
ছাগল, পুঁইশাক ও কুমড়ো
কলমে – অরিন্দম ঘোষ
ছবি – নিকোলাস
এই গল্প আমার মায়ের কাছে শোনা। যে সময়ের কথা বলছি তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। আমার নব্বই ছুঁই ছুঁই মা তখন আট-ন’ বছরের ফ্রক পরা খুকী। মামা ছিলেন সবার বড়, তারপর দুই মাসীর পর মা।
আমার মামার বাড়ি ছিল জলপাইগুড়ি জেলার মাধবডাঙা গ্ৰামে। সে এক গন্ডগ্ৰাম বললেই চলে। সে আমলে ইলেকট্রিকের আলো বা পাকা রাস্তা বলে কোন কিছু পৃথিবীর কোথাও যে আছে, মাধবডাঙার মোড়লও সেটা জানতেন বলে মনে হয় না। কাছেপিঠের একটু বড় জায়গা ছিল ময়নাগুড়ি। সেটাও আর একটু বড় গ্ৰাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। মাধবডাঙাতে তখন সাকুল্যে হয়তো তিরিশ-চল্লিশটা পরিবারের বাস ছিল। সবাই সবাইকে চিনত- সবাই সবার খবর নিত- একে অপরের বিপদে নিজের লোকের মতোই এগিয়ে আসত।
এই এগিয়ে আসা গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন আমার দাদু- বিমলবরণ রায়। তিনি কাজকর্ম বিশেষ কিছু করতেন না, রোজগার পাতিও সেরকম কিছু ছিল না। দাদুর বড়দা, আমরা যাঁকে বড়দাদু বলতাম, জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার ছিলেন। সারা সপ্তাহ তিনি জলপাইগুড়িতেই পোস্ট অফিসের লাগোয়া একটা ঘরে থাকতেন, আর শনি-রবিবার চলে আসতেন মাধবডাঙায়। গ্ৰামশুদ্ধু লোক তাঁকে মাস্টারমশাই বলে ডাকত। তাঁর পরের দু’ভাই, মেজদাদু আর সেজদাদু, চাষবাস নিয়েই থাকতেন। আমার দাদু ছিলেন সবার ছোট। সকলের ফাইফরমাশ খাটা, বাড়ীর দোকান বাজার করা ছাড়া বাড়ীর দু’তিনটে গরু-বাছুরের দেখাশোনা করাই ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। আর হাতে সময় থাকার জন্য গ্ৰামের যে কোন লোকের আপদবিপদে তাঁর ডাক পড়ত সবার আগে। শীতকালে প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই জরদা নদীর পাড়ের শ্মশানে মড়া পোড়াতে যেতে হত দাদুকে।
বড়দাদু মাছ খেতে বড় ভালবাসতেন, বিশেষ করে নদী থেকে ধরে আনা ছোট ছোট ট্যাংরা বা বোরোলি জাতীয় নদিয়ালী মাছ। মঙ্গলবার ময়নাগুড়িতে বড়সড় হাট বসত, সেখানে একদম টাটকা মাছ পাওয়া যেত। সেবার কিসের যেন ছুটি ছিল পরপর কয়েকদিন। বড়দাদু শনিবার থেকে টানা ছিলেন বাড়ীতে। মঙ্গলবার দাদুর ওপর হুকুম হল ময়নাগুড়ির হাট থেকে ছোট মাছ আনার। রান্নাবান্নার প্রধান ভার থাকত আমার দিদিমার ওপর। পুঁইশাক দিয়ে খাওয়ার জন্য বড় মাছের তেল আনারও ফরমাশ করা হল দাদুকে। পুঁইশাক তো বাড়ীর উঠোনের মাচাতে লকলকিয়ে হয়ে ছিল, দিদিমা বারবার মনে করিয়ে দিলেন কুমড়ো আনার কথা। কোনকালে একবার নাকি দাদু পুঁইশাক এনেছিলেন, কিন্তু কুমড়ো আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। সেই কথা দিদিমা এতবার শুনিয়েছেন যে আমার বাবাকেও মা বাজারে পাঠাবার সময় পইপই করে পুঁইশাকের সঙ্গে কুমড়ো আনার কথা বলে দিতেন।
