ছাতা বিষয়ক কথকতা

Chata-Bishoyok-Kathokatha-Ramyo-Rachona-Bengali-Story-Sukanta-Nahe-Kunal-Das-Pandulipi-dot-net

লেখা: সুকান্ত নাহা | ছবি : কুণাল দাস

বর্ষা ঢুকলেই ছাতা বেরিয়ে আসে। কিছু ঢুকলে তবেই না কিছু বেরোয়। আর্কিমিডিস গামছা পরে চৌবাচ্চায় না ঢুকলে কি অমন সত্যটা বেরিয়ে আসত? এ হলো জাগতিক নিয়ম। রোগ ঢুকলে টাকা বেরিয়ে যাবে। আবার ওষুধ ঢুকলেই রোগ বেরোবে, চাকু ঢুকলে রক্ত বেরোবে, শীত এলে সোয়েটার বেরোবে, তেমনি বর্ষা এলেই ছাতা বেরোবে। কার্যকারণ সম্পর্ক। তবে হ্যাঁ, বর্ষা এলে ছাতার সঙ্গে আরো কিছু বেরোয়। যেমন রেনকোট, ওয়াটার-প্রুফ ব্যাগ, আগাছা, প্যাচপ্যাচে কাদা, ব্যাঙের ঘ্যাঙোর-ঘ্যাং, বাজারে ইলিশ, নাকের সর্দি। তবু ছাতার মতো নস্টালজিক, রোমান্টিক কিছু হয় না। বর্ষা আর ছাতা যেন তবলা আর সন্তুরের যুগলবন্দী। ছাতাহীন বর্ষা কখনো ভাবা যায়! বর্ষাতি কস্মিনকালে ছাতার বিকল্প হয় নি, হতে পারে না। ছাতা হ’ল বাপের মতো। শেষদিন অবধি রোদ-বৃষ্টি থেকে আড়াল করে যাবে। আগেকার দিনে বাড়ির পিতা বা পিতৃস্থানীয়রা বুক ঠুকে বলতেন, “চিন্তা করস ক্যান। অখনো তর বাপ বাঁইচ্চা আছে, মরে নাই।” বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তখন হয়ত দু’মাসের বাকি সুদ আদায় করতে আসা কাবুলিওয়ালাটা হাসছে। কুছ পরোয়া নেহি। হালত-পাংচার তো কেয়া হুয়া! বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়ার মানসিকতা জেগে আছে কুম্ভের মতো। তেমনি ফুটো ছাতা জল চোঁয়ালেও সেটাই ভরসা। আমাদের বাগানের বাবুদের বাগাল জেঠা তামাংয়ের ছাতার কাপড় ফুটো চালনি, তবু মাথাছাড়া হয়নি কোনদিন। ছাতা ঝড়-জলের সাথে লড়ছে, লড়বে। ফুটো, তবু ভরসা হয় মাথার ওপর কিছু একটা আছে। তবে সেসব ক্ল্যাসিক্যাল ছাতা মোটেই হাল ফ্যাশনের ফোল্ডিং নয়। ছাতা সেগুলিই সবচেয়ে রিলায়েবল যেটা রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে, খেলার মাঠে, মধ্যরাতে রাস্তার খেঁকি কুকুর তাড়াতে, পাওনাদার থেকে কিংবা পরকীয়া চলাকালীন স্ত্রী কিংবা স্বামী অথবা দুজনকেই আড়াল করতে অপরিহার্য। বাঁশের বাঁট, মোটা শিকের ছাতা হ’ল বড়ে গোলামের দরবারি-র মতো। ধারে ভারে ওজনদার। কাঠের বাঁট যদি মান্না দের ‘গোরি তেরি পয়জনিয়া’ হয় তো স্টিল- বাঁট হলো গে কিশোর কুমারের, ‘মেরে নয়না শাওন-ভাদো।’ আর ফোল্ডিং হল পাক্কা রকস্টার। গান গাইতে গাইতে কখন যে ডিগবাজী খাবে ঠিক নেই। তবু ছাতা ছাতাই, বিকল্প নেই তার।


