অনেকদিন কোথাও বেরোন হয়নি অফিসের গ্রুপ নিয়ে, তাই মনটা কেমন ছুটি ছুটি করছিল, কিন্ত গন্তব্যটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না। কেউ বললেন জলঢাকা, কেউ বললেন ঝান্ডি- আমি তখন চটকপুর এর প্রসঙ্গ তুলি। আমি আগে একবার চটকপুর গিয়েছিলাম, খুব ভাল লেগেছিল, কিন্তু রাত্রিবাস করা হয়নি। সবাইকে রাজি করানো খুব কঠিন হল না, আগেরবার তোলা ছবিগুলো দেখাতেই কাজ হল।
ব্যাস! গাড়ি আর হোম স্টে ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম সেচ ও জলপথ বিভাগের আমরা আটজন। সকাল সকাল স্টার্ট করার প্ল্যান থাকলেও সবাইকে জোগাড় করে যাত্রা শুরু করতে করতে প্রায় পৌনে দশটা বেজে গেল। চটকপুর যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে, ড্রাইভার এর প্রোপোজাল অনুযায়ী ঠিক হল আমরা যাওয়ার সময় যাব মংপু হয়ে, আর ফিরব পরের দিন কার্শিয়াং হয়ে।
গাড়ি ছুটছে বেশ গতিতে, সেভকের কাছে মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির কাছে একবার দাঁড়াতেই হল ছবি তোলার জন্যে। ঘন জঙ্গলের বুক চিরে কালো পিচঢালা এই রাস্তাটা খুবই সুন্দর এবং উপভোগ করার মতো। পরের স্টপেজ দেওয়া হল কিছু দূর এগিয়ে রিম্বিক ঢোকার আগে, তিস্তার জল সেখানে ঘন সবুজ রংয়ের। তিস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে অপূর্ব মনোরম সেই দৃশ্য দেখে যেন মনের সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে গেল।
সকালে সেরকম কিছু খাওয়া হয়নি, তাই সবারই খিদে পেয়েছিল। এন.এইচ.পি.সি.’র পাশ দিয়ে আমাদের মংপু যেতে হবে। আমার বি.টেক এর যাদবপুরের ব্যাচমেট সিদ্ধার্থ ওখানে পোষ্টেড আছে, তাই ওখানে একবার ঢুকলে ওর সাথে দেখা হয়ে যেত আর ওদের গেস্ট হাউসে খাওয়াও হত। কিন্তু সময় বাঁচাবার জন্যে আমরা একটা ছোট্ট রেস্টোরেন্টে খেয়ে নিলাম। মোমো, স্যুপ আর আচার… সেই আচারের স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে রয়েছে।
এন.এইচ.পি.সি.র গেস্টহাউসের পাশ দিয়েই রাস্তা গেছে, সিদ্ধার্থ হয়তো অফিসেই আছে। যাত্রাপথের আশপাশটা খুবই সুন্দর, আমাদের ড্রাইভার সারাক্ষণ কথা বলতে বলতে, বর্ণনা দিতে দিতে চলেছে। সে আমাদের সিংকোনা গাছের বাগান দেখাল, রাস্তার দুপাশে সারি সারি সিঙ্কোনা গাছ । প্রধানতঃ মেয়েরাই সিংকোনা চাষের সঙ্গে যুক্ত। মংপুতে কুইনাইন ফ্যাক্টরি আছে সেটাও বলল। আর রয়েছে কমলালেবুর বাগান, কোনটা তখনো সবুজ, কোনটা বা পেকে হলুদ কমলা রঙের, অপূর্ব দেখাচ্ছে। কোথাও কমলা লেবুর ভারে গাছ হেলে পড়েছে, বাঁশ দিয়ে খাড়া করে রাখা। এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে কমলালেবু কিনলাম, খুবই সুস্বাদু।
এবার গাড়ি থামল অর্কিড বাগানের সামনে। অর্কিড দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। আমরা প্রায় আধ ঘন্টা ধরে দেখলাম। একটা গাছ দেখিয়ে আমাদের ড্রাইভার বলল এটা অনেক প্রাচীন গাছ, ডাইনোসর যুগের, তবে গাছটার নাম জানা নেই ওর। এখানে নাকি সকালের দিকে হরিণ ভালুক সব দেখতে পাওয়া যায়। অর্কিড বাগানের ভেতরে হোমস্টে আছে দেখলাম, খুবই সুন্দর পরিবেশ, কখনো আসা যেতে পারে।
