সে তবে কে ? [দ্বিতীয় পর্ব] লেখা – শান্তনু দাস
আগে যা হয়েছে…
ইন্সপেক্টর সমাদ্দারের কাছে আসা এক ফোনের সূত্র ধরে ইন্দ্রদা আর আমি হাজির হলাম স্কটিশচার্চ কলেজের হোস্টেলে। কিন্তু প্রায় আমাদের সামনে খুন হয়ে গেল কলেজ ছাত্র অলীক… ত
তারপর…
( ২ )
জবানবন্দি
অন্ধকারে বসে আছি আমি আর ইন্দ্রদা একটা চেয়ারে, অন্য একটাতে ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার।
-“হাবিলদার… জেনারেটরটা চালিয়ে দাও। আপনারা চা কফি কিছু নেবেন?”
-“নো, থ্যাঙ্কস।”
পরের দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ থানায় এসে পৌঁছেছি আমি ও ইন্দ্রদা। বাইরে আলোর আভা থাকলেও থানার ভেতরটা অন্ধকার। ইন্সপেক্টরের নির্দেশে হাবিলদার জেনারেটর চালিয়ে দিল।
-“তারপর বলুন সমাদ্দারবাবু, ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগোল?”
-“আপনাকে বলেছিলাম না, মার্ডার যে করেছে সে যথেষ্ট চতুর। হোস্টেল সার্চ করে মনের মত কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আমার কি মনে হয় জানেন যে মেয়েটা আমাকে ফোন করেছিল সে খুন করেনি। ওটা একটা ট্রিকস মাত্র।”
-“খুন করা আর খুন করানো ভাড়াতে গুন্ডা দিয়ে একই ব্যাপার। মেয়েটি সম্পর্কে কিছু উদ্ধার করতে পারলেন?”
-“মোবাইল নম্বর ট্রেস করে কোনো লাভ হয়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট আর আধ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাব। তার আগে চলুন একবার অকুস্থলটা দেখে আসি।”
ছটার মধ্যে স্কটিশ চার্চ কলেজের কাছাকাছি জিপ এসে থামল। আকাশে তখনও যথেষ্ট আলো। যে ঘরটায় খুন হয়েছে সেই ঘরটার তালা খুলতে খুলতে ইন্সপেক্টর সমাদ্দার বললেন, “অলীক সেন বি এস সি থার্ড ইয়ার, ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ত। বাড়ি মেদিনীপুরের তমলুক। আসলে কলেজে দশদিনের টানা ছুটি ছিল, তাই সব স্টুডেন্টরা বাড়ি চলে যায়। হোস্টেলে প্রায় কেউ ছিল না। সুযোগটা চমৎকার কাজে লাগিয়েছে খুনি। যে চারজন ছাত্র সেদিন রাতে উপস্থিত ছিল তাদের জেরা করা হয়েছে, সুফল কিছু পাওয়া যায়নি।”
আমরা সেই ঘরটায় ঢুকলাম। হিমহিম স্যাঁতসেঁতে সোঁদা গন্ধ। টিউবলাইটের আলোতে ছোট্ট অগোছালো ঘরটির দিকে এবার চোখ গেল। বিছানার উপর কোনো বেডকভার নেই, তার উপর মাদুর পাতা। এখানেই লাশটা ছিল তাই মাদুরে লাল রক্তের দাগ স্পষ্ট। রয়েছে বালিশ যার উপর বেশ গভীর একটা দাগ পড়েছে, দেখলেই মনে হয় আগে কেউ যেন কনুইয়ে ভর দিয়ে শুয়েছিল। চেয়ারগুলো ছড়ানো এদিক ওদিক। একটা টেবিলের উপর খাতাপত্র, কিছু ফিজিক্সের বই আর দু চারটে বাংলা উপন্যাস। ইন্দ্রদা ড্রয়ারটা টেনে খুলল। কতকগুলো গ্ৰিটিংস্ কার্ড পাওয়া গেল। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। একটা জায়গায় চকের লেখা ‘অলীক’ তার চারপাশে হিজিবিজি ডিজাইন করা। ইন্দ্রদার প্রখর দৃষ্টি রুমটার মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত চক্রের মত ঘুরছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর আমরা রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশের যে ঘরে রাঁধুনি শবর থাকতো সেই ঘরটা দেখতে আরো দশ মিনিট লাগল। হোস্টেল সুপার সৌমেন চক্রবর্তীকে ডাকা হল।
-“নমস্কার, আমি ইন্সপেক্টর কালীচরণ সমাদ্দার। ইনি স্বনামধন্য ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সান্যাল এবং ওনার সহকর্মী সৌমাভ।”
-“বলুন। আমার দিক থেকে যতটুকু সাহায্য করার আমি করব।”
ইন্দ্রদা বলল, “প্রথমত হোস্টেলের মেনগেট রাতে বন্ধ ছিল না সেদিন, দ্বিতীয়ত বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়েও তো বাইরের লোক ভেতরে আসা যাওয়া করতে পারে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?”
