তো?” দিয়া বলে উঠল।
-“দাঁড়া তো একটু, দিচ্ছি। এমন করলে এখনই ফোনের লাইন কেটে দেব। ”
-“আরে আরে, আপনি বকছেন কেন ওকে? দিন তো একটু দিয়ার সঙ্গে কথা বলি, কখন থেকে অপেক্ষায় আছে।…হ্যালো দিয়া। কি করছিলে? তুমি দুস্টুমি করছ না তো? মাম্মা আর ঠাম্মিকে বিরক্ত করছ না তো ?”
-“না আঙ্কেল, আমি একটুও দুস্টুমি করছি না। আমি শুধু তোমাকে খুব মিস করছিলাম, তাই তোমাকে ফোন করতে বললাম। মাম্মা রাজি হচ্ছিল না, তাই বায়না করছিলাম। তুমি আমাকে স্টোরি শোনাবে গো? দাদাই আমাকে রোজ রাতে স্টোরি বলত। আঞ্জেলের স্টোরি তুমি বলবে। আমার ডিনার হয়ে গেছে, এখন স্টোরি টাইম। ঠাম্মি আর মাম্মা কেমন যেন চুপ করে বসে আছে, তুমি আমাকে স্টোরি বললেই আমি ঘুমিয়ে পড়ব।”
দিয়ার কথা প্রথম দিন থেকেই সুমিতের খুব ভালো লাগত। নার্সিংহোমে যখনি দেখা হ’ত ও কথা না বলে থাকতে পারত না। কি একটা টান সুমিত অনুভব করে, আর সেই টানেই যেন সুমিতের ফাঁকা জায়গাটা পূরণ হয়ে যায়। এই প্রথমবার সুমিতকে তার এই বয়সে এসে ছেলেবেলায় ফিরতে হল। স্মৃতিচারণ করলেন তাঁর মা খাওয়ানোর সময় দুয়োরানি, পক্ষীরাজ, পরীর গল্প বলতেন। তবেই সুমিতের খাওয়া সম্পূর্ণ হ’ত। কিছুক্ষন পর গল্প বলার পর ফোনের ওপর থেকে সীমার গলা শুনতে পেলেন, “মিঃ বসু, দিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব! কিন্তু আর একটা ভয় কাজ করছে।”
-“কি বলুন তো?”
-“এইভাবে ও যে আপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তাতে তো আপনার যেমন অসুবিধে তেমন ওর মনের উপর প্রভাব পড়বে।” -“একটা সত্যি কথা সীমাদেবী আপনাকে না বলে পারছি না। আসলে ও কতটা নির্ভরশীল হবে সেটা তো পরের কথা, আমি এই কয়দিনে ওকে যে বড় আপন করে ফেলেছি। ভীষণ কাছের একজন মনে করতে শুরু করেছি। ওর আধো আধো কথা যে সব সময় শুনতে ইচ্ছে করে, ওর দুস্টুমিকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করে। আজ বিকেলে মাকে দেখে ফেরার পথে আমার যে ওকেও দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সংকোচ বোধ হচ্ছিল, তাই আর দেখা করতে যাই নি।” সুমিতের সব কথা ফোনের ওপার থেকে সীমা শুনল, তারপর কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষন চুপ থেকে সুমিত ফোনটা রেখে দিল।
রাত বাড়তে লাগল, সীমার চোখে ঘুম নেই। পাশে দিয়া ঘুমোচ্ছে, ও ঘরে মা একা শুয়েছেন। বলা সত্ত্বেও মা শুনলেন না। আরও একবার মৃত্যুশোক, কাছের মানুষকে হারানোর যন্ত্রনা। প্রদীপ্ত যখন আকস্মিক অক্সিডেন্টে মৃত্যু, তখন দিয়ার বয়স আড়াই বছর। বাবা পুত্রশোকে ভেঙে না পড়ে নাতনিকে আঁকড়ে ধরে গোটা পরিবারকে সামলেছেন। তারপর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত আর আজ সমস্ত দায়িত্ব সীমার হাতে তুলে দিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। নিজের মনে সীমা বললেন, “আমি পারবো তো, মা এবং দিয়াকে সামলে রাখতে? এই সংসারের সকল দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে? আমাকে আশীর্বাদ করুন বাবা।” কাঁচের জানালা দিয়ে ভোরের আলো সীমার চোখে এসে পড়ল। চোখে ক্লান্তি আর মনের ভিতরে শূন্যতা সব যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে।
সকাল হতেই সুমিতের মনে হ’ল মা কে হয়তো আগামীকাল ডিসচার্জ করে দেবে। তার আগে সুমতিদিকে দিয়ে পুরো বাড়িটা গোছগাছ করে নিতে হবে। আর সংসারে কি প্রয়োজন তার একটা লিস্ট নিয়ে কেনাকাটা নিতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে নার্সিংহোমে গেল। আজ মা সম্পূর্ণ সুস্থ, তাকে দেখেই সেই চেনা নিষ্পাপ হাসি।
-“আমাকে কবে ডিসচার্জ করবে ডক্টরের সঙ্গে তোর কথা হয়েছে?” -“হ্যাঁ হয়েছে। খুব সম্ভবত আগামীকাল ডিসচার্জ করে দিতে পারেন। কিন্তু মা তোমাকে যে এবার নিজের কথা ভাবতে হবে। এভাবে অবহেলা করলে যে ফল ভালো হবে না। আমার কথা তো তুমি ভাববে, তুমি ছাড়া আমি যে একদম একা।”
-“সেই জন্য বলছি বাবা, এবার নিজের কথা যে ভাবতে হবে। আমি আর কয়দিন।”
-“এসব কথা এখন থাক। তুমি বাড়ি চলো, তখন নাহয় দুজনে এই বিষয় নিয়ে ভাবব।”
