রহস্যের নাম ক্রিকেট (দ্বিতীয় পর্ব)
লেখা – শান্তনু দাস
ছবি – অরিজিৎ
আগে যা ঘটেছে…
ইন্দ্রদার সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে এসে ওর বন্ধু ক্রিকেটার সুমিতদার সঙ্গে দেখা। সেমিফাইনালে গোহারান হেরে সুমিতদার সন্দেহ ঐ টুর্নামেন্টে কিছু একটা কারচুপি চলছে। এদিকে বিকালে হাঁটতে গিয়ে এক পাগল গোছের লোক আমাদের সাবধান করল, স্টেডিয়ামে নাকি চোরাকারবার চলে! তারপর…
-“বাঃ! একদম ঘুরতে ঘুরতে ক্লাবে চলে এসেছেন আপনারা। তারপর বলুন ইন্দ্রজিৎ বাবু দার্জিলিং কেমন লাগছে?”… তপেন গুহ বলে উঠলেন।
আমরা তিনজন ছাড়া ক্লাবঘরের মধ্যে ছিলেন ম্যাচের দুজন আম্পায়ার গণেশ ঘোষ ও তপেন গুহ। দুজনে চেয়ারে বসে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। আরো চারজন কমবয়েসি ছেলে কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করছিল। কথায় কথায় জানলাম গনেশ ঘোষ ও তপেন গুহই এ ক্লাবের হেড। রুমটা খুব অগোছালো। বাঁদিকে একটা র্যাকে হলুদ ফাইল ভর্তি। লাল সিমেন্টের মেঝের উপর কিছু এ ফোর সাইজের প্রিন্ট করা কাগজ ছড়ানো ছেটানো। চার পাঁচটা কম্পিউটার রয়েছে যেখানে বসে কিছু পাহাড়ি যুবক মন দিয়ে কাজ করছে। আসবাবপত্র প্রায় নেই বললেই চলে, তবে অনেকগুলো প্লাস্টিকের চেয়ারের ছড়াছড়ি। আমরা আসার পর শ্রীকান্ত বলে একটা বাঙালি ছেলে আমাদের চেয়ার দিয়ে গেল বসবার জন্য। তপেন গুহর প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রদা বলল, “দার্জিলিং ঘুরতে আসাটা এবারে আমার প্রথম নয় তপেনবাবু, তবে আমার এই ভাইটির সঙ্গে প্রথমবার।”
গণেশ ঘোষ ইন্দ্রদার উদ্দেশ্যে বলল, “আপনিই তো সেবারে দার্জিলিঙে একটা খুনের কেসের সুরাহা করলেন। তখন থেকেই আপনাকে চিনি। তা এবারে দার্জিলিং কি ঘুরতে এসেছেন, নাকি গোপনে কিছু গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন?”
-“স্রেফ হাওয়া বদল। তবে এখানে থাকলে কিছু মাথা খেলানোর মত সামগ্রীও জুটে যেতে পারে। আমার এই অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌম্য মনে করে, আমি নাকি যেখানে যাই সেখানেই রহস্যের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।”
তপেন বাবু বললেন, “তা এখানে মানে কি আপনি এই ক্লাবের কথা মিন করতে চাইছেন?”বলেই উনি হাসলেন।
-“হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে।”
ঘরের সবাই এখন নিস্তব্ধ, কম্পিউটারের কাছে বসা ছেলেগুলো টাইপ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্দ্রদার গলার স্বর হালকা কিন্তু দৃঢ়।
গণেশ বাবু একটু পরিবেশটাকে সামাল দেবার জন্য কথা ঘোরালেন, “আপনাদের জন্য চা কফি টফি কিছু বলি?”
-“নো থ্যাঙ্কস। আর একদিন এসে দার্জিলিং টি খেয়ে যাব , বাট নো কফি। সকালের কফিটা বেশ কড়া ছিল। আমরা একটু অসময়ে এসেই হয়তো আপনাদের বিব্রত করছি। তবুও একটা কথা আপনাদের না জানালেই নয় গণেশ বাবু এবং তপেন বাবু … আপনাদের ক্লাবে চোরাকারবার হয়?”
