ক্ষমার অযোগ্য

ক্ষমার অযোগ্য || লেখাঃ অতনু কর্মকার

আগের পেশেন্ট এর রিপোর্টটা ল্যাপটপে অনলাইনে সাবমিট করে কিছুক্ষন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো ইদ্রিস, তিন চার সেকেন্ডস হবে হয়তো; এর বেশি নয়। একটু গম্ভীর ভাবে কিছুক্ষন আগে র করা আসিসমেন্টটা নিজের মনে মনে একবার যাচাই করে নিল। নাহ! ঠিক ই আছে, এই ধরনের পেশেন্টের কেসের অভিজ্ঞতা ওর ভালোই আছে। ভদ্রমহিলা ক্রনিক লোনলিনেসে ভুগছেন, এক্ষুনি কোনো ওষুধ ও সাজেস্ট করে নি। আরও দু-তিনটে সিটিংএর পর ভেবে দেখবে, ততক্ষণে একটু কনসাল্টিং ফিসের পরিমানটাও মোটা রকমের হয়ে যাবে। মেডিসিন ইস নট আ সল্যুশন রাইট নাউ;  এটাই ওর ক্লোসিং স্টেটমেন্ট ছিল;  যেটা একটু আগে জমা করলো ল্যাপটপ এর মাধ্যমে ।

উত্তর কলকাতার একটা মাঝারি মানের ক্লিনিক ;  তবে মনোরোগীদের জন্য। ইদ্রিসের নয়-নয় করে বছর দশ হয়ে গেলো এই ক্লিনিকে । ২০১০ সালে ডিপ্লোমা ইন সাইক্রিয়াটিকে করে ভেবেছিলো নিজের মতন করে প্রাকটিস শুরু করবে । কিন্তু প্রথম তিন-চার বছর সে রকম ভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি, এদিক ওদিকে প্রাকটিস করত; কিছুদিন ভুবনেশ্বরেও ছিল । উড়িয়া ভাষাটা ওর মা এর থেকে শেখা সেই ছোটবেলাতেই ; মামাবাড়ি তো কটকেই । কিন্তু লোকাল ভাষা জানা সত্ত্বেও খুব একটা জমেনি ওখানে । তাই কিছুটা নিজের ওপর বিরক্ত হয়েই কলকাতা ফিরে এসেছিলো । ওই সময়টাতে অরুনিমা অনেকটা হেল্প করেছিল ইদ্রিসকে , ইনফ্যাক্ট ওর জন্যই এই ক্লিনিক টা মোহনবাগান লেনে লিজে নিতে পেরেছিলো । মোহনবাগান লেন এর ঠিকানাটা ফুটবল পাগল বাঙালিরা খুব সহজেই মনে রাখতে পারে, আর এতেই আদতে ইদ্রিসের পেশেন্ট ভাগ্যটাও বেশ খুলে গেছিলো ।

অরুনিমা প্রসঙ্গে না হয় একটু পরে আসা যাক ! এখন ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁইছুঁই,  ডায়েরির এপয়েন্টমেন্ট এর পাতাটা উল্টে দেখলো,  আজকে আর একজন আসার কথা আছে;  নামটাতে চোখ রাখলো – মিসেস শর্বরী মজুমদার। নাম আর উপাধির মিশ্রনে একটা গাম্ভীর্য্য আছে ! সমস্যাও নিশ্চই সেরকমই গম্ভীর হবে! 

“বাপি, দেখতো, কেউ কি অপেক্ষা করছেন গেস্ট রুমে?”  কেয়ারটেকার টাকে একটা হালকা করে আওয়াজ দিলো । মন বলছিলো,  কেউ আর না থাকলেই ভালো হয় । তাহলে একটু কলেজস্ট্রিটে হিন্দু হোস্টেলের গলিতে ঢুঁ দিয়ে আসত; ওখানে ওদের ছোটবেলার বন্ধুদের একটা গল্পের ঠেক আছে;  কেউ না কেউ রোজই থাকে আড্ডা মারার জন্য । এটা ওদের সবার কাছে একটা  লাইফলাইনের মত;  সে গল্পতেও না হয় পরে আসা যাবে । আপাতত মিসেস শর্বরী মজুমদার ওর ঘরের পর্দাটা হালকা করে সরিয়ে জানতে চাইলো –

“ইস ইট ওকে, ইফ আই কাম ইন ?” 

খানিকটা হকচকিয়ে যে যায়নি ইদ্রিস, তা নয়! বুঝতে চেষ্টা করছিলো যে হতভাগা কেয়ারটেকারটা কোথায় গেলো ! কিন্তু কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি আবার বলে উঠলেন; এবার পর্দাটা পুরো সরিয়ে আর, একটা পা চৌকাঠে রেখে ;”আই এম শর্বরী ফ্রম ডোভের লেন, বাল্লিগঞ্জ !”

“সিওর, প্লিজ কাম ইন এন্ড বি সিটেড !”  ইদ্রিস সপ্রীতিত ভাবে ভদ্রমহিলাকে বসতে বললো । ওর চেম্বারে বেশি আসবাব পাত্র, একুয়ারিয়াম বা ডেকোরেশন অর্থাৎ আধুনিক ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ভিড় বাড়ানোর মতন কোনো জিনিস সেরকম নেই,  বেশিরভাগটাই তাই খালি, চার দেওয়ালে হালকা নীল রঙের ওয়াল পেইন্টিং । অনেকটা পুজোর সময়ের আকাশের মতন । চোখে লাগার মধ্যে একটা টি টেবিল আছে আর আছে হেলান কেদারা অতিথিদের জন্য । ইদ্রিস ওর পেশেন্টদের কে গেস্ট বলেই সম্বোধন করে, এটা ওকে পেশেন্ট দেড় সাথে কানেকশন তৈরির কাজটা সহজ করে দেয় । 

ধন্যবাদ বলে শর্বরী চেয়ার টা টেনে বসতে গিয়ে একটু থমকে গেল ।” যদি কিছু মনে না করেন, ইস দেয়ার এনিথিং এলস ফর সেটলিং ইন? এইটা খুব কোজি টাইপের” একটু ইতস্তত করে বললো ! 