ফেরার পথে দিয়াকে দেখার ইচ্ছে হল। আজ সংকোচ কাটিয়ে বাড়ির কলিংবেল হাত দিল। একজন এসে দরজা খুলতেই সুমিত বলল, “দিয়া ঘরে আছে?” উনি অদ্ভুত ভাবে সুমিতের দিকে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষন পর সীমার শাশুড়ি এসে বললেন, “ও তুমি! এসো এসো, ভেতরে এসো।” অমনি দিয়া একছুটে এসে তার আঙ্কেলের কোলে উঠে পড়ল। তারপর দুজনের মধ্যে কত কথা, যা বাড়ির অন্যদের বোঝার বাইরে। দিয়াকে রেখে বাড়ি ফিরতে মন চাইছিল না সুমিতের । কিন্তু এখনো যে ওই পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে নি, শুধুমাত্র দিয়া তার খুব কাছের।
সুমিতের মা বাড়ি ফিরেছেন। সুমতিদি সর্বক্ষণ তাকে নজরে রাখছেন, আর তিনি খেয়াল করছেন তার ছেলে একটি বাচ্চার সঙ্গে ভীষণ ভাবে বন্ধুত্ব হয়েছে। সময় পেলেই তার গল্প করছে মাকে। রাতে ঘুমোনোর আগে গল্প বলছে, যেন বাচ্চাটি তার ছায়াসঙ্গী। দুদিন পর সুমিতের মা বললেন সীমার ফোন নম্বরটা দিতে, একটু কথা বলবেন। সুমিত একটু ইতস্তত করছিল কিন্তু মাকে না বলতে পারে নি। তারপর কি কথা হয়েছে সেটা আর শোনে নি মায়ের থেকে। দিয়াকে একবার করে গিয়ে দেখে আসছে।
সীমার শশুরমশাইয়ের পারলৌকিক ক্রিয়া নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হল, এখন দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব। তবে সীমা আর সুমিত ঠিক এখনো নিজেদের মধ্যে আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি, কেবল দিয়া ওদের যোগসূত্র।
এবার সুমিতের ছুটি শেষ, কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হবে। মাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ঠিক করেছে, কিন্তু আরও একজনের জন্য তার মন কেমন করছে। কি করে থাকবে ও দিয়াকে চোখের দেখা না দেখে? সেই ভেবেই গত কয় রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। একটা সিদ্ধান্ত যে নিতে হবে তাকে, কি বলবে সে সীমা এবং ওর শাশুড়িকে? বুকের ভেতর যে তোলপাড় করছে, বলতে যে ওকে হবেই।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সুমিত তার মায়ের ঘরে ঢুকে বিছানায় গিয়ে বসল।
-“মা আমি যে সিদ্ধান্ত নেব তুমি মেনে নিতে পারবে তো?”
-“তুই যা করবি আমি তাতেই খুশি, কিছু বলবি কি?”
-“ঠিক আছে, আমি একটু আসছি।” এই বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে সটান সীমাদের বাড়ি। দরজা খুলতেই সীমা কে বলছে, “মাসিমা কে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ? কথা বলার আছে।” সীমা একটু ভয় পেয়ে যায়, এতো উদভ্রান্তের মতো আগে কখনো দেখে নি। সীমার শাশুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “কিছু বলবে কি?” সুমিত নিজেকে শক্ত করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি দিয়ার দায়িত্ব নিতে চাই, আশাকরি আপনি আপত্তি করবেন না।” কথাটা শেষ হওয়ার আগে সীমা বলে উঠল, “এ আপনি কি বলছেন সুমিত?” সীমার শাশুড়ির দিকে সুমিত তাকিয়ে আছে, যেন কোনো কথা তার কানে যাচ্ছে না। আবার এক নিশ্বাসে বলতে শুরু করল, “আসলে আমি আপনাদের সবার দায়িত্ব নিতে চাই। সীমা না হয় বন্ধুর মতোই থাকুক, কারণ ওকে সময় দেওয়া উচিত। তবে আমি যে দিয়াকে ছাড়া থাকতে পারছি না, ও যে আমার নয়নের মণি।” সব শুনে সীমার শাশুড়ি বললেন, “তোমার বলার আগে আমার এ ব্যাপারে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। শুধু তোমার মতামত জানার ছিল। সীমার সঙ্গেও অবশ্য এ বিষয়ে কথা হয় নি আমার, ওর মতামত নেওয়ার আছে।” এবার সুমিত সীমার দিকে তাকিয়ে বলল, “পারবে না দিয়া কে আমার হাতে তুলে দিতে? আমি কথা দিচ্ছি, ওকে বাবার মতো পিতৃস্নেহে বড় করে তুলব।” সীমার যে আর কিছুই বলার নেই, কারণ সে দেখতে সুমিতের চোখে তখন পিতৃত্বের স্নেহ উজ্জ্বল উপস্থিতি। দিয়া সুমিতের কাছে এসে দাঁড়াল। সুমিত কোলে তুলে নিয়ে বলল, “দিয়া রানী কি আমার সঙ্গে পক্ষীরাজের ঘোড়ায় চেপে তেপান্তরের মাঠে যাবে? অমনি গলা জড়িয়ে ধরে দিয়া সুমিতকে বলল, “যাবে তো তোমার সঙ্গে।”