আলোয় ঘেরা ছায়াপথ ।। লেখা – অনির্বাণ সরকার ।। প্রচ্ছদ – নিকোলাস
রাই আজ খুব খুশী। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে নিউমোনিয়ায় ভোগার পর সুস্থ হয়ে আজ তার বাবা বাড়ি ফিরবে। মায়ের সাথে গাড়ি করে সে চলেছে হসপিটাল থেকে বাবাকে আনতে। মাসখানেক আগে বাবা অফিসের কাজে তমলুক গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার দিনতিনেক পর থেকেই তার হঠাৎ সর্দি-কাশি ও জ্বর, আর তারপরই নিউমোনিয়া ধরা পড়ে।
তবে, ওর বাবার তমলুক থেকে ফেরার দিনটি আজ রাইয়ের চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠছে বারবার। সেদিন মা দু’দিনের এক আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সম্মেলন সেরে মিলান থেকে কলকাতায় ফিরবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাবে ফ্লাইট কলকাতা এয়ারপোর্টে নামতে নামতে; তারপর ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেক, লাগেজ ক্লিয়ারেন্স্– এসবের পর অ্যারাইভাল গেটে পৌঁছতে মা-র লাগবে আরও প্রায় ঘণ্টাদেড়েক। সুতরাং সব মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টার ব্যাপার শুধু এয়ারপোর্টেই। এরপর মহানগরের পথে ট্র্যাফিক জ্যাম, মিছিল-পদযাত্রা কিংবা আচমকা ডাইভার্শন কাটিয়ে যাদবপুরে বাড়ি ফিরতে আরও দু’ঘণ্টা। ওদিকে, বাবারও ফিরতে বেশ রাত হবে। তমলুক থেকে মেচেদা হয়ে লোকাল ট্রেনে করে হাওড়া পৌঁছতেই তো দু’ঘণ্টার উপর সময় লাগে। তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি চেপে বাড়ি ফেরা– সে আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক। অর্থাৎ, বাবার বাড়ি ঢুকতে রাত এগারোটা বেজে যাবে।
ঐদিনই আবার রাইয়ের জীবনে আরও একটি বিশেষ উপলক্ষ ছিল। সে সাহিত্যের ভীষণ অনুরাগী। কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যই নয়, নানান দেশের সাহিত্যের প্রতিও তার প্রবল আকর্ষণ। আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালীর মতই রবীন্দ্রনাথ যেমন তার চিরকালীন প্রিয় সাহিত্যিক, তেমনই তার সমকালীন প্রিয় লেখক হলেন নয়ন গুপ্ত, যাঁর নতুন উপন্যাস ‘আলোয় ঘেরা ছায়াপথ’ এর প্রথম সংস্করণটি সেদিন প্রকাশিত হওয়ার কথা। বইটি একইসাথে মুদ্রিত আকারে এবং অনলাইনে– দু’ভাবেই প্রকাশিত হবে। বইটির একটি মুদ্রিত সংস্করণ তার কেনা চাই-ই; অনলাইনে সে পরে কিন্ড্ল এডিশন তো পড়বেই, কিন্তু আজ সেই বইয়ের প্রথম প্রকাশিত সংস্করণটি তার কিনতেই হবে। সেটাই হচ্ছে তার সেদিনের প্রথম কাজ।
সকালেই স্নান-খাওয়া সেরে রাই তাদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কলেজ স্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই সে তার প্রিয় লেখকের প্রকাশিত বইটি কিনে নিল। তারপর এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বই ঘেঁটে আরও কিছু গল্পের বই কিনে শেষে দুপুর নাগাদ কফি হাউজ়ে গিয়ে বসল। টিফিন করার ফাঁকেই সে বইগুলোর পৃষ্ঠা উলটে-পালটে একটু-আধটু চোখ বুলিয়ে নিল। ইতিমধ্যে তার মা ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল যে সে দিল্লী এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে এবং সেখানে লে-ওভারের পর কলকাতার ফ্লাইটে চাপবে। নিশ্চিন্ত মনে রাই অবশেষে কলকাতা বিমানবন্দরের পথে রওনা হয়ে গিয়েছিল মাকে নিতে।
মাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিশ্যি গাড়ি আসবে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে। শুধু তা-ই নয়, সেইসঙ্গে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে আসতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ কিংবা ইঞ্জিনীয়ারিং-এর ডীন। রাইয়ের মা ডঃ অবন্তিকা সেনগুপ্ত একেই ঐ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, তার উপর আবার মিলানের ইন্টারন্যাশনাল টেক্নোলজি কন্ফারেন্সের অন্যতম প্রধান বক্তা। অবন্তিকা বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস্ ইন্টিগ্রেশন, অর্থাৎ নির্মাণকার্যের উপাদানগুলোর সমাকলনের উপরে এক যুগান্তকারী গবেষণা করেছে, যাতে একাধারে নির্মাণকার্যের সময় ও পরিশ্রম অনেকখানি বাঁচানো যাবে এবং একইসাথে পরিবেশ দূষণও কম হবে। এর জন্যই তাকে মিলানের ঐ আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সম্মেলনে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য, অবন্তিকা আজ একজন বিখ্যাত গবেষক ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটির এক খ্যাতনামা অধ্যাপিকা। নিঃসন্দেহে এই খ্যাতির জৌলুস অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
হাতে নয়ন গুপ্তের বইখানা নিয়ে এয়ারপোর্টের অ্যারাইভাল গেটে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল রাই। সেখানে বেশ কয়েকটি নিউজ চ্যানেল থেকে সাংবাদিকরা এসে জমায়েত হয়ে ছিল মায়ের ইন্টারভিউ নেবে বলে। তা দেখে মায়ের জন্য ভীষণ গর্ব বোধ হচ্ছিল রাইয়ের। ইন্টারভিউ হওয়ার পর মায়ের সাথেই বাড়ি ফিরেছিল সে, তবে নিজেদের গাড়িতে নয়, ইউনিভার্সিটির গাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন প্রফেসর ডঃ সৌম্যব্রত ঘোষাল, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনীয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডীন। ওদের গাড়িটা ড্রাইভার পিছন পিছন চালিয়ে নিয়ে এসেছিল।
সেদিন দুপুরের পর কোনও এক ফাঁকে বাবাও তাকে ফোন করেছিল; কিন্তু রাই সে-ফোন ধরার সুযোগ পায়নি, সে তখন কফি হাউজ়ে বসে নতুন বইগুলি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই ব্যস্ত ছিল। পরেও আর পালটা ফোন তার করা হয়নি বাবাকে।
মিলান থেকে মা তার জন্যে একটি অসাধারণ সুন্দর ড্রেস্ এনেছে– সাদা ও ময়ূরকণ্ঠী রঙের উজ্জ্বল যৌথ সমন্বয়ে ঘাগরা ধরণের একটা পোশাক। বাড়ি ফিরে সেটা নিয়েই মশগুল হয়ে পড়ল সে। এরপর মায়ের ক্যামেরায় বন্দী ইটালির শহর ও শহরতলি, হোটেলের কারুসজ্জা এবং মিলানের কন্ফারেন্সের ছবিগুলি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল রাই। রাত প্রায় সোয়া এগারোটা নাগাদ বাড়ির বাইরে ট্যাক্সি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল, সেইসঙ্গে অয়নের গলা। রাই বুঝতে পারল, বাবা তমলুক থেকে ফিরেছে।
ঘরে ঢুকে অয়ন অন্যান্য দিনের মতই প্রথমেই রাইয়ের খোঁজ নিয়েছিল। রাই নিজের ঘরেই বসে গল্পের বই পড়ছিল আর মাঝে মাঝে মিলানের ছবিগুলো দেখছিল; বাবার ডাকে সাড়া দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই মনে করেনি সে। অবন্তিকা আড়চোখে পরদার ফাঁক দিয়ে রাইকে দেখে নিল। মেয়ের সাথে তার চোখাচোখিও হল, সেইসঙ্গে একটু মৌন বিসংবাদও। শেষে খানিক বাধ্য হয়েই সে অয়নকে জানাল, রাই শুয়ে পড়েছে। সে কিন্তু তখনও জেগে, নিজের ঘর থেকেই মা-বাবার কথাবার্তা শুনল। ওদিকে বাইরের ঘরে তখন অফিসের ব্যাগ থেকে অয়ন কিছু একটা বের করে ডাইনিং টেব্লে রাখল। তাকে বলতে শোনা গেল, “এই মুক্তোর মালাটা আর এই একজোড়া কানের দুল রাইয়ের জন্য, আর এই আরেক জোড়া কানের দুল তোমার জন্য। দুলগুলো সব সাদা ঝিনুক দিয়ে তৈরী। দিঘায় গিয়েছিলুম, কিনে এনেছি।” ওরা দু’জন খেতে বসলে পর রাই একবার বাইরের ঘরে এসেছিল। ওর খাওয়া বাবা আসার আগেই সারা হয়ে গিয়েছিল। অয়নের দিকে তাকিয়ে সামান্য মুচকি হাসি হেসে মাকে উদ্দেশ করে বলেছিল সে, “নয়ন গুপ্ত এবারে জাস্ট্ ফাটিয়ে দিয়েছেন, বুঝেছ মা! কী অপূর্ব স্টোরিলাইন এই ‘আলোয় ঘেরা ছায়াপথ’-এর! এই গল্প নিয়ে সিনেমা হওয়া উচিৎ।” অয়ন তার মেয়ের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী স্টোরি, একটু বল, শুনি?”
