ক্যাশলেস ও একটি গন্ডার
লেখা – সুকান্ত নাহা
ছবি – জয়দেব ভট্টাচার্য
প্রবল রাগে সেকেন্ড ক্লার্কের টেবিলে একটা ভীমপাঞ্জার ঘুঁষি মেরে চেঁচিয়ে ওঠে ‘গেন্ডা-ফিলিপ’, “মোয় নি মানবু, মোকে নগদ পইসা লাগি বাবু… এখ্নে লাগি…।” শব্দের প্রাবল্য ও বাঁশ ফাটা গলার আওয়াজের যুগপৎ অভিঘাতে চমকে ওঠেন অফিসের বাবুরা। অফিস ছেড়ে বারান্দা, বারান্দা ছেড়ে বাইরের খোলা চত্বর, হাওয়া গরম করেই ফের ঢুকে পড়ছিল ‘গেন্ডা’ ভেতরে। এটাই ওর স্টাইল। এমনটা চলতে থাকে একবার, দুবার, তিনবার…। মেইন গেটের সিকিউরিটি গার্ড থেকে কারখানার শেষপ্রান্তে সর্টিং রুমের প্যাকিং লেবারটিরও জেনে যায় ‘গেন্ডা’ ফের হামলা করেছে অফিসে। ম্যানেজমেন্টের ওপর ক্ষেপলে ও এভাবেই ঝাঁঝালো তরলে মেজাজ চড়িয়ে ক্ষ্যাপা গন্ডারের মত সোজা ছুটে আসে। জিভের জড়তায় বক্তব্যের বোধগম্যতা স্পষ্টতর না হওয়াটা পুষিয়ে নেয় ‘গাঁক-গাঁক’ আওয়াজের দমকে। চেঁচিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়ে যতক্ষণ না সিকিউরিটি এসে চেপে ধরে গেটের বাইরে বের করে দিচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়েও ও অনর্গল চেঁচায়। চেঁচিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে পুনরায় ফিরে আসার অদৃশ্য ভয়টা গেটের বাইরে ঝুলিয়ে দিয়ে ও বাড়ির ফিরে যায়। এই চেনা দৃশ্যের মঞ্চায়ন অল্পসময়ের ব্যবধানে তৃতীয়বার ঘটে গেলেও ‘গেন্ডা’র পক্ষে জোরালো সওয়াল করতে কেউ আসেনি। সবাই যে যার স্বার্থ বুঝে নিয়ে খোলসে ঢুকে পড়ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষ। বদলাচ্ছে নিয়ম, অচেনা হয়ে পড়ছে দৈনন্দিনের পৃথিবী। দ্রুত বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনা গেন্ডা। আধুনিকতার যাঁতাকলে পড়ে হাঁসফাঁস করে। বিপন্ন ‘গেন্ডা’ তাই অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
-“চৌকিদার… বাহার ইতনা হল্লা কিঁউ?”- শব্দ পৌঁছেছে বড়সাহেবের চেম্বারে। ভ্রু কোঁচকান তিনি। সদ্য জয়েন করেছেন দিন পনেরো হল। এ যাবৎ এহেন আপদের মুখোমুখি হন নি। সহকারী ম্যানেজাররা অপ্রস্তুত, সন্ত্রস্ত। বেল বাজিয়ে চৌকিদারকে ডাকা হয়। চৌকিদারের কাছে ‘গেন্ডা’ বিষয়ক অনেক স্কুপ-নিউজ সংগ্রহ করে নেন বাগানের দন্ডমুন্ডের কর্তা। ‘গেন্ডা’-র ঠিকুজি কোষ্ঠি থেকে শুরু করে এভাবে হুটহাট অফিস টার্গেট করে তেড়ে আসা এবং এই আক্রমণের নেপথ্য কারণ অবধি। সব জেনে তার কপালের ভাঁজ আরেকটু গভীর হয়। চোয়ালের হাড়গুলোয় কাঠিন্য জেগে ওঠে।