-“হোয়াট? চোরাকারবার!” গণেশ ঘোষ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছিল। কথাটা শোনামাত্রই চমকে উঠল।
ইন্দ্রদা বলল, “কাল একটা খ্যাপাটে গোছের লোক একথা বলছিল।”
গণেশ ঘোষ আবার চমকে উঠে তপেন গুহর দিকে আড়চোখে তাকাল।
-“পাগলাটার মাথায় কি টুপি ছিল?” গনেশবাবু জানতে চাইলেন।
-“হ্যাঁ।” ইন্দ্রদা উত্তর দিল।
-“তার মানে সেই একই পাগলা।”
-“মানে?”
-“হ্যাঁ, কদিন থেকেই লক্ষ্য করছি ক্লাবের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে, ক্লাবের কাছে এসে ঘুরঘুর করছে। এতদিন ব্যাপারটা খতিয়ে না দেখলেও আজ আপনার কথা শুনে বেশ ভাবতে হচ্ছে তো।”
ইন্দ্রদা আর কথা বাড়াল না। পাগলটা যে ক্লাবে ঢুকেছিল সেকথাও বলল না। টেবিলের উপর থেকে একটা প্রিন্ট করা কাগজ তুলে নিল… টুর্নামেন্টের সমস্ত ম্যাচের লিস্ট। আমিও ঝুঁকে পড়ে কাগজটার উপর দৃষ্টিপাত করলাম। সব ম্যাচই শিবতলা স্টেডিয়ামে। কিছু কিছু ম্যাচ আবার ডে নাইটের। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল এটা যে, জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে যে যে দলের ম্যাচ হয়েছে , কোনোটাই ডে নাইট নয়। যদিও ব্যাপারটা অবাক হবার মত কিছুই নয় তবুও আশা করি ইন্দ্রদার সেটা নজরে পড়েছে। আমরা যে ঘরটাই বসেছি তার ঠিক পেছনের দিকে একটা দরজা রয়েছে, দরজাটা খোলা। ইন্দ্রদা ওইদিকে একবার তাকাতেই সুমিত বিশ্বাস বলে উঠল, “ঐ ঘরটাতে ক্রিকেটের সব সরঞ্জাম ব্যাট, বল, উইকেট ইত্যাদি রয়েছে।”
ইন্দ্রদা বলল, “আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে একবার ঐ ঘরটা দেখা যায়?”
ওনারা আপত্তি করলেন না। আমরা ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। তপেন গুহ টর্চ মেরে আলো দেখাচ্ছেন। ঘরে কোনো জানালা নেই তাই আলো প্রবেশ করতে পারে না তাছাড়া বাইরে ততক্ষণ অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ইঁদুর জাতীয় কিছু একটা পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। আমি শিউরে উঠলাম।
গনেশবাবু বললেন, “কিছু নয়, এ ঘরে ছুঁচোর উৎপাত আছে।”
ইন্দ্রদা সবার অলক্ষ্যেই ফিক করে হেসে উঠল। আমি মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম। আবছা টর্চের আলোতেই তপেন গুহ ঘরটার আনাচকানাচ দেখাচ্ছিলেন। ঘরটা একটা গুদাম ঘরের মতই বলা যায়, ভিজে কাঠের সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছিল মাঝে মধ্যে। একজায়গায় দেখলাম পনের ষোলোখানা ব্যাট সাজানো রয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন সাইজের, কোনোটা ভারী কোনোটা হালকা। ইন্দ্রদা সব নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল, তারপর বলল, “এখান থেকেই প্লেয়াররা ব্যাট সংগ্রহ করে?”
গনেশবাবু বললেন, “হ্যাঁ। তবে কেউ চাইলে পারসোন্যাল ব্যাটও বাইরে থেকে আনতে পারে।”
ঘরের মধ্যে ছোট ছোট বস্তা রয়েছে দেখলাম, ভেতরে অনেক বল, এক একটা বস্তাতে তাও প্রায় পঞ্চাশ ষাটটার মত বল। টর্চের আলো ফেলতেই বলগুলো দেখলাম কর্কের তৈরি। ইন্দ্রদা নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ দেখল তারপর কি জানি ভেবে মুচকি হাসল।
ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল, “সব বল খেলা হয়?”
তপেনবাবু উত্তর দিলেন, “সব হয় না। তবে হারিয়ে টারিয়ে গেলে বল তো লাগে, তার জন্যই…”
-“বল মাঠে খেলা চলাকালীন কি দিয়ে যাওয়া হয়? নাকি আম্পায়াররা বল নির্বাচন করে বেছে দেন?”
