একটি সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কের গল্প :: লেখা : অতনু কর্মকার
যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সমস্থিথা
নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নম নমঃ …
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সমস্থিথা
নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নম নমঃ …
যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সমস্থিথা
নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নমস্থ্যসই নম নমঃ …
সামনের প্যান্ডেল থেকে মহালয়ার চন্ডীশ্লোক ভেসে আসছে। প্রতিটা শব্দ কবিতার গায়ে যেন কাঁটার মতন ফুঁটছে। যদিও আজকে ষষ্ঠীর অপরাহ্ন, কিন্তু ফিলিংসটা মহালয়ের দিনের ভোরে মতনই এসে গায়ে বিঁধছে যেন দুজনেরই, কবিতা আর সুজয়ের।
আজকে কবিতা পুরো আটপৌঢ় বাঙালি সাজে এসেছে দেখা করতে। একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি, তার ওপরে হালকা হলুদ রঙের প্রিন্ট; আঁচলটা গাঢ় রানী রঙের। ডান হাতে একটা পুঁথির বালা আর ম্যাচিং লাল রঙের আইফোন। আড়চোখে আরেকবার দেখে নিল সুজয়, বাঁ হাতে আবার একটা ছোট্ট রুমাল ফোনের রঙের সাথে মিলিয়ে।
” রুমালটা গত পরশু কিনেছি; ভালো ম্যাচ করেছে না ? বল? ” সুজয় যতই আড়চোখে দেখুক, কবিতার নজর এড়ানো মুশকিল ।
“হুম ! ঠিকই আছে । “
“ কত বছর পর এলি যেন ?” – সুজয় কবিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো
“ আগের বারেই তো এলাম, ব্রেনোলিয়া খা এবার থেকে ” খানিকটা অবাক হয়েই উত্তর দিলো ও।
“ ও হ্যা ঠিক ই বলেছিস ! ” সুজয় মাথা নাড়লো।
“ আমি ঠিক ই বলি। ” কবিতার সপ্রতিভ উত্তর ।
সুজয় আর কবিতা একটা রুফটপে এসে বসছে, এইটা একটা পুরানো জমিদার টাইপের বাড়ি – আইটিসি গ্রুপ এখন রিনোভেট করছে, নিশ্চই রিসোর্ট বানাবে। ওরা ম্যানেজ করে ছাদে চলে এসেছে। এই চত্বরে ওরা পরিচিত মুখ, তাই বাঁধা পাওয়ার ব্যাপারটা নেই – পাঁচিলের ওপরে পা ঝুলিয়ে বোসে আছে কবিতা, আর সুজয় পা গুটিয়ে পদ্মাসন এর মতন ধ্যান এর পোজ নিয়ে বসার চেষ্টা করে চলেছে।
এই জায়গাটা তা ছোটবেলা থেকেই হ্যাং আউট এর সেরা জায়গা ছিল কবিতার; এখানেই ওদের বন্ধুদের গ্রুপের আড্ডার জায়গা ছিল। স্পেশালি পূর্ণিমার রাতে অসম্ভব ভালো ফীল হয় এই জায়গাটাতে এলে, তার সাথে সবাই একসাথে এনজয় করাটাও একটা স্পেশাল ফিলিং ছিল ওর কাছে।
“ তুই যে কেন এখানেই পরে রইলি ? স্টেট এর বাইরে বেরোনো টা খুব দরকার ছিল তোর … you probably missed the bus by yourself. “
সামনের দিকে তাকিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো কবিতা। একটু দূরেই ইছামতি নদী, বর্ষা এলে দুই কুল ছাপিয়ে যায়, কিন্তু এখন অনেকটাই শান্ত – কিছুটা সুজয়ের মতন। ” কি রে কিছু বল ” – কবিতা ঝাঁজিয়ে উঠল।
“ আসলে কি বলতো ! একটা সময় অনুভব করলাম যে এই জায়গাতে অনেক শেঁকড়-বাকড় জড়িয়ে গিয়েছে আমার । চেষ্টা করেছিলাম, টেনে টেনে ছাড়ানোর, কিন্তু একটা জট ছাড়াচ্ছি তো দেখছি আর একটা জায়গায় জট আটকে আছে ! শেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। এই তো বেশ আছি রে ভাই এখানে। “
সুজয় খানিকটা স্বগতোক্তির মতো বলে গেলো কথাগুলো।
একদিন কবিতা বলেছিলো, ” এই তুই কথায় কথায় ভাই বলিস কেন রে? আমি কি তোর ভাই ? ” ও বলেছিলো ” আরে এইটা বাঙালিদের কথা বলার ধরণ, ভাই/ দাদা এই গুলো ফিলার – তোর তো বাংলা বলার অভ্যেস চলে গেছে, তুই বুঝবি না। ” মনে মনে দুটো গালাগালি দিয়ে ব্যাপারটা হজম করে নিয়েছিলো কবিতা।
বাইরে থাকলেও কবিতা অন্যদের থেকেও অনেকটা বেশি বাঙালি। আচারে, ব্যবহারে, পোশাকে – আশাকে সব মিলিয়ে। ওর প্রবাসী বর এনিয়ে প্রায়ই ওকে খোঁটা দেয় – কিন্তু বাইরে থাকলে বোধহয় বাঙালিয়ানা টা বেশিই মিস হয় !
