সে তবে কে ? [চতুর্থ পর্ব] লেখা – শান্তনু দাস
আগে যা হয়েছে…
স্কটিশচার্চ কলেজের হোস্টেলে প্রায় আমাদের সামনে খুন হয়ে যায় অলীক। পরদিন নাইটগার্ড, হোস্টেলের রাঁধুনি আর প্রধান সন্দেহভাজন হীরা কে জেরা করেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। অলীকের ওয়াকম্যান থেকে বোঝা গেল খুনির নাম সম্ভবত সুমি। অলীকের বান্ধবী সুমিলি এবং বন্ধু রজককে জেরা করার পর হীরার উপর সন্দেহ যেন আরো বাড়লো। তারপর…
( ৪ )
অলীকের বাড়িতে
পরদিন ইন্দ্রদা আর আমি থানায় ইনস্পেক্টর সমাদ্দারের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। শবরকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।
-“আমি তো যা জানি সব খুলে বলেছি স্যার, তবে আমাকে আবার থানায় ডেকেছেন কেন?” শবর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
ইন্দ্রদা বলল, “বোসো শবর, এবার ঠিক করে বল সেদিন রাতে কি হয়েছিল।”
-“আমি তো…”
“তুমি সত্যি বলছ না।”
“আমি আর কিছু জানি না।”
“হাজতবাস করলে তোমার বাড়ির লোকেদের কি হবে সেই ধারনা আছে?”
কালীচরণবাবু বলে উঠলেন, “ভালোয় ভালোয় সব কিছু বলে দে, না হলে তোর কপালে অসীম দুঃখ আছে।”
শবরের কালো মুখটা আরো বিবর্ণ হতে থাকে। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে ওঠে, “আমাকে মেরে ফেলবে। আমি বাঁচতে চাই, আমার পরিবারের জন্য বাঁচতে চাই। আমি রাতে অলীকের পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছিলাম। ঘুম যখন ভাঙলো তখন পাশের ঘর থেকে অলীকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছিল। মনে হল অলীক এত রাতে আবার কার সাথে কথা বলছে? আমি বারান্দার আলোটা জ্বেলে বাইরে এলাম। দেখলাম অলীকের ঘরের দরজাটা খোলা, ভেতরে লাইট জ্বলছে। দরজার চৌকাঠের ঠিক বাইরে হীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমার কিছুটা গোলমাল ঠেকল।”
-“এক মিনিট, তুমি হীরাকে চিনতে?”
-“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে অলীকের কাছে আসত।”
“আচ্ছা, বল তারপর।”
-“তারপর আমি অলীকের দরজার সামনে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম। সেই কালো কোট টুপি পরা লোকটার হাতে বন্দুক। আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না । দেখলাম আমার চোখের সামনে লোকটা অলীকের বুকে গুলি করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করার আগেই আমার মুখ চেপে ধরল।”
-“লোকটার হাতে গ্লাভস ছিল?”
-“হ্যাঁ, ছিল স্যার। তারপর আমাকে হঠাৎ জোরে মেঝেতে ঠেলে ফেলে দিল। আমি মাটি থেকে উঠে চিৎকার করার আগেই লোকটা বন্দুকটা ঐ অজ্ঞান হওয়া হীরার হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়ে গেল।”
“তারপর তুমি ‘খুন খুন’ বলে চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলে।”
“হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন। এর বেশি আমি কিছু জানি না।”
“তবে মিথ্যে বলছিলে কেন?”
“ভয়ে, ঐ লোকটা যদি আবার আমাকে খুন করে বসে।”
“শবর, লোকটার মুখ দেখেছিলে?”
“না অন্ধকারে তেমন… তবে গোঁফ দাড়ি ছিল আর একটা কালো চশমা পড়েছিল।”
“তোমার কথাগুলো সত্যি হলে ভালো, আর যদি পরে প্রমানিত হয় যে, তুমি তোমার কথাগুলো না বলে অন্যের শেখানো বুলি আওড়াচ্ছ তাহলে এবার তোমাকে ডেকে পাঠানো হবে না, সোজা বাড়ি থেকে তুলে এনে লকআপে ঢোকান হবে। তুমি এখন যেতে পার।”
শবর ধীর পদক্ষেপে চলে যেতেই ইনস্পেক্টর ইন্দ্রদাকে বলল, “ইন্দ্রজিৎ বাবু, হীরা তাহলে সত্যিই বলছে?”
