
-“বাবিন, বেরোচ্ছিস নাকি অফিসে?”
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“একটা কথা ছিল।”
-“আবার কি, জলদি জলদি বলো, অলরেডি লেট হয়ে গেছি।”
-“রোজই তোর দেরী হয় ফিরতে। বলছি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবি বাবু। তোর জন্যে ওই নলেন গুড়ের..“
-“দু’দিন অন্তর অন্তর তোমাদের ওই এক প্রলাপ। কি করে আমাকে বাড়িতে আটকে রাখা যায়! অফিস তো আর আমাকে বসিয়ে বসিয়ে এতগুলো টাকা মাইনে দেয় না। মিটিং আছে, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না”, মায়ের কথাটা পুরোপুরি না শুনেই এক স্রোতে বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল সুব্রতবাবু আর পার্বনীদেবীর একমাত্র আদরের ছেলে বাবিন ওরফে বিতান।
-“দেখলে তো, না করে ছিলাম ওসব বানাতে… আমাদের ছেলে এখন বড়ো হয়ে গেছে, বনী… সব যুগের পরিবর্তনের হাওয়া …আমাদের ইচ্ছের উপর সবকিছু নেই… মন খারাপ করে কি লাভ, এই বাস্তবকে মেনে নিতে হবে বনী…”, কথাগুলো বেশ থেমে থেমে বললেন হুইল চেয়ারে বসা বছর পঞ্চাশের শিক্ষক সুব্রতবাবু। শহরের একটি নামী স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। এগারো বছর আগে এক পথ দুর্ঘটনায় হঠাৎ করেই তার চলার ক্ষমতা হারিয়ে চিরকালের জন্য হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে নিয়েছেন। পায়ের সাথে সাথে চাকরিটাও চলে গেছিল। সে এক ভয়াবহ দিন গেছে। উপায় না পেয়ে পার্বনী টিউশন দিতে শুরু করেছিল ছবি আঁকা আর সেলাই এর। ছেলে অবশ্য বরাবর মেধাবী থাকায় অত চিন্তা করতে হয় নি। তবুও বাবিনের স্কুল, কলেজ, পড়াশোনার জন্য রাত জাগা, ঘরের কাজ, টিউশন, উফফ্ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল তার বনী। পুরো সংসারটা দুহাতে আগলে রেখেছিল। ভেবেছিল ছেলেটা চাকরি পেয়ে একটু সুখের মুখ দেখবেন। তার বনীর সখ আহ্লাদ পূরণ করবে। কিন্তু না, সংসারের অভাব দূর হলেও সেই শান্তির সুখটা আর আসলো না। চাকরি পেয়ে তাদের আদরের বাবিন কেমন দূরে চলে গেছে। সত্যিই আজ সংক্রান্তির দিনে মনে হচ্ছে তাদের প্রতি ছেলের ভালোবাসাটাও কেন জানি শেষ হয়ে এসেছে হয়তো। ভেতরে ভেতরে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকেন।
