
স্বাদ। লিখেছে গোগোল
জানুয়ারি ২৭
আমার খিদে পাচ্ছে। প্রচণ্ড খিদে। সর্বগ্রাসী আগুনে খিদে। কারণ আছে এই যন্ত্রণার। আমি গত দুদিন ধরে কিছুই খাইনি। খালি কিছু কাঁচা ব্রকলি ছাড়া। দুদিন না তিনদিন? নাকি এক মাস? দুদিন হবে। আসলে খিদেতে সময়ের তাল থাকে না। তারপর এই দ্বীপে আমি একা। আমার হাতঘড়িতে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে খারাপ হয়ে গেছে।
দ্বীপ না বলে একে বালির চড়া বলা উচিত। লম্বায় সাড়ে তিনশো পা, আর চওড়ায় মেরেকেটে আড়াইশো পা হবে। আর তিনটি সুন্দরী গাছ। একটি বড় রকম সাইক্লোন এলেই যে এই চড়ার কোনো নাম ও নিশানা থাকবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি ভয় পাচ্ছি না যদিও। কোনো বাঘের আওয়াজ পাইনি আমি এখনও। আর কিছু ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চয়ই আমাকে রেসকিউ করতে কেউ না কেউ আসবেই।
আমি রুনু ঠাকুর। এটা আমার ডায়েরি। আমার এমনিতে ডায়েরি লেখার খুব অভ্যাস নেই। ডায়েরি কেন, কোনো কিছুই লেখার অভ্যাস নেই। কিন্তু এখন আমি একা। এই বালির চড়ায় আর কেউ নেই। আমার ডিঙি নৌকাটি ছাড়া। আর আছে একটি রেডিও ওয়েভ ট্রান্সমিটার। যেটি আমি চালু করে দিয়েছি। যেকোনো মুহূর্তেই পুলিশ রেসকিউ টিম চলে আসবে আমার উদ্ধারে। এতক্ষণে তো চলে আসা উচিত ছিল। দুদিন লাগছে কেন কে জানে? আর আছে দুটি ব্রকলি। আমি ব্রকলি খেতে ভালোবাসি। যাই হোক, যতক্ষণ না কেউ আমায় রেসকিউ করছে আমি এই ডায়েরি পাতা ভরতে থাকি। তারপর একে সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে দেব। আপাতত টাইম পাস করতে হবে। আমার মনটা খিদের দিকে যাতে না যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
কামিং ব্যাক – আমি রুনু। সাব ইন্সপেক্টর রুনু। পোস্টিং সুন্দরবনে। একটা দুর্ঘটনার ফেরে এই মুহূর্তে একটা জনমানববিহীন দ্বীপে আমি নিখোঁজ হয়ে রয়েছি। ছোটবেলায় বাবা একটা চটি বই কিনে দিয়েছিল। প্রচ্ছদে একটা দাড়ি মুখ, মাথায় পাইরেট টুপি। বইটির নাম রবিনসন ক্রুসো। এখন আমি নিজেই রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেছি।
ওটা কী? দূরে যেন একটা তিতির পাখি মনে হচ্ছে? যাই আমি দেখি ধরতে পারি কিনা। সময় কাটানোর সাথী পাওয়া যাবে। ওর একটা ডানা ভেঙে দিলেই হবে, যেমনটি আমি রিফিউজিদের ডানা ভেঙে দিয়েছি। মরিচঝাঁপিতে।
জানুয়ারি ৩১
ব্যথা। কী ব্যথা আমার ডান পায়ে। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না আমি। ওই লক্ষ্মীছাড়া তিতিরের বংশ নির্বংশ হোক। ওটাকে যদি হাতের কাছে পাই আমি ওর একটা একটা করে পালক ছিঁড়ে ছিঁড়ে যন্ত্রণা দিয়ে মারব। ওরে বাবা রে। ওরে মা রে। আমাকে যখন রেসকিউ করে নিয়ে যাবে তখন আমি সদর থানার ভেতরে একশোটা তিতিরের মাংস রোস্ট করে বাকিদের খাওয়াব। আমি খাবো না। আমি তো নিরামিষাশী। এই মুহূর্তে আমার চাই একটি – না না অনেকগুলি পেনকিলার। ওই হতচ্ছাড়া তিতিরের পিছু করছিলাম আমি। তিতিরটি গিয়ে উড়ে বসে ডিঙির উপর। আমি আমার হাতে একটি পাথর তুলে নিয়েছিলাম ওর ডানাটি ভাঙব বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে উড়ে যায় এবং আমি পাথর লাগিয়ে ফেলেছিলাম নিজের ডান পায়ে। সেই অসম যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছি না। ওরা এখনো কেউ আসছে না কেন? খিদে – খিদে পেয়েছে আমার। যাই গিয়ে ব্রকলিটা খেয়ে আসি।