-“অনেক বড় স্টোরিলাইন, বলতে সময় লাগবে,” খানিকটা বিরক্তি আর অনেকটা অনীহা নিয়েই জবাব দিয়েছিল রাই, “আজ আর পারছি না, পরে শুনবে।”
অপ্রস্তুত বোধ করেছিল অয়ন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে টেব্লের উপরে রাখা দিঘা থেকে কেনা সেই মুক্তোর মালা এবং ঝিনুকের তৈরী কানের দুলগুলো দেখিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে সেগুলো তার পছন্দ হয়েছে কিনা। কিন্তু রাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেগুলো দেখে “হুম্, ভাল জিনিস” ছাড়া আর কিছুই বলেনি। অয়ন মেয়ের মধ্যে উৎসাহ জোগানোর চেষ্টা করেছিল আবার, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। রাই ফের বিরক্তির সাথে জবাব দিয়েছিল, “কাল দেখব, বাবা। আজ তুমিও ক্লান্ত, আর আমরাও।”
অয়নের কাছে এ আর নতুন কিছু নয়। তার মেয়ে রাই তার আনা উপহারে ততটা আনন্দিত কখনওই হয় না, যতটা হয় মা অবন্তিকার আনা উপহারে। এর কারণ হচ্ছে অয়ন ও অবন্তিকার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত মান্যতার আকাশ-পাতাল তফাৎ। অয়ন সাধারণ মানের স্নাতক, পাশ কোর্সে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, একটি মাঝারি মাপের প্রাইভেট কোম্পানিতে সুপারভাইজ়ার হিসেবে চাকরি করে। অন্যদিকে, অবন্তিকা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং এর প্রফেসর এবং একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তার এই অতুল বৈভব ও বিশ্ববিদিত খ্যাতির জৌলুসের পাশে অয়নের সর্বসাধারণ পেশাদারিত্ব প্রায় ম্লান। রাই ছোট থেকেই তার মা ও বাবার ঐ শিক্ষাগত ও পেশাগত বিশাল পার্থক্যের প্রত্যক্ষদর্শী। অয়ন ও অবন্তিকার মধ্যে অবশ্য এই পার্থক্যের জন্য সম্পর্কের কোনও অবক্ষয় দেখেনি সে; বরং সে দেখে এসেছে আগাগোড়া দুই পেশাদার মানুষ ভিন্ন বর্গে জীবিকানির্বাহ করেও ঘরের ভিতর অসামান্য দক্ষতায় সাংসারিক– যেন একটি সুষ্ঠু নির্বিবাদ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে দু’জনে একে-অপরের শিক্ষা ও পেশার চাইতে পারিবারিক সংসর্গের প্রতি নিবিষ্ট-হৃদয়।
তা সত্ত্বেও, অনেক চেষ্টা করেও রাই বাবা ও মাকে কোনওদিনই একই পাল্লায় বসাতে পারেনি মনে মনে। বাবা কোনমতেই মায়ের সমকক্ষ নয়– তার মনের কোনও এক কোণে যেন এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে সেই ছোটবেলা থেকেই। মায়ের জাঁকজমক তাকে বাবার মলিন উজ্জ্বলতার চেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছে সবসময়। সে যখন স্কুলে পড়ত, তখন থেকেই বাবার মোটর সাইকেলের তুলনায় মামার ফোর-হুইলার বেশী প্রিয় ছিল তার। মায়ের দেওয়া বাস্কিন রবিন্সের আইস্ক্রীম বাবার কেনা অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রসগোল্লার