“সরি, আমার এতটাই অর্র্যাঞ্জমেন্ট এখানে । আপনি আরাম করে বসুন না! আমি না হয় বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসছি, দুই তিন মিনিটই লাগবে, বড়োজোর ।” 

এই বলে ইদ্রিস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে রোয়াকে বসে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেটটা বার করলো । ইচ্ছে করেই বেরিয়ে এসেছে ও রূম থেকে । মহিলাটি এর মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে পারবেন আসা করি ।  মনে মনে হাসছিলো – আই এম শর্বরী ফ্রম ডোভের লেন, বাল্লিগঞ্জ ।  এই কথাটা মনে পরাতে । প্রথম দু তিনটে মুহূর্ত দিয়ে যেটুকুনি বোঝা যাচ্ছে যে মহিলাটি স্বতন্ত্রতা নিয়ে খুবই সচেতন । নিজেকে সাবধান করলো,  এতো তাড়াতাড়ি পেশেন্ট এর ব্যাপারে কনক্লুশনে আসাটা উচিত নয়, পক্ষপাতিত্ব চলে আসে পুরো প্রসিডিউরের মধ্যে। 

মিউনিসিপালিটি কাজের জন্য রাস্তাটা খুঁড়ে রেখে গলির দুই দিকেই নো এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে চারচাকা নিয়ে ঢোকা বা পার্কিং, কিছুই গত দুই সপ্তাহ ধরে করা যাচ্ছে না;  ওকে এখন ট্যাক্সি করেই যাতায়াত করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু হেঁটে মেট্রো ধরে নেয় কোনো কোনো দিন, আজকে কি করবে সেটাই ভাবছে। সিগারেটটা পুরো শেষ করলো না,  দেরি হয়ে যাচ্ছে । “ আই এম কামিং ইন” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইদ্রিস চেম্বারে ঢুকে স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল । কোলের ওপর ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে বললো, 

“বলুন, মিসেস শর্বরী, কি ভাবছেন?”

“ ভাবছি, কিভাবে শুরু করবো ! যাতে ব্যাপারটা পরে অস্বস্তিজনক না হয়ে যায়।” শর্বরীর গলার আওয়াজ আর ভঙ্গিমাতে বোঝা যাচ্ছে যে ওই তিন-চার মিনিটে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে ।  

“আপনি নিজের মতন করে বলুন না, আমি শুনছি।” ইদ্রিস একটু অধ্যেইয্য হয়ে পড়ছে, যদিও এটা ওর সহজাত নয়। এরপর ভদ্রমহিলা চেয়ার থেকে উঠে ধীর গতিতে জানালার সামনে গিয়ে পর্দাটা টেনে দিয়ে বললো, ” একটু অন্ধকার করে রাখলাম, আপনাকে দেখলে হয়তো কথা গুলো নিজের মতন করতে বলতে পারবো না, বুঝতেই তো পারছেন।”  

এটাকে ওদের ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘মুড ট্রিটমেন্ট সিচুয়েশন’ , ভদ্রমহিলা ইদ্রিস এর কাজের সুবিধাই করে দিলেন । ইদ্রিস কোনো কথা বলছিলো না, কারণ ও বুঝতে পারছে যে এবার শর্বরী কথা বলতে শুরু করবে, শুধুমাত্র কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা !

“ আমার জন্ম দুর্গাপুরে, বাবা ওখানেই স্টিল প্লান্টে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন । উনি তিন বছর আগে মারা গেছেন, মা চলে গেলেন আগের বছর । সামনের মাসে আমার উনচল্লিশ বছর পূর্ণ হবে, আর আমি হ্যাপিলি সিঙ্গেল। আপনি নিশ্চই কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস কোম্পানির নাম শুনেছেন, ডালহৌসিতে আমার অফিস । সেরকম বিশাল কোনো হ্যাপেনিং লাইফ আমি লিড করি না । কিন্তু বুঝতেই পারছেন, সিঙ্গেল বলে বন্ধুদের তালিকা না চাইলেও অনেকটা বড়ো হয়ে যায়;  এটা একধরেণর প্রফেশনাল হ্যাজার্ডের মতন । কিন্তু সেটা আমার সমস্যা নয়, এটা আমি হ্যান্ডেল করতে পারি নিজের মতন করে।

আমি বউবাজার গোয়েঙ্কা কলেজে পড়তাম তখন, বি.কম অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি সবে। ওখানেই ওর সাথে আলাপ ।  মেয়েটার নামে পরে আসছি, না হলে পুরো গপ্পটা শেষ করতে পারবো না। আচ্ছা আমরা কল্পনা করেনি ওর নাম সুলগ্না, ওই নামে আমার আবার তিনটে বন্ধুও আছে,” এই বলে স্বাভাবিক ছন্দে একটু হাসলো শর্বরী। 

ইদ্রিস চোখ দুটি বন্ধ করে হেলান দিয়ে শুনছে, শুধু শুনছে নয়; একটা এসেসমেন্ট করার চেষ্টাও করছে। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে যে এই কেসটা একটু অন্য ধরণের, কারণ মূলত পেশেন্ট সীমস ভেরি স্টেবল, এই ধরণের পরিস্থিতে মনোরোগের মূল কারণ খুঁজে পাওয়াটা একটু চাপের । যাই হোক, দেখা যাবে বলে মনে মনে আবার কানদুটোকে সজাগ করলো। 

“ আমি তখন একটু ইন্ট্রোভার্ট আর রিসার্ভড টাইপের ছিলাম। সুলগ্না ছিল মাঝামাঝি, খুব যে হুল্লোড়বাজ তা নয়, তবে আমাদের মধ্যে কিছু কমন ইন্টারেস্ট ছিল,  ফ্রীকোয়েসি খুব ভালো মিলতো । একসাথে সিনেমা দেখতে যেতাম, ফুচকা তো আমাদের সবথেকে প্রিয় স্ট্রিট ফুড ছিল,  গ্লোব সিনেমা হলের পাশের গলির ফুচকায়ালা তো আমাদেরকে প্রায় চিনেই গেছিলো । এখন তো হলটাই উধাও, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়ে গেছে শুনেছি; আসলে ওই ঘটনার পর থেকে আর কোনোদিন ওদিকে যাইই নি ।

আমার আপনার এখানে আসার কারণটা, মানে চিরাচরিত ভাবে লোকে যেটা বলে মনোরোগ, তার কারণ কিন্তু ও। আমরা জানেন তো আসলে খুউউব ক্লোস ছিলাম, মানে ছোটবেলাতে যেমন দুই বোনেরা হয়ে থাকে, একদম সেরকম। এখনকার বাচ্চারা খুব স্লীপ ওভার বলে শুনি, আমরা তো দিনের পর দিন কেউ না কেউ কারো বাড়িতে থাকতাম। আমাদের বাড়িদুটো কিন্তু পাবলিক বাসে মাত্র পনেরো মিনিট ! তাহলেই ভেবে দেখুন !”

