জলসিঁড়ি

জলসিঁড়ি ।। লেখা – সুকান্ত নাহা ।। ছবি – কুণাল

শীত পড়তেই চা-গাছগুলো যখন মাথা মুড়িয়ে সন্ন্যাস নেয়, মাইলকে মাইল ছায়াগাছগুলোর মনেও তখন বৈরাগ্য আসে। বসন্তে যখন পাতাহীন শাখা মেলে গাছগুলো একতারা হাতে বিবাগী বাউল হয়ে ওঠে, তখন যেন সেই বৈরাগ্যের ছোঁয়াচ লাগে চা-জমির ঢালু প্রান্তভূমি ছুঁয়ে থাকা জলহীন পাথুরে নালাগুলোতেও। ভুল করে সেখানে কোঁচবকের ঝাঁক নেমে পড়ে দেখে কোথাও একবিন্দু জলের চিহ্নমাত্র নেই। নিরাশ হয়ে তারা ডানা মেলে উড়াল দেয় আকাশে। আদিগন্ত জলনিঃস্বতার মাঝে অশ্বত্থতলার শান বাঁধানো প্রাচীন কুয়োটারই শুধু ছুটি মেলেনি এতকাল। বুড়ো-কুয়ো জল জোগাতে হাঁফিয়ে উঠেছে। বসন্তে শুকিয়ে গেছে বুক। তবুও শেষরাতে কোনো এক অজানা রহস্যবলে জীর্ণবুকের হাড়পাঁজর ঠেলে কিছু সময়ের জন্য উঠে আসতো মিঠেজল। কেন, তা কেউ জানে না। মানুষের বিশ্বাস কুয়োয় ‘জলদেওতা’র বাস। শুখা মরশুমেও জলদেবতা তাই বুক ফাটিয়ে পানীয় জলটুকু অন্তত যোগান দিয়ে গেছে। ভোর রাতে উঠে মানুষ জল সংগ্রহ করে নিত। কেন না রোদ উঠতেই যে ফের শুকিয়ে যাবে কুয়োর বুক। বুড়ো-কুয়ো এভাবেই জল জুগিয়েছে। তৃষ্ণার্ত রাখে নি কাউকেই এতকাল।

মানুষ কুয়োটাকে তাই পুজো করে। কেউ সেখানে চান করে না, কাপড় ধোয় না, বাসন মাজে না। সে সব সারতে মানুষ যায় টিলার নিচে শীর্ণকায় পাহাড়ি ঝোরার কাছে। এতদিন কুয়োটা জলদানে অকৃপণ ছিল বলেই মানুষজন পানীয় জলের জন্য নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক চৈত্রের ভোরে জল আনতে গিয়ে একজন দেখল কুয়ো শূন্য। একবিন্দু জল নেই তাতে।

