
কোরিয়ান (দ্বিতীয় পর্ব) || লেখা: শুভাশীষ দে
শুরুটা করি আমার একদম ছোটবেলা থেকে। মা, তোমার হয়তো মনে আছে খুব ছোটবেলার কথা। আমার টিভিতে দেখা সেই ফ্যাশন শো এর কথা। তোমরা হয়তো ভেবেছিলে সেই ফ্যাশন শো থেকেই আমার কোরিয়া প্রীতি শুরু। কিন্তু না। কোরিয়ার প্রতি আমার অনুরাগ আরো আরো অনেক ছোটবেলা থেকে। ঠিক মনে করতে পারি না। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় যখন থেকে এ জীবনে জ্ঞান-বোধ এসেছে, তখন থেকেই মনে হয় যেন কোরিয়ান আমার অনেক অনেক আগেকার চেনা ভাষা। এই ভাষা যেন আমার নিজের মাতৃভাষা। তোমাদের হিসেবে অত কঠিন আর খটোমটো কোরিয়ান ভাষা আমার কাছে কখনই কঠিন বলে মনে হয় নি। বরঞ্চ মনে হয়েছে কোরিয়ান ভাষার মত মিষ্টি ভাষা আর পৃথিবীতে নেই। শুধু ভাষাই নয়, কোরিয়ান গান, কোরিয়ান সিনেমা, কোরিয়ান ডেলিকেসি, কোরিয়ান ড্রেস – এক কথায় কোরিয়ান কালচার – সব কিছুই মনে হয়েছে যেন জগতে অতুলনীয়। বরাবর মনে হয়েছে আমি আসলে একজন কোরিয়ানই। এদেশের নোংরা, ধুলো, ধোঁয়া, আবর্জনা, অসাস্থ্য, কুসংস্কার, অশিক্ষা, দারিদ্র – এগুলো কোনটাই আমার জন্য নয়। আমার আসল জায়গা হল কোরিয়া – পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর স্থান। তুমি তো খুব পূর্বজন্ম – পরজন্ম মান। আমার মনে হয় আগের জন্মে আমি কোরিয়ানই ছিলাম। আর তুমি তো দেখেইছ এই জন্য কত চেষ্টা করেছি। নাহলে ইংরেজিতে বা অঙ্কে আর বিজ্ঞানেও আমার কি রকম মাথা ছিল তা তো জানই। অত হেলাফেলা করে পড়া সত্ত্বেও ওই সব সাবজেক্ট এ কত নম্বর পেয়েছি? ইচ্ছে করলে আমি একজন আই আই টি ইঞ্জিনিয়ার বা আই আই এম থেকে এম বি এ করতে পারতাম। ইউরোপ -আমেরিকার দরজাও খুলে যেত তাহলে আমার। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকা তো আমি যেতে চাই নি। আমার লক্ষ্য তো কেবল একটাই দেশ -কোরিয়া। তাই আই এস সি এর পরেও কোরিয়ান ভাষায় অনার্স নিয়ে জে এন ইউ তে গ্রাডুয়েশন কোর্সে ভর্তি হলাম। কোরিয়ান ভাষায় জন্মগত দক্ষতা থাকায় অন্যদের টপকে বরাবরই টপার। পোস্ট গ্রাডুয়েশনে তো রেকর্ড নম্বর পেয়ে বেরোলাম। এর ফলে যা আশা করেছিলাম তাই হল। কোরিয়ার সবথেকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি করার সুযোগ। এসব তো তোমার জানা কথা। মনে পড়ে সেই সময় আমার বিয়ের সময় কত চাপাচাপি করেছিলে? আর তোমার জামাই তো সেই কলোনিয়াল ব্রিটিশ ছাপ। দিল্লী এন এল ইউ থেকে ল গ্রাজুয়েট করে কানপুরের কোন এক আদিকালের ব্রিটিশ ফর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ও তো কানপুর ছেড়ে নড়বেই না। তা সবকিছু ছেড়ে কানপুরে গিয়ে ওর কিচেনে খুন্তি নাড়ার জন্যে কি আমি এত কিছু করলাম? মনে পড়ে আমি কি রকম অ্যাডামান্ট হয়ে উঠেছিলাম? তোমার জামাইকে তো স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলাম হয় এখানে কানপুরের পাট চুকিয়ে আমার সঙ্গে কোরিয়ায় যাবে, নয় তো আমাকে ভুলে যাক। তাতেই তো তোমার জামাই সুড়সুড় করে কানপুরের চাকরি ছেড়ে আমার সঙ্গে কোরিয়ায় চলে এল।’
এইবার মিসেস দে এর মুখোমুখি বসা মিসেস ব্যানার্জীর জামাই একটু স্মিত হেসে মাথা নিচু করল।