-“সত্যি বললেও হীরা সেই রাতে অলীকের কাছে কেন গিয়েছিল? কেনই বা হীরাকে অজ্ঞান করলো খুনি? নাকি হীরারই সব এ কারসাজি? খুনটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিজেকে অজ্ঞান করতে বলা… নাকি শবর এখনও কিছু লুকোচ্ছে? আচ্ছা ইনস্পেক্টর সেই রাতে আপনাকে যে ফোন করেছিল সেই মেয়েটা কি সুমিলিই?”
“আই অ্যাম কনফিডেণ্টলি সিওর অ্যাবাউট ইট।”
“আপনি একবার হীরার মোবাইল নম্বরে ফোন করে ওকে থানায় ডাকবেন আর জিজ্ঞেস করবেন কেন ও অলীককে শাঁসাত? আমার মনে হচ্ছে রিভলবারটা হীরারই । ”
“তার মানে হীরাই?”
“খুন করতে সে রাতে হীরা ওখানে উপস্থিত হলেও খুন যে হীরা করেনি প্রথম দিনই ওকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে বুঝেছিলাম। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হীরাকে ফলো করছিল। খুনটা হীরা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার, তাই নিজের হাতেই গুলি করে প্ল্যানমাফিক হীরার ডান হাতে রিভলবারটা গুঁজে দিয়ে সে চলে যায়, যাতে হীরা ফেঁসে যায়। লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় হীরা সব কাজ বাঁ হাতে করে। তাহলে গুলি চালাতে হলে ওকে ঐ হাতেই চালাতে হবে। কিন্তু ওর ডান হাতে রিভলবার পাওয়া যায়। মানেটা হচ্ছে, খুনি ঐ কালো কোট টুপি পরা লোকটাই। হীরাকে অজ্ঞান করে রিভলবার নিয়ে অলীককে খুন করে আবার রিভলবারটা হীরার ডান হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায়।”
“কিন্তু কে হতে পারে ঐ ব্যক্তি?”
“আমরা কাল সকালে ভাবছি একবার তমলুক যাব, অলীকের বাড়ি। অলীকের ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে কথা বলে যদি কিছু জানা যায়। আপনি এদিকে হীরাকে গ্রেফতার করুন।”
“কিন্তু কি অপরাধে? কোনো প্রমান তো নেই।”
“আপাতত লাইসেন্স বিহীন রিভলবার রাখার অপরাধে ও অলীককে মেনটালি টর্চার করার জন্য। আমি সিওর ঐ রিভলবারটি যদি হীরার হয় তাহলে ওটার লাইসেন্স হীরার কাছে পাবেন না।”
ইনস্পেক্টরকে বিদায় জানিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সি বুক করে বাড়ি ফিরছিলাম। চাঁদের আলোতে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছিল এদিক থেকে ওদিকে। স্টার থিয়েটারে নতুন শো এসেছে বলে হলের সামনেটা লোকে লোকারণ্য। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের কাছে আসতেই বেশ জ্যামে পড়লাম। ইন্দ্রদা দেখলাম ওর মোবাইল থেকে একটা নম্বর ডায়াল করছে। এইসময় আবার কাকে ফোন করছে কে জানে? পরে বুঝলাম ফোনটা করেছে অলীকের বাড়িতে। অলীকের বৌদি ধরেছিলেন। উনি বললেন ওখানে থেকেই আমরা খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারি। ওনারা যেকোনো মূল্যেই অলীকের খুনি ধরা পড়ুক সেটা চান।
পরের দিন সকালে বেরোতে একটু দেরি হলেও আমি আর ইন্দ্রদা একদম রাইট টাইমে তমলুক স্টেশন পৌঁছলাম। ওখান থেকে অলীকদের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের সামনে আসতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল। সরু পালিশ করা সিমেন্টের রাস্তা চলে গেছে বিশাল ফ্ল্যাটের হলুদ দরজা পর্যন্ত। আমরা এগিয়ে চললাম। দুধারে গোল ছাতার মত সমান মাপের ঝাউগাছগুলো সমান দুরত্ব নিয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। ডানপাশে অর্ধবৃত্তাকারে সবুজ কার্পেটের মত নরম স্নিগ্ধ ঘাস পাতা। মাঝখানে সুদৃশ্য ফোয়ারা, ফোয়ারার পাশে শ্বেতপাথরের আয়তকার ব্লকগুলো থেকে রোদ্দুর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