-“আমি হায়ার অথরিটিকে অনেকবার জানিয়েছি। কোনো লাভ হয়নি। আর মেনগেটে নাইট গার্ড থাকে। হয়তো নাইট গার্ডকে অজ্ঞান করে…”
-“আপনাদের গেট কিপার?”
-“ছিল না। ছুটিতে বাড়ি গেছে।”
-“আপনি কাল কোথায় ছিলেন?”
-“সাধারণত এখানেই থাকি, তবে কাল বাড়িতে ছিলাম। ছেলের জন্মদিন ছিল।”
ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা থানায় এলাম সাড়ে সাতটায়। প্রথমে ডাকা হল নাইট গার্ড ভীমুকে। লিকপিকে লম্বা পুরু গোঁফওয়ালা ভীমু এসে বসল ইন্দ্রদার সামনের চেয়ারে।
-“কাল রাতে ঠিক কি কি ঘটেছিল প্রথম থেকে বল, কিচ্ছু বাদ দেবে না।”
ইন্দ্রদা টেবিলের উপর অলীক সেনের ফাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ভীমু বলতে শুরু করল, “আমি হেঁটে হেঁটেই পাহারা দিচ্ছিলাম। চারদিক খুব নিস্তব্ধ ছিল, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ আমার কানে এল, শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। দেখি একটা কালো কোট আর টুপি পরা লোক এদিকে আসছে। হাত দুটো তার কোটের পকেটে ভরা। সোজা আমার কাছে এল লোকটা। অন্ধকারে মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে কালো গোঁফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল মুখে। আমি জোরে বলে উঠলাম, “এত রাতে কাকে চাই?” কথাটা শেষ হল না আমার। লোকটা একটা রুমাল আমার নাকে চেপে ধরল। আমার হাতের লাঠিটা পড়ে গেল। তারপর আর কিচ্ছু জানি না।”
-“লোকটার হাতে কি গ্লাভস ছিল?”
-“না।”
-“লোকটা তোমার সাথে কোনো কথা বলেনি?”
-“না।”
-“তুমি এখন যেতে পারো।”
ইনস্পেক্টর সমাদ্দার বলে উঠলেন, “এইমাত্র খবর এল ইন্দ্রজিৎবাবু। আপনার ধারনাই ঠিক। লাঠিতে দুরকম ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে। একটা ভীমুর, আর অন্যটা কারোর সাথে ম্যাচ করেনি। ওটা নিশ্চয় ঐ কালো কোট টুপি পরা লোকটার। আরো একটা খবর, যে রিভলবার থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে সেটিতে একটি গুলিই ফাঁকা এবং ঐ রিভলবারের গুলিই অলীকের শরীরে পাওয়া গেছে পোস্টমরটেম বলছে। কিন্তু একটা হিসেব মিলছে কই? ঐ রিভলবারে তো কালো কোট টুপি পরা লোকটার ফিঙ্গার প্রিন্ট থাকা উচিত, তাই না?”