মাধবডাঙা থেকে ময়নাগুড়ির দূরত্ব নেহাত কম নয়। মেঠো এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা লেগে যেত। দাদু সকাল সকাল বেরোলেন সাইকেল নিয়ে। বেলা বাড়লে ঐ সব মাছের স্বাদ নাকি নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু বেলা গড়িয়ে গেল, দাদুর ফেরার নাম নেই। দিদিমা গজগজ করতে শুরু করলেন, “দুই পোহর বেলা হইয়া গেল, মিনসের অ্যাহনো আইবার সময় হইল না… বটঠাকুররে খাইতে দিমু… কখন আইবো, কখন রান্না করুম…।” বেলা যত বাড়ে, দিদিমার গজগজানি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাকী দিদিমারাও একটু চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন- কোন বিপদআপদ হল না তো! দিদিমা বললেন, “বাদ দ্যান দিদি, যমের অরুচি ওইটা… কোথায় বইস্যা বিড়ি ফুঁকতাসে। আসুক আইজ…!”
কিন্তু দিদিমার গজগজানির পারদ বেশিক্ষণ চড়ল না। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, দাদু ফিরল না। বাড়ীর সকলেই তখন দুশ্চিন্তা শুরু করেছে, মেয়ে মহলে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। বড়দাদু ঘনঘন পায়চারি করছেন উঠোনে আর একে ওকে ডেকে বলছেন, “দ্যাখ না একটু আগাইয়া, কোথায় বা যাইল বিমলেডা!” মাধবডাঙার সবার মুখে মুখে দাদুর এই হারিয়ে যাওয়ার খবরটা চাউর হতে দেরী হল না, বাড়ীতে লোক জমায়েত হয়ে গেল অচিরেই। দাদুর পঁচানব্বই বছরের বিধবা মা তখনো বেঁচে। বুড়ী আবার বদ্ধ কালা। বারবার জিজ্ঞেস করেন, “অ বৌ… কি হইসে? অ্যাতো মানষি আইসে ক্যান?” তাঁকে বোঝানো হল কালো বাছুরটাকে পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে। বড়মা বললেন, “তো বিমলেডারে পাঠাইস্ না ক্যান? ধইর্যা আনবো গিয়া।” তাঁকে আশ্বস্ত করা হল এই বলে যে বিমল বাছুরটাকেই খুঁজতে গেছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল- কোন খবর নেই। সাইকেলের সামনে লন্ঠন ঝুলিয়ে মেজদাদু- সেজদাদু ময়নাগুড়ি অবধি খুঁজে এসে ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগলেন। কান্নার রোল ক্রমশ জোরদার হল। বড়মা বললেন, “তগো সব তাতেই বাড়াবাড়ি! বাছুরের লগে অ্যামনে কাঁইন্দতাসিস য্যান সোয়ামী হারাইসে।”
যদিও দাদু সাঁতার কাটতে পারতেন, তবু পরদিন কাছেপিঠের সব ছোট-বড় পুকুরে জাল ফেলা হল। কিন্তু কোন খোঁজ নেই। কে যে পুলিশে খবর দিল জানা গেল না, কিন্তু দারোগাবাবু এসে হাজার রকমের প্রশ্ন করে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। তাঁর বিশ্বাস দাদু স্বদেশীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। শেষে বড়দাদু বললেন বিপিন ওঝাকে খবর দেওয়া হোক, সে যদি গুনে গেঁথে কিছু বলতে পারে। বিপিন ওঝা এসে হ্রিং ব্রিং মন্ত্র পড়ে, ধুনি জ্বালিয়ে, মাটিতে আঁক কষে কি সব হিসেব নিকেশ করল। তারপর বিধান দিল যে দাদুকে ব্রহ্মদত্যিতে ধরেছে, সাদা-কালো রঙ মেশানো কোন ছাগলে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। সারা গ্ৰাম তখন বেরোল সাদা-কালো ছাগল খুঁজতে। দু’টো ছাগল পাওয়াও গেল যা বিপিন ওঝার বর্ণনার সঙ্গে মিলছে, কিন্তু তাদের মালিকরা জানাল যে ঐ ছাগল তাদের কাছে তিন-চার বছর ধরে রয়েছে- ওদের বিমল হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। রহমত আলী, যে বটতলার মোড়ে রবিবার করে পাঁঠা কাটত, তাকেও বলে দেওয়া হল সাদা-কালো ছাগল যেন না কাটে। মা-মাসীরা চিন্তা করতে লাগল যে ছাগলটাকে যদি পাওয়া যায় তাকে কি বাবা বলে ডাকা যাবে!