“ কোন বছরে আপনি গোয়েঙ্কাতে ভর্তি হয়েছিলেন?” ইদ্রিস কৌতূহল বসে প্রশ্ন করল । 

“ কেন ? কলেজের রেজিষ্ট্রেণ চেক করবেন না কি?” বলে শর্বরী হাসতে শুরু করলো  ।  শীতকালে বিকেল পাঁচটাতেই বেশ অন্ধকার নেমে আসে। তারই ফাঁকে রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ির ডিপারের আলো ওর রুম টাকে ছুঁয়ে গেল । এক ঝলকে শর্বরীর সারা শরীরের ওপর দিয়ে আলোর রেশটা সৈকতের জলের মতন ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল । ওর পুরো শরীরটা হাসির তালে তালে কাঁপছে , ভরাট বুকের খাঁজটা এখন যেন আরো সুস্পষ্ট , তখনই খেয়াল করলো যে সাদা ব্লাউসের মধ্যে দিয়ে ভেতরের গারো রঙের অন্তর্বাস বেশ সুস্পষ্ট । আবার চোখ বন্ধ করলো ইদ্রিস , ঠাট্টাটাকে আমল দিলো না। আমল দেওয়ার মতন জিনিস তো চাক্ষুস হয়েই গেছিলো বাইরের আলোতে ! খুব ধীরে বললো, ” না না, আমি এমনি এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম ।”

“হ্যা , তো কি যেন বলছিলাম? আমাদের বন্ধুত্ব এরকমই ছিল , আমরা সবকিছুই শেয়ার করতাম। ইনফ্যাক্ট, আমাদের বয়ফ্রেইন্ডও।” এতোটুকনি বলে আবার হাসতে শুরু করলো ! এক ঝলক কিছু , আরো একটু বেশি কিছু দেখার আশায় আলতো করে চোখ দুটো খুলেছিলো ইদ্রিস , কিন্তু কোনো গাড়ির আওয়াজ এবার আর শুনতে পেলো না।

একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো, ” যদিও ঘটনাটা আমি জানতে পারিনি , আমিই কেবল জানতাম না , ওরা কিন্তু জানতো । ছেলেটার নাম ছিল ইউসুফ , আমি ওকে ইউ বলে ডাকতাম । তখন তো আমি অল্প বয়সের প্রেমে হাবুডুবু , আমাদের সমস্ত ডেট এর গল্প ও মানে সুলগ্না জানতো , এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুলগ্না যে সত্যিটা আমাকে বলেনি ; এটা আমি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি । এই রকম প্লটের সিনেমা, ন্যাকা ন্যাকা টিভি সিরিয়াল খুব কমন ; কিন্তু এটা যে আমাদের সাথেও হবে কখনো ভাবি নি।”

নিজের কাঁধের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে একটু চুমুক দিয়ে  বোতলের মুখ বন্ধ করে আবার ভেতরে রেখে বলতে শুরু করলো শর্বরী “ভাবা আর বোঝাটা সেইদিন হলো যে দিন দেখলাম ইউ ওদের বাড়িতে বসে টিভি দেখছে, মানে আমাকে ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেখে ইউ টিভি দেখার অভিনয় করছে, আর আমার বন্ধু বেডরুম এর চাদর ঠিক করছে !

আমি সেদিন কিছুই বলিনি ওদের কে, ইনফ্যাক্ট নেক্সট এক মাস আমি ওদের কে বুঝতেই দিইনি আমার রিঅ্যাকশন টা ! আমি আসলে মানসিক ভাবে খুব স্ট্রং ছিলাম ওই সময়ে । তাই অনেক করে নিজেকে বুঝিয়ে ছিলাম যে ওদের দুজনের মধ্যে কেউ নিশ্চই আর একজনের আগে ব্যাপারটা আমার কাছে স্বীকার করবে , তারপর আমি যা করার করবো । দেখুন এই পরিস্থিতিতে আপনি যতই চেষ্টা করুন, আগের মতন করে আর ওদের সাথে মিশতে পারবেন না । কিন্তু ওই সময়ে আমার কস্টিং এর ফাইনাল পেপার এর পরীক্ষা ছিল , ফলে সাপে বড় ই হলো আমার জন্য । ওই সময়টাতে আমি দিনরাত এক করে , কস্ট একাউন্টেন্ট ক্লিয়ার করে ফেললাম !  

ইনফ্যাক্ট যে তারিখে আমার কস্টিংয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো , সেই রাতেই সুলগ্না আমার কাছে চলে এলো । বিশ্বাস করবেন না , আমার বাড়িতে আসার পর থেকে সেই যে কান্না শুরু করলো , পরের দিন ওকে আমি ওর বাড়িতে ড্রপ করা অব্দি কাঁদছিলো । চোখ মুখের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন, ওর মা জিজ্ঞেস করছে 

“ কিরে বাবিন , শরীর খারাপ নাকি ? কি হলো তোর ?”

আমি ওর হাত টিপে ধরে উত্তর দিলাম – কিছু না কাকিমা, কাল আমরা সারারাত জেগে ফ্রেন্ডস দেখেছি, হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে একাক্কার , এবার সামলাও তোমার মেয়ে কে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকি নি ।”

“ বাবিন ? সুলগ্নার ডাক নাম?” ইদ্রিস আচমকাই জিজ্ঞেস করে বসলো ।

“ হ্যাঁ ।  সেইদিনও আমাকে সুলগ্না বলেনি ঠিক কি ঘটেছিলো ঐদিনে , অথবা কি সম্পর্ক ওদের মধ্যে ছিল বা হচ্ছিলো । আমিও প্রশ্ন করিনি । কারণ কিছুভাবে আমার মনে হয়েছিল , যদি কিছু হয়েও থাকে সেটা সুলগ্নার অজান্তে । আপনি, অথবা নিরপেক্ষ ভাবে যারা শুনবেন তারা হয়তো ভাববেন , এটা কি ধরণের পক্ষপাতিত্ব ? কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কেন যে আমি ওদের দুজনকেই খুব কাছের থেকে চিনি আর জানি । তাই এখানে এই বিচারককে আপনারা ভরসা করতেই পারেন । যাইহোক , এরপর থেকে আমাদের দুজনের বন্ধত্বর মধ্যে একটা তফাৎ এলো , আমি অনেক বেশি সাবধানী হয়ে উঠলাম ওর ক্ষেত্রে । যাতে ওকে কেউ এরকম ভাবে না আর ব্যবহার করতে সাহস করে । সুলগ্নাও এইসব ব্যাপারে অনেকটা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল । যাইহোক , আমাদের বধুত্ব আবার আগের মতন বাধনহারা আর সহজাত হয়ে চলছিল ।”