-“বল মাঠে আমরাই নির্বাচন করি। ডিপেণ্ড করে কত ওভার খেলার পর বল হারিয়েছে বা নষ্ট হয়েছে। অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে আমাদের বল সিলেক্ট করতে হয়।”
এরপর ঘরের উইকেট বেল সব ইন্দ্রদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল যেন কোনো অজানা রহস্যের ক্লু খোঁজার প্রচেষ্টায় রয়েছে। মাঝে মাঝে ইন্দ্রদার আচরণে এবং সুমিত বিশ্বাসের বোকা বোকা কথাগুলো ভেবে বেশ বিরক্তি আসছিল। ম্যাচ হারার কারন খুঁজতেই ইন্দ্রদা এই অন্ধকার দমবন্ধকরা ঘরে তদন্ত চালাচ্ছিল নাকি চোরাকারবারের সন্ধান করছিল সেটাই মাথাতে আসছিল না। ইন্দ্রদাকে এরকম বোকা বোকা রহস্যের পেছনে ধাওয়া করতে এই প্রথম দেখলাম।
তপেন গুহ বললেন, “ভাবছি এবারে ফাইন্যাল ম্যাচটা পুরোটাই ভিডিও রেকর্ডিং করাব। পরের বার থেকে থার্ড আম্পায়ার ডিসিশন মেকিং এরও ব্যবস্থা রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে।”
ইন্দ্রদা এবার বাম হাতে একটা থাই প্যাড ও ডান হাতে একটা গ্লাভস তুলে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “তাতে আমার সুবিধেটাই বেশি তপেন বাবু।”
-“মানে?”
ইন্দ্রদা মুখে হাসি এনে বলল, “কারন ফাইন্যালের দিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত নাও থাকতে পারি, জরুরী দরকার আছে। তাই পরে ম্যাচটা দেখতে পাব। একটা ফাইন্যাল ম্যাচের সি ডি কপি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন তো?”
-“তা পারব না কেন?”
-“কিছু অ্যাডভানস লাগবে কি?”
-“কি যে বলেন আপনি স্যার, আপনি কি দার্জিলিঙে প্রথম নাকি? আগেরবারও তো মিস পামেলার খুনের ব্যাপারে আমার দোকানে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সারভিস স্যার।”
-“এই টাকাটা রাখুন। যেদিন প্রয়োজন হবে সেদিন এসে নিয়ে যাব।”
-“আরে স্যার, আমার কার্ডটা রাখুন, একটা ফোন করবেন, দেখবেন বান্দা সি ডি প্লেয়ার নিয়ে হোটেল মঞ্জুষায় হাজির।”
-“ও বাবা! হোটেল মঞ্জুষায় উঠেছি সে খবরও রেখেছেন দেখছি। এখনও স্যাটেলাইটটা বেশ পাওয়ারফুল আছে দেখছি।”
-“তা আছে স্যার। এইবারে কি তাহলে আবার কোনো রহস্যের সন্ধানে? নাহলে দার্জিলিং এসে হোটেলে বসে সিনেমা দেখার লোক তো আপনি নয় স্যার…”
-“এবারেরটা অন্যরকম। একটু ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছি।”
শিবতলা স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে সুমিত বিশ্বাস বাড়ি চলে যাবার পর ইন্দ্রদা আর আমি হোটেল মঞ্জুষায় ফিরিনি। তবে সেটা যে দার্জিলিং এর রাতের সৌন্দর্য দেখার কারনে নয় তা ইন্দ্রদার সঙ্গে একটা স্যামসাং এর সারভিস সেন্টারে ঢুকেই বুঝতে পারলাম। যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সে একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছোকরা, নাম টাইটান, টেকনিসিয়ানের কাজ করে, বাঙালি নয় কিন্তু বাংলাটা ভালই সড়গড় আছে। আকাশী রঙের গেঞ্জিতে তার গায়ের ফর্সা রং ফুটে বেরোচ্ছিল। আমার সঙ্গে ইন্দ্রদাই আলাপ করে দিল। আগের বার মিস পামেলার খুনের রহস্যের সমাধানের সময় ইন্দ্রদাকে অনেকটা হেল্প করেছিল এই ছেলেটি। যাইহোক একটা সি ডি প্লেয়ার ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা সেই খোঁজেই এসেছিল ইন্দ্রদা। বোঝা গেল ইন্দ্রদার প্রশংসায় গদগদ টাইটান। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সূর্যটাকে তুলে আনতে বললেও হয়তো ইন্দ্রদার জন্য একবার ট্রাই করে দেখত, এ তো সামান্য একটা সি ডি প্লেয়ার।
হোটেলে ফিরে রাতের ডিনার সেরে ইন্দ্রদা একটা লবঙ্গ চেবাতে চেবাতে বলল, “বুঝলি সমু, রহস্যটা বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
-“কিন্তু তুমি ফাইন্যালের দিন থাকবে না কেন বললে?”
