রবীন্দ্রনাথ ও ভারতীয় দর্শন
লেখা : অরূপ কুমার পাল ও ছবি : অরিন্দম ঘোষ
“তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই.. “
রবীন্দ্রনাথের প্রতিটা সৃষ্টি তাকে নতুন করে চেনায়, তবে উপরের এই গানটি আমাকে যেভাবে ওনাকে চিনিয়েছে সেটা সর্বোত্তম বলে মনে হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ কে যারা তথাকথিত ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’ ও ‘পূজা’ পর্যায়ে আটকে রেখেছে, এই গানটি আমাকে তার থেকে অনেক দূরের তাঁর এক নতুন অস্তিত্বের সন্ধান দিয়েছে।
ভারতে প্রচলিত দর্শনগুলির একটি সাধারণ মত আছে, তা হল প্রায় সবাই বিশ্বাস করেন যে মানব অস্তিত্বের পাঁচটি সূক্ষ্ম স্তর আছে। প্রথম স্তরে মানুষ শুধু একটি শরীর, যা খাদ্যের অংশ পাচিত হয়ে একটু একটু করে কোষের মাধ্যম দিয়ে তৈরি হয়, এটাকে ওনারা বলেন অন্নময় কোষ। এই শরীরের অভ্যন্তরে যে বিদ্যুৎ সংকেতরূপী প্রাণ বইছে তাই অস্তিত্বের দ্বিতীয় স্বরূপ, প্রাণময় কোষ। এই প্রাণ যার দ্বারা নির্দেশিত বা পরিচালিত হয় সেই হল মন, আর মন হল অস্তিত্বের তৃতীয় স্বরূপ, মনোময় কোষ।
মন সমৃদ্ধ হয় জ্ঞানার্জন ও বুদ্ধির পরাক্রমতায়, আর সেটাই হলো অস্তিত্বের চতুর্থ সূক্ষ্ম স্বরূপ, বিজ্ঞানময় কোষ। এসবের বাইরে, মানুষের যে সূক্ষ্ম অস্তিত্ব থাকে, যা সব সময় আনন্দময়, যা সকল দুঃখ-কষ্ট ও জরাজীর্ণতার বাইরে, যে অস্তিত্ব তাকে অসীমের উপলব্ধি দেয়, যা এক অগাধ ও নিরবিচ্ছিন্ন সমর্পণের মাধ্যমে শান্তির স্থিরতা দেয়, যে অস্তিত্বের উপলব্ধি সমস্ত ভারতীয় দর্শনের মূল উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে, তাই হল অস্তিত্বের পঞ্চম ও সূক্ষ্ম মূল স্বরূপ, আনন্দময় কোষ। রবীন্দ্রনাথের এই গানের লাইন এর পরের কথাগুলো কিন্তু সেই দিকেই নির্দেশ করে -“কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই… ”
যে কোন শিল্পীর সৃষ্টিকারের উদ্দেশ্য একটাই যে তাঁর সৃষ্টি এতটাই হৃদয়গ্রাহী হবে, বা ছোঁয়াচে হবে, সকলের অন্তরে প্রবেশ করে যাবে নিমেষে। ভারতীয় দর্শন বলে যদি শিল্পী আনন্দময় কোষে গিয়ে কোন রচনা করেন তাহলে কিন্তু সেটা এরকমই হয়।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিগুলি কি এতটাই হৃদয়গ্রাহী, ছোঁয়াচে নয়?
মনে আছে রবীন্দ্রনাথের সেই বহুল প্রচলিত গানের লাইনটি “ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়.. ” আমি বহুবার এই লাইনটির মানে বোঝার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোথাও যেন গিয়ে প্রতিবার ঠিক ধরতে পারি না। কিন্তু যখন ভারতীয় দর্শনের প্রাথমিক ছাত্র হিসাবে ভক্তি তথা উপনিষদীয় দর্শনের বিভিন্ন পঙক্তির সাথে আলাপ হচ্ছিল তখন প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম প্রেমের স্বরূপ। প্রেম আসে তখনই যখন অস্তিত্বের ভিন্নতা থাকে না, অর্থাৎ ‘দুটি’ এই সংজ্ঞা থাকে না। যেমন মা তার সন্তানকে আলাদা অস্তিত্বের ভাবতে পারে না তাই সেখানে প্রেম নিগূঢ় হয়, যেভাবে প্রেমিক-প্রেমিকারা ভাবনায় দুটি শরীর থাকে, শুধু মনে এক হয়ে যায় প্রেমে পড়ে।
আর যদি সমগ্র প্রকৃতির অখন্ডতা জানতে পারি তাহলে সমগ্র কিছুই একাত্ম হয়ে যায় নিজের সাথে, তখন আর কিছু পাওয়ার থাকে না কর্তব্যটাই যেন আনন্দ হয়ে যায়। যেভাবে মা তার সন্তানকে আনন্দে পরিচর্যা করে, কোন উদ্দেশ্যে নয়, প্রেমে… এটাই তো রবীন্দ্রনাথ বলছেন “ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়…।” আর জানেন এটাই শেখায় অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন, যা বর্তমান ভারতের সবচেয়ে গ্রহণীয় দর্শন।
এখন রবীন্দ্রনাথকে আমি নতুন ভাবে জানি। “হে সখা, মম হৃদয়ে রহো, সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো…।” এই লাইনগুলি যে দিকে নির্দেশ করে, সে ভাবনায় এখন সহজিয়া ভাবেই চোখে জল আসে, রবীন্দ্রনাথ যেন আরও আপন হয়ে যায়, হয়তো আলাদা কেউ নয় এক, ‘অদ্বৈত’।