-‘অবশ্য কানপুরের চাকরিটা মোটা মাইনের ছিল। কোরিয়ায় গিয়ে যে ফার্মে ঢুকলো সেখানে অত পেল না। কিন্তু ওদিকে আবার আমি দক্ষিণ কোরিয়ার সব থেকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো। মোটা টাকার স্কলারশিপ পাচ্ছি। তাই কোন দিক দিয়ে অসুবিধা হয় নি। পি এইচ ডি করার পর তো আমি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম সেরা কমার্শিয়াল ফার্মে চাকরিই পেয়ে গেলাম। মাইনেও প্রচুর। তাই কোরিয়ায় কোনদিন আর্থিক অসুবিধা হয় নি।
কিন্তু আসল অসুবিধে হল অন্য জায়গায়। আমেরিকা, ইউরোপের মত কোরিয়ান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও সারা পৃথিবী থেকে মেধা নিয়ে আসে উঁচু মাইনে আর অন্য সুযোগ সুবিধের লোভ দেখিয়ে। এর ফলে ওই কোম্পানিগুলোর সমৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু এর পরোক্ষ একটা প্রভাব আছে কোরিয়ার জনসাধারনের ওপর। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এইভাবে বিদেশ থেকে মেধা আমদানী করায় কোরিয়ার ভূমিপুত্ররা হয় বঞ্চিত। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় একটা আংশিক বেকারত্বের। এই নিয়ে এদের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ থাকলেও এর বহি:প্রকাশ এতদিন কোরিয়ানরা অন্তত: প্রকাশ্যে দেখা যায় নি । বরঞ্চ বাইরের দেশ থেকে আসা মেধাবী ও বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত বিদেশীরা, যারা ওদের দেশের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন পদ দখল করে এন আর আই হিসেবে কোরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে রয়েছে, তাদের কোরিয়ার আম জনতা নিজেদের একজন বলেই দেখে এসেছে। গোলমালটা বাধল গত বছরের বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার ফলে কোরিয়ার অর্থনীতি দারুনভাবে ধাক্কা খাওয়ায় । সেই ধাক্কা এমনই যে তার প্রাথমিক জেরেতেই প্রচুর কোরিয়ার সাধারণ মানুষ কর্মচ্যুত হল। সেইসঙ্গে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি। হু হু করে বাড়তে লাগল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে লাগল মানুষের রোজগার। ঘরে ঘরে শুরু হল হাহাকার। কোন অর্থনীতিবিদের চোখে এর মুল কারণটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক। প্রবল জনবিস্ফোরণের অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ সারা বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার কারনে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার উন্নত পশ্চিম আর উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ। সারা পৃথিবীর বেশীর ভাগ দেশেই জি ডি পি বৃদ্ধির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশী হওয়ায় কমেছে কর্মসংস্থানের হার। তার ফলে নেমেছে মানুষের জীবনযাত্রার গুনগত মান বা স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং। এর পরোক্ষ ফল ভুগতে হয়েছে পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থা আর পন্যের বাজারকে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত আর বিক্রয় করে তা থেকে প্রয়োজনীয় মুনাফা সংগ্রহ করা হয়ে উঠেছে কঠিন। ফলে কমেছে সেনসেক্স। বেড়েছে সোনার দাম। বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি।