চেয়ে তার খেতে বেশী ভাল লাগত। তার কাছে অনেক বেশী রোমাঞ্চকর মনে হত মায়ের রাজধানী বা দুরন্ত এক্সপ্রেসে চেপে কিংবা ফ্লাইটে করে দূরের কোনও শহরে গিয়ে কন্ফারেন্স বা সেমিনারে যোগ দেওয়া; আর, অতি-সাধারণ মনে হত লোকাল ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে ঝুলে বাবার ঐ খড়্গপুর- মেদিনীপুর- উলুবেড়িয়া- ব্যান্ডেল গিয়ে ইনস্পেকশনের কাজ করা। যেমন, সেদিন মায়ের দেওয়া ময়ূরকণ্ঠী ইতালীয় পোশাকের কাছে তার বেমানান মনে হয়েছিল বাবার আনা মুক্তোর মালা ও ঝিনুকের তৈরী কানের দুলজোড়া।
ঐ ঘটনার দিনতিনেক পর থেকেই অয়ন জ্বর-সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগতে আরম্ভ করে। অবন্তিকা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেও রাইয়ের বিশেষ চিন্তা ছিল না বাবাকে নিয়ে। হস্পিটালে বাবাকে দেখতে এলেও তার হাতে থাকত তার প্রিয় লেখকের বই। বাবার যত্ন ও খেয়াল রাখা নিয়ে তার কোনও উৎসাহই ছিল না। ভাবখানা এমন, যেন শরীর অসুস্থ হয়েছে, চিকিৎসা হলেই ভাল হবে। এ-নিয়ে মা-মেয়েতে আড়ালে বেশ কয়েকবার বাদানুবাদও হয়ে গিয়েছে। রাই যেন ধীরে ধীরে বাবার প্রতি উদাসীন হতে শুরু করেছিল এরই মধ্যে। সেই মেয়েই আজ সানন্দে মায়ের সঙ্গে হস্পিটালের পথে চলেছে তার সুস্থ বাবাকে ঘরে ফেরাতে।
আসলে ঘটনার মোড় ঘুরেছে ঠিক দু’দিন আগেই; আর, তা এতটাই আকস্মিক ও তাৎপর্যপূর্ণ যে, রাইয়ের চিন্তাভাবনা ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে এরপর। সেদিন হস্পিটাল থেকে অয়নকে দেখে বাড়ি ফিরে অবন্তিকা তার মেডিক্লেমের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছিল। অয়ন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে, ডাক্তারবাবু তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে বলেই দিলেন যে দু’-একদিনের মধ্যেই তাকে ডিস্চার্জ করে দেওয়া হবে। সুতরাং এইসময় অয়নের মেডিক্লেম প্রসেস্ করা যেতে পারে। ওদিকে রাইও মায়ের কথামত বাবার অফিসের ব্যাগ থেকে এক-এক করে সমস্ত কাগজপত্র বের করে টেব্লের উপরে রাখছিল। সে কোনওদিনও তার বাবার অফিসের ব্যাগে হাত দেয়নি; মধ্যবিত্ত ছা-পোষা সাধারণ চাকরিজীবীর অফিসের ব্যাগে কী এমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকতে পারে। কিছু অফিসিয়াল চিঠিপত্রের প্রতিলিপি, কাজের ফিরিস্তির বয়ান, আর কোনও একটা বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র – বড়জোর এইটুকু। কিন্তু, রাই বোধ হয় স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি, তার নিতান্ত সাধারণ বাবার অতি-সাধারণ অফিসের ব্যাগের ভিতরেই এক অসাধারণ অজানা সত্য লুকিয়ে রয়েছে। ঐ সমস্ত কাগজের তাড়ায় হঠাৎ বেমানান একটি কাগজের উপর দৃষ্টি পড়ল রাইয়ের। একটি বড় নামকরা বুক পাবলিশিং কোম্পানির দেওয়া একটি স্মারকলিপির কপি, যাতে একজন লেখককে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে। সাথে ঐ কোম্পানিরই লেটারহেডে ছাপানো একটি চিঠি, তাতে সেই লেখককে জানানো হচ্ছে যে তাঁর লেখা উপন্যাস সর্বজনগৃহীত হয়েছে এবং সর্বসম্মতিক্রমে পাবলিশার্স্ অ্যান্ড বুক সেলার্স্ গিল্ডের তরফে সেই উপন্যাসটি বই আকারে সেইবছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হতে চলেছে। বছরতিনেক পুরনো সেই চিঠি ও স্মারকলিপি যাঁকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামটা পড়ে রাই ভীষণভাবে চমকে গেল। ঐ কাগজগুলোতে লেখকের নাম রয়েছে ‘অয়ন সেনগুপ্ত’, যাঁর স্বীকৃত ছদ্মনাম হল ‘নয়ন গুপ্ত’! রাইয়ের মনে কে যেন সজোরে চাবুক মারল! যে বাবার প্রতি সারাজীবন প্রত্যক্ষে অন্যায় উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছে সে, যে বাবার ভালবাসাকে কোনওদিন যথোচিৎ সম্মান দেয়নি সে, যে বাবার আনা কোনও উপহারের মর্যাদাটুকু রাখেনি সে, সেই বাবারই সমান্তরাল অস্তিত্ব এক লেখক-সত্ত্বা। শুধু তাই-ই নয়, সেই লেখক আবার রাইয়ের সমকালীন সর্বপ্রিয় সাহিত্যিক! নিজের বাবার অস্তিত্ব এতদিন তো তার কাছে প্রায় ছিল না বললেই চলে, অথচ বাবার লেখার সে এতবড় ভক্ত। তড়িঘড়ি মাকে দেখিয়েছিল সে কাগজটা। অবন্তিকাও অবাক, অস্ফুটে বলেছিল, “বিয়ের আগে সাহিত্যচর্চা করত বলে জানতাম। পরে নিজের চাকরির খাতিরে এবং আমার পড়াশুনার নির্বিঘ্নতা বজায় রাখতে সে-শখ পরিত্যাগ করেছিল।”
এরপর দু’জনে নিশ্চুপ হতভম্বের মত বেশ খানিকক্ষণ বসে ছিল। ওদের দু’জনের যাবতীয় দম্ভ-অহঙ্কার ভেঙে খান-খান করে দিচ্ছিল ঐ নৈঃশব্দ্য। অবশেষে অবন্তিকাই মুখ খুলল, “পাণ্ডুলিপির খাতাটা তার মানে ওর স্যুটকেসেই রাখা আছে। রাত জেগে পাণ্ডুলিপিগুলি থেকে ল্যাপটপে সমস্ত গল্প-উপন্যাস লিখে আর কপি করে রাখত। আর, আমি ভাবতাম, অফিসের কাজ করছে।” এরপর সে তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, “তোর নয়ন গুপ্তের কতগুলো বই পাবলিশ হয়েছে রে?” রাই তার মায়ের কথার কোনও উত্তর দিতে পারল না, ভেঙে পড়ল বাঁধভাঙা কান্নায়।
কথায় বলে, দুঃখের স্মৃতিচারণে হৃদয় হালকা হয়ে যায়। আজ রাইয়ের মনও ভীষণ হালকা। অন্যান্য দিনের মত আজও তার হাতে রয়েছে ‘আলোয় ঘেরা ছায়াপথ’, লেখক নয়ন গুপ্ত। বাবাকে আজ সে এই বইটা উপহার দেবে বাড়ি ফেরার সময়। অনুশোচনা নয়, শুধু সম্মান আর ভালবাসাই ফুটবে তার প্রতিটি কথায়। বাবার প্রতি তার ব্যবহারের স্নিগ্ধতাই অয়নকে অনুভব করাবে, তার ছায়াপথ সত্যি সত্যিই আলো দিয়ে ঘেরা! আর অন্তরাল নয়, এবারে ‘নয়ন গুপ্ত’-র খ্যাতির উজ্জ্বলতায় ফেরার পালা।