সুজয় আর কবিতা এই গ্রামের ই। কবিতা মামাবাড়ি তে মানুষ, কিন্তু সুজয়ের এখানেই জন্ম , দুজনের বড় হয়ে ওঠা ইছামতির তীরে এই গ্রামেই । সুজয় ঠিক কোর ফ্রেন্ড গ্রুপে পড়েনা কবিতার , এক্সটেন্ডেড ফ্রেন্ড গ্রুপে বলা যায়।
অনেকটা সিনিয়র কবিতার থেকে, কিন্তু ওদের চিন্তা ভাবনা টা অসম্ভব ভাবে মেলে – যে কোনো টপিকেই হোক ! কবিতাকে বোধহয় সুজয়ের থেকে ভালো কেউ বোঝেনা বা ফীল করতে পারেনা পৃথিবীতে। সেটা দুজনেই জানে, কিন্তু এই ফিলিংস টাকে ওরা এক্সপ্লিসিটলি কোনোদিন একনোলেজ করেনি নিজেদের কাছে।
কবিতা বরাবরই কনফিউসড ছিল এ ব্যাপারে – ওর মতে এতো সুন্দর বন্ডিংটা অবভিয়াস একটি প্রেমে পরিণত হয়ে ফিকে না হয়ে যায় ! তার থেকে এইভাবেই চলুক না ! ওর বন্ধুরা বলতো – “You guys are very close to each other; hope you two are aware of it !!” – এই কথাটা সুজয়কে বলেছিল কবিতা একদিন, বোঝার চেষ্টা করেছিল ওর রিঅ্যাকশনটা। সুজয়ের রিঅ্যাকশন বুঝতে পারাটা মাঝেমাঝে কবিতার মনে হতো স্কুলের সিঁড়িভাঙ্গা অংকের মতন, অনেক চেষ্টা করেও যার উত্তর বেশিরভাগ সময়ই মিলতো না ।
সুজয় শুনে ওর দিকে তাকিয়ে হালকা করে হেসে বলেছিলো; “ সব সময়ই আমাদের মধ্যে একহাত গ্যাপ থাকে কিন্তু, মেপে দেখিস কখনো ! “
কবিতা পড়াশুনোয় মোটেই খারাপ ছিলনা – সুজয় বলতো, “ তুই কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট, ট্যালেন্টটাকে রেস্পেক্ট দিস “ যাইহোক, সেই ট্যালেন্টের জোরে সুজয়ের মনের সিঁড়িভাঙা অঙ্ক মাঝেমাঝে সল্ভ করে ফেলতো, কিন্তু সুজয় কোনোদিন উত্তরটা মেলাতে দিতোনা !