এইভাবে কয়েক দিন কেটে গেল। কান্নাও ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। সবাই ধরে নিল যে ছাগলে রূপান্তরিতই হোক, অথবা জরদা নদীর জলে ডুবেই যাক, দাদুর আর ফিরে আসার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। লোকজনের ভীড় আস্তে আস্তে কমে গেল, সকাল-সন্ধ্যে কেউ কেউ এসে খবর নিয়ে যেত, খালি দারোগাবাবু সাইকেল চেপে দিনের মধ্যে একবার ঠিক নিয়ম করে চক্বর লাগিয়ে যেতেন। বড়দাদুও সোমবার সকালে জলপাইগুড়ি চলে গেলেন পোস্ট অফিস খোলার জন্যে।
ঘটনাটা ঘটল মঙ্গলবার। বেলা সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ হঠাৎ দাদু হাজির- ছাগলের বেশে নয়, স্ব-শরীরে সাইকেল চেপে। সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করতে থাকে কি হয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল? কাঁচুমাচু মুখে দাদু জানালেন যে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। কলকাতা দেখার সখ দাদুর অনেক কালের। তখন কলকাতা যাওয়া নেহাত চাড্ডিখানি ব্যাপার ছিল না। হলদিবাড়ি থেকে ট্রেনে চেপে পদ্মার ব্রীজ অবধি যেতে হত। তারপর দু’ কিলোমিটার ব্রীজ পেরিয়ে আবার অন্য ট্রেন। ময়নাগুড়ির কোন মরণাপন্ন রুগীকে নাকি কলকাতা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তারা সঙ্গে যাবার লোক পাচ্ছিল না। তাই কারোর বাড়ীতে সাইকেলটা রেখে দিয়ে দাদু তাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন।
এই শুনে বাড়ীর সবাই হাসবে কি কাঁদবে ভেবেই পাচ্ছিল না। দিদিমা বারবার আকাশের দিকে জোড়হাত করে প্রণাম করতে লাগলেন, আর চিৎকার করে বিপিন ওঝাকে বাপবাপান্ত করতে লাগলেন।
ওহঃ, আসল কথাটাই বলা হয় নি। দাদু আসার সময় ময়নাগুড়ির হাট থেকে দু’ব্যাগ ভর্তি বাজার করে এনেছিলেন। আর এবার কিন্তু পুঁইশাকের জন্যে কুমড়ো আনতে ভোলেন নি।
বাঃ ! বেশ গুটি গুটি পায়ে গল্প চলল গল্পের মতোই…।প্রথম থেকে শেষ অবধি সুন্দর বাঁধন আছে। ছেলেবেলার গল্প শোনার দেশেই চলে যাওয়া যায় ..??
ধন্যবাদ। বড়দের ছোটবেলার গল্প বলার চেষ্টা করলাম একদিন।
দারুণ সুন্দর হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর এবং বেশ মজার গল্প
অনেক ধন্যবাদ। একদম ভিন্ন স্বাদের কিছু লেখার চেষ্টা করলাম।
Khub Bhalo Laglo…….. Amar Thakumar kache emni sohoj sorol mon bhalo kora golpo suntam.