খবর ছড়াতেই লাইনের মেয়ে-বৌ সকলে ভীড় জমাতে লাগল কুয়োর কাছে। বেশ কিছু মরদও জুটে গেল খবর পেয়ে। উঁকি মেরে কুয়োর ভেতর তাকিয়ে তারা ভেঙে পড়লো হতাশায়। কাছাকাছি বিকল্প পানীয় জলের উৎস বলতে টিলার নিচে একটা কাঁচা কুয়ো আছে বটে, তবে সে কুয়োর জল খেলে মানুষ প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষজন তাই নিজেদের অসহায় বোধ করতে লাগল। নিশ্চয়ই কেউ কুয়োর জলে চান করেছে বা বাসন মেজেছে। যে কারনে ‘জলদেওতা’ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সন্দেহের তিরে বিদ্ধ হতে থাকে অনেকেই। নির্দিষ্ট করে কাউকে বলির পাঁঠা না করা অবধি কারো মনে স্বস্তি হয় না কিছুতেই। ঝোপবুঝে এই মোক্ষম সময়ে চৈতন নাইক তার পুষে রাখা তিরটা ছুঁড়ে দেয়, “উ-দিনা মোয় দেইখো, রাইত ঘড়ি উইঠকে রোজিঠো ই কুপ কর পানি সে উকর লুলহা ছোউয়াঠোকর হাগল লুগা ধোয়কে লেগলক।” রাতের অন্ধকারে রোজি নাকি কুয়োর জলে ওর জড়ভরত ছেলেটার বর্জ্য মাখানো কাপড় ধুয়েছে। কথাটা যেন আগুনে ঘি ফেলল। উপস্থিত অনেকেই ক্ষেপে উঠল নিমেষে। যে ভীড়ে বিনীতাও ছিল। কিন্তু অসন্তোষের স্রোতে ভেসে না গিয়ে চটজলদি পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে বিনীতা, “তোঁয় আপন আঁইখসে দেইখিস?” (তুই নিজের চোখে দেখেছিস?) দুম করে কেউ কাউন্টার করে দেবে আঁচ করে নি চৈতন। একরোখা বিনীতার সামনে তাই আমতা আমতা করতে থাকে, “মোয় নি দেইখো… মোকে উ… কে হর জুন্ বাতালাক…” (আমি দেখিনি, কে যেন বললো আমাকে…) চৈতুর কথা শুনে যা বোঝার বুঝে নিয়ে ফুঁসে ওঠে বিনীতা, “ইকরমে রোজি ভৌজি (বৌদি) কে নি ফাঁসাবে তো! আগে ইসোব কালে নি বাতালে? তোহার ধান্ধা হামিন নি বুঝোনা সোচোথিস?”

এসবের মধ্যে রোজিকে টেনে আনাটা পছন্দ হয় না বিনীতার। তাছাড়া ওর কথায় যুক্তি ছিল। চৈতু আগে কেন বলেনি। তাল বুঝে এসব তথ্য উত্থাপনের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে!
সমবেত আক্রোশ বিনীতার পাল্টা প্রত্যাঘাতে ধন্ধে পড়ে যেন হঠাৎ থিতিয়ে পড়ে। চৈতু যে রোজিকে ফাঁসানোর তাল করছে না এর বাস্তবতা কেউ একেবারে উড়িয়ে দিতে পারে না। স্টিফানের একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগী চৈতু, রোজিকে একলা পেয়ে একদিন মত্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে জবরদস্তি করতে গেছিল। রোজির চিৎকারে আশপাশের দু একজন ব্যাপারটা জেনে গেলেও তা পাঁচকান হয় নি। অথচ সারা ময়নাধূড়ায় সেটা চাউড় করে দিল স্টিফান নিজেই। একঢিলে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায়নি। দলবদলু চৈতন আর আশ্রয়দাতা যোহান দুজনকেই বদনাম করে বেকায়দায় ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। খুব একটা সুবিধে হয় নি তাতে। মাঝখান থেকে চৈতুর যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ল রোজির ওপর। রোজিকে বিপাকে ফেলার সুযোগটা ফের ঘেঁটে যাচ্ছে দেখে মরিয়া হয় চৈতু। তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলের লক্ষ্যে জল সমস্যা সমাধানের প্রস্তাবটা ছুঁড়ে দেয়। প্রথমত, পঞ্চায়েতের কাছে দরখাস্ত করা হবে কুয়ো সংস্কারের জন্য। তাতে সকলকে ‘ঠেপা’ (টিপছাপ) দিতে হবে। আর সরকারি কল যাতে বসে তার জন্য দরবার করতে হবে জেলা পরিষদের কাছে। দায়িত্বটা আগবাড়িয়ে চৈতু নিজের কাঁধেই তুলে নেয়। ঘোষণা করে দেয় ডিপালাইনে কল বসবেই। তবে তার জন্য দুটো শর্ত পালন করতে হবে। এক, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের টিকিট পেলে চৈতন নাইককে জেতানো চাই। দুই, সংস্কারের পর এই অশ্বত্থতলার ‘বুড়া-কুপ’ থেকে রোজি যেন জল নিতে না পারে, সেটা সবাইকে দেখতে হবে। ও অপয়া। ও থাকলে ডিপালাইনের কিস্যু হবে না। চৈতনের প্রস্তাব কেউ কেউ মেনে নিলেও বিনীতা বেঁকে বসে। চৈতুর আসল উদ্দেশ্য আঁচ করতে পেরে অধিকাংশ মেয়ে-বৌ বিনীতার দিকে ঝুঁকে থাকে। প্যাঁচে ফেলে শ-দেড়েক সুপারি গাছ সমেত বাড়ি আর স্বামীত্যক্তা যৌবনবতী রোজিকে দখলে আনার স্বপ্ন চৈতনের অনেকদিনকার। বৌ মরার পর সেই স্বপ্নে যেন ডানা গজিয়েছে। অবশ্য দখলদারীর এই বিদ্যেটা গুরু স্টিফানকে দেখেই ওর শেখা।