কিন্তু সাধারণ মানুষ আর কবে অর্থনীতির এই স্থূল কচকচানি বুঝেছে? তারা সাধারণভাবে তাদের দুর্দশার একটাই কারণ বুঝে নিল। আর তা হল অন্য দেশ থেকে এই দেশে এসে এন আর আই হিসেবে থাকা ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশীরা।
রাতারাতি যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একের পর কোরিয়ান জাতীয়তাবাদী দল। এদের একটাই প্রোপাগান্ডা। গোটা দেশ থেকে বিদেশী বিতাড়ন। এর ফলে আমাদের কি অবস্থা হল বুঝতেই পারছো। গোটা কোরিয়ান জনগণ যেন আমাদের ওপর বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল। ছোটবেলায় গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পড়েছিলাম। পড়েছিলাম কিভাবে গান্ধীজি এই এক অস্ত্রে গোটা ইংরেজ সরকারকে নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন। কিন্তু কেন যে অমন দুর্ধর্ষ ইংরেজ সরকার, গোটা পৃথিবীতে যাদের রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না, তারা কেন যে অমন নাকানিচোবানি খেয়েছিল তা সেদিন বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলাম এখানে কোরিয়ান আম আদমির অসহযোগিতার মুখে পড়ে। বুঝলাম অসহযোগ আসলে কি জিনিস।
প্রথমেই ফ্ল্যাটে দুধ দিত যে ছেলেটি সে কোন কারণ না দেখিয়েই দুধ দেওয়া বন্ধ করল। তারপর বন্ধ হল কাগজ। গ্রসারীতে কোন জিনিস আনতে গেলে সেই জিনিসটা থাকা সত্ত্বেও দোকানদার বলে -‘নেই! অল সোল্ড আউট।’ বাইরে গেলে ক্যাব নিতে চায় না। আগে থাকতেই মিটার বক্সের জায়গায় বোর্ড ঝুলিয়ে দেয় ‘রিজার্ভ’। আমাদের রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সএর অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে এমনিই তো কোন মেলামেশা, কথাবার্তা নেই। কিন্তু আগে তবু দেখা হলে সৌজন্যমূলক হাসিটুকু দেখতাম। এখন বাইরে চোখাচুখি হলেও মুখ কঠিন করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেন আমরা বিরাট এক অপরাধ করে ফেলেছি। কোন বিপদে-আপদে সাহায্য করা তো দুরের কথা। কিন্তু আসল সমস্যা হল কর্মক্ষেত্রে। কোম্পানিতে যোগদান করার আগে কন্ট্রাক্ট ফর্ম সই করায় তাড়াতে পারবে না। কিন্তু এমন অবস্থার সৃষ্টি করল যাতে নিজেই কাজ ছেড়ে দিই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অফিস বস নিজের চেম্বারে ডেকে সময় নষ্ট করে। তারপর দুই-তিন জনের কাজ একা আমাকেই দেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই সব কাজ এমন যেগুলো আমার করবার কথাই নয়। রোজ অফিস থেকে বেরোতে সাড়ে দশটা-এগারোটা হয়ে যায়। আর তাতে একটু ভুল-ত্রুটি হলে বা ঠিক সময়ে সেই কাজ দিতে না পারলে প্রকাশ্যে অধ:স্তন কর্মচারীর সামনে অপমান। অধ:স্তন কর্মচারীরাও কোন কথা শোনে না। কোন বাহানা করে কাটিয়ে দেয়। উত্তর চাইলে উদ্ধতভাবে জবাব দেয়। এমনকি একটা ফাইল বয়ে নিয়ে যাওয়া বেয়ারাকে দিয়েও কোন কাজ করান যায় না। তোমার জামাইয়ের অফিসেও একই অবস্থা। কিন্তু পরিস্থিতি গুরুতর হল গত বৃহস্পতিবার, মানে পরশুদিন আগে। সেদিন একটু আগেই অফিসে এসেছি। দেখি চার-পাঁচ জন কোরিয়ান ছেলে-মেয়ে আমার টেবিলে। একজন আমার চেয়ারে বসে একটা পা ডেস্কের ওপর তুলে দিয়েছে। টেবিলের ওপর একটা মস্ত বড় হুইস্কির বোতল। ওরা সেটা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে আদি রসাত্মক গল্প করছে যার মধ্যে অজস্র অশ্লীল শব্দ। মাথাটা গরম হয়ে