ফেব্রুয়ারি ৩
কতদিন হয়েছে আমি আর গুনতে পারছি না। ওরা কি আমাকে ভুলে গেছে? আমি ইন্সপেক্টর – সাব ইন্সপেক্টর রুনু। সুন্দরবনের পুলিশ অফিসার। আমাকে কি করে ওরা ভুলে যেতে পারে? আমি একা মরিচঝাঁপিকে শান্ত করেছি। সেই মরিচঝাঁপি যেখানে রিফিউজিগুলো এসে বসে সরকারি জমি কিনে নিজেদের জমি ভাবার ভুল করেছিল। বাঘ তাড়িয়ে নিজেদের বসতবাড়ি করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। আমার রিভলবারের বুলেটে অন্তত ২৫টা রিফিউজির শরীর ছুঁয়ে গেছে। ওদের লিডারের নাম ছিল নিমাই। অন্তত পাঁচশো জন লোক আমাকে ঘিরে ডেপুটেশন দিচ্ছিল। ওদের সাহস এত, আমায় বলে – আপনার ডিঙি আটকে দেব। আপনাকে মেনল্যান্ডে ফিরে যেতে দেব না। নিমাই বলে – এই জমি তো নোনা জমি। এই জমি অপ্রয়োজনীয়। আমি ওর পায়ে গুলি চালিয়ে বলি – নে তোর এই পাটাও অপ্রয়োজনীয়। বাকি লোকগুলো ক্ষেপে উঠে আমাকে আক্রমণ করতে গেল। আমিও ডিঙিটা চালিয়ে পালিয়ে চলে আসি এই দ্বীপে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তবে এবার রেসকিউ টিম না এলে আমি বিপদে পড়ে যাব। আমার ডিঙিটিতে যেটুকু খাওয়ার জল আছে তা আর বেশি দিন যাবে না।
ফেব্রুয়ারি ২৮
আচ্ছা – আকাশের গায়ে কি সত্যি টকটক গন্ধ যেমন বলে গেছেন সীতানাথ – তবে এখানকার রাতের আকাশ রাতের বেলাতেও যেন নীল হয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে কালো হয়। ঠিক যেমন আমার ডান পাটা প্রথমে নীল তারপর কালো হয়ে গেছে। এরকম কালো একবার পুলিশ ট্রেনিংয়ের ম্যানুয়ালে দেখেছিলাম যখন এক ভদ্রলোকের গুলি লেগে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছিল। গ্যাংগ্রিনের ফলে তার মাংসপেশিতে পচন ধরে। আমার পায়ে কি তবে গ্যাংগ্রিন হচ্ছে? তার তো একটাই চিকিৎসা কেটে বাদ দেওয়া এবং সেটা জলদি করতে হবে। আসছে না কেন আমাকে বাঁচাতে উদ্ধারকারী দল? আমি ইতিমধ্যে একটি ব্রকলি খেয়ে ফেলেছি আর আরেকটি রেখে দিয়েছি।
মার্চ ৩
আমাকে কেউ রেসকিউ করতে আসবে না। কারণ কোন রেডিও সিগনাল যায় নি। আজ আমি রেডিও ট্রান্সমিটারটা খুলে দেখি ওর ব্যাটারি নোনা জলে খারাপ হয়ে ছিল। তাই রেডিও ট্রান্সমিটার চালু হয়নি। তখন কার যেন একটি অট্টহাসির শব্দ শুনতে পাই।
মার্চ ৭
পায়ের যন্ত্রণা লাঘব করার একটাই পথ। Amputation। আমি একটি পাথরকে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ বানিয়েছি। ওটাই হবে আমার শল্য চিকিৎসার উপাদান। এ কার অট্টহাসির আওয়াজ আমার পিছনে? এর সাথে আমি শুনতে পাচ্ছি কার কথা, সে বলছে, সে বলছে – পাটা অপ্রয়োজনীয়। ঘুরে তাকিয়ে দেখি – এ তো নিমাই! নিমাই এখানে কী করে?
