
একটি পুতুল বাড়ি || লেখা: ডাঃ মোঃ নাজমুল হক
নিঃশব্দ রাতে জোছনার আলোয় ঢাকা ছিল ছোট্ট গ্রাম “পাহাড়পুর” । গ্রামের এক কোণে, একটি পুরনো, ভাঙাচোরা বাড়ি- যার গায়ে কেবল সুতো পেঁচানো । দেয়ালের ফাটলে ফাটলে সাদা ও লাল রঙের সুতোয় ঝুলে আছে হরেক রকম পুতুল । তবে তা সবসময় দেখা যায় না । লোকমুখে বলে, বাড়িটা নাকি “পুতুল ভূতের বাড়ি” । কেউ জানে না কে তৈরি করেছিল, বা কেন তার চারদিক জুড়ে এভাবে সুতো পেঁচানো পুতুল দেখা যায় । দিনের বেলায় বাড়িটা নীরব থাকে, তবে রাতে মাঝে মাঝে জানালার ফাঁক দিয়ে আলো জ্বলে উঠতে দেখা যায় । এছাড়াও বাতাসহীন রাতে সুতো পেঁচানো পুতুলগুলি নিজেরাই কাঁপছে এমনটাও দেখা যায় ।
গল্পের শুরু
সদ্য পাশ করা ডাক্তার রিয়াদ হাসান পাহাড়পুর গ্রামের প্রান্তে এক পুরনো ঘরে বাসা নিয়েছেন । বিসিএস পোস্টিং হিসাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি যোগ দিয়েছেন । শহর থেকে আসা রিয়াদ একা থাকতে ও নির্জনতা পছন্দ করেন । অল্প কয়েক দিনে রিয়াদ গ্রামবাসীর কাছে একজন মহৎ ডাক্তার হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন । তবে একটি বিষয় তাকে খুব চিন্তিত করে তুলেছে । একদিন বিকেলে গ্রামের সবাই তার কাছে গড়গড় করে বলল, “স্যার, পুতুল বাড়ির পাশে যাবেন না! ওখানে ভূত থাকে!” । রিয়াদ হেসে বললেন, “ভূত মানে? তোমরা তো সিনেমা দেখেছ, বই পড়েছ। এসব গল্প বিশ্বাস করো?” । তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই বাড়িটি নিয়ে কিছু একটা আছে-একটা চাপা টান, এক ধরনের অস্বস্তি রিয়াদ বোধ করছিলেন ।
এক রাতে রিয়াদের ঘুম ভেঙে যায় । বাইরে টিপটিপ শব্দ হচ্ছিল । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন-একটা হালকা ছায়ামূর্তি, একটা লাল সুতো ধরে টেনে সুতোর বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে । কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে চুপিচুপি পেছনে হাঁটলেন । দরজার কাছে আসতেই দরজা নিজে থেকে খুলে যায়, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিল । বাড়ির ভেতরে ঢুকে রিয়াদ দেখতে পান শত শত রঙিন সুতো-প্রতিটা দেয়ালে, ছাদে, এমনকি মেঝেতেও । সবগুলো সুতো যেন এক কেন্দ্রে গিয়ে মিশেছে-একটি পুতুলের মধ্যে । কাঠের পুতুলটা নিঃশব্দে বসে আছে, তার চোখে কাচের মত চকচকে অদ্ভুত দৃষ্টির ছায়া । হঠাৎ পুতুলের ঠোঁট নড়ে উঠল-
“তুমি আসবে জানতাম… তুমি কোন অতৃপ্ত কষ্ট খুঁজছো নাকি?”
রিয়াদের মাথা ঘুরে উঠল ।
“তুমি কে? আমি কাউকে খুঁজছি না…”
পুতুল বলল, “এখানে প্রতিটা সুতো কষ্ট পাওয়া একেকটা মানুষের স্মৃতি । তারা হারিয়ে গেছে, কিন্তু সুতোয় বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের অতৃপ্ত কষ্ট । তাদের এই অতৃপ্ত কষ্ট যাদের নিয়ে নিয়তি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসে চিরজীবনের জন্যে” ।
চিন্তায় পড়ে যান রিয়াদ । কলেজে পড়ার সময় একবার রাতের বেলায় বাইক চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠেলাগাড়িতে ধাক্কা লাগে । রিয়াদ প্রচণ্ড আঘাত পান । পরে সুস্থ হলেও ঠেলাগাড়িতে থাকা বাবা ও তার ছোট্ট মেয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় । এই দুঃসহ স্মৃতি আজও রিয়াদকে খুব কষ্ট দেয় । এই ঘটনার জন্য নিজেকে তার অপরাধী মনে হয় । পুতুল বলল, “তুমি যে লাল সুতোটি দেখে এখানে এসেছ ওটাই তোমার অতীত অজানা কষ্টের স্মৃতি । এবং তোমাকে এখন লাল সুতো ধরতে হবে । চাইলেও তুমি পুতুল বাড়ির এই মায়া ছাড়তে পারবে না” ।
রিয়াদ লাল সুতোটির দিকে তাকিয়ে রইলেন । সময় যেন থেমে গেছে । মনে পড়ল মায়ের কান্না, বাবার থমথমে মুখ । চোখ বন্ধ করে সুতোটা ধরলেন । হঠাৎ এক তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল । সবকিছু নিঃশব্দ হয়ে গেল ।
পরদিন গ্রামের লোকজন দেখল রিয়াদ আর নেই । পুতুলের ঘরে কেবল একটি নতুন লাল পুতুল পড়ে আছে-তার মুখ, চোখ যেন অবিকল রিয়াদ হাসানের মতো । আর সুতোর বাড়ির ভেতর আরেকটা নতুন সুতো জুড়ে গেছে সেই কেন্দ্রে-একটি লাল সুতো ।
এখনো রাত হলে কেউ কেউ দেখতে পায়, দুটো ছায়ামূর্তি পুতুলটাকে নিয়ে গল্প করছে… আর বাড়ির সুতোগুলি ধীরে ধীরে কাঁপছে হাওয়াহীন বাতাসে ।।।।