১।
রূপসার বয়স এখন মাত্র চার। ওর বাবা অতনুবাবু স্কুল শিক্ষক। সকাল বেলা ছাত্র পড়িয়ে অতনুবাবুর স্কুল। বিকেলে আবার পড়ানো। রূপসা বাবাকে কাছে পায় খুব কম। রূপসা আর ওর মায়ের এটা নিয়ে বড্ড অভিযোগ। কিন্তু তবু ওদের এই তিনজনের ছোট্ট সংসার বড্ড সুখের।
ছবির মত সুন্দর গ্রাম রুপসাদের। পুব দিকে পাহাড়ের সারি। একটুখানি এগোলেই শুরু হয় জঙ্গল। ঘন জঙ্গল। দুপাশে গহীন অরণ্য আর তার মাঝখান দিয়ে সরু পিচের রাস্তা। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আরেকটা ছোটো গ্রাম। অতনু বাবুর স্কুলটা সেখানেই। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ওই জঙ্গল পারাপার অতনু বাবুর। সবাই ভয় পায়। উনার বেশ লাগে।
সেবছর টিকেজি জঙ্গিদের উৎপাত বড় বেড়েছিল রাজ্যে। সকাল বেলার খবরের কাগজটা দেখে খুব বিরক্ত হয়েই বাড়ি থেকে স্কুলের জন্য বেরোলেন রূপসার বাবা। এইখানেই উনার জন্ম। বড্ড ভালোবাসার জায়গা। সেখানে রোজ রোজ এত খারাপ খবর উনার ভেতরটাকে বড় কাদায়। ফেরার পথে সবে জঙ্গলের মাঝপথ। হঠাৎ পেছন থেকে কিছু লোক এসে জাপটে ধরল অতনুবাবুকে। মাটিতে পড়ে গেলেন অতনুবাবু।
বাড়ি ফিরলেন না অতনু বাবু। একদিন দুদিন করে কয়েক মাস কেটে গেল। রূপসার মা রুপা দেবী পাগলের মত খুঁজলেন স্বামীকে। পুলিশি অভিযান চলল পুরোদমে। ওরা বলল জঙ্গিরা ধরে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কিছু চাইবে মুক্তি দেওয়ার বদলে। অপেক্ষা করুন। রূপসার চোখের জল শুকিয়ে গেল একদিন, বাবাকে ফিরে পেলো না রূপসা।
২।
মঙ্গলবারের হাট। এমনিতেই প্রচুর ভিড় হয় এদিন। তারওপর আবার একটা বড়সড় জটলা। এক বৃদ্ধ পড়ে আছে উপুড় হয়ে। বেহুঁশ। ভিড় ফাঁকা করে বিপিন মন্ডল এগিয়ে আসল। বুঝতে পারলো বৃদ্ধের অবস্থা খুবই খারাপ। তাড়াতাড়ি করে নিয়ে গেলো হাসপাতালে।
বৃদ্ধ সুস্থ হল ধীরে ধীরে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ। বিপিন মন্ডল প্রাণ দিয়ে করলো বৃদ্ধের জন্য। কেন, কেউ জানে না। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল বৃদ্ধ। বিপিন বৃদ্ধকে জুটিয়ে দিল ছোটো খাট একটা স্কুলের চাকরি। বৃদ্ধ বেশ আছে।
৩।
কিছুক্ষন আগেই অনির্বাণ তার শ্বশুর মশাইকে দাহ করে আসল। অনির্বাণের খুব মনখারাপ। রূপসার তো মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না।
এই তো এক বছর আগের কথা। হ্যা, মাত্র এক বছরই হলো।
সকাল সকাল একটা ফোন-
” হ্যালো, এটা কি অনির্বাণের বাড়ি?”
“হ্যাঁ, আমিই অনির্বাণ”
“একটু রূপসার সাথে কথা বলা যায়?”
“নিশ্চয়ই। আপনি কে বলছেন?”
“আমি রূপসার বাবা, অতনু”
চমকে উঠেছিল অনির্বাণ। এটা কি করে সম্ভব।
জীবনটা যেন এক নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ভুল শুনলো না তো অনির্বান? যে মানুষটা ২৪ টা বছর ধরে নিখোঁজ সে কি বেঁচে থাকতে পারে? এটা প্রতারণা নয়ত?
না। অনির্বাণকে প্রতারিত হতে হয়নি।
একবছর আগে যেদিন বৃদ্ধ অতনু বাবু দরজার কলিং বেল বাজালেন, দরজা খুলেছিল রূপসা। অনির্বাণ ওর পেছনে। বাবাকে চিনতে রূপসার কোনো ছবির প্রয়োজন পড়েনি। ওদের দুজনকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে অনির্বাণও কেঁদেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে না, সবার সামনেই। সাত বছরের বিবাহিত জীবনে রুপসাকে কখন এত আনন্দে থাকতে দেখেনি যতটা ও গত এক বছরে ছিল। বুড়ো বয়সে বাপ মেয়ের সোহাগ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে অনির্বাণ।
৪।
সকালবেলার লোক জনের ভিড় এখন অনেকটাই হালকা। কয়েকজন আত্মীয় শুধু রয়ে গেছে। একটু খাবার খেয়ে অনির্বাণ বিশ্রাম নিচ্ছে। রূপসা বারান্দায় দাড়িয়ে অতীতে ডুব দিল। বাবা নিখোঁজ হবার কিছু দিন বাদেই রূপসা কে একা করে মাও চলে গেল। অজান্তেই দু গাল দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল রূপসার। বাবার কথা মনে পড়ছে খুব। গল্পের মত লাগছিল যখন বাবা বলছিল কি ভাবে স্কুল থেকে ফেরার পথে উনি জঙ্গিদের হাতে বন্দী হলেন, ১২ বছর বন্দী থাকার পর কিভাবে দারুন বুদ্ধি করে পালিয়ে আসলেন, কিন্তু অ্যাকসিডেন্টে স্মৃতিশক্তি হারালেন। ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালেন, ছাত্র পড়ালেন আরো কত কিছু।
সন্ধ্যে নামতে বেশি দেরি নেই। চোখ মুছে বারান্দার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো রূপসা। সারি সারি টবে রাখা অনেক গাছ। দুদিন আগে যে গোলাপের চারা টা প্রায় মরেই যাচ্ছিল আজ ওর গায়ে নতুন দুটো ছোট্ট পাতা। বেঁচে যাবে গাছটা।
হঠাৎ মনটা ভালো লাগলো রূপসার। যাকে ভুলতেই বসেছিল রূপসা, তাকে যেভাবে কাছে পেয়েছে গত এক বছর, সেটাই ওর কাছে এক আকাশ প্রাপ্তি। রূপসা আবার নতুন করে বাঁচবে, ওর নতুন করে ফিরে পাওয়া বাবার প্রতিটা স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। কখন যেন অনির্বাণ এসে দাড়িয়েছে রূপসার পেছনে। রূপসা জড়িয়ে ধরলো অনির্বাণকে।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। স্থান, কাল ও চরিত্র পরিবর্তিত)
লেখাঃ পিংকি
ছবিঃ সঙ্কেত
Matro ekti bachor | Pinki | Sanket | www.pandulipi.net | Emotional | Bengali | Story