গেল। এমনিতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেকটের কাজ দেওয়া আছে যার জন্য সময় পেয়েছি মাত্র একদিন। এই কাজটা তিনজনে মিলে করলেও একদিনে হবে না। এই নিয়ে কাল রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত অফিসে টানা কাজ করেছি। এখনো অনেক কাজ বাকী আছে। তাই আজ সকালে শুধু চা খেয়েই অফিসে চলে এসেছি। ভালো করে ব্রেকফাস্টও হয় নি। এখন অফিসে এসে আমার টেবিলেই এই। মাথাটা জ্বলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা টাক মাথা কোরিয়ানকে ঝাঁঝিয়ে উঠলাম :
-‘এসব কি? এটা অফিস তো? উঠে যান। আমাকে কাজ করতে দিন। আজ অনেক কাজ আছে।’
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখের সিগারেটের ধোঁয়ার সবটুকু আমার মুখের ওপর ছেড়ে দিয়ে লোকটা বলে উঠল :
-‘কাজ দেখাতে এসেছিস! কাজ শুধু তোরাই করিস? তোরা কাজের আমরা কোরিয়ানরা অকাজের তাই না! তা এত যখন কাজের শখ তো এদেশে এসেছিস কেন, ইন্ডিয়ান জঞ্জাল? যা না এই কাজটা নিজের দেশে করে দেখা। বেরো এ দেশ থেকে,,,’ বলতে বলতে লোকটা একটা চরম নোংরা, অশ্লীল শব্দে গালাগালি দিল আমার মাকে, মাতৃসম আমার দেশকে আর আমার দেশবাসীকে। আর পারলাম না। এগিয়ে এসে গায়ের যত জোড় আছে সমস্তটা একত্রিত করে সজোরে এক চড় মারলাম লোকটার গালে। কিন্তু এর ফল হল উল্টো। ওরা পাঁচজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। মাটিতে ফেলে কিল, চড়, লাথি, আঁচড়, কামড়ে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। ততক্ষনে অন্য কর্মচারীরা আসতে শুরু করেছেন। সৌভাগ্যবশত: আমার বসও চলে এসেছেন।
-‘এ কি হচ্ছে মিঃ ওয়াং? এখানে কি হচ্ছে? এটা কি অফিস? মিসেস দে কে নিয়ে এক্ষুনি আমার রুমে আসুন। ‘
ততক্ষনে আমি মাটি থেকে উঠে পড়েছি। মনে কিছুটা জোরও এসেছে। মনের মধ্যে সমস্ত ঘটনাটা গুছিয়ে নিচ্ছি বলবার জন্য। নাকের কাছটা প্রচন্ড জ্বলছে। বোধহয় একটা কোরিয়ান মেয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে বসের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
-‘এসব কি হচ্ছে মিঃ ওয়াং? মিসেস দে কে আপনারা হোয়্যাক করছিলেন কেন?’ আমাকে বসতে বলার বিন্দুমাত্র সৌজন্য না দেখিয়ে ওয়াং এর দিকে ঘুরে বস প্রশ্নটা যেন ছুঁড়ে দিলেন।
-‘মিসেস দে কোরিয়া আর কোরিয়ান দেশবাসীদের গালাগাল দিয়েছেন, স্যার।’
-‘সত্যি! এসব কি শুনছি, মিসেস দে?’
-‘মিথ্যে কথা, স্যার! একেবারে নির্জলা মিথ্যে। মিঃ ওয়াংই আমার মা, আমার দেশ আর আমার দেশবাসীকে গালাগাল দিয়েছেন।’
-‘উনি মিথ্যে কথা বলছেন, স্যার! আমরা সবাই সাক্ষী আছি।
মিসেস দে ই গালাগালি দিয়েছেন। আপনি অন্যান্যদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’ মিঃ ওয়াং এর সহযোগীরা একবাক্যে বলে উঠল।
-‘ঠিক আছে, তাই হবে। এই পর্যন্ত যাঁরা অফিসে এসেছেন, তাঁদের সবাইকে ডাকুন।’
একে একে উপস্থিত অন্যান্য কর্মচারীরাও বসের অফিসে এসে ঢুকলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে বসের জেরার উত্তরে তারা সবাই ওই একই কথা বলল, যে কথা মিঃ ওয়াং ও তার সঙ্গীরা বলেছেন যে আমিই কোরিয়া ও কোরিয়ানদের গালাগালি দিয়েছি। অথচ ঘটনার সময় এদের অনেকেই অফিসে ঢোকেই নি।তবু দেহের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে বলে উঠলাম :