আর অন্যদিকে বর্ষাতি হ’ল খানিকটা গার্লফ্রেন্ডের মতো। কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকেও কেমন যেন আনফেইথফুল ক্যারেক্টার। যত দামি বর্ষাতিই চাপাও না কেন, কোথা দিয়ে যে নিঃশব্দে জল গলে অন্দরমহল ভিজিয়ে দেবে, খুললে মনে হবে, ‘আহা বেচারা বুঝতে পারেনি… অসাড়ে করে ফেলেছে’। আধুনিক রেনকোট তো আরো ডেঞ্জারাস। বাহারি তার রং। সার দিয়ে শো-উনডোতে ঝুলছে। গোলাপি,সাদা, হলুদ, নীল, ডালিমদানা, কুসুমরঙা, পেস্তাসবুজ- তাকালেই মনে হয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেকেলে রাতচরা ডিটেকটিভ কিরিটি কিংবা দীপক কুমারের মত কালো কুচকুচে কিংবা রেলের পয়েন্টসম্যানদের মত খাকি, জাবদা, বদখত দেখতে নয়। তবে সেগুলো বেশ টেকসই ছিল। হালফিলের রেনকোট ছিপছিপে, তন্বী, সেক্সি দেখতে হলেও দুদিন যেতে না যেতেই কখন যে রিলেশান ব্রেক করে যাবে গ্যারান্টি নেই। তার ওপর কিছু আবার স্বচ্ছ। স্বচ্ছন্দে এপার ওপার দেখা যায়। ভীষণ রিস্কি। নাকে মুখে লাঞ্চ-পাঞ্চ করে, ঢকঢক জল খেয়ে বাইকে চেপে অফিস ছুটেছেন, হঠাৎ রাস্তায় হিসি চেপে গেল। রাস্তার ধারে বাইক দাঁড় করিয়ে অনেক কসরৎ করে সবে শুরু করেছেন, বসের ফোন। তাড়াহুড়োয় ওঠার সময় দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেলেন। ব্যাস, অফিসে ঢুকেছেন কি ঐ স্বচ্ছ বর্ষাতি ভেদ করে ‘কচ্ছ’-র রণ অবধি আপনার অন্তরাত্মা দর্শণ করে নিল অনেকেই। রক্তিমা ম্যাডাম কিছু বলতে এসে আরো রক্তিম হয়ে কিছু না বলেই সরে গেলেন। এই হল মোস্ট আনরিলায়েবল অ্যান্ড ভালনারেবল ফান্ডা অফ ট্রান্সপারেন্ট রেনকোট।


ছাতা হল বিশ্বস্ত বন্ধু। অপদস্থ করে না সচরাচর। তবে সকলেই যেহেতু পোড় খাওয়া ছত্রপতি নয়, কেউ কেউ পতি, তাই বেশীর ভাগ তালকানাদের ছাতা প্রায়শ তাদের নাকে-নরুণ করে ছাড়ে। তেমনি এক গেঁড়েমদন হারু পাল। ছাতা বগলে জীবনে প্রথম স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গেছে। ঢোকার মুখে কেউ ফোড়ন ছাড়ল, “ও হারুদা, ছাতা নিয়া লাভ নাই। খুলতে পারবা না। রাইখে আসো বাড়িতে।” হারু নির্বিকার চিত্তে ঢুকে গেল ভেতরে। খেলা চলছে। উত্তেজনা যখন চরমে, হঠাৎ বৃষ্টি নামল। আর সঙ্গে সঙ্গে রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ফটাস করে হারু পাল, পেল্লায় সাইজ কে. সি পাল ছেতরে দিল। “আরে… আরে.. গেল গেল, আমার চশমা…”, ছাতার শিক কখন যে পাশের জনের রিমলেস টার্গেট করে ছিটকে দিয়েছে সামনের সারিতে হারু পাল তাল পায়নি। “স-সরি” বলার অবকাশও হ’ল না, চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা দু’ অক্ষর,চার অক্ষরের মুষলবর্ষণ হারুকে নিমেষে ধর্ষণ করে ছেড়ে দিল, “আরে অ্যাই শালার… মাকড়া কোথাকার… ছাতা বন্ধ কর, খেলা দেখব না তোর ইয়ে দেখব…” হারু তেতে উঠে পেছন ফিরতেই প্রবল আক্রোশে পাশের ‘ভাঙা-রিমলেস’ এই চান্সে হাত বাড়িয়ে ছাতার লক টিপে দিতেই গেঁড়েমদন হারুর বদন হারিয়ে গেল ছাতার ভেতর। আর ঠিক সেই মোক্ষম সময়েই গো-ল। উত্তেজনায় ফেটে পড়া দর্শক গো-ওওওল বলে চেঁচিয়ে উঠে মুহুর্তে ছিনতাই করে নিলো হারুর ছাতা। নিয়ে ওড়াতে শুরু করে দিল। ঝিরঝির বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজে- কাক হারু দেখতে পাচ্ছিল হাতের ছাতা বেহাত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্যালারিময়। হাতবদল হতে হতে রিলে রেসের ব্যাটন যখন ফিরে এলো হাতে, তখন আর সেটা ছাতা নেই। ছাতু হয়ে গেছে।