লাঞ্চ টাইমে অফিসের ক্যান্টিনে চিকেন বার্গার খেতে খেতে বিভিন্ন পয়েন্ট গুলো মিলিয়ে নিচ্ছিল মার্কেটিং অ্যানালিস্ট বিতান মজুমদার। বিকেলে ফরেন ক্লায়েন্টের সাথে মিটিংটা ঠিকঠাক উতরে গেলেই তার প্রমোশন আর বিদেশ যাওয়াটা ফাইনাল হয়ে যাবে। উফফ্… আরো একধাপ স্বপ্নের কাছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে মনে মনে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। ঘোর কাটল পাশের টেবিলের সেনবাবুর ডাকে, “কি হে ভায়া চলবে নাকি দুটো পাটিসাপটা, সত্যিই তোমরা, আজকের ছেলে মেয়েরা পিঠে পুলির দিনেও ওইসব আগার বাগার খাও যে কি করে…!” “না আপনি খান, আর এটা বার্গার”, এই বলে ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়ে এল বিতান। পুরো ক্যান্টিন জুড়ে আজ ওই গুড়ের মিষ্টি গন্ধ, বার্গারের স্বাদটা কেমন জানি তেতো হয়ে গেল বিতানের কাছে।
বিকেলে মিটিং এ ঢোকার কিছু আগে হঠাৎ টুং টুং করে মোবাইলে মেসেজ এল। তার প্রিয় বন্ধু সুদূর আমেরিকা থেকে তাকে পৌষ পার্বনের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। আর সাথে একগুচ্ছ মেসেজ, যেগুলো তাকে পিঠে পুলির দিন একসাথে বসে মায়ের হাতে বানানো নরম তুলতুলে সাদা চালের পিঠে, পাটিজোড়া, দুধপুলি, মালপোয়া, নলেন গুড়ের পায়েসের মিশেলে কিশোরবেলার কথা মনে করিয়ে দিল। একরাশ ঠান্ডা হিমেল স্মৃতি তার মাথায় ভিড় করে এল। মনে পড়ল ছোটবেলায় একবার সে তার দিম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা দিম্মা, মা এত সুন্দর পিঠে পুলি পায়েস বানায়, কে শেখালো, তুমি?”… “না রে বাবিন, তোর মা তো পৌষ সংক্রান্তির দিন জন্মেছিল, তাই ভগবান তোর মাকে এসব শিখিয়েছিল আগে থেকেই, আর তাই তো তোর মায়ের নাম পার্বনী”.. হেসে উত্তর দিয়েছিলেন তার দিম্মা।
“ইসসসসস..ইসস.. প্রথমে পড়াশোনা, তারপর এম্.বি.এ. আর এখন কাজের চাপে ভুলেই গেছি যে সংক্রান্তির দিনই তো মায়ের জন্মদিন… বাবার অ্যাক্সিডেন্ট এর পর সব কিছু এমন ওলট পালট হয়ে গেল… কিন্তু মা এত কষ্টের মধ্যে প্রত্যেক বছর আমার জন্মদিন পালন করে আসছে আর আমি… আমি আজ এই জায়গায় শুধু মাত্র মায়ের জন্য!!! সত্যিই ঘরের বাইরের মার্কেট অ্যানালিসিস করতে করতে নিজের বাড়ি, কাছের মানুষদের থেকে অনেকটাই বাইরে চলে এসেছি…” কথাগুলো যেন নিজের মন বলে উঠলো। না, আর দেরি করা উচিৎ হবে না।
-“অজিত, অজিত, একটু এদিকে আসবে… “
-“হ্যাঁ স্যার বলুন…”
-“এই ধরো ফাইল আর চটপট টপিকগুলো ঝালিয়ে নাও। আজকের সেমিনার তুমি অ্যাটেন্ড করবে অন বিহাফ্ অফ্ মি… বুঝলে? আর বসকে বলবে আমার একটা জরুরী কাজ ছিল বলে বেরিয়ে গেছি।”
-“কিন্তু স্যার… আপনার প্রমোশন এই মিটিং এর উপর!!”