-‘মিথ্যে কথা, স্যার! ওরা সবাই মিথ্যে কথা বলছে।’
-‘সকলে মিথ্যে আর আপনি একাই সত্যি কথা বলছেন এটা তো হতে পারে না, মিসেস দে। মিথ্যে আপনিই বলছেন। গালাগালি আপনিই দিয়েছেন।’
আমি তখন প্রায় বোবা। এতখানি অন্যায় অবিচারে গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না। একটু থেমে উনি আবার বলতে শুরু করলেন – ‘দক্ষিণ কোরিয়ায় দেশ আর দেশবাসীকে গালাগালি দেওয়া ক্রিমিন্যাল অফেন্সের পর্যায়ে আনা হয়েছে জানেন তো? এ প্রায় দেশদ্রোহীতার অপরাধের সমান এখন। আমরা আপনাকে এখনই পুলিশে দিতে পারি। কিন্তু আপনি আমাদের একজন দক্ষ কর্মী। এতদিন ধরে দক্ষতা আর সততার সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। এই কথা মাথায় রেখে আমরা আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আপনি এক্ষুনি রেজিগনেশন দিন। আমরা আর থানা -পুলিশ করব না।’
আমার মাথার ভেতরটা তখন প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। তবু ক্লান্ত কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম :
-‘স্যার, আপনি কিন্তু একটা বিরাট ভুল করছেন,,,,,’ কিন্তু আমার ক্ষীন গলার স্বর অন্যান্যদের সম্মিলিত প্রতিবাদের আওয়াজে চাপা পড়ে গেল।
৩
সন্ধ্যা প্রায় সাতটা। অফিসে রেজিগনেশন দিয়ে এসে নিজের ফ্ল্যাটে চুপ করে এসে বসে আছি। অফিসের কাপড়টাও ছাড়ি নি। ঘরের আলোটাও জ্বালতে ইচ্ছে করছে না । তোমার জামাইও এসেছে। ওরও অফিসের খবর ভালো না। সামান্য ভুলের ছুতোয় ওরও একমাসের মাইনে কেটে নিয়েছে। কিন্তু ও আমার মত চুপ করে বসে নেই। ঘরের টেলিভিশন সেটটা চালিয়ে একটা ভারতীয় খবরের চ্যানেল দেখছে। হঠাৎ টিভির দিকে নজর গেল আমার। আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। দেখি তখন খবরে দেখাচ্ছে। সেদিন নতুন দিল্লীতে আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি দক্ষিণ কোরিয়ারই প্রেসিডেন্ট। এবারের সোনাজয়ী অলিম্পিক হকি দলের প্রত্যেক সদস্যের গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন একটি করে মেডেল আর হাতে দিচ্ছেন দশ হাজার ডলারের চেক। এরপর দেখাল ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার একটি ক্লিপিংস :
-‘,,,,,, হম ভারতকে ইস মহান খিলাড়িওকো হার্দিক সম্মান জানাতে হ্যায় হর তখলিফ অউর মুশিব্তকে সামনা করতে হুয়ে আপনা দেশকো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রমে ইতনা বড়ে সম্মান দেনে কে লিয়ে। সাথ মে ভারত কে উন সব কৃতি পুরুষ অউর মহিলাকো মেরা প্রণাম যো ইস দেশ কি ভুখ, দারিদ্র, অশিক্ষা অউর এইসে ঢের সারে কঠিনাইয়োকো সামনা করতে হুয়ে অউর আপনে ভারত মা কো ছোড় কর দুশরে কিসি দেশ মে ন জা কর, ইস দেশ মে রহ কর উন্নতিকে সব ক্ষেত্র মে দেশকো আগে বাড়ায়া। আজ ইন মহান লোগকে কারণ হি ভারত আমেরিকা অউর চীন কে বাদ দুনিয়া কা সবসে বড়া অর্থনীতি। চাঁদ কা দক্ষিন মেরু অউর মঙ্গল গ্রহ কা নজদিগ্ জানে ওয়ালে পহলা দেশ,,,,,,’
