মরচে ধরা রহস্য (পর্ব ৫ )
লেখা : শান্তনু দাস
প্রচ্ছদ : অনিন্দিতা রায় কর্মকার
আগে যা ঘটেছে
বিপিন চ্যাটার্জির বাবা সোমনীল বাবু এক নারীকে দেখে অজানা আতঙ্কে মারা গেলেন। তাঁর শেষ কথাগুলো, ‘জুল, হার, ক্ষমা, গুপ্তধন’ যে অসংলগ্ন কথা নয় তা ইন্দ্রদার ঘরে মার্টিনা ক্যাম্পবেলের আবির্ভাব এবং গুপ্তধনের ধাঁধা সমাধানের জন্য শাঁসানোর পর নিশ্চিত হল। কিন্তু সোমনীলের ঘরে গিয়েও কিছু বোঝা গেল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার ও বেশ রহস্যময়। খোঁজখবর করে জানা গেল, সোমনীল জীবনের বেশ কিছু সময় আমেরিকায় কাটিয়েছেন। তাহলে কি ওনার সঙ্গে মার্টিনার কোন যোগসূত্র রয়েছে? তারপর…
পর্ব ৫ – হার রহস্য
চারদিকটা শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যা যেন রাস্তার ধারে লাইটপোস্টের টিমটিমে আলোর অবস্থা দেখে হাসছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটা বিকট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খস খস করে কালো কোট আর টুপি পরা একজন সোমনীলবাবুর ঘরের দরজার দিকে ছুটে গেল। হাতে একটা টর্চ জ্বলছে নিভছে। সিঁড়ি দিয়ে নিস্তব্ধে ওপরে উঠে তালাচাবি দেওয়া ঘরটা খুলে ফেলল আগন্তুক। ক্যাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল। দুটো সন্ধানী চোখ আর টর্চের আলো খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু একটা জিনিস। এবার অন্ধকারে একটা বিকট শব্দ হল। কেঁপে কেঁপে শব্দটা বাতাসে মিশে গেল। আর সেই ছায়ামূর্তি কিছু একটা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।
সকাল হয়ে গেছে, পূবদিকের জানালায় মিটিমিটি রোদ। পাশের ফ্ল্যাটের পোষা ময়নাটা কথা বলছে। নীল প্রকৃতির রুপে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ফোনের রিংটা বেজে উঠল।
-“হ্যালো… ”
-“আমি বিপিন চ্যাটার্জী, তোমার ইন্দ্রদা আছেন?”
-“না, সে তো নেই। কাল বন্ধুর বাড়ি গেছিল। আজ সকালে আসার কথা। মোবাইলটাও অফ আছে। কেন, কোনো বিপদে পড়লেন নাকি? আপনার গলায় শঙ্কার ভাব…”
-“কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে বাবার মৃত্যুটাও ঠিক মেনে নিতে পারছি না। পুলিশের ওপর কোনো ভরসা নেই। একটাই উপায়, যদি ইন্দ্রজিৎ বাবু ওই শয়তান মেয়েটাকে ধরতে পারে। শোনো সৌম্য, কাল রাতে আমি যখন বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে কেউ আবার হানা দিয়েছিল।”
-“বলেন কি? আবার?”
-“পুলিশ তো আবার এসেছে, খুচখাচ তদন্ত চলছে।”
-“টাকা পয়সা চুরি গেছে নাকি?”
-“সমস্যাটা তো সেখানেই। চোর এসে অ্যাসিড দিয়ে তালা খুলে ঘর ঢুকেছে। ঘরের জিনিস সব যেমনকার সেরকম। আলমারি খোলার চেষ্টা হয়নি। আমি নিজে দেখেছি, সবকিছু যেমন ছিল তেমন আছে। আমি এটা বুঝতে পারছি না, আমাদের সঙ্গে কার এমন শত্রুতা আছে যে আমাদের এমন সর্বনাশ…”
-“রিল্যাক্স বিপিনবাবু। আমি ইন্দ্রদা এলে সব জানাচ্ছি। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি।”
-“ধন্যবাদ ভাই।”
মনে মনে একটা প্রশ্ন খোঁচা দিচ্ছিল । কাল রাতে সোমনীলবাবুর ঘরে তাহলে কে ঢুকেছিল? আমার সন্দেহটা অমূলক নয়। চট করে ইন্দ্রদার বন্ধু স্বপনদার বাড়িতে একটা ফোন করলাম কারণ ইন্দ্রদার ফোন এখন সুইচ অফ।
ঠিক আটটা দশে ইন্দ্রদা ঘরে ঢুকল। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। এসে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। প্রায় দশ মিনিট পর বেরিয়ে আসতেই একটা সটান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে, “গুপ্তধনের ব্যাপারটা কিছু মাথায় এল?”
-“হ্যাঁ, শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি। তবে তোকে পরে বলব। কালই এটার সমাধান করে ফেলেছিলাম। গাধা খুঁজতে গিয়ে কি বোকামিটাই না করেছি। সোমনীলবাবু একটা ধাঁধা তৈরি করেছিলেন বটে।”
-“তার মানে তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছ?”
