
খোটে সিক্কে
কলমে – সুপ্রতিম সিনহা
ছবি – জয়দেব ভট্টাচার্য
-“ঠাকুরসাব, খোটে সিক্কে তো দোনো হি তরফ সে খোটে হোতে হ্যায়।”
– “ইয়েহি ফর্ক হ্যায় শায়েদ সিক্কে অউর ইনসান মে…”
জলপাইগুড়ি শহরের রায়কত পাড়ার চক্রবর্তী পরিবার। দীর্ঘ সাত বছরের অপেক্ষার পর চক্রবর্তী দম্পতির প্রথম সন্তান, পুত্রসন্তান। বাবা-মা বড় ভালোবেসে ছেলের নাম রাখল শৌর্য। কালের নিয়মে বাবা-মার নয়নের মনি হয়ে বড় হতে থাকলো আদুরে শৌর্য। ন্যায্য-অন্যায্য কোনো আবদারই অপূর্ণ রইলো না। প্রথম খটকাটা এলো ক্লাস নাইনে। ফনীন্দ্রদেব বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় শৌর্য অঙ্ক সহ চারটি বিষয়ে ডাহা ফেল। রাজগঞ্জ ব্লকের নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও শিক্ষকেরা শৌর্যকে উত্তীর্ণের সুযোগ দিলেন না। সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছিলেন বাবা। বাড়ী ফিরে ঘর অন্ধকার করে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাবা, তোর কি পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু ভালো লাগে? খুলে বল।” একগুঁয়ে, জেদী, শৌর্য মুখ চেপে বসে থাকল। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
কোনোমতে টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করে শহরের এক আনকোরা ইস্কুলে কলা বিভাগ নিয়ে ভর্ত্তি হয়েছে শৌর্য। ফ্রয়েডীয় সিনড্রোমে বাবার সাথে দূরত্ব অনেকটাই বেড়েছে। যতটুকু কথা হয় মায়ের সাথেই। অগোছালো-বেপরোয়া শৌর্যর জীবনে নতুন আমদানি হয়েছে মাদক। বাবার চোখরাঙানিকে আর গ্রাহ্যই করে না সে। যথারীতি হায়ার সেকেন্ডারিতে ল্যাজে-গোবরে। ছেলের দ্বারা যে কিস্যু হবে না বাপ-মা, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এতদিনে টের পেয়ে গেছে। তাও দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টায় হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কলেজ জীবন শুরু করল শৌর্য। এ যাবৎকাল শুধু একজন বন্ধুকেই পাশে পেয়েছে সে, নিলয়। শহরের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র এখন নিলয়। শৌর্যর যা সুখ-দুঃখ, প্রত্যাশা-অভিলাষা সবই মন দিয়ে শুনত নিলয়। মদ্যপ শৌর্যকে বহুবার বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেছে সে। এরই মাঝে ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর কেলেঙ্কারিটা। পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচের বাক-বিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছল, শৌর্য ব্যাট তুলে মাথা ফাটিয়ে দিল প্রতিপক্ষের এক ফিল্ডারের। সে আবার চেয়ারম্যানের ভাইপো। কোতোয়ালি থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করলো শৌর্য কে। খবরটা পেয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না অবসরপ্রাপ্ত বাবা। হৃৎপিন্ডে প্রবল ব্যথা নিয়ে ভর্তি হলেন নার্সিংহোমে। উকিল মামার প্রচেষ্টায় শৌর্যকে হাজত থেকে ফেরানো গেলেও, বাবাকে ফেরানো গেল না, তিনি বিদায় নিলেন চিরতরে।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি দিনটা। শীত সবে পড়তে আরম্ভ করেছে শহরে। সকাল থেকেই মনটা ভালো নেই শৌর্যর। আজ বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের সাথে সকাল থেকে কোনো কথা হয়নি। বিকেলের দিকে নিলয়ের সাথে বের হল শৌর্য। তিস্তার বাঁধের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে বসল দুজনে। বড় নিরিবিলি এ জায়গাটা, লোকজন খুব একটা আসে না। জল কম থাকায় বালির চড়া পড়ে রয়েছে। একের পর এক পাখির দল সারাদিনের কাজ সেরে নীড়ে ফিরছে। নিলয় সিগারেটে ভরে মারিজুয়ানা টানছে। শৌর্যকে অফার করল একটা জয়েন্ট- আজ ইচ্ছে নেই, ফিরিয়ে দিলো সে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে সমস্ত প্রবৃত্তি, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে। বড় মায়াবী অথচ করুণ এ দৃশ্য। ফেরার সময় বাইকটা স্টার্ট দিয়ে খানিকটা এগিয়েছে নিলয়, পেছনে বসা শৌর্য এক অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ পেল। আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে সেটা। বাইক থামিয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে খানিক এদিক-ওদিক খোঁজার পর বাঁধের কোনটায়, শৌর্যর চোখে পড়লো ঘটনাটা। তিনজন পুরুষ পাশবিক অত্যাচার করছে একটি অষ্টাদশী মেয়েকে। মেয়েটা কোনোমতেই পেরে উঠছে না ওই পিপাসু পুরুষদের পাশবিকতার সাথে। মুহূর্ত দেরী করলো না শৌর্য। ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই তিন বর্বরের উপর। এগিয়ে এসেছে নিলয় ও। সেদিন হঠাৎ যেন শৌর্যর শরীরে কোথা থেকে অসীম শক্তি ভর করল, ওর সাথে ধস্তাধস্তিতে পেরে উঠল না ওই তিনজন। নিজের টি-শার্ট দিয়ে মেয়েটির আব্রু ঢেকে বাঁধের উপরে তুলে আনল সে। নিলয় মোবাইল হাঁতড়ে পুলিশকে ইনফর্ম করলো ঘটনাটা। এতক্ষনে বাঁধের আশেপাশে লোকজন জমায়েত করে ফেলেছে। এক বৃদ্ধ শৌর্য র মাথায় হাত রেখে বললো, “বাঁইচ্যা থাইকো বাবা।” আকাশপানে চাইল শৌর্য, সদ্য ফুটে ওঠা তারা গুলোর একটি একটু বেশি জ্বলে উঠল….।
“ওহ বদমাস হ্যায় পর বাহাদুর হ্যায়, খতরনাক হ্যায় তা কি লড় সকতে হ্যায়, বুরে হ্যায় ফিরভি ইনসান হ্যায়….”
কথায় বলে, একটা বন্ধ ঘড়িও দিনে দু’বার ঠিক সময় দেয়। ‘শোলে’র সংলাপের ব্যবহার অনবদ্য। খুব ভালো লাগলো পড়ে।
অসাধারণ লেখা. ফটোগ্রাফি top notch
আলোর গল্প, আশার গল্প ভালো লাগলো।
mon chuye gelo.
খুব ভালো লিখেছ ।
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.