“ আর ইউসুফ ?” ইদ্রিস জানতে চাইলো । 

“ আপনি না  ! খুব প্রেডিক্টবল টাইপের পুরুষ মানুষ মনে হয় ।” শর্বরী একটু বিরক্ত হলো ।” ওই প্রসঙ্গে পরে আসছি , না হলে গল্পটা শেষ করতে পারবো না ।” ইদ্রিস মনে খটকা লাগলো, প্রেডিক্টবল টাইপের কেন বললেন ভদ্রমহিলা ওনাকে ? ওর চোখ যে শর্বরীর উর্ধাঙ্গে ঘোরাফেরা করছিলো একটু আগে, সেটা কি উনি বুঝতে পেরেছেন ? 

“ দাদা  বাইরের  গেট  কি  লক  করে  দেব ?”  কোনো জুতো জোড়া রাখা নেই দেখে ধরেই নিয়েছিল যে আর কেউই নেই । কেয়ারটেকার বাইরে থেকে জানতে চাইলো ।” না না , চাবিটা গেটে তালার মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে যা , আমি না হয় লাগিয়ে দেব বেরোনোর সময়ে ।” ইদ্রিস তড়িঘড়ি উত্তর দিলো  ।”  

“ ঠিক আছে দাদা , আমি আশেপাশেই আছি , শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে একটা বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলাম , স্পট ডেড ! একটু দেখে আসছি । ফেরার সময় একবার না হয় আওয়াজ দিয়ে যাবো ।” এই বলে বাপি উধাও হয়ে গেলো ।

“ ঠিক আছে”,  এই বলে আবার শর্বরীর দিকে তাকালো ইদ্রিস । উনি একটু বিরক্ত মনে হলো ছন্দপতন  হওয়াতে । অনেকবার করে  কেয়ারটেকারটাকে বলা হয়েছিল যে ভেতরে গেস্ট থাকলে আওয়াজ না   করতে । “দুঃখিত , আপনি বলুন প্লিজ ” বলে ইদ্রিস আবার চোখ বুজলো । 

“ এভাবেই চলছিল বেশ অনেককটা মাস,  প্রায় দেড় বছর হবে । তারপর সুলগ্না কলকাতার বাইরে একটা প্রাইভেট মেডিকেল সেন্টারে একাউন্টেন্ট হয়ে জয়েন করলো । আমিও তখন আমার কোম্পানিতে  নতুন , কাজকর্মের ধরণ বোঝার চেষ্টাতেই অনেকটাই সময় চলে যাচ্ছিলো অফিসে । ফলে আমাদের মধ্যে  ঐ যে একটা রোজকারের আলাপ-পরিচয় ছিল , সেটা আস্তে আস্তে একদিন অন্তর , তারপর সপ্তাহে দুবার, একবার করে হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কিন্তু ওইটাকে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম , কারণ এটাই  প্রাক্টিকাল !

কিন্তু পরে মনে হয়েছিল যে আমার একটু সতর্ক হওয়াটা উচিত ছিল । অফিসের বাইরে কি করছে  আর  করছে না ;  সেটার খবর নেওয়াটা হয়তো উচিত ছিল আমার । না হলে , আমাকে আজ আপনার  সামনে বসে থাকতে হতোনা ।”

ইদ্রিস মনে মনে বললো ,” ঘটনা ঘটাবে তোমরা , আর এমন ভাব করবে যে সাইক্রিয়াটিকরা টাইম  মেশিনে করে সময়-কাল জয় করে পৌঁছে গিয়ে ঘটনাগুলোকে বদলে দেবে ।  শোনাই যাক না পুরো  ইতিহাসটা ,  চায়ের ঠেকটা আজ আর হলো না ।” হোয়াটসাপে ছোট্ট করে একটা নোটিফিকেশন পাঠিয়ে রাখলো স্কুলের গ্রুপে ,  যে আজ আর যাওয়া হচ্ছে না !

“এইভাবেও প্রায় দেড় বছর কেটে গেছিল , তারপর একদিন সুলগ্না বোমাটা ফাটালো , একটা চিঠি ইমেইল  করে আমাকে পাঠালো । আফটার রিডিং দ্যাট আই ওয়াস আটার্লি কনফিউসড ! আমার রাতের ঘুম   চলে গেছিলো পুরো ওই সপ্তাহটাতে । দিনের বেলায় অফিসের কাজেও মন বসছিলো না । একটাই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। 

কিভাবে এতটা জড়িয়ে গেলো সুলগ্না ! ওখানকার চিফ এককোনটেন্টের সাথে ওর একটা বেশ সিরিয়াস সম্পর্ক তৈরি হয়েছে , আর সেটাকে নিয়ে ও খুব অবসেসড । দেখুন , বন্ধু হিসাবে এটাতে আমার খুবই  খুশি হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু আমার সবার প্রথমে খটকা লাগলো এই ভেবে যে,  এতদিন পরে  আমাকে ও কেন জানাচ্ছে এই ঘটনাটা ? আমারতো সবার আগেই জানা উচিত ছিল , তখনি মনটা  আমার কূ ডেকেছিল । কিন্তু চিঠিটা পুরোটা পড়ার পরে সমস্ত ঘটনাটা আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হলো ।

সংক্ষেপে বলতে গেলে ওর কলিগটি বিবাহিত , কিন্তু চিরাচরিত গল্পের প্লটের মতন নয় । মানে সেটা ও শুরু থেকেই জানতো । আসলে সেই ইউসুফ এর ঘটনাটার পর থেকে ও একটু রিসার্ভড হয়ে গেছিলো , আর এই পুরো ঘটনাটাই নাকি ওর কলিগটিকে ও জানিয়েছিল । কিছুটা সহানুভূতি , কিছুটা কান্ধা দেওয়া , আর বাকিটা হাসি ঠাট্টার ছলে ওরা দুজনেই খুব দুজনের কাছাকাছি চলে আসে । কিন্তু সেটাকে যে অন্য আরেকজন সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করবে, সেটা বুঝতে কি খুব অসুবিধে হয় ?  কিন্তু যার বোঝার ছিল, সে কেন বুঝলো না কে জানে ? 