এইভাবেই চলছিল। ফিনান্সিয়াললি সুজয়ের ফ্যামিলি দুর্বল ছিল বরাবরই , তাই কলেজে পড়ার সময় থেকেই সুজয়ের ফোকাস ছিল চটজলদি কিছু একটা করার, যাতে ফিনান্সিয়াললি সেটল হয় ফ্যামিলিটা ।
ওদিকে কবিতা উছকাঙ্খী ছিল, সেটা অনেকেটা সুজয় ও ওকে হতে হেল্প করেছে; জোর করেই পোস্ট-গ্রাডুয়েশনের জন্য কলকাতায় ওকে রাজি করিয়েছিলো সুজয়। প্রেসিডেন্সিতে মাস্টার্স করার পর আর ওকে পিছনে তাকাতে হয়নি। লাইফের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কগুলোকে অবলিলিয়ায় সল্ভ করে এগিয়ে গেছে কবিতা। এখন ও টরেন্টোতে সেটলড, সিটিজেনশিপও পেয়ে গেছে । কিন্তু যেখানেই থাক, পুজোর সময়ে বাড়িতে ও ফিরবেই ফিরবে। বাইরে ওর হাঁপ ধরে যায়, এখানে তিন-চারটে সপ্তাহ মা আর মামা বাড়ির সান্নিধ্যটা ওর কাছে বিশুদ্ধ অক্সিজেন এর মতন ।
সুজয় একবার বলেছিল ওকে – “ তুই প্রতিবছর পয়সা খরচ করে এখানে আসিস কেন ? এর বদলে তোর আরামসে একটা ভালো ইউরোপ ট্রিপ হয়ে যেত। কাকিমাকে যদি তোর ওখানে নিয়ে যাস পার্মানেন্টলি; যদি উনি রাজি থাকেন তাহলে তোর প্রতিবছর এই রেকারিং খরচটা বেঁচে যাবে, বদলে ওয়ার্ল্ড টুর টাও কমপ্লিট করে ফেলতে পারবি । তুইতো ঘুরতে ভালোবাসিস খুব, আমি জানি । “
এইযে পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বসা, কোনো পিছুটান ছাড়া সুজয়ের এক হাত পাশে বসে এই কদিনের আড্ডা, এগুলো কি কিচ্ছু না ? সামনের এক বছরের জন্য অনেক গুলো অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রাখার মতন ব্যাপারটা । কিন্তু সুজয় কি এগুলো জানে? – এই অঙ্ক আর সল্ভ করার চেষ্টা করেনা কবিতা ! সেই সময়গুলো তো চলে গেছে ।
মুখে শুধু বললো – ” ফ্রি এর সাজেশন দেওয়া বন্ধ কর, আজকাল কেউ না ফ্রি জিনিস নেয় না ! বরঞ্চ তোর ওই গরুর গোয়ালে গিয়ে দিস, ওরা শুনবে । “
কবিতা বলতে থাকলো – “আচ্ছা, তার মানে তুই টিউশন করিয়েই কাটিয়ে দিবি বাকি জীবনটা? তাই তো? আচ্ছা, তোর কি নাম ডাক হয়েছে ? আশেপাশের পাড়ার লোকজন তোকে মাস্টার বলে ডাকে?” কবিতা ছুড়ে ছুড়ে কথা গুলো বলছিলো।
ও এখনো মেনে নিতে পারেনি যে সুজয় মফস্বলে বসে টিউশন করে চলেছে, it’s is a sheer waste of talent! আগে সুজয় রাজনৈতিক ভাবেও সক্রিয় ছিল, কিন্তু পালা বদলের পর সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে |ভালোই করেছে মনে হয় | আগে সুজয় সভাবে মডারেট ছিল, কিন্তু লাইভলি ছিল ! এখন ক্রমশ খুব শান্ত হয়ে যাচ্ছে, মাঝেমাঝে চিন্তা হয় ওর জন্য খুব । কিন্তু এই কয়েকটা দিনের মধ্যে কিচ্ছু বুঝে ওঠার আগেই কবিতার রিটার্ন ফ্লাইটের দিন চলে আসে।
আর একটা ব্যাপার ও খুব অদ্ভুত লাগে, ওর ফেরার দু তিনদিন আগে থেকেই সুজয় বেপাত্তা হয়ে যায়, অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ কারণ নিয়ে কোথায় একটা হারিয়ে যায় ! একবার কবিতা বিরক্ত হয়ে পরে জিজ্ঞেস করেছিল, ” তুই এরকম করিস কেন প্রতিবার, আমি তো সামনের বছর আবার আসছি ? তুই কি চাস ? আমি এখানেই থেকে যাই? “ অবভিয়াসলি উত্তরটা আসে, কবিতা ফিরে যাওয়ার পরে। টরেন্ট থেকে কবিতা উত্তরটা পরে মনে মনে হাসে। সুজয় লিখেছিলো –