-“থাকব, কিন্তু ভি আই পি গেস্ট হিসেবে নয়।”
আমি অবাক হলাম। কিন্তু আমি জানি ইন্দ্রদা এখন মুখ খুলবে না। সময় হলেই সব জানতে পারব। দার্জিলিঙে এসে যে এভাবে ক্রিকেট রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়ব কক্ষনো ভাবিনি।
-“একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস সৌম্য? অবশ্য সেটা তোর লক্ষ্য করার কথাও নয়।”
-“কি?”… আমার প্রশ্ন।
-“আমি যখন ক্লাবঘরের বস্তায় বলগুলো লক্ষ্য করছিলাম তখন দেখলাম বলগুলোর গায়ে পেন্সিলে করে ইংরেজির এইচ অক্ষর লেখা। তবে সবগুলোতে নেই সেটাও লক্ষ্য করেছি।”
-“তুমি কি এর মধ্যেও জোর করে কিছু রহস্যের গন্ধ পেতে চাইছ? আমার বাপু অতসব মাথায় ঢুকবে না। বলে কি লেখা থাকল না থাকল তার সাথে খেলার হার জিতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?”
-“সেটাই তো রহস্য।”
-“তবে একটা জিনিস খটকা লেগেছে। ম্যাচের লিস্টটা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছিলে ইন্দ্রদা? জয়পুর স্পোর্টিং দলের সবকটা ম্যাচই কিন্তু হয়েছে দিনের বেলায়।”
-“গুড অ্যান্ড ক্লিন অবজারভেশন সমু। কিন্তু সেখানেও সেই একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সেটার সাথে হারা জেতার কি সম্পর্ক?”
-“সুমিতদার কথাগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য বলে তোমার মনে হয়?”
-“জানি না। মে বি ফ্রম লিটল বিট অফ ফ্রাসট্রেশন।”
ইন্দ্রদা মুখে কথাটা বললেও, ও যে শুধু সুমিত বিশ্বাসের মন রাখতে শিবতলা স্টেডিয়ামে তদন্ত করতে যায় নি সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি। দিনে একটানা এতটা ঘুমিয়েও আজ সন্ধ্যে থেকেই হাই তুলতে শুরু করে দিয়েছি। অবশ্য ইন্দ্রদাও যে বেশ খানিকটা টায়ার্ড তা ওর হাবভাব দেখে ভালই টের পাচ্ছিলাম।
-“আজ অনেক ঘুরেছি ইন্দ্রদা, তাই শরীরটাও আর টানছে না।”
ইন্দ্রদা মুখের লবঙ্গটা জিভের তলায় রেখে বোতল থেকে এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, “একটুখানি বারবিটন খেয়েই এত ঘুম এলে চলে সৌম্য?”
-“বারবিটন?” আমি অবাক হয়ে ইন্দ্রদার দিকে চেয়ে রইলাম।
-“হ্যাঁ, একধরনের সাদা গুঁড়ো জাতীয় পদার্থ, জলে দ্রাব্য, ঘুমের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আজ সকালে খেলার স্টেডিয়ামে দেওয়া ব্ল্যাক কফিতে মেশানো ছিল। আমিও অবশ্য খেয়েছি, কিন্তু সহ্য করে নিয়েছি।”
-“কিন্তু কে মেশালো? আর তুমি বুঝলেই বা কি করে?”
