পলাশ সাক্ষী

 

 

 

স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের শুভারম্ভের দিন ১০ই ফেব্রুয়ারি আর  বিদ্যার দেবী সরস্বতী’র আরাধনা একই দিনে– এমন সমাপতন ক্কচিৎ দেখা যায়, শোনা যায়। সারদা নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভাগ্যাকাশে এমন একটি দিন আসায়  ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী– সকলেই ভীষণ আপ্লুত। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি থেকে শুরু করে নাইন-টেন, ইলেভেন-টুয়েলভের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় দিন দশেক আগে থেকেই আয়োজনে লেগে পড়েছে। নীচু ক্লাসের ছেলে-মেয়েরাও প্রবল উৎসাহে দাদা-দিদিদের সাথে হাত লাগানোতে ব্যস্ত। স্কুলে একটা সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে। এই সুযোগে যারা মন দেওয়া নেওয়ার পালায় কাছাকাছি আসতে চায়, স্কুলের কড়া নজরদারিতে যা সব সময় হয়ে ওঠেনা, তাদের কাছে এই ক’টা দিন যেন স্বর্গের হাট। হেড স্যার নীললোহিত বাবু, সেক্রেটারি সনাতন বাবু এবং কয়েকজন উদ্যমী শিক্ষক আমন্ত্রণের লিস্টটা আর একবার দেখে নিলেন। মনে হচ্ছে তেমন কেউ বাদ পড়েনি। তাছাড়াও সংবাদপত্রে তো বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হচ্ছে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে, যাতে এই স্কুলের সাথে অন্তরঙ্গ স্মৃতিগুলো অভাবনীয় মিলন মেলায় আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে এই কথা মাথায় রেখে।

মধুরা সেনগুপ্ত–আজকের এই বিশেষ দিনটিতে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত একজন অতিথি যেমন, আবার সে এই স্কুলেরই প্রাক্তনীও বটে। বিশেষ অতিথি এই জন্যই, এই স্কুলকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেধাতালিকায় রাজ্যসেরার সম্মান এনে দিয়েছিল সে। বরাবর স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে থাকা মেয়েটা যখন এই রকম দুর্দান্ত রেজাল্ট করে শিরোনামে উঠে এল সামনে থাকা বাকি ন’জনকে পেছনে ফেলে, তখন স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাও একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও মধুরার মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার আগে পর্যন্ত একদম গা ছাড়া ভাবেই সে পড়াশোনায় সময় দিত। ফার্স্ট বয় রাজীবের প্রতি ওর একটা যে আকর্ষণ ছিল তা ওদের ক্লাসের কারোরই অবিদিত ছিলনা। রাজীব দরিদ্র পিতার একমাত্র সন্তান। মেধাটাই যখন মা সরস্বতী দিয়েছেন, তাই ও কখনও মেধার চর্চায় আলসেমি করেনি। সবাই জানত বোর্ডের পরীক্ষায় রাজীব স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবেই। কিন্তু রাজীবকে টপকে মধুরা যখন মেধাতালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিল, তখন অবাক সবাই হবে এতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। মাধ্যমিকের পর সেই রাজীব স্কুল ছেড়ে হঠাৎই চলে গেল ওর মামার বাড়ি, ওখানে থেকে পড়াশোনা করবে বলে।

আজ দীর্ঘ দশ বছর পর  আবার দেখা হল ওদের। সেই পুরনো বন্ধু রাজীব আজ একজন নামজাদা পত্রিকার অবিচ্ছেদ্য এক লেখক। যার নতুন লেখা পড়বার জন্য নব প্রজন্ম উন্মুখ হয়ে থাকে। মধুরা ব্যস্ত শহরের এ গ্রেডেড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। দুজনেই একক জীবনে আজ ব্যস্ত।

নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে মধুরা পাশে ডেকে নিল রাজীবকে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনেই বাক্যহারা। তারপর মধুরাই অসমাপ্ত বক্তব্যের রেশ টেনে বলতে শুরু করল– “পারবে ক্ষমা করতে আমাকে? মেধা তালিকায় শীর্ষে যে নাম থাকার কথা ছিল সে হল রাজীব চট্টোপাধ্যায়। টেস্টের পরে স্কুলে  সরস্বতী পুজোর রাতে পথ আটকে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের কথা জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম আজ আমাকে স্বীকার করে না নিলে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসব না। চলে যাব এ শহর ছেড়ে। মা সরস্বতী তোমায় শুধু বিদ্যেই দিয়েছেন তা নয়, বিদ্যানুরাগীর হৃদয়ও দিয়েছেন। আজ সবার সামনে মুক্ত কণ্ঠে বলব, সেদিন তোমার বুকে আমার হাত টেনে নিয়ে আমাকে দেবী সরস্বতীর মৃন্ময়ী প্রতিমার সামনে দাঁড় করিয়ে কথা দিতে বলেছিলে, তুমি যেখানেই থাকো, বসন্তের পলাশ ফোটার অপেক্ষায় থাকবে আমার প্রতীক্ষায়, যদি আমি সেরার সেরা হয়ে স্কুলের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখতে পারি, তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।  আমি আজ আবার সেই আমাদের স্কুলে, সেই সরস্বতী পুজোর দিনে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে। বলো বসন্তের পলাশ ফুটেছে কি?”

ওদিকে তখন স্কুলের পুজো মন্ডপে মঙ্গলধ্বনিতে দেবী সরস্বতীর আবাহন মন্ত্রে দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছে‌‌ সাড়ম্বরে…

 

লেখাঃ দেবশ্রী

ছবিঃ অনন্যা

 

Palash Sakshi    |    Debashree    |    Ananya    |    https://pandulipi.net    |    Emotional    |    Bengali    |    Love Story    |    Story

Author: admin_plipi