-“উসকো পকড়কে অন্দর লাও।” হুকুম জারি হয়। আদতে ‘গেন্ডা’ ওরফে ফিলিপ এক্কা একজন সরল সিধে মানুষ তাবৎ রাজপুর তা জানে। কিন্তু রোখ চাপলে ওকে রোখা দায়। স্বভাবে তৃণভোজী, আপাত নিরীহ, গাত্রপুরু, একাচোরা প্রাণীটির সাথে ওর ব্যাপক মিল। মিল আরো প্রকট হয় প্ররোচনায়, যখন শৃঙ্গ বাগিয়ে একবগ্গা বুনো-টার মতই ও তেড়ে আসে। ওর এহেন আচরণের জন্যই ‘গেন্ডা’ নামটা ল্যাংবোটের মতো জুড়ে গেছে ওর নামের সাথে।
-“তুম হল্লা কিঁউ কর রহা থা?” কাজ করেছে, বেতন পায়নি। রাগ তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যে আর নগদে বেতন মিলবে না, সেকথা ওকে কে বোঝাবে। বোঝানোর চেষ্টা যে হয় নি তা নয়, বিস্তর হয়েছে। ও বুঝতে চায় ন, চায়ও না। এতকাল যেভাবে বেতন পেয়েছে সেভাবেই নগদ টাকা হাতে পাওয়া চাই। এটাই ও জানে। বাপ ঠাকুদ্দার যুগ থেকে চলে আসা ‘দস্তুর’ দুম করে বন্ধ করে দেওয়া হবে কেন, কেনই বা হয়রান হবে ‘মজদুর’ আর কেনই বা নগদ টাকায় বেতন মিলবে না। নগদ না মিললে ‘তলব’এর দিন দুর্গা-টাঁড়ে ‘গুদরি’ হাটও বসবে না। হাট না বসলে ছোটো ছোটো দোকানিগুলোর পেটে লাথি পড়বে। এমনটাও বা কেন হবে! ইত্যাকার নানান ‘কেন’ ভেতরে ভেতরে তাতিয়ে তুলেছে ‘গেন্ডা’কে। এসবের পেছনে নির্ঘাৎ ‘গরমিন্ট’ আর মালিকের গোপন চক্রান্ত রয়েছে, এই সহজ সত্যটা আর কেউ না বুঝুক ও বোঝে। তাই ওকে বোকা বানানো অত সহজ নয়।
-“মোকে বুরবাক্ সোইছিস কি কা? মোয় ‘গেন্ডা’ হাকো। মোকে না শিখাবে।” বোকা ভেবে কেউ ওকে শেখাতে আসুক ‘গেন্ডা’র সেটা বেজায় না-পসন্দ। কথায় কথায় তাই ‘মোকে না শিখাবে’টা ওর মোক্ষম পাঞ্চলাইন।
বড়সায়েবের চেম্বারে ঢুকে টলোমলো পদক্ষেপ অটোমেটিক নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। অতঃপর অ্যাটেনশান মোডে সলিড একটা স্যালুট ঠুকে বলে, “মেরেকো তংখা নেহি মিলা সাব!” এই ‘তেরেকো’ ‘মেরেকো’ বলা হিন্দি লব্জ আর স্যালুটের কায়দাটা ও রপ্ত করেছে দিল্লিতে বছর খানেক সিকিউরিটির কাজ করতে গিয়ে। নতুন নিয়মের ফেরে পড়ে বেতন পায়নি। কারণটা যদিও বড়সায়েব আগেই সেকেন্ড ক্লার্কের কাছে জেনে গেছেন। তবু পুনরায় আদ্যোপান্ত শুনে নেন ‘গেন্ডা’র মুখে।
সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও নিয়মটা প্রথমে অনেকেই মানতে চায়নি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে একলপ্তে একটি নির্দিষ্ট অংকের বেশী টাকা তুললেই উৎসমূলে ট্যাক্স কাটা যাবে। আদেশ জারি হতেই তামাম কর্পোরেট মালিকদের ঘুম উড়েছে। তড়িঘড়ি নির্দেশ এসেছে ম্যানেজারের কাছে। তিনি সেই এত্তেলা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেন লেবারদের কাছে। সকলেই যেন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর অফিসে জমা করে। বেতন আর নগদে মিলবে না। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে। সেজন্য অবশ্য ব্যাংকে যেতে হবে না তাদের। ব্যাংকের লোক এসে মেশিনে প্রত্যেকের টিপছাপ নিয়ে টাকা দিয়ে যাবে। এত কিছুর পরও লোকের ধন্দ যায় নি। পাতলা কুয়াশার মত দ্বিধা লেগে ছিল সবার মনে।