“এখন এখানে এসে সেটল করিস না, তোর ধার-দেনা সব চুকিয়ে, প্রচুর ক্যাপিটাল বানিয়ে নে আগে, তারপর এখানে আয়, আমরা একটা NGO খুলব; বেশি কিচ্ছু না – অল্প করে শুরু করব, প্রচুর নিডি আর ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চা আছে, ওদেরকে পড়াবো। তুই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পার্টটা দেখবি, আমি টিচিংটা দেখবো। But make sure that you have enough money to support this! ”
ফ্ল্যাশব্যাকে মেমরিগুলো একটার পর একটা আসছিলো, সম্বিৎ ফিরে এলো সুজয়ের ডাকে। একটা তেতুল পাতার ডাল হাতে নিয়ে সুজয় তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“ কিরে, কি দেখছিস দূরে তাকিয়ে ? নদীতে মাছ খুজছিস নাকি?” সুজয় হাসতে হাসতে বললো ।
“না না, এমনি ” – কবিতা উত্তর দিলো।
“এমনি বলে কিচ্ছু হয় না – তুই তো বলতিস ।” সুজয় ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
সুজয় আনমনে বললো, ” যাইহোক, এই দ্যাখ তোকে একটা ট্রিকস দেখাই। “ বলে সুজয় তেঁতুলের ডালটা দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে আস্তেআস্তে ওপর থেকে নিচে টানলো; অদ্ভুত ভাবে হাতের তালুতে ছোটছোট পাতা গুলো জড়ো হয়ে এলো।
এরকমই করে সুজয়, বাচ্চাদের মতন কিম্ভুত সব কাজ। কবিতা হেসে বললো; ” বাহ্ ! ব্যাপক তো। আমায় দে, আমিও ট্রাই করি” ।
কিছুক্ষন কবিতা আর সুজয় এভাবেই ব্যস্ত থাকলো। লাস্টে কবিতা সব তেঁতুল পাতাগুলো সুজয়ের হাতে থেকে তুলে নিয়ে ওর মাথায় ঢেলে দিলো আলতো করে। সুজয় চোখ বন্ধ করে বসেছিল যখন কবিতা সব পাতাগুলো ওর মাথার ওপর চাপিয়ে দিলো, সম্ভবত চোখে পাতা ঢুকে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু ওই মুহূর্তে সুজয়কে মায়াবী ভাবে কোনো এক দেবদূতের মতন লাগছিলো ! ওর সারা গায়ে পাতায় ভর্তি, হালকা একটা হলুদ রঙের ফতুয়া ওর গায়ে, হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া মাথা ভর্তি চুল, সব কেমন যেন ওলোটপালোট করে দিচ্ছিল কবিতাকে।
কেমন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিলো কবিতার, এই অনুভব গুলো খুব কনফিউস করে দেয় কবিতাকে। এটা কি ভালোলাগা ! নাকি সুজয়ের ওপর মায়া, করুণা ; এটা বুঝে উঠতে পারে না কিছুতেই ! একটা লোক, যে হয়তো সারা বছর এই কটা দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। যে কিছুতেই প্রতিবছর ওর ফিরে যাওয়াটাকেও মেনে নিতে পারেনা ঠিক করে, তাকে সান্তনা দেওয়ার মতন সাহস ওর এখন আর নেই। নিজের মনের এই দ্বন্দ্বগুলো খুব ভয় পায় ও; যদি কিছূ ভুল করে ফেলে ! নিজের জন্য ওর চিন্তা অতটা নেই, ও হয়তো সামলে নেবে । কিন্তু সুজয় কি করবে ও চলে যাওয়ার পর !
সম্বিৎ ফিরলো সুজয়ের ডাকে; “এই মুখ থেকে পাতাগুলো সরিয়ে দে না ! চোখ দুটো খুলতে পারছি না তো !”