মুখের ওপর যেন কেউ কশে চাবুক মারল। মনে পড়ল ছোটবেলায় শোনা মহম্মদ ইকবালের সেই গান -‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা,,,’। সত্যি তো! আমার দেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আর সবচেয়ে কম খরচে মঙ্গল গ্রহের কক্ষে মহাকাশযান পাঠান প্রথম দেশ। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, কৃষিতে, মহাকাশ বিদ্যায়, বৈদেশিক বাণিজ্যে, শিল্পে, নাগরিক পরিকাঠামোয়, সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে, ঐতিহাসিক গৌরবে পৃথিবীর অগ্রগন্য দেশগুলোর মধ্যে একটি। আর এইসব ক্ষেত্রে ভারতের উন্নতির মুলে যাঁরা তাঁরা ভারতে থেকেই নিজের দেশমাতাকে এই সম্মান দিয়েছেন। আর আমি? আমার সেই সোনার দেশ, সেই মাতৃভূমি, সেই মাকে ছেড়ে এত দুরে এই কোরিয়াতে পড়ে আছি? ছিঃ আমাকে! এই যে সোনাজয়ী অলিম্পিক হকি দলের খেলোয়াড়রা, এঁদের মধ্যে কতজন কোরিয়ান ভাষার অ – আ – ক – খ জানেন? কিন্তু স্বয়ং কোরিয়ান প্রেসিডেন্ট আমাদের দেশে এসে তাঁদের সম্মানিত করছেন। আর আমি ছোটবেলা থেকে আজ অব্দি আপাদমস্তক কোরিয়ান হওয়ার প্রচেষ্টায় কি পেলাম? আমার প্ৰিয় কোরিয়া আর কোরিয়ানদের গালাগালি দেওয়ার মিথ্যে অভিযোগ? চোখ দিয়ে দর দর করে জল পড়ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান -‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পড়ে ঠেকাই মাথা,,,’। হ্যাঁ, আজ আমার দেশজননীর পায়ে বারবার মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এক লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। আমার সেই বন্ধুরা – তারা আজ কোথায়? তারা আজ আমার দেশের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। ওরাই তো আমার দেশবাসী, আমার প্রকৃত স্বজন, আমার আত্মীয়। আজও হয় তো ওদের মধ্যে আছে দারিদ্র, ক্ষুধা, বঞ্চনা, অনুন্নতি , জীবন ধারনের প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এই সবের মধ্যে থেকেও এদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে কল্পনা চাওলা। বেরিয়ে আসেন অমর্ত্য সেন, ডঃ এ পি জে আবুল কালাম। বেরিয়ে আসেন সুন্দর পিছাই। বেরিয়ে আসেন সচিন তেন্ডুলকর, অলিম্পিক সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া। এদের তো বিদেশ যেতে হয় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এদেশে থেকেই রচনা করেছেন ‘গীতাঞ্জলী’। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীরা তো এদেশের শত প্রতিব্ন্ধকতার মধ্যেই করেছিলেন তাঁদের কালজয়ী আবিষ্কার!
মনে পড়ল যে দেশের প্রেমে আমি এত মশগুল সেই দেশের নাগরিক এই কোরিয়ানরা – এরা কতটা জাতীয়তাবাদী। হ্যাঁ, এরাও বিদেশী ভাষা শেখে। বিদেশে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু সবই দেশের স্বার্থে। ফিরে এসে সেই শিক্ষা এরা মনে প্রাণে নিজের দেশের উন্নতির কাজে লাগায়। বিদেশী ভাষাও এরা শেখে ভাষাটা শেখার জন্য, আমার মত বিদেশী হয়ে যাওয়ার জন্য নয়। আর আমরা? বিদেশী দেখলে, বিশেষ করে সাদা চামড়া দেখলে তাদের ভাষা, তাদের সভ্যতা, তাদের সংস্কৃতি, তাদের আচার-আচরণ এই সবের পায়ে আমাদের মাথা পর্যন্ত বিকিয়ে দিই। দেশের খেয়ে, দেশের পড়ে, দেশের জল-হাওয়ায় বড় হয়ে আমাদের লাখ লাখ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র সুযোগ পেলেই বিদেশে গিয়ে সেটল করে বিদেশী ফার্মগুলোর, সেই সঙ্গে ওই বিদেশী সরকারের শ্রীবৃদ্ধি করার জন্য । আর তাদের বাপ -মা এদেশের কোন বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থেকে বুক ফুলিয়ে দশ হাত চওড়া করে আশেপাশের যতজনকে পারে এই কথা