কলিংবেল বাজাতেই একজন চাকরানী দরজা খুলে দিল। ডাইনিং হলটা বিশাল। ড্রয়িংরুমের জানলায় ঝুলছে অপূর্ব সব পর্দা। সূর্যের আলো রঙ্গিন হয়ে আছড়ে পড়ছে ঘরের মেঝেতে। বাড়িতে লোকজন বলতে অলীকের দাদা-বৌদি, অলীকের মা ও এক চাকরানী। দুঃখী পরিবারটি আমাদের আপ্যায়নের একটু ত্রুটি মাত্র করল না। আমাদের জন্য একটা দোতলার ঘর ঠিক ছিল। অলীক হোস্টেল থেকে এলে ঐ ঘরেই থাকত। অলীকের দাদা-বৌদি, মা, চাকরানী একতলাতেই থাকে। একতলার তিনটে রুম আর দোতলার দুটো। দোতলার একটা রুম আমাদের জন্য খোলা হল আর অন্যটা তালাবন্ধ ছিল।
স্নানের আগে ইন্দ্রদা অলীকের মায়ের ঘরে গেল। বয়স ষাটের কাছাকাছি, পরনে সাদা থান, শিথিল চামড়ায় অসংখ্য কুঞ্চন, বলিরেখা সুস্পষ্ট, কাঁচাপাকা ভ্রু চোখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ইন্দ্রদা বলল, “কিছু মনে করবেন না মাসীমা, আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম।”
অলীকের মা অবাক হয়ে ইন্দ্রদার দিকে চেয়ে আছে। হয়তো ওনাকে ইন্দ্রজিৎ সান্যাল মাসীমা বলবে ভাবতে পারেন নি।
-“অলীকের সাথে আপনার শেষ কবে কথা হয়?”“যেদিন অলীক পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সেদিনই সন্ধ্যায় অলীক ফোন করেছিল।”
“ওর কথায় সন্দেহজনক কিছু আভাস পান কি?”
“না, বাবা। ও বলেছিল পরদিন সকালেই চলে আসবে। কিন্তু…”
“মনকে শক্ত করুন মাসীমা। জানি এসময় আপনি একদম কথা বলার মত পরিস্থিতিতে নেই তবু অলীকের খুনিকে ধরতে আপনাদের কিছু প্রশ্ন আমাকে করতেই হবে।”
“সবই বুঝি বাবা। তবু মন মানতে চায় না। আমার সোনার টুকরো ছেলে ছিল অলীক।”
-“আচ্ছা, অলীকের বাবা কতদিন হল মারা গেছেন?”
“পাঁচ বছর প্রায়।”
“আচ্ছা কিছু মনে করবেন না। আপনার অবর্তমানে সম্পত্তির কিরকম ভাগাভাগি হবে সেটা যদি একটু বলেন, অবশ্য এটা বলা না বলাটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
উনি কিছুক্ষণ থামলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন, “সম্পত্তির ব্যাপারে অলীকের বাবা কিছু ঠিক করে দিয়ে যান নি। তবে আমি ঠিক করেছিলাম আমার সম্পত্তির পঞ্চাশ শতাংশ এখানে অনাথ আশ্রমে দান করব। চল্লিশ শতাংশ পাবে অলীক। আর বাকি দশ শতাংশ আমার বড় ছেলে সমীরণের জন্য। ঐ মাতাল সমীরণটাকে আমি ইচ্ছে করেই আমার সম্পত্তির বৃহত্তর অংশ থেকে বঞ্চিত করেছি।”
-“আচ্ছা, উইল তৈরি হয়ে গেছে?”
“না, তবে অলীক না থাকলেও আমার সম্পত্তির ওইটুকু ভাগ ছাড়া সমীরণ কিছু পাবেনা।”
“আপনার শরীর বুঝে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উইলটা তৈরি করে নেওয়াই ভালো মাসীমা।”
আমরা এবার অলীকের বৌদির ঘরে এলাম। ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি ল্যাভেন্ডারের গন্ধে মনটা ভরে গেল। অলীকের বৌদি দুহাত দিয়ে ভর করে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে তুলল সোফার ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে মনের কষ্টটা লুকানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। মেদহীন শরীর, মসৃণ চুলে কোনো পাক নেই, পরনে সুতির ছাপা একটা শ্যাওলা কালারের শাড়ি, চকচকে টানা টানা চোখদুটো যেন বহুদিনের রাত্রি জাগরণের কারণে ঢুলুঢুলু। সমীরণবাবু ছিলেন না। এসে থেকেই ওনাকে ঘরে দেখিনি। আমরা একটা সোফায় উপবেশন করে কথোপকথন শুরু করলাম।
-“আপনার নামটা?”