এরপর যত দিন যাচ্ছিলো ব্যাপার গুলো আস্তে আস্তে জটিল হয়ে আসছিলো , আর তার সাথে সুলগ্নার মানসিক পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছিল । এর মধ্যে বাড়ি থেকে ওর বিয়ের জন্য একটা সুক্ষ চাপ আসা শুরু হয়েছে , কিন্তু এই সম্পর্কের কথা তো কাউকে বলতেও পারছে না !  স্বভাবততই বাবা মা এর সাথে প্রায় রোজই ওর কথা কাটাকাটি লেগেই থাকতো এ নিয়ে । আস্তে আস্তে ও ডিপ্রেশনের দিকে এগোচ্ছিল,  সেটা আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম ।

যাই হোক,  চিঠিটার প্রসঙ্গে আসি আবার । যদি সংক্ষেপে বলতে হয় তাহলে ঘটনাটা হলো,  সুলগ্না ঠিক  করেছে যে সারা জীবন ও কাউকে বিয়ে করতে পারবে না । ওদিকে আবার ওর কলিগের থেকে কোনো সোশ্যাল এক্সপেকটেশনও নেই, কিন্তু উনি যেন কোনোদিন ওকে ভুলে না যায় বা ওর সাথে যোগাযোগ যেন বন্ধ না করে । এতো অব্দি তাও ঠিক ছিল – মোটামুটি চেনা গল্পের ছক । কিন্তু  নিজের বৌয়ের অনুপস্থিতিতে নিজের ফ্ল্যাটে , নিজের বিছানায়; কিভাবে একটা লোক দিনের পর দিন কাউকে জড়িয়ে নিতে থাকে ? একটা মানুষ কি আর একটা মানুষের শুধুই টাইমপাস এর বস্তু হয়ে উঠতে পারে এইভাবে ? লোকেরা হয়তো বলবে এটাতো দুজনের সম্মতিতে , কিন্তু হোয়াট এবাউট আফটার এফেক্ট ?  অনুশোচনা হয় না এই ভেবে যে একজন নয় ,  দুজনকেই ঠকাচ্ছি ? আমরা যখন কারো সাথে মিশি তখন তার ভালোমন্দর সামান্য হলেও দায়িত্ব তো বর্তায় , তাই না ? দায়িত্ব আসে না বলুন ইদ্রিস বাবু ?”

এই ধরণের অস্বস্তিকর প্রশ্ন ওকে কেউ করেনি অনেকদিন, উত্তরটা এড়িয়ে গেলো। শর্বরী উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চলেছে ” কিন্তু আমার মনে আবার একটা খটকা লাগছিলো এই ভেবে যে আমাকে সুলগ্না এখন কেন বলছে ? কেন এখন ওই ইমেইলটা যেটা ও ওর কলিগকে লিখেছিলো সেটা আমাকে ফরওয়ার্ড করেছে ? এমন কি আছে কারণ ? একদিন হোয়াটসআপ করলাম, আর ইউ মিসিং  পিরিয়ডস ? বললো, না না ওরকম কিছু নয় । তখন বুঝলাম, স্বাভাবিক ভাবেই ওর কলিগ এসব ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধানী । 

আস্তে আস্তে পরের এক দুই মাসে আমার সাথে অনেকটা খোলাখুলি হলো সুলগ্না আবার । মাঝের  ঘটনাগুলো আর বলছি না, সংক্ষেপে ওকে আমি অনেকটা কনভিন্স করতে পেরেছিলাম যে এই  ব্যাপারটাকে ফিজিক্যাল রিলেসন হিসাবে পাল্টে ফেলতে । অনেকটা ডেটিং আপের সম্পর্কগুলোর মতন। আপনি হয়তো ভাবছেন এতো ডিটেলস আমি কেন আপনাকে দিচ্ছি ? মূলত দুটি কারণে , প্রথমত এতে  আপনার ডায়গোনসিসে সুবিধা হতে পারে । আপনার কনসাল্টিং চার্জ আমি প্রতি ঘন্টা হিসাবেই মিটিয়ে দেব ,  তাই একটু ধৈর্য্য দিয়ে শুনবেন দয়া করে । আর দ্বিতীয়ত , আমার মনে হলো পুরো ঘটনা যেটা  আমার সো কল্ড ডিপ্রেশনের কারণ সেটা যদি কাউকে বলে ফেলতে পারি , তাহলে হয়তো অনেকটা  রিলিভড হবো , ন্যাচারাল হিলিং ও বলতে পারেন আর কি ।”

ইদ্রিসকে একটু কনফিউসড লাগছিলো , এতটা ডিটেইলিং কোনো পেশেন্ট নিজের থেকে কোনো দিন করে না ,  কোথাও যেন একটা জট আছে । ও নিশ্চিত ওর সামনের হালকা হলুদ রঙের শাড়ি পড়া মহিলাটি জট এর আশেপাশে ঘুরছেন , এখনো মূল সমস্যার মধ্যে ঢোকেননি । নিজের মনেই “দেখা যাক” বলে আবার মনোযোগ দিলো । যখন থেকে শর্বরীর রূপ একঝলক নজরে এসেছে তখন থেকে ওর দিকে নজর যেতেই একটু অস্স্বস্তি আসছে , হাজার হোক পেশেন্ট তো !

“কিন্তু ঘটনাটা এবার অন্য দিকে টার্ন নিলো । ওদের কিছু পার্সোনাল ফটো ছিল ,  যেমন হয় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ; বিছানায় বসা শোয়া অবস্থায় ইত্যাদি । অসাবধানতা বসত তারই একটা ফটো ওর কলিগ তার হোয়াটস্যাপ গ্রূপে শেয়ার করে ফেলে , পরে নাকি ভুল বুঝতে পেরে ডিলিট করেও দিয়েছিলো । কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছিলো কিছুটা । প্রথমে সুলগ্না জানতো না , পরে আশেপাশের লোকের আচার আচরণ দেখে আর আলোচনা শুনে ওর কলিগকে জিজ্ঞেস করে,  সেও স্বীকার করে ফেলে । আশ্চর্য ভাবে ওই লোকটার কিস্তু কোনো আফসোস ছিল না , বরঞ্চ ওকে জিনিসটা ফ্রেন্ডলি ভাবে স্বীকার করতে বলে । শহরটা ছোট, লোকজন কম ; তাই স্বভাবিক ভাবেই যত দিন যাচ্ছিলো , লোক জানাজানি বাড়ছিল পরিচিতদের মধ্যে । আমি যখন জানতে পারলাম , ওকে সঙ্গে সঙ্গে রেসিগ্ন্যাশন দিয়ে ফিরে আস্তে বললাম । কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসেও ও আর স্বাভাবিক হতে পারে নি কোনো দিন , নতুন কোনো চারকিতে জয়েনও করেনি আর । বাড়ির মধ্যেই টিউশন শুরু করেছিল । শেষ ছয় মাস তো বাড়ি থেকেই বেরোয়ই নি । ওর শেষ হোয়াটস্যাপ , এই দেখুন বলে চেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে দেখালো শর্বরী 

1. সেদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই টেরই পাইনি যে কখন ইউসুফ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ।

2. একবচন নয়রে, ফটো শেয়ার হয়েছে বহুবচনে । অসাবধানতা বসত নয়রে, আজ জানতে পারলাম ।”

ইদ্রিসের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো , হোয়াটস্যাপ এর স্ক্রীনসেভার টা লক্ষ্য করার পর । একটু থেমে আর থমকে থমকে ইদ্রিস বলে উঠলো “ অরুনিমা ! আপনি ওকে চেনেন নাকি ?”

“তাহলে এতক্ষন কি আমি সময়টা পুরোই নষ্ট করলাম ?” শর্বরী একটু তাচ্ছিল সুরেই বললো । এবার ইদ্রিসের টাইম মেশিনে চড়ে পিছিয়ে যাওয়ার পালা । অরুণিমার সাথে সম্পর্কটা ওর বৌ জানার পর থেকে কিছু দিন আলাপ পরিচয় বন্ধ করতে হয়েছিল । এটা কোনোদিনই দৈহিক ছাড়া অন্য কিছু ছিল না ওর কাছে , বৌ সেই ঘটনার পর থেকে ওর ওই চাহিদা সুদে আসলে মিটিয়ে দিতো । 

কলকাতায় আসার পর আবার কথা হয়েছিল ওদের মধ্যে , মূলত এই ক্লিনিকটা সেট করার পেছনে অরুণিমার অনেক কান্ট্রিবিউশন ছিল । অরুনিমাই ওর জ্যাঠা কে বলে এই জায়গাটার লিজ এর কাগজ পত্তর জোগাড় করেছিল , হটাৎ করে মেয়েটা একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল । হয়তো কিছু এক্সপেক্টশন রেখেছিলো ইদ্রিসের ওপর ও । ইদ্রিস এর কোনো এক বন্ধু নাকি অরুণিমাকে ফাঁস করে দিয়েছিলো  যে ওর কাছে যে ইদ্রিস নিজের এলিট পৌরুষত্ব এর স্টেটাস প্রমান করার জন্যই একাধিক ফটোগুলো জেনেবুঝেই পাবলিক করেছিল । এটা শোনার পর থেকে অরুনিমা ইদ্রিসের সাথে আর কখনো যোগাযোগ করে নি । এক দুই বার হোয়াটস্যাপ করেছিল ইদ্রিস , কিন্তু উত্তর না আসায় ও নিজেও কিছু দিন পর ব্যাপারটাকে নরমাল ভেবে ভুলে গেছিলো ।  

“ও এখন কোথায়? আপনার সাথে কন্টাক্ট আছে ?” ইদ্রিস যথেষ্ট বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করলো।  

“পুরো গল্পটা তো এখনো বলা হয় নি , শুনুন না । হ্যা , আমার সাথে ওর কন্টাক্ট এখন আছে বলতে পারেন । তারপর কোথায় যেন ছিলাম , হ্যা ওর হোয়াটস্যাপ টেক্সট তো আপনি দেখলেন । যে রাত্রে ও টেক্সট করলো , বর্ষার বৃষ্টিতে তখন কলকাতা পুরো ভেসে আছে । তাই ভাবলাম পরেরদিন সকালে অফিসএ যাওয়ার আগে ওর বাড়িতে ঢুঁ দেব । পারলে একটাদিন অফিস ডুব দিয়ে দেব , অনেক কথা জমে আছে আমাদের মধ্যে । 

রাতে ফোনটা রিং হতে ঘড়িতে দেখলাম দেড়টা , এতো রাতে ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে ধরতে গেলাম! সুলগ্না,  এই নামটাই থাক গল্পতে , অরুনিমা উহ্য থাক নয়, ঠিক আছে ? কলার আইডি তে ওর মায়ের নাম ভাসছে;  কাঁপা কাঁপা গলায় কাকিমা শুধু এইটুকুনি বলতে পারলেন – শর্বরী একটু আমরি সল্টলেকে আস্তে পারবি ? তোর বন্ধু … 

আর কিছু শুনতে পেলাম না আর । কোনোভাবে পৌঁছে গেলাম ইমার্জেন্সিতে , কিন্তু সব শেষ জানেন তো ! ডান হাতের কব্জির ওপরটা ডাক্তাররা ব্যাণ্ডেজ করে রেখেছে । পুরো শরীর তা সাদা চাদরে ঢাকা মুখ অব্দি  ! ওই হাতটা একটু বেরিয়েছিল, আমি ওর বেরিয়ে থাকা হাতের ওপর একটু হাত রাখলাম । হাত বুলিয়ে দিলাম, ক্ষমা তো ওকে আমি আগের রাতেই করে দিয়েছিলা । সামনাসামনি বলার সুযোগই আর দিলো না জানেন তো, আসলে ও খুব অভিমানী তো । আপনি কোনোদিন বোঝেননি না ?

আমি কিন্তু হাসপাতাল থেকে চলে আসিনি পালিয়ে । ও একমাত্র সন্তান,  বুঝতেই পারছেন ওর বাবা মায়ের অবস্থা । থানা-পুলিশ , হাসপাতাল, মর্গ, দাহ – শেষ অব্দি ছিলাম আমি । কেমন একটা ঘোরের মতন কাটছিলো , ওকে মিস করার কথা মনেও আসছিলো না । মাস দুই-তিন পর কাকু কাকিমা কলকাতা ছেড়ে বাঁকুড়া শিফট হয়ে গেলেন ওদের পৈতৃক বাড়িতে , ওনারা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা একাকিত্ব  আর অবসাদ এসে থাবা বসালো , খালি মনে হতো যদি সেই রাতেই আমি চলে যেতাম ওর সাথে দেখা করতে ! কি এমন ক্ষতি হতো ? একটু ভিজতাম হয় তো, এর থেকে বেশি তো কিছু নয় ! গত দুবছর ধরে এই স্মৃতি , একাকিত্ব , অবসাদ আর অনুশোচনা নিয়ে আমি রয়ে গেছি । একদিন অন্তর একদিন রাতে ঘুম আসত ! তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে বোঝালাম, অনুশোচনা আমার কেন হবে?   তাদের কেন হবে না ?  যাদের নাম ওই টেক্সটের দুটো লাইনে উল্লেখ ছিল ।”  

মাথায় হাত দিয়ে টেবিলে ভর দিয়ে বসে আছে ইদ্রিস , এখন ওর হৃৎপিন্ডটা বেশ ভালোই ওঠানামা করছে , এখন শর্বরীর পালা সেটাকে উপভোগ করার !