-“কালারলেশ বারবিটনের স্বাদ হালকা তেতো হলেও সেটা ব্ল্যাক কফির স্বাদের সাথে মিশে গেছে। আর যে মিশিয়েছে সেই হল ক্রিকেট রহস্যের নায়ক। এ ধরনের পদার্থ নিয়ে আমি আগে ক্রিমিনোলজিতে পড়াশুনো করেছি। হালকা সন্দেহ মনে জাগতেই কফির স্যাম্পেল টেস্ট করার জন্য আমার কফিতে ভেজা রুমালটা নিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে গিয়েছিলাম আমি।”
-“কি সাংঘাতিক!” মুখ দিয়ে আমার কথা বেরোচ্ছিল না।
*
-“সাংঘাতিক, মিস্টিরিয়াস, অবিশ্বাস্য যাই বিশেষণ বলিস না কেন সুমিত, আমি কিন্তু এখনও পর্যন্ত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিটি ম্যাচ জেতার মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পায়নি। তবে আর কিছুদিন টাইম দে, আশা করি তোকে নিরাশ হতে হবে না। কারন ইন্দ্র–সৌম্য জুটি নিরাশ হয়ে দার্জিলিং ছাড়বে এমনটা আগে কোনো কেসে হয়নি।”
সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল, সাতটার সময়। ফাইন্যাল দেখতে যাব তবে ভি আই পি গেস্ট হিসেবে থাকব না, এটুকু মাত্র জানি, আর সবই জানে ইন্দ্রদা। ব্রেকফাস্টটা হোটেলেই সারলাম। তারপর রওনা দিলাম শিবতলা স্টেডিয়ামের দিকে। রাস্তায় সুমিত বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হল। বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের হারটা এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সুমিতদা।
-“কিরে ইন্দ্র, তোর তো আজ ফাইন্যাল দেখতে আসার কথা নয়।”
-“হঠাৎ মত পরিবর্তন করলাম। চল একসঙ্গেই যাওয়া যাক।”
মেঘবালিকার দল লম্বা চুলের গুচ্ছ খুলে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে। কখন যে বেরিয়ে শিবতলা স্টেডিয়ামটাকে ঝুপুস জলে স্নান করিয়ে দেবে ভরসা করা যায় না। তবে ওয়েদার রিপোর্ট বলছে আজ ম্যাচ চলাকালীন বৃষ্টি হবার কথা নয়। গোটা স্টেডিয়ামটা আজ লোকে লোকারণ্য। ভি আই পি গেস্টের সিটগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, কালকে যারা ছিল তারা সবাই রয়েছে। আমরা ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম, এখানে ভিড়টা বেশ কম। সুমিত বিশ্বাসকে অবশ্য ইন্দ্রদা ভি আই পি সিটে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল। ইন্দ্রদার কথায় পরে বুঝতে পারলাম, ও এমন কিছু এখানে লক্ষ্য করতে চায় যেখানে ওর বন্ধুর থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমি বেশ অবাক হলাম। যেখানটাতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে কোনো চেয়ার নেই, তবে গায়ে সোনালী রোদের স্পর্শ পেয়ে বেশ আরামবোধ করছিলাম। মেঘবালিকার দল তখন সূর্যের চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে।
যথারীতি খেলা শুরু হল। জয়পুরের বিপক্ষ টিম ব্যাট করছে। কিন্তু পনেরো ওভার পর ওদের অবস্থা গতকালের বলাকা ক্লাবের মতই হল। দর্শকরাও অনেকে তখন পালিয়ে যাচ্ছে। ইন্দ্রদার মনের অবস্থা যে কি বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করছিলাম ক্লাবটার দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে। স্কোর বোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই ইন্দ্রদাকে আর দেখতে পেলাম না। ছুটে গেলাম ক্লাবঘরের দিকে। কি মনে হল কি জানি, দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ভেতরে ঢুকলাম। আমরা যে গুদামঘরটায় কাল ঢুকেছিলাম সেই দরজায় আড়ি পেতে কিছু একটা দেখছে ইন্দ্রদা। আমি সন্তর্পণে পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইন্দ্রদা আমাকে গায়ে হাত দিয়ে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিল। আমিও এবার উঁকি মারলাম। দেখলাম সেই পাগলটা ঘরের ভেতরে কিছু একটা খুঁজছে। একবার ব্যাটগুলো তুলে জোরে জোরে নাড়া দিল। উইকেটগুলো একবার হাতে তুলেই ফেলে দিল। আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। এবার দেখলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটাতে পাগলাটা একটা ধারালো ছোরা বের করেছে। আলখাল্লার মত জামার পকেটটা থেকে একটা টর্চ লাইট বের করতে দেখলাম। পাগলটা মনে হল এবার বলের বস্তাগুলোর দিকে এগোচ্ছে। টর্চের সামান্য আলোতেই লক্ষ্য করলাম আজ ওর মুখে পাগলামির কোনো চিহ্ন নেই, নিস্পলক চোখে বস্তাগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে। এবার ও বস্তার দড়িটা খুলে কতকগুলো বল নেড়ে চেড়ে মাটিতে ড্রপ মেরে দেখল। তারপর অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল, একটা বলকে ছোরা দিয়ে মাঝামাঝি কেটে দু ফালা করে দিল। বুকপকেট থেকে একটা ছেঁড়া ময়লা ছোট ডায়রির মত কি একটা বের করল। লক্ষ্য করলাম ওর কাছে পেনও রয়েছে। পেনে করে ডায়রিতে কিছু একটা লিখল। ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে কিছু একটা আলোর আভাস প্রতিফলিত হচ্ছে। মুখে বিড়বিড় করে বলছে, “পি এস… পি এস… পি এস।”
এবার মুখের ওপর টর্চের আলো পড়তেই চমকে উঠলাম। পাগলটা চিৎকার করে বলছে, “কে? কে ওখানে?”