একটি স্পিডবোট এসে নেমেছে সুন্দরবন থেকে ১০০ km ভিতরে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত একটি দ্বীপে। সচরাচর এই দ্বীপে কেউ আসে না। কারণ দ্বীপটিতে কিছুই নেই। খালি তিনটি সুন্দরী গাছ ছাড়া। স্পিডবোট এসেছে অন্য কারণে। মাস তিনেক ধরে সাব ইন্সপেক্টর রুনু ঠাকুর নিখোঁজ। তার খোঁজে পুরো পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড়। মরিচঝাঁপিতে নাকি পুলিশ অত্যাচার করেছে এবং তার প্রধান কালপ্রিট রুনু ঠাকুর। কিন্তু তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে একটা জেলের নৌকা এদিকে মাছ ধরার সময় একটি ভাঙা ডিঙি দেখতে পেয়ে পুলিশকে জানায়। সেই সূত্রে ইন্সপেক্টর বাবু এই দ্বীপে এসেছেন। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল আর একজন চালক। ইন্সপেক্টর বাবু নিশ্চিত হন যে এই ডিঙ্গিটি রুনু ঠাকুরের। তার পরার হাতঘড়িটি এবং একটি রক্ত মাখা ডায়েরি – দুটো জিনিস এই ভাঙা ডিঙির ভেতর পাওয়া গেছে। কিন্তু রুনু ঠাকুর নিজে কোথায়? আর ডায়েরিটিতে রক্ত কার?
ইন্সপেক্টর বাবু রাতে নিজের রুমে সব এভিডেন্স ফাইল করতে লাগলেন। রাত জেগে কাজ করা স্বভাব। রুনু ঠাকুর নিখোঁজ বলে মামলা বন্ধ করা হবে। ইন্সপেক্টর বাবু খালি একটি ধাঁধার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। দ্বীপ থেকে উনি গেলেন কোথায়? উনি মৃত, এটা তাঁর মনে সন্দেহ নেই। বেচারি নিরামিষাশী ছিলেন। শেষ সময় লতাগুল্ম খেয়েই বিষক্রিয়ায় মারা গিয়ে থাকবেন। কিন্তু ডেড বডিটি কোথায়? ভাবতে ভাবতে যখন উনি চিন্তায় নিমগ্ন ওনার চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিতে। সেই রক্ত মাখা ডায়েরি যেটি দ্বীপে পাওয়া গিয়েছিল। পাতা উল্টোতে থাকেন।
এপ্রিল ৭
ব্যথা। পায়ে ব্যথা। নিমাই বলেছে পা টা অপ্রয়োজনীয়। খাবার নেই। সুন্দরী গাছের পাতা খাচ্ছি আমি। নিমাই রাতে আসে। দিনে মিলিয়ে যায়। সমুদ্রের জলে।
এপ্রিল ১৫
নিমাই বলল
দুটো পা অপ্রয়োজনীয়।
৮ আঙুল হাতের অপ্রয়োজনীয়।
বলল মাংস খাঁ।
বলল সমুদ্র সাঁতার কেটে পার হব আমরা দুজন।
প্রচণ্ড ব্যথা।
এপ্রিল ২৫
সুন্দরীর পাতা শেষ।
মে ১
আজকে সাঁতার কেটে পার হব।
আঙুল কাটলাম।
খুব কুরমুরে খেতে। মানুষের মাংসের স্বাদ ঠিক যেন ব্রকলি।
সমাপ্ত