“বিশ্বাস করুন , আমি এসব কিছু জানিই না , আমাকে কেউ জানায়ও নি ! হোয়াট আ লস !  সাচ আ লাভলী লেডি সি ওয়াস ।”

এই প্রথম শর্বরীর চোখ দুটো আগুনের মতন জ্বলজ্বল করে উঠলো ।  সেটা ইদ্রিসের নজর এড়িয়ে গেল। “আরে, আপনি এতো ভেঙে পড়েছেন কেন এক্ষুনি ? আচ্ছা একটু আগে জানতে চাইছিলেন না যে আমার ইউ এর কি হলো ?”

“হ্যাঁ?” কিছুটা বোকার মতন প্রশ্ন করে ফেললো ।  

“শুনুনই না তাহলে, সে তো একটা নামকরা সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করতো । ওর একটা স্বভাব ছিল সবসময় ব্যালকনির রেলিং এ ঝুকে সিগেরেট খাওয়ার । অনেক বারণ করতাম জানেন, যদি কিছু হয়ে যায় । দু সপ্তাহ আগে খবরের কাগজে একটা ছোট্ট নিউস কলাম ছিল , হয়তো আপনার চোখে পড়েনি। অফিসের সাততলার ব্যালকনি থেকে পরে এক তরুণ কর্মীর মৃত্যু , এই ধরণের কিছুই একটা । তবে নাকি তদন্ত হচ্ছে , এটা এক্সিডেন্ট কিনা নিশ্চিত নয় । করুক না পুলিশ তদন্ত !”

ইদ্রিস এর মাথায় কিছু আসছে না , কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে মনে হচ্ছে ওর । শর্বরীর চোখ দুটো খুব অস্বাভাবিক লাগছে এখন ইদ্রিসের কাছে । ভদ্রমহিলা কি কোনো ইলুশন তৈরি করছেন ? এইরকম একটা কেস ওরা কলেজে পড়ার সময় ক্লাসে ডিসকাস হয়েছিল । কিন্তু এখানে তো ও নিজেই জড়িয়ে গেছে ! কি করবে ঠাওর করতে পারছে না একদম ।  

“দেখবেন না কি ইউ এর প্রোফাইল পিকচার ? বেশ হ্যান্ডসম টাইপের ।” এই দেখুন বলে শর্বরী হটাৎ করে ফোনের স্ক্রিনটা ওর চোখের সামনে নিয়ে এলো , ঘটনার আকস্মিকতায় ইদ্রিস চোখে মুখে সর্ষেফুল দেখার মতন অবস্থা । এবারে শর্বরীকে চেয়ার থেকে উঠতে হয় নি , বসে বসেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে এলো ইদ্রিসের চোখের সামনে । অস্বাভাবিক লম্বা একটা হাত অন্য হাতটার তুলনায় ! এ কি করে সম্ভব! বুড়ো আঙুলের নেইলপলিশ এর রং লাল , বাকি আঙ্গুলগুলো গাড়ো নীল । ইদ্রিসের কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হচ্ছে , তলপেট এর জায়গা থেকে ঘাম জড়ো হয়ে নিচের দিকে জায়গা খুঁজছে। এতোটা ইলুশন ওর কি করে হচ্ছে ? ইউকে দেখার মতন মানসিক শক্তি ওর বেঁচে ছিল না , স্ক্রিনের পাস্ দিয়ে শর্বরী চোখের দিকে নজর গেল ! এ কি ভয়াবহ ! এ কি দেখছে ?  শর্বরীর ওই সুন্দর চেহারার মধ্যে শুধু চোখের কোঠর দেখা যাচ্ছে , দুটো জ্বলন্ত কোঠর । নিজের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, খালি সময় গুনছে । যদি এইটা দুঃসপ্ন হয় , নিশ্চই একটা সময় ভেঙে যাবে।    

হটাৎ করে শর্বরীর চোখদুটো আবার আগের মতন শান্ত হয়ে গেল। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো ইদ্রিসের দিকে, ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে টেবিল এর ওপর ঝুঁকে পরে বললো, ”বলুন এখন কেমন অনুভব করছেন?”

“ মানে?” ইদ্রিস থতমত খেয়ে জানতে চাইলো ।

“মানে এই যে একটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মহিলা, সিঙ্গেল, শাড়ি পড়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । এইটা কেমন উপভোগ করছেন ?” আরো একটু ইদ্রিসের দিকে ঝুঁকে ওর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালো ।

সাদা রঙের ডিপ কাট ব্লাউস ভেদ করে ভেতরের অন্তর্বাস অনেকটাই দেখা যাচ্ছে । ওর শরীরের অল্প অল্প ঘামের মিষ্টি গন্ধ ইদ্রিসের নাকে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে , বুকের বাঁদিকের গভীরে বাদামি তিলটা একদম একই জায়গায় রয়েছে, যেরকম ছিল অরুণিমার । দামী পারফিউমের তীব্র গন্ধ শর্বরীর গ্রীবা থেকে, কানের লতির পিছন থেকে আসছে । একদম ঠিক একইরকম অনুভূতি , অরুণিমার সময় যেটা ও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করত । 

“ আপনি কে ?” আর থাকতে না পেরে প্রশ্ন করে উঠলো ইদ্রিস , এটা যে দুঃস্বপ্ন নয় সেটা ও বুঝতে পেরেছে । 

নিজেকে ওই ভঙ্গিমাতেই রেখে শর্বরী উত্তর দিলো, “যে পরিচয় আপনাকে দিয়েছি, আমি সেই । আপনি বুঝতে পারেন নি? আপনার কেয়ারটেকার ছোকড়াটি কাউকে দেখতে না পেয়ে তালা দিয়ে দিছিলো, আপনি বারণ করলেন। আপনি জানেন যে এই কয়েকদিন আপনার ক্লিনিকের সামনের গলিতে কোনো গাড়ি যাতায়াত করছে না, তাও আপনি গাড়ির আলোতে আমার রূপের বাহবা করলেন মনে মনে । বাবিন, এই ডাকনামটাও তো আপনার জানা , তাও আপনার মনে কোনো সন্দেহ হয় নি ! গত আধ ঘন্টা আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় ঠিকঠাক কাজ করছিলো না মনে হয়, অন্য একটি ইন্দ্রীয় প্রবল ছিল বলে হয়তো।