ইন্দ্রদা আমাকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে সোজা ছুটে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এল। আমরা দর্শকদের মাঝে মিশে গেলাম। ইন্দ্রদা বাইরে এসে গুম হয়ে গেছে। স্কোরবোর্ডে দেখলাম খেলার অবস্থা শোচনীয়। ফাইন্যাল কাপ অবধারিত জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের হাতে।
ইন্দ্রদা বলল, “চল সৌম্য, হোটেলে ফেরা যাক, আর খেলা দেখে কাজ নেই।”
-“তোমার তদন্ত কতদুর এগোল?”
ইন্দ্রদা হাসল। কিন্তু হাসিটা যেন পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। ধরা গলায় বলল, “সুমিতের কথাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে, এই খেলার পেছনে রয়েছে এক গভীর চক্রান্ত।”
-“সুমিতদা যে সত্যি বলছে, মনগড়া কথা বলছে না, সেটা এতটা জোর দিয়ে তুমি ভাবছ কি করে ইন্দ্রদা?”
*
-“সত্যি মিথ্যে জানি না ইন্দ্রজিৎ বাবু, তবে বেটিং নিয়ে যদি কিছু বলতে বলেন তাহলে হলফ করে বলতে পারি বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবে এমন কোনো প্লেয়ার নেই, যে এই সাহসটা দেখাতে পারে। অনেক ইয়ং প্লেয়ার বসে আছে টিমে জায়গা পাবার আশায়। বেটিং এ কেউ ধরা পড়লে সে আর কোনদিনও দলে জায়গা পাবে না।” বলাকা স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ সুবিমলবাবু জানালেন।
এটা দুদিন পর বিকেলের ঘটনা। এই দুদিন আমরা ক্রিকেট রহস্য মাথা থেকে মুছে দিয়েছিলাম। প্রাণ ভরে শুধু দার্জিলিংকে উপভোগ করেছি। কখনও বা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে, কখনও আবার হোটেল মঞ্জুষার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ এসে আলতো স্পর্শে তাদের ভালোবাসা জানিয়ে গেছে। মোটমাট এই দুদিন আমরা যতটা সাইটসিইঙ করা সম্ভব করে নিয়েছি। সুবিমল বাবুর কোয়ার্টার আমাদের হোটেলটা ছাড়িয়ে আর দু তিনটে বাড়ির পরে। তাই বিকেলে ইন্দ্রদার সাথে ওনার বাড়ি এসে পড়েছি। ওনার শরীরখানা রোগা হলেও যেন একেবারে পাথরে কোঁদা, যেমন মজবুত তেমন শক্ত। তবে বুকদুটো তক্তার মত সমতল। ঢলঢলে একটা সাদা গাউন পড়ে ছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল হাড়ের কাঠামোর উপর এগরোলের কাগজের মত সাদা গাউনটা চেপ্টে আছে।
-“শিবতলা স্টেডিয়ামে চোরাকারবারের ব্যাপারে কিছু জানেন?” ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল।
-“হোয়াট রাবিশ! এধরনের কোনো ইনফরমেশন আমার কাছে নেই।”
-“আপনার টিমের হারার কোনো স্পেশাল রিজন?”
-“কে বলেছে আমার টিম সব ম্যাচ হেরেছে? সেমি পর্যন্ত কোয়ালিফাই করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে জয়পুর স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে প্রত্যেকটা ম্যাচ হারার কারন খুঁজে পাইনি।”
-“বেটার লাক নেক্সট টাইম সুবিমল বাবু, আজ আমরা উঠি। ধন্যবাদ।”
(চলবে…)