-“তাই ধরে নিতে পারিস সমু।”
-“কিন্তু তার চেয়েও বড় সারপ্রাইজ আমি তোমাকে দেব।”
-“সেটা আবার কি?”
-“আগে প্রমিস করো গুপ্তধনের ব্যাপারটা এখনই সব খুলে বলবে?”
-“আগে তোর সারপ্রাইজটাই তো শুনি।”
-“জানো কাল রাতে সোমনীলবাবুর বাড়িতে আবার চোর ঢুকেছিল। আশ্চর্য্য যে চোর ঘর থেকে কিছুই নিয়ে যায়নি।”
-“এটাই তোর সারপ্রাইজ সৌম্য?”
-“দাঁড়াও, এখনো বলা শেষ হয়নি।”
গলাটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে ইন্দ্রদার স্টাইলে বলার চেষ্টা করলাম। ইন্দ্রদার দৃষ্টি আমার দিকে। মুখে আলতো হাসি। আমার দৃষ্টি সোজা ইন্দ্রদার চোখে।
-“কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে?”
-“কেন? আমার বন্ধু স্বপনের বাড়িতে।”
-“না। এখনই স্বপনদাকে ফোন করেছিলাম। ওখানে তুমি কাল যাওনি। কাল রাতে তুমিই গিয়েছিলে সোমনীলবাবুর বাড়িতে, গুপ্তধনের সন্ধানে। তাই না?”
-“ব্রিলিয়ান্ট গেস সৌম্য! সত্যি আমি ইমাজিন করতে পারছি না তোর এই উচ্চ চিন্তাধারাটা। এবার তো তোকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাবতে গর্ববোধ হচ্ছে।”
-“তার মানে আগে হত না বুঝি?” আমি ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করলাম।
-“না না, তা নয়। আই এম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ। সে যাই হোক, এবার শোন গুপ্তধনের রহস্যটা। ‘গাধারে মেরে দাদা’ এটা একটা স্বরলিপি। পরপর সাজালে দাঁড়ায় ‘গা – ধা – রে – মা – রে – কোমল ধা – কোমল ধা।’ কালো সাদা রং বলতে হারমোনিয়াম এর রিডগুলো বোঝানো হয়েছে। আর কান টানলে আওয়াজ হয় বলতে, বেলো টানলে তবেই তো সুর হয়। এই চিন্তাটা কাল মাথায় খেলে যেতেই কাল রাতেই পরখ করতে চলে যাই সোমনীলবাবুর বাড়ি। হারমোনিয়াম এর রিডে পরপর গা- ধা -রে -মা -রে কোমল ধা, কোমল ধা, বাজাতেই একপাশের কাঠটা বিকট শব্দ করে খুলে যায়। ভেতরে দেখি কতকগুলো হীরে আর থোকা থোকা টাকার বান্ডিল। হারমোনিয়াম এর ভেতর থেকে একটা ফটো পাই। শুধু ফটোটা নিয়ে হারমোনিয়াম এর কাঠটা যেমন ছিল সেট করে দিয়ে চলে আসি।”
-“ওহ মাই গড, ইন্দ্রদা! এতো একদম ফেলুদার গল্পের মত। সেখানে ছিল মেলোকর্ড, আর এখানে হারমোনিয়াম। কিন্তু ডিটেকটিভ তো গানের ‘গ’ জানে না, এটা কি তবে ঝিলিকদির কাছে শেখা?”
ইন্দ্রদা হেসে ফেলল। ঝিলিক সেনগুপ্ত ইন্দ্রদার গার্ল ফ্রেন্ড। আমি সুযোগ পেলেই ইন্দ্রদাকে খোঁচা মেরে দিই ইন্দ্রদার মুখে ফেলুদা মার্কা হাসিটা দেখবার জন্য। আমি জানতাম, ঝিলিকদি রবীন্দ্রসংগীত এ ফিফথ ইয়ার কমপ্লিট করেছে। ‘কোমল ধা’ কে যে সঙ্গীতের ভাষায় ‘দা’ বলে সেটা ইন্দ্রদার মস্তিষ্কপ্রসূত নয় বেশ ভালই বুঝতে পারছিলাম। ইন্দ্রদার কোমল হাসিটাই তার প্রমান। এবার ইন্দ্রদা বুক পকেট থেকে একটা পোস্ট কার্ড সাইজের ছবি বের করল।
আমি আবার ইয়ার্কি করে উঠলাম, “কার ফটো? মিস ঝিলিক সেনগুপ্তের নাকি?”
-“এবার একটা গাট্টা খাবি সমু। আমার মাথায় একটা স্টোরি প্লে করছে। তবে সবটাই অনুমান। সোমনীলবাবুর আমেরিকায় ওই কয়েকটা বছরই রহস্যের মূল শিকড়। দ্যাখ তো ছবিটা চিনতে পারিস কিনা?”
-“এ তো মার্টিনা ক্যাম্পবেল এর ফটো! কিন্তু সোমনীলবাবু এটা হারমোনিয়ামের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন কেন?”
-“সেটাই তো বুঝতে পারছি না সমু। আপাতত সোমনীলবাবুর ‘হার’ শব্দের অর্থ বুঝলি তো?”
-“হারমোনিয়াম। কিন্তু জুল মানে কি?”
চলবে …