“মিসেস সীমন্তিনী সেন।”
“আপনার বাবার বাড়ি কোলকাতায়, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু…”
“অলীকের বন্ধুরা সেদিন বিকেলের সেই ঘটনা সব আমাকে বলেছে।”
“কিন্তু কেন, কেন খুন করলো হীরা আমাদের অলীককে? শত্রুতা কি এমন পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে?”
“হীরা খুন করেনি।”
“মানে?”
“ইয়েস ইটস ট্রু । আচ্ছা আপনি সুমিলিকে চিনতেন?”
“না। সেদিনই বিকেলে প্রথম দেখেছিলাম।”
“সুমিলি অলীককে ভালোবাসত এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?”
“হোয়াট রাবিশ? অলীককে ওর কথা অনেক বলতে শুনেছি তবে অলীক সুমিলিকে ভালবাসবে এটা ভাবা আমার পক্ষে কঠিন।”
“সুমিলি নিজের অজান্তেই আমাদের কাছে সেটা স্বীকার করেছে।”
“কিন্তু সেরকম কিছু হলে অলীক আমাকে নিশ্চয় বলত। আমার কাছে ও কোনোকিছুই লুকোয় না বলে আমার ধারনা।”
“আর সুমিত?”
“হ্যাঁ, ওর কথাও প্রায় বলতো অলীক, একবার আমাদের বাড়িতেও এসেছিল অলীকের জন্মদিনে।”
“সুমিলি আসে নি?”
“না, ইন্দ্রজিৎ বাবু। তবে সুমিতকে আমার ওদের তুলনায় একটু ম্যাচিওর মনে হত। একটু হলেও ওদের থেকে আইসোলেটেড থাকত, সবই অলীকের কাছে শোনা।”
“অলীক কোনোদিন ওর বন্ধুদের বাড়ি যায় নি?”
“জানি না, হয়তো গেছে। তবে সুমিতের বাড়ি যায় নি কারন সুমিতের বাবা সৌমেন চক্রবর্তী এসব পছন্দ করতেন না।”
“সৌমেন চক্রবর্তী? মানে হোস্টেল সুপার? ও মাই গড। এটা তো আগে জানতাম না।”
“হ্যাঁ সুমিতের তো স্কটিশে অ্যাডমিশনটা ওর বাবার জন্যেই হয়েছে। নাহলে মেরিটের ভিত্তিতে ওর চান্স পাবার কথা নয়।”
বিদ্যুতের মত মাথায় একটা জিনিস খেলে গেল। এইজন্যই সুমিত চক্রবর্তীর মুখটা খুব চেনা চেনা লেগেছিল ছবিতে। সুমিত প্রায় অনেকটা দেখতে ওর বাবা সৌমেন বাবুর মত। তাহলে সুমিলির ব্রেসলেটে এস সি লেখা মানেটা কি সুমিত চক্রবর্তী? সুমিতই কি সুমিলিকে ব্রেসলেটটা গিফট হিসেবে দিয়েছিল? কিন্তু এর সাথে খুনের কি যোগাযোগ থাকতে পারে? কারোর মুখ দেখে তার মনের ভেতরটা পড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ইন্দ্রদার । আমি বিড়বিড় করছি দেখে ও থাকতে না পেরে বলে উঠল, “এস সি মানে সিডিউল কাস্ট তো হতে পারে সৌম্য, তাতেও যদি সন্দেহ থাকে তবে স্কটিশ চার্চ ও ভাবতে পারিস। আপাতত ব্রেসলেটের রহস্যটা মন থেকে খুলে রাখ।”
কথাবার্তার অপ্রাসঙ্গিকতায় অলীকের বৌদি হকচকিয়ে গেলেন।
-“আপনারা ঠিক কি নিয়ে কথা বলছেন বলুন তো?”
ইন্দ্রদাই ব্যাপারটাকে সামাল দিল, “আরে না না। ও কিছু না। মিসেস সীমন্তিনী সেন, আপনার স্বামী সমীরণবাবুকে তো দেখছি না?”
