
লেখা – শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ – নিকোলাস
(আগে যা ঘটেছে:
গুরুচরণ পাত্রের নিমন্ত্রণে ইন্দ্রদার সঙ্গে আমি ওনার বীরভূমের গ্ৰামের বাড়িতে হাজির হলাম। ওনার পারিবারিক একটা মূল্যবান নীল হীরে বিক্রি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে কোন অজানা ব্যক্তি। সেইদিন গভীর রাতে হঠাৎ শব্দ পেয়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম গুরুচরণ বাবু খুন হয়ে বাগানে পড়ে আছেন। আরো ভালো ভাবে কিছু দেখার আগেই ক্লোরোফর্ম দিয়ে কেউ আমাকে অজ্ঞান করে দিল। তারপর…)
জ্ঞান ফিরল ইন্দ্রদার ডাকে…
-“সমু, সমু! আমি তোর ইন্দ্রদা রে… এখন কেমন আছিস?”
আমি দেখলাম আমি বিছানাতে শুয়ে আছি, পাশে ইন্দ্রদা আর বাড়ির সবাই। গুরুচরণ বাবুকে দেখতে পেলাম না। আমি উঠে বসলাম, দেখি বুবাই এর মা বাবা চন্দ্রকান্ত বাবু সবাই কাঁদছেন।
ইন্দ্রদা বলে উঠল, “কাল রাতে তুই ঠিক কি দেখলি বলতো? আমি তিনটে নাগাদ তোর বেডের দিকে তাকিয়ে দেখি তুই নেই। সূর্যবাবু আর বাকি সবাইকে ডাকতে গিয়ে দেখি গুরুচরণবাবুও নেই। আমরা মেনগেট থেকে বাইরে আসি, প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছুদূর গিয়ে দেখি তুই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস। গুরুচরণবাবুকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এখনো কোথাও পাওয়া যায়নি। রাতে ঠিক কি হয়েছিল বলতো?”
আমি এক এক করে সব কথা খুলে বললাম। ঘরে তখন গুরুচরণ বাবুর জন্য কান্নার রোল পড়ে গেছে। ইন্দ্রদা গম্ভীর হয়ে গেছে। ঘড়ি বলছে সকাল আটটা। এরপর পুলিশ এল, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ চলল। তবে লাশের হদিশ না পাওয়া গেলে কিছু করা যাবে না স্পষ্ট জানিয়ে দিল।
ইন্দ্রদা আমাকে বলল, “চল কোথায় তুই লাশ দেখেছিলি দেখে আসি।” আমরা বাইরে এলাম, ইন্দ্রদা আমি সূর্যকান্ত চন্দ্রকান্ত আর বুবাই, জ্যাক আর নমিতা দেবী ঘরে থাকল, চাকরটাও রান্নাঘরে গেল। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গোটা সকালের আকাশটা আজ পালিশ করা আয়নার মত মনে হচ্ছে। আজ আলোতে বাগানটা প্রথম দেখলাম। কারণ লাশ যেখানে পড়েছিল সেটা দেখতে যাবার আগে ইন্দ্রদা বাগানে যদি কিছু পাওয়া যায় তা দেখতে চাইল।
বাগানে দাঁড়িয়ে গুরুচরণবাবুর ছোট্ট দোতলা বাড়িটা ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। গোটা ছাদটা থেকে লতিয়ে ওঠা গোলাপ আর ফোঁটা ফোঁটা রক্তের মত ফুলগুলো দুলছে। বাগানটাও অপূর্ব। ঝিরিঝিরি স্পাইডার চন্দ্রমল্লিকার অর্ধবৃত্তাকার নীল হলদে পাপড়িগুলো হাওয়ায় মাথা নাড়ছে। বাইকালারের ডালিয়াগুলো আনমনা হয়ে চেয়ে আছে অন্যদিকে। ছোট ছোট টোপর এর মত লাল হলুদ সাদা বিচিত্র ফুল মখমলি সবুজ ঘাসে বর্ডার দিয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে দু চারটে পেয়ারা আর আম গাছ, একটা রাবার গাছও রয়েছে। কাল রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে, আমরা কাদা মাড়িয়ে চললাম। ইন্দ্রদা ডানদিকে সার দিয়ে লাগানো লম্বা লম্বা রজনীগন্ধার স্টিকের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। একটা আধ খাওয়া সিগারেট মাটিতে পড়ে, বোধহয় চার্মস।
ইন্দ্রদা সূর্যকান্তবাবুর উদ্দেশ্যে বলল, “আপনারা বাড়িতে কেউ স্মোক করেন?”