জীবনে একজনকেই দেখেছিলাম, শৌখিন ছাতারু। তিনি হলেন আমাদের ব্যানার্জীদা। বাড়িতে ছাতার আর্কাইভ। গোটা বারো ছাতা তো হবেই। স্টকে ব্যক্তিগত ছাতাই মোট পাঁচটা। বাড়ির কারো সাধ্য নেই ওগুলোতে হাত লাগায়। পাঁচটার মধ্যে তিনটে সাবেক। একটি ফোল্ডিং। তার একটি আবার ইম্পোরটেড। হংকং মার্কেট থেকে কেনা। সরু স্টিলের বাঁট। যেমন ছিপছিপে দেখতে তেমনি মিশমিশে কালো সিল্কের কাপড়। মেড-ইন-চায়না। ঘের প্রায় আটচল্লিশ ইঞ্চি। ডাবল স্প্রিং। সুইচ দিলেই শব্দহীন উন্মোচন। আহা, যেন দুহাত ছড়িয়ে ভোরঘুমের আড় ভাঙল জেনেলিয়া ডিক্রুজ।


ছাতার যত্নের কথাই যদি বলতে হয় তো দুই চরমপন্থীর কথাই শোনা যাক। এক, ঐ সুকল্যাণ ব্যানার্জী, অন্যজন আমাদের পাড়ার মাছ ব্যবসায়ী কাম সুদখোর, হাফলুঙ্গি- নগেন সাহা। জীবনে লুঙ্গি যার হাঁটু ছাড়াল না। রাস্তায় ছাতা ঠুকে ঠুকে তাগাদায় যেতে যেতে আগা-র স্টিলের টুপি দু’মাসেই গায়েব। শিক থেকে কাপড় খসে পড়ে লতপত করছে। ন্যাংটো শিকের বেপরোয়া উছৃত ডগা ভিড়ে-ভারে এর তার পেছনে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে অসভ্যের মতো। নগেনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যেমন লক্ষ্য নেই রোদ্দুরে কাঁধে লটকে থাকা খোলা ছাতার জং-ধরা রডটা কখন গত-জন্মে-গায়ে-ওঠা ফতুয়ার কাঁধটা রাঙিয়ে দিয়ে গেছে। বৃষ্টি এলে শিক চোঁয়ানো জল টুপটাপ ভিজিয়ে দেয় নগেনের পাতলা চুল আর ফতুয়ার কাঁধ। ঝোড়ো বাতাস রিভার্স-সুইং করলে ডিগবাজী খায়। ওদিকে সুকল্যান ব্যানার্জীর ছাতা আবার কখনোই মাটি ছোঁয় না। এলিট ক্লাস। বন্ধ ছাতা ঝোলে কনুইয়ের ভাঁজে। বাড়ি ফিরতেই সেটা লটকে পড়ে আলমারির পেছনে। আর বর্ষা যেতেই সবকটা যত্নে পাটপাট ভাঁজ হয়ে, খাপবন্দী উঠে যায় দেরাজের ভেতর। সামান্য সেলাই খুলল কি তৎক্ষনাৎ সেটা রিপেয়ার হয়ে গেল। আর এই যত্নের সুবাদেই লাস্ট ফাইভ ইয়ারস কোনো ছাতা কেনেননি ব্যানার্জীদা।


উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে চ রাষ্ট্রবিপ্লবে, ছাতাই বন্ধু, পরম সখা। শ্রাদ্ধবাসরে ছাতা অপরিহার্য। শ্রাদ্ধ কিংবা পুজোয় রেনকোট দিতে দেখেছেন কেউ? জানিনা আগামীতে পুরোহিত কল্যাণ সমিতি সংবিধান সংশোধন করে সেটাও ঢুকিয়ে দেবে কিনা। তবে দুর্ভিক্ষ বাদ দিলে রাষ্ট্র বিপ্লবেও ছাতার ভুমিকা অপরিসীম। ছাতা মাথায় মিছিল, মিটিং, স্লোগান। লাফরা লাগলে পেঁদিয়ে পাট করতে ছাতাই ভরসা। একসময় স্কুলজীবনে চিরশত্রু বয়েজ হাইয়ের সঙ্গে খেলা পড়লে অলিখিত নির্দেশ ছিল মাঠে ছাতা নিয়ে খেলা দেখতে যাওয়ার। কেননা রেজাল্ট যাই হোক না কেন শেষে ক্যাচাল লাগবেই। অপোনেন্টের মার সামলাতে ঐ ছাতাই ভরসা।


ছাতা হারাতে হারাতে ফেড আপ হয়ে ছাতা নেওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল হরিদা। আমাদের কলেজ হোস্টেলের সিনিয়র দাদা। বৃষ্টি নামলে তাই ভেজাটাই ভবিতব্য মেনে চিরকাল ন্যাতা আমসত্ব হয়ে রুমে ফিরত। আর আমার এক মাতুল ছাতা বিহনে কেমন যেন ইনসিকিওরড ফিল করতেন। কেননা টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার নেড়িগুলো কি এক অজ্ঞাত কারণে মামার পেছু নিত। আর সারাটা রাস্তা কুকুর গুলোকে আম্ব্রেলা-পয়েন্টে তফাতে রেখে মুখে হ্যাট-হ্যাট করতে করতে ঘরে ফেরা ছিল তার নৈমিত্তিক বিটিং-রিট্রিট। একদিন কুকুরের অত্যাচার সীমা ছাড়ালে তেরিয়া কুকুরগুলোর সামনে বেমক্কা হড়াক করে ছাতা হড়কে দিয়ে এমন চমকেছিলেন যে সেদিনের পর ওগুলো আওয়াজ দিলেও পিছু নিতো না আর।


ছাতা বিষয়ক শেষ একটা গপ্পো শুনিয়ে ইতি টানছি। বাঙালিরা অনেকে ছাতাকে ছাতি বলে। ছাতি ভিন্নার্থে বক্ষদেশও বটে। চা-বাগানে এককালে কোনো কোনো বাবু-মাঈজিরা শহরে বাজারে করতে যেতেন পেছনে চাকর নিয়ে। চাকর ব্যাগ সামলাত। একদিন এক বড় বাবুর স্ত্রী গাড়ি নিয়ে গেলেন বাজারে। সঙ্গে সহজ সরল বাচ্চা একটি আদিবাসী ছেলে। ছাতা হাতে ভদ্র মহিলা বাজার করছেন। জিনিস কিনছেন আর বলছেন, “মংরু সামান ঠো ভর লো।” হঠাৎ খোঁপা খুলে যেতেই উনি ছেলেটাকে মোলায়েম স্বরে বললেন, “মংরু ছাতিঠো পাকড়ো তো।” বাচ্চাটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফের বললেন, “আরে, আগে আও। ব্যাগ রাখকে ছাতি পাকড়ো!” তবুও সে হাঁ করে চেয়ে আছে মুখের দিকে। শেষে নিজেই কাছে এসে বললেন, “ক্যায়া বোলা তুম শুনা নেই, জলদি ছাতিঠো পাকড়ো।” থতমত খেয়ে ভেবড়ে গিয়ে ছেলেটা এরপর বাজার শুদ্ধ লোকের সামনে যা ঘটিয়েছিল তা আর কহতব্য নয়।

Author: admin_plipi