-“কোনো কিন্তু, পরন্তু নয়… জাস্ট ডু ইট… আই হ্যাভ সামথিং মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দিস হোলি প্রমোশন…” কথাটা বলে আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে গেল বিতান।
বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই, “মা, ও মা… কই গেলে… জলদি এদিকে এসো।”
-“কি হলো? এত চেঁচামেচি করছিস কেন? এত তাড়াতাড়ি এলি! তুই যে বললি দেরী করে ফিরবি।”
-“ওসব পরে… আগে জলদি জলদি শোনো এদিকে আর পায়েসের বাটিটা নিয়ে এসো তো।”
-“তোর তো সবসময়, ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ অবস্থা! বল কি হয়েছে?”, পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পার্বনী দেবী।
-“শুভ জন্মদিন মা…” বলে মায়ের কাঁচা পাকা খোপাতে গুজে দিল বেলি ফুলের ছোট্ট গাজরা আর হাতে পরিয়ে দিল একটি সোনার আংটি।
-“তোর মনে আছে বাবিন!!! কিন্তু এসবের এর কি দরকার ছিল? বেকার পয়সা খরচ…” বলে আঁচল দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিলেন বিতানের মা।
-“কোনো বেকার কিছু না, সব কিছুর দরকার। মনে আছে সেলাই মেশিনটা কেনার জন্য তুমি ওই হাতের আংটিটা বিক্রি করেছিলে! কিছুই ভুলিনি আমি। চলো আমরা তিনজন মিলে কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলব আজ, বাবার কোনো কষ্ট হবে না। তুমি শুধু হ্যাঁ করে দাও মা… ” বলে মায়ের মুখে এক চামচ পায়েস তুলে দিল বিতান।
-“পাগল ছেলে… নে এবার পায়েসটা খেয়ে নে।” বলে পরম মমতায় ছেলের মাথা হাত বুলিয়ে দিলেন পার্বনী দেবী।
“কই সেরকম খারাপ তো লাগছে না। আজ পৌষের শেষ দিনে আমার স্বপ্নের সংক্রান্তি হলেও কাছের মানুষদের নিয়ে আবার নতুন করে একটা জীবনে এগোলাম, মা বাবার ভালোবাসার যে কোনো শেষ হয় না… প্রতিটা মুহূর্তে শুধু ভালোবাসার রং গুড়ের মতো মিষ্টি হয়…” নলেন গুড়ের পায়েস খেতে খেতে কথাগুলো ভাবছিল মা বাবার আদরের ছেলে বাবিন।
হুইল চেয়ারে বসে মা ছেলের কান্ড খানা দেখে অনেক দিন পর সুব্রতবাবুর মনটা বেশ ভরে উঠল। “না, আমি ভুল ভেবে ছিলাম, আজ এই ছেলের জন্য সংক্রান্তিতে আবার করে আমার পার্বনীর নতুন জন্ম দেখতে পেলাম, সত্যি এবারের পৌষ পার্বনটা সার্থক…” সবার অলক্ষ্যে চোখের কোণ মুছে নিলেন বাবিনের বাবা, সুব্রতবাবু|
লেখাঃ মাধবীলতা
ছবিঃ কুণাল
Songkranti | Madhabilata | Kunal | www.pandulipi.net | Emotional | Story | Bengali
খুব সুন্দর, মনটা ছুঁয়ে গেল।
ব্যস্ততার মাঝে এক পলক স্বস্তি নিয়ে এলো আপনার গল্প। খুব সুন্দর।
??
ধন্যবাদ
নরেন গুড়ের পায়েসের মতই মিষ্টি এক গল্প।
খুব সুন্দর মনে গেঁথে যাওয়ার মতই গল্প । আসলে আমরা আজকাল ছোটো ছোটো আবেগ , মুহূর্ত ভুলে শুধু ছুটছি । শুধু বাবার বয়েসটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলে মন্দ হত না ।
ধন্যবাদ.. ম্যাডাম
এই ছোটো ব্যপারগুলোতে নজর দেওয়ার জন্য।
ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো খেয়াল রাখব।
এই যান্ত্রিক যুগে এই আবেগ ও ভালোবাসা হৃদয় ছুঁয়ে গেল
খুব সুন্দর।।
খুব সুন্দর গল্প
Khub valo laglo .
Golpota samanya holeo gabhitota anek anek beshi.Maa Babar manosik tripti ta eto bhalo phutiechhe j porar kichhukhan porey ektu holeo sabaai bhab bay o atmatustir ananda upobhog korbe. Dhanyabad Lekhok o Pandulipi.
ভালো মিনি গল্প। ছবি সুন্দর
ভালো লাগলো পড়ে। খুব আবেগ ঘন।
Like!! Thank you for publishing this awesome article.