-“ওকে কি আপনি পাবেন? সারাটা দিন জুয়া খেলছে কোথাও হয়ত। কোনোদিন দুপুরে খেতে আসে, আবার কোনোদিন আসে না। রাতে এসে আবার মদ খায়।”
“আচ্ছা গতবছর আপনি অলীকের হোস্টেলে নিউ ইয়ারে একটা গ্রিটিংস কার্ড পাঠিয়েছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ অলীকও প্রতি বছর পাঠাত, আর্চিস থেকে কিনে, আমাকে খুব ভালোবাসত, জানেন ইন্দ্রজিৎবাবু।”
-“সুমিলিও ওকে কার্ড পাঠিয়েছিল, তাতে যা কিছু লেখা ছিল সেটা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সুমিলি অলীককে ভালোবাসত। এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানতেন?”
“নাথিং, নট অ্যাট অল। অলীকের তরফ থেকে সেরকম কিছু ছিল কিনা সে ব্যাপারে আপনি এত নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ বাবু।”
“হুম, আচ্ছা সীমন্তিনী দেবী কোলকাতায় আপনার বাবার বাড়ির ফোন নম্বরটা একটু দিন।”
“হ্যাঁ, এখনই লিখে দিচ্ছি।”
“আপনার বাবার নামটা পাশে লিখে দেবেন প্লিজ।”
সীমন্তিনী সেনের সাথে আর কোনো কথা হয়নি। অলীকের বাড়ির সব মানুষজনদের মধ্যে আলাদা হলেন সমীরণবাবু, বিকেলে ওনার সাথে আলাপ হতেই টের পেলাম।
-“আপনি সমীরণ সেন? অলীকের দাদা?”
-“হ্যাঁ। কি জানতে চান তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সময়ের অনেক দাম।”
আমি এক ফাঁকে সমীরণ সেনের চেহারাটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। থলথলে ভারী চেহারা, মুখে গোঁফ দাড়ির লেশ মাত্র নেই, নাক কান থেকে গোছা গোছা চুল বেরিয়েছে, গোল গোল ঘোলাটে চোখ, কম পাওয়ারের সরু সোনালি ফ্রেমের চশমাটা বুক পকেট থেকে ঝুলছে, জানি না চোখের ঘুমন্ত ভাবটা সত্যি কিনা।
-“সারাদিন ড্রিঙ্ক করে অসংযত জীবনযাপন করে আপনার কি লাভ হয় সমীরণবাবু?”
“সেটা আমার পারসোন্যাল ব্যাপার গোয়েন্দা বাবু।”
“আপনি কি জানেন আপনার মা আপনাকে সম্পত্তির বৃহত্তর অংশ থেকে বঞ্চিত করেছেন?”
“ জানি, আর এও জানি অলীকই প্রায় সবকিছু পাবে।”
-“তাহলে খুনের মোটিভটা আপনার না বোঝার কথা নয়।”
-“মানে? কি বলতে চাইছেন? আমিই সম্পত্তির লোভে ভাইকে খুন করেছি।”
-“ইটস নট ইম্পসিবল।”
“দেখুন আমার বাড়িতে এসে টিকটিকিগিরি করছেন করুন, কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করলে…”
“বাড়াবাড়ি করলে আপনাকেও লকআপে ঢোকাতে পারি।”
“আমারই বাড়িতে এসে আবার আমাকেই শাসাচ্ছেন? আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।”
-“ইউ আর রং সমীরণবাবু, বাড়িটা আপনার নয়। এখনও পর্যন্ত আপনার মায়ের।”
সমীরণবাবু হঠাৎ বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেলেন। ইন্দ্রদার মোবাইলটা তখনই পকেটে বেজে উঠল।
-“বলুন ইনস্পেক্টর সমাদ্দার।”
“ইন্দ্রজিৎ বাবু, হীরা যে মোবাইল নম্বরটা দিয়েছিল ওটা অন্য একজনের। সারা কোলকাতায় এখনো পর্যন্ত হীরার খোঁজ পাওয়া যায় নি।”
“হীরাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল খুঁজে বের করুন।”
“ওদিকের খবর কি ইন্দ্রজিৎবাবু?”