Thanks…sotyi eta ektu chhotoder kotha bhebei lekha. Tobe boyose boro hoyeo jader mon ta chhoto achhe tader o bhalo lagbe asha kore chhilam.
Khub bhalo laglo! Ekdom situation e chole giyechhilam.
Thank you bhai. I am happy if you have enjoyed.
Brilliant ending sir.. really enjoyed a lot..
Thanks Madam….this time a story with different taste.
Excellent likhechhe re Arindam. Pore khub valo laglo. Eirakom aro lekh. Apekkhay roilam.
Thanks Bhai. Chesta thake sobsomoy bivinno type er golpo lekhar. Toder feedback amay utsaho dey.
খুব সুন্দর, বেশ একটা অন্য পরিবেশে চলে গিয়েছিলাম ।গল্পের শেষটা বেশ মজার । খুব ভালো লেগেছে ।
অনেক ধন্যবাদ। পরিবেশটা আজ থেকে আশি বছর আগের, আমাদের কারোরই নিজের চোখে দেখা নয়। শুধু কল্পনায় ভর করে লেখার চেষ্টা।
Aar ekti anno swader golpo…golper seshe chomok ta ektu kom pelam…tobe presentation valo…next golper jonno apekkhay thaklam…
Ei golpo ta ager gulor theke anyo swader. E dhoroner mojar golpe ager gulor moto dramatic twist na thakai swabhabik. Thanks a lot as you have enjoyed.
Arindam khub bhalo hoyeche. Ekkathay fatafati
Thank you Dada. Apnar comment khub mulyoban amar kache.
fatafati dada. daroon bornona.
Thank you. I am happy that you liked it.
এত মজা পেলাম গল্পটা পড়ে মন খুলে হাসলাম ও খুব ভালো লাগলো
অনেক ধন্যবাদ। কাউকে হাসাতে পারা কিন্তু খুব সহজ নয় আজকাল। সবাই সারাদিন চাপে থাকে।
Osadharon ekta golpo.khub valo laglo pore.
Thank you Bhai.
চমৎকার লেখা। Fluid story telling. দারুন মজা পেলাম অরিন্দম দা। নিকোলাসের ছবিও গল্পের সাথে perfectly blended.
অনেক ধন্যবাদ। লেখাটা নিয়ে সবাই বলছে, কিন্তু ছবিটাও সমান উপভোগ্য।
বেশ একটা আড্ডার মেজাজ নিয়ে লেখা। বাড়িয়ে না বললেও বলতে হচ্ছে যে এই লেখাটা তোমার অন্য লেখা গুলোর থেকে একেবারেই ব্যতিক্রমী এবং সৈয়দ মুজতবা আলির এবং তারাপদ রায়ের লেখার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। লেখাটা চলুক। আমরা পড়ি। এটুকুই থাক।
এভাবে উৎসাহিত করতে থাকলে লেখা আর থেমে থাকে কি করে? অনেক ধন্যবাদ।
Darun golpo Arindam da.. akdam Madhabdangay pouche giyechhilam. Pui sak aar kumro r taste o onubhab korlam! Khub mojar akta achena jogot…????????
বাঃ। এতো প্রাণবন্ত লেখা লিখলাম যে কুমড়ো দিয়ে পুঁইশাক চচ্চড়ির টেস্ট পাওয়া যাচ্ছে! অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগল
অনেক ধন্যবাদ।
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
329593 237860Oh my goodness! an incredible write-up dude. A lot of thanks Even so My business is experiencing trouble with ur rss . Do not know why Struggle to sign up to it. Can there be everybody getting identical rss dilemma? Anyone who knows kindly respond. Thnkx 418041
Nice story. Interesting. I love this Story. Keep it up. Write more stories like this. God bless you.