‘পাতি-মেলা’-য় (দলবদ্ধ ভাবে যেখানে চা-পাতা তোলা হয়) যখন নোটিশটা পড়ে শোনাচ্ছিল বুধুসর্দার, মৃদু আপত্তি ভেসে আসছিল টুকরো টাকরা। আশপাশের অনেক বাগানেই এমন নোটিশ এসেছে। নতুন ব্যাবস্থা কায়েমও হয়েছে কোথাও কোথাও। এমন কথাও অনেকে বলাবলি করতে থাকে। শুনতে শুনতে আচমকা রাজপুরের তিন নম্বর লেবার ইউনিয়নের সেক্রেটারি সুখন মাঝি এগিয়ে এসে নোটিশটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে দেয়। তারপর বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে ছোটখাটো একটা বক্তৃতাও দিয়ে ফেলে নতুন ফরমানের বিরুদ্ধে। সুখনের বক্তব্য নাড়া দিয়েছিল ফিলিপকে। রক্তের তাপমাত্রা তখন থেকেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সুখনের ইউনিয়ন যদিও সরকার বিরোধী, ধকটাও খানিক স্তিমিত, তবু ওর গরম গরম কথাগুলো অনেকে খেয়েও নিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল যারা খেয়েছিল তারা সেসব হজম করে অনেক ভেবেচিন্তে ব্যাবস্থাটাই মেনে নিল। এরপর থেকেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যখন ক্রেডিট হতে থাকল, বেতনের টাকা দেখা গেল, ঝাঁকের অধিকাংশ মাছ নিরাপদ স্রোতে ভেসে গেলেও দু চারটে ‘জিদ্দি’ কুচো যারা ফেঁসে গেছিল বাঁশের খালুইয়ে, তারাও অগত্যা বাধ্য সন্তানের মতোই নথি জমা দিয়ে টাকা পেতে লাগল ব্যাংক মারফত। এমনকি দেখা গেল চুপিসাড়ে সুখন মাঝিও বয়ান বদলে সামিল হয়েছে সেই ঝাঁকেই। শুধু ‘গেন্ডা’ই পারল না। ওর একটেড়ে জিন ওকে বাধা দিয়েছিল প্রবল। যে কারনে এই নিয়ে দু-দু’টো পাক্ষিক বেতন ওর ঝুলে আছে।
-“তুম ব্যাংক খাতা কা নাম্বার কিউ নেহি জমা কিয়া?” এতকাল খাতায় টিপছাপ দিয়ে আঙুলের বাড়তি কালিটা প্রথমে কাউন্টারের বাইরের দেয়ালে এবং শেষটুকু মাথায় ঘষে টাকা হাতে নিয়েছে ফিলিপ এক্কা। টাকা গুনে সন্তর্পণে পাতলুনের পকেটে গুঁজে ও ধীরেসুস্থে পা বাড়াত অফিস গেটের বাইরে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চৌমাথা তক পৌঁছে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে যেত। ডাইনে না বাঁয়ে, বাঁয়ে না ডাইনে। ডাইনে হাট। সেখানে না গিয়ে বাঁদিকে ঘরের রাস্তা ধরলে কিছুটা টাকা অন্তত বাঁচে। বাঁচানো টাকা চৌকির তলায় মাটি খুঁড়ে রাখা হাঁড়িটাতে গোপনে চালান করে দিতে পারলেই বুকের ভেতর নিশ্চিন্তির নরম রোদে ছেয়ে যায়। অসময়ে ওই সঞ্চয় বড় কাজে লাগে। আগে