“ দাঁড়া দাঁড়া , দিচ্ছি ! “ মুখটা সামনে নিয়ে এসে জোরে একটা ফুঁ দিয়ে পাতাগুলো সরিয়ে দিলো কবিতা । কিন্তু কিছূ এখনো লেগে আছে ওর মুখের আনাচে কানাচে। দুজনের মধ্যে দূরত্বটা এখন এক হাত থেকে কমে কয়েকটা আঙুলের ব্যবধানে এসে দাঁড়িয়েছে ! সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক কি এতদিনে সল্ভ হবে ?
কবিতা বাকি পাতাগুলো একটা একটা করে খুব যত্ন করে সরিয়ে দিচ্ছিল ! ” দেখিস চোখের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিসনা যেন। ” বিড়বিড় করে সুজয় বলে যাচ্ছিলো।
আলতো করে জিজ্ঞেস করলো কবিতা – ” সেই পারফিউমটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছিস? জিনিস বটে তুই একটা। “ পাঁচ বছর আগে কবিতার নিজের গিফট করা পারফিউম এর গন্ধটা ওর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিলো।
“ তুইও তো তোর ফেভরিট পারফিউম এখনো ছাড়িসনি দেখছি ” – সুজয় বললো, কিন্তু একটু থেমে থেমে । কবিতা উত্তর দিলো – ” হ্যা, কিন্তু এটা নতুন কালেকশন, তোর দেওয়া বোতলটি বহুদিন আগেই খতম !”
“ আচ্ছা আমি কি চোখ খুলব ?” – সুজয় জিজ্ঞেস করলো ।
“না, চোখ মেলে নতুন কিছু দেখার নেই, যখন বলবো তখন খুলবি। ” – কবিতা হেসে উত্তর দিলো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো হালকা হাসির ভঙ্গিমায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকা সুজয়কে, নিশ্চিতে বসে থাকা একটা ছেলেকে, যে কিনা চোখ খোলার জন্য একজনের নির্দের্শ এর অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষন পরে সুজয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইছামতির দিকে নজর ফেরালো কবিতা, তারপর নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। মনটা একদিকে ভারাক্রান্ত হয়ে আসছে, আবার একটা সুন্দর ভালোলাগাতে ভরে যাচ্ছে !
মিনিট দুই পরে ওরা দুজনেই চোখ খুললো। সামনে পরন্ত সূর্য্য দিগন্তে আর প্যান্ডেলে ঢাকের ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে আওয়াজ ভালোলাগাটাকে রেসোন্যান্সের মতন বহুগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে – আর তারসাথে ক্যাটালিস্ট এর মতন রয়েছে ওদের কয়েক আঙুলের এই বাব্যধান।
হঠাৎ করে কবিতার ফোনে এবার নোটিফিকেশন এলো, ওর মামাতোবোন রত্না ডাকছে । একসাথে প্যান্ডেল হপিং করবে ঠিক করেছিল ওরা সকালে ; রেডি হয়ে বসে আছে কবিতার জন্য।
“ আজ উঠিরে, ডাক এসেছে – বাড়ি যেতে হবে । “ কবিতা পাঁচিলের ধার থেকে উঠে বসলো।
“ হ্যা, হ্যা, তুই যা ! আমি একটু বসি এখানে আরো কিছুক্ষন।“ সুজয় ওর ডাকিয়ে তাকিয়ে বললো
“ আমি কিন্তু আর আসব না এখন ফিরে, পরে আবার দেখা যাবে; যদি টাইম পাই ! “
“ হুম । সিঁড়ির দিকটা অন্ধকার, সাবধানে যাস ! “ সুজয় আর কিছু বললো না।
কবিতাও আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে এগোলো। হোটেলের লোকগুলোর রুচি খুব একটা খারাপ নয়; রেডিওতে গান চালিয়ে ওয়াল পেইন্টিং এর কাজ করে চলেছে। মনে হলো ওর মনের ভাবনাগুলো আজ পুরো বাড়িটাতে গানের মধ্যে দিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে যেন –
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস …
আর একটু ওপরে ছাদের পাঁচিলে বসে থাকা সুজয়ের চোখদুটো খানিকটা আদ্র যেন এখন; তারও কানে হালকা হয়ে গানের বাকি কথাগুলো যেন ফিরে ফিরে আসছে –
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও …
অসমাপ্ত …