সোমবার সকাল সকাল রিজিওনাল ম্যানেজার কুলকার্নি সাহেবকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যেতে হয়েছিল শুভময় দাসগুপ্তকে। প্রোমোশনের বছর, কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়, তাছাড়া প্রোটোকল বলেও একটা জিনিস রয়েছে প্রাইভেট কোম্পানিতে যেটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। অন্য কোনো অফিসারের ওপর ভরসা করতে পারেন না শুভময়। তাছাড়া উনি যেভাবে শক্ত হাতে অফিসটা চালান তাতে বাকি অফিসার বা স্টাফেরা যে তাঁর ওপর খুব একটা প্রসন্ন নয় তা তিনি জানেন। সামনাসামনি কারোর কিছু বলার সাহস নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর আড়ালে যে তাঁকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা হয় সেটা তাঁর কানেও এসেছে দু’এক বার। তাই আর কাউকে এয়ারপোর্টে পাঠাবার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু অফিসের অবস্থাটাও ঠিক কি রকম থাকবে সেটাও চিন্তার বিষয়। যে দিকটা নিজে দেখবেন না সেইখানটাই যেন অগোছালো হয়ে থাকে। লিপিকা সেন থাকলে এত চিন্তা করতে হতো না, কিন্তু তিনিও এখন মেটার্নিটি লীভ এ। বাকি কারোর ওপর বিশেষ ভরসা নেই দাসগুপ্ত সাহেবের। কারোরই যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হয়নি এখনো, সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সব ব্যাপারে।
ফ্লাইটটা একটু দেরীতে পৌঁছল, ওয়েদার সামান্য মেঘলা, কাল রাতেও বৃষ্টি হচ্ছিল। কুলকার্নি সাহেবকে হোটেলে চেক ইন করিয়ে সরাসরি অফিস যাওয়ার প্ল্যান। উনি বললেন ব্রেকফাস্ট করবেন না, ফ্লাইটেই সেরে নিয়েছেন। কুলকার্নি ফ্রেশ হতে গেলেন রুমে, আর দাসগুপ্ত লাউঞ্জে বসে মোবাইল থেকে অফিসে ফোন করতে লাগলেন। তাঁর অফিসে তিনি নিজে ছাড়া আর কাউকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেন না। ঠিকঠাক ভাবে ব্যবহার করবে না কেউ, ফেসবুক- হোয়াটস্অ্যাপ খুলে রাখবে কাজের সময়, তিনি জানেন। তাঁর চেম্বারের নম্বরটা বেজে গেল- কেউ ওঠালো না, বাইরের ফোনটায় যতবারই করলেন- ‘বিজি ইন অ্যানাদার কল’। মাইতির মোবাইলে চেষ্টা করলেন- বন্ধ আছে। মাথাটা গরম হতে শুরু করল দাসগুপ্ত সাহেবের। এমন সময়ে কুলকার্নি সাহেব স্যুট বদলে নেমে এলেন লাউঞ্জে, বললেন, ”চলিয়ে গুপ্তাজী, আয়্যাম রেডী।”
অফিসে পৌঁছে দাসগুপ্ত সাহেবের মাথাটা আবার গরম হতে শুরু করল যখন দেখলেন তাঁর চেম্বারের তালা খোলা হয় নি। এর একটা চাবি তাঁর নিজের কাছে থাকে, আর অন্যটা থাকে পিওন তপনের কাছে। তার কাজ সকালে এসে টেবল্ সাফ করে, খাবার জল এনে, এসি অন করে রাখা। তপন আজ আসেনি তার মানে। এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কেউ কিভাবে হতে পারে, জানে যে আর.এম. সাহেব আসবেন, চেয়ারে নতুন টাওয়েল দেবার কথা, ফুলের ব্যবস্থা করার কথা, টী জংশন থেকে স্পেশাল চা আনার কথা- আর সে কিনা ছুটি নিয়ে বসল। এই ছুটি তিনি অ্যাপ্রুভ করবেন না, মাইনে কাটবেন। এখনো প্রোবেশন পিরিয়ড কাটে নি ছেলেটার, একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার- না হলে এরা কোনদিন মানুষ হবে না। কুলকার্নি সাহেব বোধহয় ব্যাপারটা আন্দাজ করে বিভিন্ন স্টাফের টেবিলে টেবিলে গিয়ে হ্যান্ডশেক করে দু’চার কথা বলতে লাগলেন। মাইতিকে ডেকে দাসগুপ্ত নীচু গলায় বললেন, “স্কাউন্ড্রেলটা আজই ডুব মারল, তুমি সিকিউরিটির লোকটাকে দিয়ে চেম্বারটা রেডী কর চটপট।” মাইতি বলল, “স্যর, এখনই করছি। টাওয়েল, ফুল, গ্লাস এনে রেখেছি সব, পাঁচ মিনিটও লাগবেনা স্যর।” “সে আসেনি কেন কিছু জানিয়েছে?” “না স্যর, সুদীপ্তদা ফোন করেছিল, কিন্তু মোবাইল বন্ধ।” দাসগুপ্ত কোন রকমে রাগ সামলে বলেন, “চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন রাস্কেল একটা, কোন খবর দেবার প্রয়োজন মনে করে না।”
খবর অবশ্য এল দুপুরের পর। তপন কাল রাত্রে মারা গেছে অ্যাক্সিডেন্টে। বৃষ্টির রাতে হাইওয়েতে একটা মালবাহী ট্রাক পিষে দিয়েছে সাইকেল আরোহীকে। আহা রে- বাচ্চা ছেলে, গত ডিসেম্বরেই বিয়ে করেছিল। অফিসের পরিবেশটা হঠাৎই কেমন থমথমে। দাসগুপ্ত কাউকে দিয়ে একটা ফুলের তোড়া পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলেন, রাতে একটা মিটিং হবার ছিল ওভার দ্য ডিনার। কিন্তু কুলকার্নি বললেন, “লেটস্ গো অ্যান্ড মীট হিজ উইডো। আই থিঙ্ক উই মাষ্ট গো।”
মাইতি আর সুনীল তপনের বিয়েতে গিয়েছিল, ওরা না থাকলে বাড়ীটা খুঁজে পাওয়া যেত না। টিনের চালের বাড়ীটাতে পাড়ার লোক আর আত্মীয়দের ভীড়। দাসগুপ্তরা এসে পৌঁছবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মর্গ থেকে বডি নিয়ে চলে এল পাড়ার ছেলেরা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সকলে। কচি বৌটা আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “কি দরকার ছিল তোমার বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল নিয়ে এত রাতে ফেরার? এত করে বললাম, একটা দিন ছুটি নিলে কি অফিস বন্ধ হয়ে যেত?”
শুধু কেউ জানল না তপনের মঞ্জুর না হওয়া লীভ অ্যাপ্লিকেশনটা তখনো দলা পাকিয়ে পড়ে আছে দাসগুপ্ত সাহেবের চেম্বারের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে।
লেখাঃ অরিন্দম
ছবিঃ কুণাল
Chuti | Arindam | Kunal | www.pandulipi.net | Emotional | Fiction | Story | Bengali