রাখত ঘরের পাহাড়িবাঁশের খুঁটির চোরছেঁদায়। এভাবে রাখতে গিয়ে ‘নোটবন্ধী’-র সময় জব্বর ফেঁসে গেছিল ‘গেন্ডা’। টাকা বাতিল ঘোষণা হতেই মাথায় বাজ। বোনাসের টাকা থেকে একটা হাজারের নোট ছেঁদায় ঢুকিয়েছিল। এছাড়া ছাগল বেচে ফাগনিকে লুকিয়ে রাখা দুটো পাঁচশোও ছিল ভেতরে। প্ল্যান ছিল আরো কিছুটা জমলে কয়েক বান্ডিল টিন কিনে জলচোঁয়ানো টিনগুলো বদলে ফেলবে বর্ষার আগে। তার আগেই বিপত্তি। নোট বদলাতে সবাই যখন ব্যাংকে ছুটছে, মাঝ দুপুরে বাঁশ কেটে টাকা বের করে তুলে দিতেই হল বৌয়ের হাতে। কেননা ‘গেন্ডা’র ‘বেঙ-খাতা’ নেই। ফাগনির আছে। অ্যাকাউন্ট খোলার কথা পইপই করে বলেও মরদকে বোঝাতে পারেনি ফাগনি। ওর বদ্ধমূল ধারনা, ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকা কমে যায়। ব্যাংক-বাবুরা টাকা খেয়ে ফেলে। এছাড়া ‘গেন্ডা’র ভোটার কার্ডেও লাপরা। বাপের নাম ভুল, ছবি আরেকজনের। ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য পাঠালেও এদিকে বায়োমেট্রিকে কেন যেন আঙুলের ছাপই উঠছে না। যে কারনে আধার অধরা রয়ে গেছে। কার্ড বানাতে যেখানে গেছিল সেখানকার ফাজিল ছোকরাটা বারবার চেষ্টা করে শেষে বলে কিনা, “কাকা, তোর চমড়ি মোটায় যাহে। নি হোই।” ইঙ্গিতটা যে ওর নাম-মাহাত্ম্যের প্রতি সেটা বুঝেও ‘গেন্ডা’ কিছু বলে না। সেই থেকে নথির গেরোয় পড়ে আছে গেন্ডা। কিন্তু এখন যে শিয়রে সমন! অ্যাকাউন্ট না থাকলে যে বেতনই জুটবে না। বেতন না পেলে সংসার চলবে কিভাবে!
-“মেরা বেঙ-খাতা নেহি হ্যায় সাব।” সটান কবুল করে ‘গেন্ডা’ সায়েবের কাছে। তারিখ মতো আজই ছিল ‘তলব’, মানে বেতনের দিন। গতকালই টাকা ক্রেডিট হয়েছে সবার অ্যাকাউন্টে। অফিস বারান্দায় ব্যাংকের একজন মাত্র করেসপন্ডেন্ট বায়োমেট্রিক যন্ত্র নিয়ে বসে মোবাইলে সময় হত্যা করে চলেছে। লোকজন আসছে না আর তেমন। প্রথম দিন অনেক লোক এসেছিল নতুন কায়দায় টাকা তুলতে। তিনটে যন্ত্র বসাতে হয়েছিল সেদিন। খবর পেয়ে আশপাশের মৌয়াবাড়ি, শিমুলগুড়ি, কার্মাহাটা থেকে হাটুয়ারা, যারা আশাহত হয়ে পড়েছিল নগদ না মেলায় হাট বসবে না বলে, তারাও শেষ মুহূর্তে এসে দোকান সাজিয়ে বসেছিল। তারপর থেকে ফের আস্তে আস্তে ছবিটা ফিকে হতে শুরু করেছে। অফিসে এসে টাকা তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না আর কেউ। যে যার সুবিধামতো যখন খুশি কাছের ব্যাংক, এটিএম, আধার কিয়ক্স থেকে একটু একটু করে টাকা তুলে নিচ্ছে। বাইরের দোকানিরাও তাই গতিক বুঝে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আসছে না আর কেউ। রাজপুর দুর্গা-টাঁড়ের হাট বন্ধ হয়ে গেছে। ফাঁকা মাঠটার দিকে তাকালে মনে হয় যেন হঠাৎ করে চাকরি গেছে তার। কর্মহীন মানুষের মত আকাশের দিকে তাকিয়ে সে-ও যেন অনেক ‘কেন’র উত্তর খুঁজে চলেছে ‘গেন্ডা’র মতোই।
