অন্য রকম ভালোবাসা
কলমে – দেবলীনা দে
ছবি – জয়দেব ভট্টাচার্য
তেরো বছর, হ্যাঁ তাইতো! স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি চলছে, তখন পরিচয়। তা বোধহয় উচ্চ-মাধ্যমিক দেওয়ার পর বাড়ি ফিরে হয়েছিল, সেটাও ঠিক তেমন করে নয়। ওই যখন বাড়িতে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে মৌরি কিছু বলার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা উত্তর আসত শুভনীলের কাছ থেকে।
হোস্টেলে থাকাকালীন মৌরি জানতে পারে তার বাবার অফিসে নতুন কম্পিউটার আসতে চলেছে। সেই কারণে হেড অফিস থেকে একজন মাসে কয়েক দিনের জন্য ট্রেনিং দিতে আসছে। তার থাকার ব্যবস্থা মৌরির বাড়িতে। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এক দিন সকালে বাবার সঙ্গে একটি ছেলেকে বাড়িমুখো আসতে দেখে মৌরির অনুমান করতে অসুবিধে হল না, তিনিই সেই ব্যক্তি। আপাদমস্তক তাকে একবারটি দেখে নিয়ে মৌরি বুঝে গেল যে ছেলেটি লাজুক স্বভাবের আর মিতভাষী। এরপর এ কথায় সে কথায় জানল যে তার আবৃত্তি, নাটক এইসব বিষয়ে বেশ উৎসাহ এবং কাজের ফাঁকে সেগুলো করা একপ্রকার ভালো লাগা থেকে। মৌরির এসব জেনে ভালো লাগত কারণ সেও কবিতা লেখে, এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত।
হঠাৎ একদিন টেবিলে রাখা একটি লিটল ম্যাগাজিনে শুভনীলের চোখ পড়ল, হাতে তুলে নিয়ে পড়তে গিয়ে একটি লেখায় চোখ আটকে গেল, কেমন যেন আনমনা হয়ে কি যেন একটা ভাবতে শুরু করল। দূর থেকে তা মৌরি দেখতে পেল। তারপর চা নিয়ে মৌরি তার সামনে আসতেই, ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞাসা করল, “মঞ্জরী সান্যাল তো তোমার নাম, তাই না?” মৌরি মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, তারপর কারণ জানতে চাইল। শুভনীল পাল্টা প্রশ্ন করল, “তুমি কবিতা লেখো?” এবার মৌরি বুঝতে পারল তখন তার লেখা পড়ে নাম টা ভাবছিল। “খুব ভালো লেখো তো! কবে থেকে লিখছো? বেশ পরিণত লেখা।” এতো প্রশ্ন একবারে করার জন্য মৌরি ঠিক কোন উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষে বলল খুব ছোটবেলায় ছড়া দিয়ে শুরু তারপর এখন কবিতা লেখার চেষ্টা চলছে মাত্র। এই লেখা চেষ্টার ফল। “তুমি অনেক দূরের যাত্রী, থেমো না কখনো, চালিয়ে যাও।” এই প্রথম পরিচিত মহলের বাইরে কবিতা নিয়ে কথা হল। সেও বলল, “আপনি তো শুনেছি আবৃত্তি, নাটকের সঙ্গে যুক্ত আছেন।” এর উত্তরে শুভনীল বলল, “ওই কাজের মাঝে নিজের ভালোলাগাকে একটু প্রশ্রয় দেওয়া।”
এইভাবে অফিসের কাজে আসা এবং বারকয়েক দুজনের মধ্যে দেখা, দুজনের ভালোলাগার সমীকরণ স্পষ্ট, তবে সমাধান তা বোধহয় অস্পষ্ট, কেমন যেন ধাপে ধাপে অঙ্কের মতো। উচ্চ মাধ্যমিকের পর আবার কলেজ হোস্টেল। অফিসের কাজ ক্রমশ ফুরোতে লাগল, তাই শুভনীলের যাতায়াত কমতে লাগল। এক ছুটিতে বাড়ি ফিরে জানতে পারল মৌরি, শুভনীল লম্বা ছুটি নিয়েছে তার কারণ বিয়ের পর হানিমুন সেরে তবেই অফিসে জয়েন করবে। একথা শুনে মৌরি ভাবছে, সে কি কিছু হারাল? ঠিক বুঝতে পারছে না, বুকের কাছে কিছু না বলা কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে, সেটা অনুভব করতে পারছে। কিন্তু এই অনুভূতি সে আগে কেন অনুভব করে নি।
আজ তেরো বছর পর ফেসবুকে সেই চেনা মুখ আর চেনা নামের ব্যক্তির বন্ধুত্বের অনুরোধ এসেছে, সঙ্গে মেসেজ বক্স এ ছোট্ট মেসেজ সঙ্গে মোবাইল নাম্বার আর ইচ্ছে হলে কথা বোলো, অপেক্ষায় থাকব। মেসেজ পড়ে মৌরি ক্লিশে মনে হলেও এড়িয়ে যেতে পারল না, অনুরোধ গ্রহণ করল। এখন সে পরিণত এবং কাছের মানুষ পেয়ে গেছে, তাকে নিয়ে ভীষণ ভালো আছে। লেখালেখির পাশাপাশি আর্থিক দিক থেকেও স্বাবলম্বী। এর বেশ কিছুদিন বাদে আবার মেসেজ বক্স এ ছোট্ট লেখা, ”পূর্বপরিচিত হিসেবে ফোন নাম্বারটা পেতে পারি কি?” মৌরির খুব অবাক লাগল, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য এতো ইচ্ছুক, কারণ কি? অফিস থেকে ফিরে নিজেই ফোন করল। পরিচয় দিতেই ভীষণ উৎসুক ভাবে কথা বলা শুরু করলেও থেমে গেল, বললো, “একটা ফোন আসছে।” পরদিন লাঞ্চে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে তার পার্সোনাল নম্বরে ফোন, ‘হ্যালো’ বলতেই, “আমি শুভনীল, এটা অন্য নম্বর থেকে ফোন করছি।” তারপর একটু ফরমাল কথা, শেষে পুরোনোতে ফিরে জানতে চাওয়া, এখন যেমন সাবলীল ভাবে কথা বলে সেই সময় মৌরি এত মুখচোরা কেন ছিল… তার দরুন বহুক্রোশ পেরিয়ে অফিসের কাজের অছিলায় রাতে তার বাড়িতে থেকেও মনের কথা বলা হয় নি, আর জানা হয় নি। কিছুক্ষন চুপ থেকে মৌরির উত্তর, অনেক বছর পেরিয়ে আজ সে অনেক কিছুই দেখেছে, তাই সেইদিনের কথা আজ ঝাপসা। তবে আজ তার কাছে যেটা স্পষ্ট তা হলো আকাশের উপস্থিতি। আজ তাকে যেমন দেখছে তা বোধহয় আকাশের সৃষ্টি।
শুভনীল বললো, তার এখন বয়স হয়েছে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট সংসার। তবে অন্য রকম ভালোবাসা কখনো পুরোনো হয় না। যেমন ধুলোমাখা কাঁচের ফ্রেমে আটকে থাকা ছবি চিলেকোঠার বন্ধ ঘরে এককোনে পড়ে থাকলেও কখনো কখনো ধুলো ঝেড়ে বুকে জড়িয়ে শ্বাস নিতে ভালো লাগে, সেরকমই, এক অন্যরকম ভালো লাগা।