আবার শুনিয়ে নিজের দেশবাসীকে উদ্ধার করে । এদেরই পাশের দেশ এদের ভায়রা ভাই উত্তর কোরিয়াকে দেখো। অতবড় মহাশক্তিধর আমেরিকারও পরোয়া করে না। এদের, এই দক্ষিণ কোরিয়ানদেরও দেখলাম। এদের উগ্র জাতীয়তাবাদেই তো আজ বিনা দোষে আমাদের এই হাল। ঠিক করলাম আর নয়। রাতে তোমার জামাইয়ের সঙ্গে ফ্ল্যাটের দরজা-জানলা বন্ধ করে আলোচনায় বসলাম। ঠিক করলাম এই কোরিয়ান ছদ্মবেশ আর নয়। আজ থেকে আমাদের আসল যে পরিচয় সেই আদি, অকৃত্রিম, বিশুদ্ধ ভারতীয়ত্ব আমাদের চলনে-বলনে, কথায়-বার্তায়, আচার-আচরণে প্রতি মুহূর্তে প্রকাশ পাবে। আমরা ভারতীয় – এ শুধু আমাদের পরিচয় নয়, আমাদের গর্ব।
যেমন কথা তেমন কাজ। সেই রাতেই আমাদের যাবতীয় কোরিয়ান জিনিসপত্র যেমন কোরিয়ান পোষাক-পরিছদ, কাগজপত্র, কোরিয়ান বই, ম্যাগাজিন, ঘর সাজানোর ছোটখাটো জিনিসপত্র, কোরিয়ান ব্যাংকের পাশবই, চেক, ক্রেডিট কার্ড, আমার কোরিয়ান ভাষার গ্রাডুয়েশন, পোস্ট গ্রাডুয়েশন, পি এইচ ডি সার্টিফিকেট, অফিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট এইসব একটা কোরিয়ান সুটকেশে ভরে সোজা পিয়াং ইয়াং নদীর উপরের ব্রিজের মাঝখানে গিয়ে একেবারে পিয়াং ইয়াং নদীর জলে। সামান্য কিছু কোরিয়ান টাকা রেখে দিয়েছিলাম। তা দিয়ে কোরিয়ান এয়ারলাইনসে দেশে ফেরার দুটো টিকিট কেটে আমাদের বিয়েতে পাওয়া আমার এই শাড়ি -গয়না আর ওর এই ধুতি-পাঞ্জাবী পড়ে এখন তোমাদের সামনে।’
-‘এখন কি করবি?’ অনেকক্ষন বাদে মুখ খুললেন মিসেস ব্যানার্জী।
-‘তোমার জামাই এখানেই কোন ভারতীয় ফার্মে কাজ জুটিয়ে নেবে। আর আমি হ্ব একজন পারফেক্ট হাউজওয়াইফ।’
-‘ কিন্তু তোর যে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল মা!’ একটু যেন চমকেই উঠলেন মিসেস ব্যানার্জী।
-‘সে স্বপ্ন আমার পাল্টে গেছে মা! আসল ব্যাপার কি জানো? শুধুমাত্র পেশাগত প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে নিজের পেশাগত সাফল্য অর্জনেই দেশের প্রকৃত উন্নতি হয় না। নিজের পেশাগত দক্ষতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, বাণিজ্য, অর্থনীতি, ক্রীড়া এইসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশকে যতই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক না কেন, দেশের প্রকৃত উন্নতির বুনিয়াদ আরো গভীরে। দেশ তথা সমাজের আসল উন্নতি নিহিত আছে পরিবারের মধ্যে। ঘর যদি ঠিক না থাকে, তবে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটা কখনই ঠিকঠাক নিজের কাজটা করতে পারে না। তাই আমি আজ একজন আদর্শ ভারতীয় গৃহিনী হয়ে একটা সুখী আর সুন্দর ভারতীয় পরিবার গড়ে তুলতে চাই। এতেই দেশমায়ের প্রকৃত সেবা করা হবে।’
এই বলে চুপ করল মিসেস ব্যানার্জীর মেয়ে। অত্যন্ত ফর্সা ওর গালে একটা রক্তিম আভা সৃষ্টি হল। এ কি লজ্জায়? ঠিক একই সময় এয়ারপোর্ট ক্যাফের কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে অস্তগামী সূর্যের ‘ক্রিমসন’ বা সিঁদুরে রংয়ের আলো পড়ল ওর মুখে। সেই আলোয় কি এক হয়ে গেল ওর মাথার সিঁদুর আর গালের রক্তিম আভা? সেই আভার রেশ কি পড়ল সামনে বসে থাকা মিসেস ব্যানার্জীর মাজা বাদামী রংয়ের মুখে, যে মুখে এখন স্বস্তি আর মেয়ের জন্য প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধা আর গর্ববোধ?