-“চলো, ইসবার কে লিয়ে ক্যাশ দে দিয়া। আগলে বার খাতা নম্বর নেহি দেনেসে তংখা নেহি মিলেগা। আউর আইন্দা অফিস আকর এইসা চিল্লাওগে তো তুমহারা কাম বন্ধ্ করে দেগা, সমঝা?” ‘গেন্ডা’কে হালকার ওপর কড়কে দিয়ে ম্যানেজার ফিলিপ এক্কার দু’মাসের বকেয়া বেতন নগদে মিটিয়ে দিতে বলেন বড়বাবুকে। টাকা হাতে পেয়ে পা ঠুকে মিলিটারি স্যালুট ঠোকে ‘গেন্ডা’। তারপর বাইরে এসে টাকাটা গুনে পকেটে ঢোকায়। অফিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা চ্যাংড়া চৌকিদার ‘গেন্ডা’র নগদ অর্থপ্রাপ্তিতে কিঞ্চিৎ যেন বিস্মিত হয়।
-“পইসা পাই গেলে কাকা!” গেন্ডা উত্তর করে না। অপ্রত্যাশিত নগদ প্রাপ্তি ওকেও যেন খানিকটা অবাক করেছে।
অফিস চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ‘গেন্ডা’ বাইরে আসে। শীতের হিম সন্ধ্যা কখন যেন দ্রুত শুষে নিয়েছে বিকেলের আলো। হাঁটতে হাঁটতে চৌমাথাটায় পৌঁছে অভ্যাস বশে ‘গেন্ডা’ খানিক দাঁড়ায়। ডানদিকে তাকিয়ে দেখে দূরে দুর্গা-টাঁড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো মোবাইল টাওয়ারটার মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আধুনিক সভ্যতার মিনারটা বড্ড বেশি চকচক করছে। ঘোর লাগে ‘গেন্ডা’র চোখে। নেশাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ও যেন দেখতে পায় দুর্গা-টাঁড়ে ফের হাট বসেছে। পলিথিন শিটের তলায় দোকানগুলোতে চাইনিজ চার্জারের আলোয় শেষহাটের বেচাকেনা চলছে। গুটিকয়েক দোকানি দোকান গুটিয়ে গাড়িতে তোলার তোড়জোড় করছে। হঠাৎ যেন কানে বাজে, “গুদরি সিরায় যাথে বেটা, খাজা নি পাবে, জলদি চল’”- হাট শেষ হয়ে গেল রে বেটা, মিঠাই পাবিনা আর, জলদি চল। অনেকদিন পর স্পষ্ট বাপের গলা শুনতে পেল গেন্ডা। কুয়াশা নামতে থাকা হাটের দিকে দ্রুত পা চালিয়েছে বাপ। বাপের পেছনে ছোট্ট ছেলে। হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে পড়ছে ছেলেটা। পেছন ফিরে বাপ তাকে দেখে। তারপর এগিয়ে এসে কাঁধে তুলে নেয় ছোট্ট ‘ফিলি’কে। খানিক দাঁড়িয়ে গেন্ডা অপলকে চেয়ে দেখে কুয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব, শৈশবের গুদরিহাট, হাটে বেচতে আসা মনমাতানো গন্ধমাখা তিলখাজা, খুর্মা, ‘গোপো’। নিস্তরঙ্গ রাজপুরের বুকে ক্ষণিকের শহুরে আস্বাদ। ঘোর কাটতেই নিঃশব্দে দীর্ঘস্বাস ছেড়ে টালমাটাল পায়ে গেন্ডা ঘুরে যায় উল্টোদিকে। ডিজিটাল সভ্যতার তাড়া খাওয়া এক বিপন্ন প্রাণ ধীরে ধীরে নিজেকে আড়াল করে নেয় নিবিড় নীলিমা জড়ানো বনান্তের ওপারে।