-“আমি ছাড়া কেউ করে বলে তো জানি না।”
কাল বৈঠকখানায় দেখছিলাম একটা সিগারেট পড়েছিল। চার্মস কিনা লক্ষ্য করিনি।
চন্দ্রকান্তবাবু বলে উঠলেন, “জ্যাক কিন্তু মাঝে মাঝে স্মোক করে।”
ইন্দ্রদা কোনো মন্তব্য করল না। বাঁদিকে হিলহিলে লম্বা অজানা রঙের ডাঁটার বুকে হরেক রঙের পপি যেখানে দুলছে তার নিচে এক পাটি চটি বা চপ্পল… ফিতাটা কেটে গেছে… ইন্দ্রদার দৃষ্টি সেদিকেই। আমরা ওখানে আর সময় নষ্ট না করে মেনগেট খুলে বাইরে এলাম।
ইন্দ্রদা প্রশ্ন করল, “মেনগেট আপনাদের রাতে তালা দেওয়া থাকে?”
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁ। বাবারই ডিউটি ওটা।”
-“স্ট্রেঞ্জ। তাহলে কাল রাতে মেনগেট খুলল কে? আপনাদের বাড়ির বাইরে পাঁচিলটা একবার দেখব।”
আমরা মেনগেট থেকে বেরিয়ে পাঁচিলের গা বেয়ে চললাম। ইন্দ্রদা পাঁচিলের একটা জায়গা নিখুঁত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল… একটা কাদামাখা হাতের ছাপ।
-“যে ঢুকেছে এপথ দিয়েই ঢুকেছে। মানে পাঁচিল টপকে, কিন্তু মেনগেট খুলল কে?”
কাল যেখানে লাশটা পড়েছিল সেখানে এলাম। চারপাশে কাদাজল, প্রবল বৃষ্টিতে রক্তের দাগ পড়ে ধুয়ে মুছে গেছে। তবু কাদা আর রক্ত মিশে সেখানে যে রক্ত পড়েছিল সেটা বোঝা যায়। আমি সেই জায়গা থেকে একটা চশমা পেলাম। চন্দ্রকান্ত বাবু বলে উঠলেন যে ওটা তো বাবারই। এরপর আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে আমি সেই রাতে ভুল দেখিনি। তবে যে লোকটা আমাকে অজ্ঞান করে দিল সেই কি গুরুচরণবাবুকে খুন করেছে? বুবাই এতক্ষন কোনো কথা বলেনি। এবার বলে উঠল, “দাদুর কি হয়েছে?” আমি বললাম, “তোমার দাদু কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গেছেন, কিছুদিন পরই কাজ মিটে গেলে চলে আসবেন।”
ইন্দ্রদা মাটিতে আধবসা অবস্থায় কতকগুলো পায়ের ছাপ লক্ষ্য করছিল। খালি পায়ের ছাপ, চপ্পল বা জুতোর নয়, তবে দুটি ভিন্ন লোকের তা বোঝা যায়। একজোড়া ছাপ বড় আর একজোড়া সামান্য ছোট। আমরা ফিরে এলাম ঘরে। ফেরার সময় দেখলাম গুরুচরণবাবুর চপ্পল জোড়া বাড়িতেই রয়েছে। তাহলে কাল রাতে কি উনি খালি পায়ে গিয়েছিলেন?
আমি আর ইন্দ্রদা দোতলায় এলাম। ইতিমধ্যেই চাকর লালন আমাদের জন্য ডিম টোস্ট করে নিয়ে এসে টেবিলে রেখেছে। ইন্দ্রদা ওকে কাছে ডাকল। বয়স্ক মানুষ, মুখ নিচু করে আছে। চাকরটার মুখের সঙ্গে অসম্ভব রকমের মিল গুরুচরণবাবুর। অবশ্য একটু বয়স হয়ে গেলে মুখের ত্বকের কুঞ্চন বেশিরভাগ মানুষেরই এক মনে হওয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক নয় ।
-“তুমি এ বাড়িতে অনেকদিন আছ, না?”
-“হ্যাঁ বহুবছর।”
-“কাল রাতে কোথায় ছিলে?”
-“আমি তো কাল সবাইকে খাবার দিয়ে রাতেই বাড়ি চলে যাই। আমার বাড়িটা ওই দখিন পাড়ায়।”
লালনকেও লক্ষ্য করেছি পায়ে চপ্পল পরে না।
-“কাল রাতে তুমি যখন বাড়ি যাচ্ছিলে মেনগেটের বাইরে কাউকে দেখেছিলে কি?”
-“হ্যাঁ, একজন কিন্তু ঘোরাঘুরি করছিল বাবু, সিগারেট খাচ্ছিল।”
-“লোকটার মুখ দেখেছিলে কি?”