(২)

হিসেব মতো দুটো সরকারি কল বসবার কথা ছিল ময়নাধূড়া চা-বাগানের ডিপালাইনের চল্লিশ ঘর বাসিন্দার জন্য। সেগুলো অন্যত্র বসানো হ’ল। লাইনে ঢোকার কাঁচা রাস্তাটাও আর পাকা হ’ল না। কাজটা ঝুলে গেছে। বাসিন্দাদের জব-কার্ড থাকলেও শেষ কবে ডিপালাইনে একশো দিনের কাজ হয়েছে মনে পড়ে না কারোর। এ সবই জেলা পরিষদ সদস্য যোহান মুন্ডার সঙ্গে ভূতপূর্ব পঞ্চায়েত প্রধান স্টিফান এক্কার রাজনৈতিক শত্রুতার জের। যেটা সকলেরই জানা। তামাম কার্মাহাটা ব্লকে একসময় স্টিফানদের মৌরসিপাট্টা চলত। ময়নাধূড়ার লেবার ইউনিয়নও ছিল তাদের দখলে। অফিস চত্বরে একটাই নিশান উড়ত। কেউ বিরোধী দলের নিশান তুললে, কিংবা ভোটের আগে রাতের অন্ধকারে গোপনে দেয়ালে লিখলে পরদিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। এমনই এক তুঙ্গ সময়ে ফুটবল খেলা নিয়ে ঝামেলা বাঁধল। বছর চল্লিশের স্টিফানের দলের সাথে পঁচিশের যুবক জোহানের। মার খেতে হলো যোহানকে। স্টিফান বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেলো যোহান। শত্রুতার বীজতলাও তৈরি হলো সেইদিন।

এই ছবিটাই একদিন উল্টে গেল। পাল্টে গেল দিন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়ে যোহান মুন্ডা জিতল। জিতলেও পঞ্চায়েত প্রার্থীর ব্যালট কাউন্টিং এ দেখা গেল ডিপালাইন বুথের ব্যালটে স্টিফানের দলের পক্ষে ভোট পড়েছে বেশি। মার্জিনাল ভোটে যোহানের দল জিতলেও অস্বস্তিটা থেকেই গেল। এবং তারপর থেকেই কাকতালীয় ভাবে থমকে গেল ডিপালাইনের উন্নতি। তাতে অবশ্য নিজের উন্নয়ন মোটেই আটকায়নি যোহানের। কার্মাহাটায় পাকা বাড়ি হল। দু ভাইয়ের নামে দু- দু’টো এইট-সিটার গাড়ি নামল রাস্তায়। ব্যাংক ব্যালান্স কোলা ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। স্ত্রীর স্কুলের চাকরিটাও পেকে গেল। শুধু রঙচটা মোটর সাইকেলটাই দীনতার বিজ্ঞাপন হয়ে সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকল যোহানের সাথে সাথে। আর এসব দেখেশুনেই তাল বুঝে চৈতুর মতো বিরোধী চুনোপুটি ঝাঁকবেধে মিশে গেল যোহানের দলে। হাওয়া মেপে স্টিফান অবশ্য ঢের আগেই ডেরা পেতেছিল মানঝোরার জঙ্গলবস্তিতে। ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে যেখানে পাঁচবিঘা ধানি জমি সমেত দলীয় কর্মীর বিধবাকে একদা ফিক্সড ডিপোজিট রেখেছিল। এখন সেই সম্পত্তি ভাঙিয়ে ওর দিন কাটছে। এদিকে ডিপালাইনের ‘ডিপা’ অর্থাৎ উঁচু জমিটার শেষপ্রান্তে বাসক-নিশিন্দার বেড়াঘেরা সুপারি, নারকেল, সেগুন, গামারের ছায়ায় ঢাকা সেমি-পাকা লেবার-কোয়ার্টারে রোজি তার আট বছরের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিরালম্ব পড়ে থাকে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে। যে ছেলের বোধবুদ্ধি স্বাভাবিক নয়। হাতে তুলে খাবার খেতে পারে না। হাঁটতে গেলে পা জড়িয়ে আসে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে অবিরত। ভোরে উঠে ছেলের নোংরা করে ফেলা কাপড়-জামা ধুয়ে, গা মুছিয়ে,খাইয়ে তবে কাজে যেতে হয় রোজিকে। কাজে যেতে দেরি হলে হাজিরা কাটা যায়। বাড়ি ফিরে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নানান কাল্পনিক আশংকার জাল বুনতে বুনতে নির্ঘুমে রাত কাটে রোজির।
(৩)