এবার চলতে চলতে এসে থামলাম কুইনাইন ফ্যাক্টরির সামনে, গাড়ি রেখে চলে গেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসস্থানের দিকে। খুবই সুন্দর এবং ঐতিহাসিক… রবি ঠাকুরের স্নানের ঘর, শোবার ঘর, বিভিন্ন ব্যবহৃত সামগ্রী এবং কিছু পুরনো ছবি। ওখানে যিনি ছিলেন তিনি খুব ভালো এবং আবেগপ্রবণ। ওনার ঠাকুরদা ছিলেন কবিগুরুর পালকি বাহক, অনেক রবীন্দ্র সংগীতও শোনালেন উনি আমাদের।
পাহাড়ী রাস্তা আর তার দুধারে সুন্দর ফার্ন জাতীয় গাছ পেরিয়ে আমরা যখন চটকপুর এসে পৌঁছলাম তখন বিকাল প্রায় চারটে বাজে। আমাদের অভ্যর্থনার জন্য লোক আগে থেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। প্রচুর খিদে পেয়েছিল আমাদের, তাই একটু ফ্রেশ হয়েই লাঞ্চ সেরে নিলাম। ভাত, ডাল, শাক, তরকারি আর মাছের ঝোল।
খাওয়ার পর রাস্তায় বার হলাম আমরা। ছোট্ট একটা গ্রাম, আকাশছোঁয়া সুন্দর ঘন পাইন বন। এটাই চটকপুরের সৌন্দর্য্য, একে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এখানে যে কোন হোম স্টে থেকে পায়ে হেঁটে বেরোলেই ঘন জঙ্গল। সেখানে লেপার্ড, বার্কিং ডিয়ার, এমনকি কপাল ভাল থাকলে রেড পান্ডাও দেখতে পাওয়া যায়। আর আছে নানা রকমের পাখি, যেমন ম্যাগ পাই, বুলবুল, লং টেল, পিপিট এবং আরো অনেক। এখানে একটি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি আছে, আর এর উত্তরে বিস্তৃত সবার প্রিয় হিমালয় পর্বতমালা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৮৮৭ ফিট উঁচুতে অবস্থিত চটকপুর থেকে দার্জিলিং মাত্র ২৬ কিলোমিটার দূরে, আর ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন ঘুম। আরেকটু ভাল ভাবে বলতে গেলে এটি আমাদের সকলের অতি পরিচিত টাইগার হিল থেকে খুবই কাছে। এর পাশের পাহাড়টিই আসলে টাইগার হিল। তবে এখান থেকে সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য্য কিন্তু টাইগার হিল থেকে কোন অংশে কম নয়। দার্জিলিং থেকে টাইগার হিল যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে, আর সেখানে চটকপুর থেকে পায়ে হেঁটে ওয়াচ টাওয়ারে গেলেই খুব ভাল সূর্যোদয় দেখা যায়। হোম স্টে থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই ছোট লেক দেখতে পাওয়া যায়, স্থানীয় ভাষায় যার নাম পোখরি । এখানে মাত্র ১৪টি পরিবারের বাস এবং মোট জনসংখ্যা ১০০র কাছাকাছি। তাই কোলাহলশূন্য পরিবেশ, কোন দূষণ নেই।
সন্ধ্যে নেমে আসছিল, তাই আর দেরি করলাম না। ঘরে ফিরে বনফায়ার এর ধারে বসে পেঁয়াজের পকোড়া আর চা। এখানে রাতের বেলায় সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। রুটি আর মাংস দিয়ে ডিনার সেরে ক্লান্ত শরীর বিছানার আশ্রয় নিল। পরদিন সকালে গাইড অনেক বার ডেকেছিল সূর্যোদয় দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ক্লান্তি আর ঠান্ডার জন্যে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। তাই একটু দেরীতেই সান রাইজ পয়েন্টে পৌঁছলাম আমরা।
এসে ব্রেকফাস্ট করে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে। টয়লেটে গিয়ে দেখি এখানে জল বলতে কিছু নেই, সবটাই জমে বরফ হয়ে গেছে। কাঠ জ্বালিয়ে কোনরকমে একটু জলের ব্যবস্থা করে দিল আমাদের হোস্ট প্রেমা । বিদায় নেবার সময় সে জানাল যে অক্টোবর মাসে নাকি এখানে রাতে জঙ্গল সাফারি হয় তাতে ভালুক আর চিতা দেখা যায়। তখনই ঠিক করে নিলাম এরপর অক্টোবর মাসে আসতেই হবে এখানে। বিদায় চটকপুর… কিন্তু দেখা হবে আবার খুব শিগগিরই।
লেখা ও ছবি – সৌরভ