-“না বাবু। বয়স হয়েছে তাই চোখে ভাল দেখি না।”
আমি জানলার বাইরে সরু বারান্দাটার কাছে চলে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে কিছুই পেলাম না।
-“আচ্ছা লালন, তোমার বাঁ হাতে কি হল?” ইন্দ্রদার দৃষ্টি লালনের বাঁ হাতে কিছুটা জায়গা ছুলে গেছে সেদিকে। এমন সময় নমিতা দেবী নীচে থেকে লালনকে ডাকছে শোনা গেল। লালন চলে গেল।
আমরা কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ইন্দ্রদা সিঁড়ির কাছে একটা ছোট্ট ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো কুড়িয়ে পকেটে ভরে নিল। নিচে সবাই রয়েছে, কিন্তু গুরুচরণবাবুর জন্য গোটা বাড়িটা নিস্তব্ধ। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এক অচেনা ভদ্রলোককে চন্দ্রকান্তবাবুর সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। সাধারন বামুনের পোশাক, গায়ে পৈতে, সাদা ধুতি আর গায়ে কমলা কাপড় জড়ানো। মনে হয় স্নান করে এসেছেন। বয়স অবশ্যই তিরিশের কম। কাছে আসতেই চমকে উঠলাম। কাল রাতে যে লোকটা আমাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল সেই লোকটাই তো। আমার মুখ ভয়ে শুকিয়ে আমচুর হয়ে গেল।
অপরিচিত ভদ্রলোকটি আমার উদ্দেশ্যে বলল, “আমার দিকে ওরকম ভাবে চেয়ে আছ যে, চেনা চেনা লাগছে নাকি?” আমি চুপ, ইন্দ্রদাও আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে কেমনভাবে চেয়ে আছে। চন্দ্রকান্তবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এনার নাম সীতাপতি। আমাদের গ্রামে যে কালীমন্দির আছে তার প্রত্যহ পূজারী। বাবা মা কেউ নেই। বাবাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, তাই দুঃসংবাদটা শুনে সকালেই ছুটে এসেছেন। আর সীতাপতি, এনারা দুজন থাকেন কোলকাতায়। ইন্দ্রজিৎ সান্যাল নামকরা ডিটেকটিভ এবং ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌমাভ। আপনারা কথা বলুন। আমি একটু বাজারের দিকে ঘুরে আসি।” সীতাপতি আপত্তি করলেন, “না না, আমাকেও উঠতে হবে। সকালে মন্দিরে পুজো সেরে সোজা এদিকে এসেছি। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরব। বারুইপুর থেকে পিসিমার আসার কথা আছে।”
আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে উনি চলে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, উনিও খালি পায়ে এসেছেন। কিন্তু এই নিরীহ শান্ত মুখটাই যে কাল রাতে আমার দৃষ্টিতে হিংস্র হয়ে পড়েছিল, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এতদিন ইন্দ্রদার সঙ্গে রয়েছি, কোনো মানুষকে দেখে একেবারে ভুলে যাব তা হয় না। তবে ইন্দ্রদাকে এখনো কথাটা বলার সুযোগ পেলাম না ।
দুপুরে খাওয়ার পর আমি আর ইন্দ্রদা দোতলার রুমে চলে এলাম। বুবাই এর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ও আমার বেডেই বসেছিল। আমি ইন্দ্রদাকে সীতাপতি সম্পর্কে আমার সন্দেহের কথাটা বলেই ফেললাম। কথাটা শোনার পর ইন্দ্রদা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। বুবাই আমার বলপেনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ইন্দ্রদা যে এখনও অতল রহস্যে তলিয়ে আছে তা ভালই বুঝতে পারলাম। ইন্দ্রদা বলল, “কাল রাতের ঐ লোকটা যদি সীতাপতিই হয় তবে বাগানে চটিটা কার ছিল? আর সিগারেটটাই বা কে খেয়েছিল?”
চলবে…
বাবা! গল্প ক্রমে ঘটনাটা আরো জটিল হচ্ছে। বেশ লাগছে।
ধন্যবাদ
কাঁচের টুকরো, সিতাপতি, দু জোড়া পায়ের ছাপ আর লালন। এবার জমছে সাসপেন্স।।
সাথে লালনের হাতের কাটা দাগ। এর তদন্ত হয় জরুরি
মনে হচ্ছে এ রহস্য ভেদের জন্য অপেখ্যা করতেই হবে।
একদম ঠিক।।
ধন্যবাদ । আশা করি নেক্সট পার্ট গুলোও ভাল লাগবে
Besh jomjomat kahini
ধন্যবাদ
ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান কে করলো? পুরোহিত? কেউ কি বুঝেছেন?
আরো সাসপেন্স অপেক্ষা করছে নেক্সট পার্ট এ
আমার ও তাই মনে হলো। যে ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে তাতে নিশ্চিত হলাম না। অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
নেক্সট পার্ট এ আশা করি সাসপেন্স আরো বাড়বে ।
এবারে উত্তেজনা আরো কিছু বাড়লো।
নেক্সট পার্ট গুলোতে উত্তেজনা আরো বাড়বে আশা রাখলাম । ধন্যবাদ
খুব ভাল লাগছে পড়তে।
ধন্যবাদ
Rohosow darun dana bedheche.4th part ta kobe pabo
Amio admin er approval er opekkhai achhi
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
I am incessantly thought about this, appreciate it for posting.