আপনি জানতেও পারেন নি, শ্যামবাজার এর পাঁচমাথার মোড়ে যে ফ্যাটাল আকসিডেন্টটা হয়েছে সিরাজ রেস্তোরার সামনে , সেখানে এখনো একটা মধ্যে বয়সী ভদ্রমহিলা স্কুটি থেকে পরে গিয়ে রাস্তায় পরে আছে , একটা বেসরকারি বাস ওর মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে । আসলে আপনার কাছেই আসছিলাম দেখা করতে , ট্রাম লাইনে স্কিড্ করে গেলাম এমন ভাবে যে আর টাল সামলাতে পারলাম না ! আর তখনই বাসটা কাটাতে না পেরে আমার মাথার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলো । ভাবলাম এতো কাছে এসে আপনার সাথে না দেখা করে চলে যাবো ? এটা হয় নাকি ? সুলগ্না , সরি অরুণিমাকে কি উত্তর দেব ? আপনি যদি আমার জায়গায় হতেন , তাহলে আপনি কি করতেন, বলুন?”

“আ আ … আপনি কি চান?”  অসহায় ভাবে প্রশ্ন করলো  ইদ্রিস।  

“আপনার সেই বন্ধুটিকে কি আজ আপনাদের চায়ের ঠেকে পাওয়া যাবে ? হিন্দু হোস্টেল এর পেছনে ?” শর্বরী আর একটু এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো । 

“কে ? কোন বন্ধু?” ইদ্রিস প্রমাদ গুনলো ।

“ কেন, আপনি কুন্তল কে ভুলে গেলেন ? যাকে আপনাদের রঙিন মুহূর্তের ফোট্ শেয়ার করে নিজের পৌরুষত্বের বাহবা কুড়ালেন , সেই বন্ধুটি ।”

“ ওটা তো ওরই পাড়া , তবে আজকে তো আমি যাবো না লিখে দিয়েছি , হয়তো ও আসবে না। আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন ? এটা তো অনেক দিনের পুরোনো ঘটনা , আর অরুনিমা তো বেঁচেও নেই । আর তো কোনো ক্ষতির সম্ভাবনাও নেই। ওকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।”

“ আপনি প্লিজ ওকে একটু আসতে বলুন না , আপনাদের আড্ডার জায়গাতে , একটু লিখে দিন হোয়াটসাপে। আপনি নাকি খুব তাড়াতাড়ি টাইপ করতে পারেন , শুনেছি আমি ।”

কোনোমতে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলো যে তিরিশ মিনিটের মধ্যে আমি আসছি , তুই থাকিস ; কিছু কথা আছে । 

“ আজকে আপনার আমাকে দেখে লোভ হচ্ছে না ? এই যে এতো কাছে আপনার, হাতের নাগালের মধ্যে পুরো , দিস ইউসড টু এরৌস ইউ, ভুলে গেলেন ?”

“ না না, আমি কখনো ওর অমঙ্গল চাই নি , আপনি বিশ্বাস করুন । কিন্তু অরুনিমা আমার ওপর খুব নির্ভর হয়ে পড়ছিলো । আমি চাইনি একটা অদ্ভুত টাইপের সম্পর্কের জন্য ও নিজের জীবনটা নষ্ট করুক, আমি তাই ইচ্ছে করেই একটা সময়ে ওকে ইগনোর করতাম । তারপর আমার মিসেস ও ব্যাপার টা জেনে গেছিলেন । আমার কাছে আর কোনো অপসন ছিলোনা ।“  এর থেকে বেশি আর কিছু ওর গলা দিয়ে বেরোলো না।  

“ যদি অরুনিমা চাইতো , আপনার পরিণতিও আমার সেই ইউ এর মতনই হতো , কিন্তু আপনার একটা তিন বছরের ছটফটে ছেলে আছে বলেছে আমায় । সিঙ্গেল মাদারের লাইফ খুব কঠিন, চারিদিকে হাজার হাজার ইদ্রিস আর কুন্তলে ছেয়ে আছে । অরুনিমা চায় না যে আপনার ছেলে আপনার মতন মানসিকতা নিয়ে বড় হোক, আশাকরি আপনার বৌও সেটা চায় না । আপনি আসলে ভীষণ ভাবে ক্ষমার অযোগ্য”!

একটু অবসাদ ছেয়ে এলো শর্বরীর মুখে । সেই হিংস্র ভাবটা অনেকটা উধাও। ”আপনার যখন আমাকে নিয়ে সেরকম উৎসাহ নেই , তাহলে আমি আপনার বন্ধুর সাথে একটু দেখা করে আসি । আপনার অজান্তে সে বন্ধু আপনাদের অনেকগুলো ছবি বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে দিয়েছে । শুধু খেয়াল রাখবেন, আপনাকে সব সময় দুজোড়া চোখ খেয়াল রাখছে , হিসাব নিকাশ কিন্তু এখনো পুরো শেষ হয় নি !”

এই বলে আস্তে আস্তে ঘোর থেকে বেরিয়ে গেল শর্বরী , মাথাটা অসম্ভব ব্যাথা করতে লাগলো ইদ্রিসের। জল তেষ্টায় বুকটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে । কিন্তু একবিন্দুও নড়তে পারছে না , হটাৎ করে শরীরটা ওর পুরো ছেড়ে দিলো ,  মেঝেতে গড়িয়ে পরে জ্ঞান হারালো ইদ্রিস । 

যখন চোখের পাতা মেললো , দেখলো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট তিতিন ; তার মায়ের হাত ধরে । বাবাকে চোখ মেলতে দেখে একগাল হাসি হাসলো , অনেকটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললো আরেকজন । হাতের চ্যানেলটার দিকে তাকিয়ে হটাৎ মনে পড়লো কালকের হোয়াটসআপ এর কথা । ফোনটা চালু করে হোয়াটসআপ গ্রুপ টা দেখেই বুকের বাঁদিকে আবার চীন চীন করে ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করলো ইদ্রিস । গতকাল কুন্তল বাইকে করে বাড়ি ফেরার সময়ে … 

Author: admin_plipi