-“তাহলে কি ঐ লাঠির ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে রিভলবারের ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ করেনি?” আমি বললাম।
-“না। আর রিভলবারে শুধু হীরার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে।”
ইন্দ্রদা বলল, “আচ্ছা ঐ হীরাকে একবার ডাকুন।”
এক যুবক আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। লম্বা পেশল চেহারা, পরনে নীল গেঞ্জি আর জিন্সের প্যান্ট। যুবকটি টেবিলের উপর হাতদুটো রেখে বলল, “আপনারা আমাকে শুধু শুধু ধরে রেখেছেন কেন বলুন তো? আমি তো বলছি আমি অলীকের খুনের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না।” ইন্দ্রদা বলল, “বসুন মিস্টার… আপনার নামটা?” যুবকটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “আমি হিরণ্ময় রায়। শর্টে হীরা। কিন্তু আপনারা আমাকে নিয়ে যা শুরু করেছেন…”
-“আপনি অত রাতে হোস্টেলে কি করতে গিয়েছিলেন?”
-“অলীকের সাথে দেখা করতে।” হীরার মুখে বিরক্তির ছাপ।
-“বন্ধুর সাথে দেখা করতে কেউ অত রাতে হোস্টেলে যায় না।”
-“আমি যাই। এনি প্রবলেম?”
-“আপনি তো অলীকের সিনিয়ার ব্যাচ?”
-“কেন সিনিয়াররা বন্ধু হয় না নাকি? আপনারা তো যা তা শুরু করছেন এবার…”
-“তুমি কি জানো রিভলবারে তোমার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে? ”… ইনস্পেক্টর বললেন।
-“আমার জানার প্রয়োজন নেই।”
-“প্রয়োজন আছে বইকি, বেশি চালাকি না করে যতটুকু জানিস উগরে দে, নাহলে কপালে খুব দুঃখ আছে।” ইন্দ্রদার গলার স্বর ধারালো হয়ে গেছে। ও সোজা আপনি থেকে তুই তে নেমে এল।
-“দেখুন, আমি যতটুকু জানি বলছি। আমি রাতে অলীকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কারণটা পারসোন্যাল।”
-“চাবকে তোর পারসোন্যাল বের করে দেবো, কেন গিয়েছিলি?”
-“একটা বইয়ের দরকারে।”
-“বাথরুমের পেছনে গলিটা দিয়ে?”
-“হ্যাঁ। আমি অলীকের রুমের দরজার কাছে আসতেই মনে হল কেউ আমার পেছনে আসছে। আমি পেছন ঘুরতে যাবো ঠিক তখনই একটা গ্লাভস পরা লোক পেছন থেকে রুমাল দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল। তারপর অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে দেখলাম পুলিশ স্টেশনে। ঐ টাইমের মধ্যে হয়তো সে খুন করে আমার হাতে রিভলবারটা ধরিয়ে পালায়।”
-“বিশ্বাস করলাম। তবে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে বেশি সময় লাগবে না। তোর ফোন নম্বর টা লিখে দিয়ে বাড়ি যা, দরকার পড়লে আবার ডাকব।”
হীরা নম্বরটা একটা ছোট্ট চিরকুটে লিখে সোজা গটগট করে বেরিয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম হীরা বাঁ হাতে লেখে। এবার ঘরে ঢুকল গেঞ্জি ধুতি পরা কালো রাঁধুনি শবর।
শবর শুরু করলো তার দেখা রাতের ঘটনা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ভয়ের প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
-“আমি তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছি। গুলির আওয়াজ শুনে প্রথম ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি কালো কোট টুপি পরা একটা লোক ছুটে পালাচ্ছে। আমি খুন খুন বলে চিৎকার করতে করতে বাইরে ছুটে যাই। এর বেশি আমি কিছু জানি না বিশ্বাস করুন।”
ইন্দ্রদার নির্দেশেই ইন্সপেক্টর ওকে ছেড়ে দিলেন। তার আগে ওর বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিল ইন্দ্রদা। কালীচরণবাবু সেই ছোট্ট ওয়াকম্যান টেপটা বের করে ইন্দ্রদাকে দিলেন আর বললেন, “এটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে শুনুন, দেখুন যদি কিছু আন্দাজ করতে পারেন। ক্যাসেটটা এর ভেতরেই আছে।”
-“সিওর। আচ্ছা আপনি ঐ হীরা ছেলেটা যেন শহরের বাইরে যেতে না পারে একটু ওয়াচ করবেন তো।”
চলবে…