“এখনো পর্যন্ত ব্লাইণ্ড। কিছু জানা গেলে ফোন করব।”
সন্ধ্যেবেলায় দোতলার ঘরে আমি আর ইন্দ্রদা চাকরানীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। পরনে সাদা কালো মেশানো আঁশের মত বুটি দেওয়া জীর্ণ সুতির শাড়ি, প্রায় সমস্ত মুখটাকে ঢেকে ঘোমটা দিয়ে থাকলেও বোঝা যায় মুখশ্রী বেশ সুন্দর। মুখ নিচু করে কথা বললেও ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম ফাটা ঠোঁটটা বারবারই ভয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরছিল।
-“তোমার নাম?”
“আজ্ঞে প্রমিলা।”
“অনেকদিন কাজ করছ তাই না?”
“না, কবছর মোটে হল। অলীক দাদাবাবু যেদিন কোলকাতা গেলেন…”
“তুমি একতলায় সমীরণবাবুর পাশের রুমটাতে থাকো? ”
-“হ্যাঁ।”
-“তুমি অলীকের খুনের ব্যাপারে কিছু বলবে?”
-“খুন? অলীক দাদাবাবু খুন হয়েছেন?”
-“তুমি জানো না?”
-“তবে যে বৌদিমণি বললে অলীক দাদাবাবুর কি একটা রোগ হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি আছে।”
হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। প্রমিলা নিচে আলো আনতে গেল। অন্ধকারেই বসে আছি প্রায় কয়েক মিনিট। ইন্দ্রদার অবশ্য টর্চ ছিল, সেটা ব্যাগে আছে। এবার মনে হল জানলার কাছে অন্ধকারের বুকে একটা ছায়া। অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম, চোখ কুঁচকে ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে আমাকে ইশারায় থামিয়ে ইন্দ্রদা সরীসৃপের মত এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল টর্চটা আনতে। কিন্তু টর্চ জ্বালবার আগেই ছায়ামূর্তিটা আমাদের দিকে একটা দলা পাকানো কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে ছুটে চলে গেল। আমরাও ছুটে গেলাম। একতলায় তখন সীমন্তিনী দেবীর গলা শোনা যাচ্ছে…
-“কে, কে? প্রমিলা রে, চোর, চোর ঢুকেছে।”
আমরা একতলায় নেমে আসতেই কারেন্ট চলে এল ।
-“একটা লোক, একটা… কালো কোট পরা একটা লোক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রজিৎ বাবু।”
ঠিক তখনই মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ঢুকলেন সমীরণ সেন।
ইন্দ্রদা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কাউকে বাইরে পালিয়ে যেতে দেখলেন?”
উনি জানি না বলে টলতে টলতে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ইন্দ্রদা আর আমি বাইরে এসে অনেক খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রমিলা বলল ও পাশের ঘরে আলো জ্বালছিল। বৌদির চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে।
-“ডোন্ট ওরি, মিসেস সেন। ভয়টা আপনাদের পাবার কোনো কারন নেই। কারন ভয়টা আমাকে দেখানো হয়েছে যাতে আমি এখান থেকে চলে যাই। তবে রাত্রে একটু সাবধানে থাকবেন। মেনগেট ভালো করে তালা দিয়ে দেবেন।”
আমরা দোতলায় নিজেদের রুমে এলাম। দলাপাকানো কাগজটা সোজা করার চেষ্টা করল ইন্দ্রদা। একটা চিঠি।
টিকটিকি ,
একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কাল সকালে কোলকাতা ফিরে আরাম করুন নিজের বাসায় গিয়ে। তা না হলে ফল ভাল হবে না। জানি আপনাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো যাবে না। আপনি যদি কেটে না পড়েন তাহলে অলীকের মত এ বাড়িতে আর একজনকে খুন করবো আমি। আপনি কিস্যু করতে পারবেন না। আর তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি।
ইতি
হীরা
ইন্দ্রদা চিঠিটা বারবার পড়ছে , তাই আমার কথা কানে গেল না ।
-“হিরণ্ময় রায় তাহলে আমাদের কাছে কাছেই ঘুরছে?”
-“একটা আবছা ক্লু দেখতে পাচ্ছি।”
-“কোথায়, চিঠির মধ্যে?”
-“একবার সীমন্তিনী সেনের কোলকাতার বাবার বাড়ির ফোন নম্বরটা আন তো”
-“এত রাত্রে ওদের ডিস্টার্ব করবে?
চলবে…