কাজ থেকে ফিরে সেদিন রোজি দেখে বাড়ির সামনে হাতে একটা কাগজ নিয়ে বিনী দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আরো কয়েকজন। কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “হিনে এগো ঠেপা কইর দে ভৌজি। পঞ্চায়েত বাটে জমা করেক পড়ি।” চৈতু কিছু করার আগেই ওর আইডিয়াটা হাইজ্যাক করে নিয়েছিল বিনীতা। ওর ডাকে গ্রামের আশি শতাংশ মানুষ সাড়া দিয়েছিল। কাজে ‘নাগা’ (কামাই) করে সইসাবুদ জোগাড় করেছিল বিনীতা। কুয়ো-সংস্কার, সরকারি কল, সি.সি রোড, একশো দিনের কাজ ইত্যাদি নানা বিষয় উল্লেখ করে দরখাস্তটা লিখে দিয়েছিল বিনীর কলেজে পড়া ছেলে। সেই চিঠির কপি বিডিও, এসডিও, জেলা পরিষদ, ডি.এম এমনকি মেল মারফৎ মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর অবধি পৌঁছল। পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে স্মারক জমা দিতে রোজিকে সামনে রেখেছিল বিনী। সঙ্গে ছিল গ্রামের আরো জনা পঞ্চাশেক মেয়ে, বৌ, বাচ্চা, মরদ। পঞ্চায়েত অফিসের সামনে মিডিয়াকেও বুদ্ধি করে ডেকে এনেছিল বিনীর ছেলে। প্রধানের কাছে স্মারকপত্র জমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সুন্দর করে ‘বাইট’ দেয় বিনিতা। রোজিকে দিয়েও বলিয়ে নেয় দু চারটে অসহায়তার কথা। বিভিন্ন চ্যানেল সেটা প্রচার হয় সেদিন। চৈতনকে কোণঠাসা করতে রোজিকে শিখন্ডী করে পুরো প্ল্যানিংটা এত সুন্দর করে ছকেছিল বিনীতা যে ম্যাজিকের মতো কিছুদিনের মধ্যেই কুয়ো সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে যায়। বুড়ো-কুয়ো জল ফিরে পেয়ে ফের ফোকলা দাঁতে হেসে ওঠে। আর সেই জলে ময়নাধূড়ায় ভেসে ওঠে নতুন মুখ। বিনীতা লোহার।

দেখতে দেখতে এগিয়ে আসে পঞ্চায়েত ভোট। ভোটের আগে নতুন করে দুটো সরকারি কলের শিলান্যাস করে যায় যোহান মুন্ডা নিজে এসে। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে যোহানের পাশে দাঁড়িয়ে ফিতে কাটার কাঁচিটা এগিয়ে দিতে দেখা যায় বিনীতাকে। দুজনের মাঝে কিছুক্ষণ কথাও হয়। দূর থেকে এসব লক্ষ্য করে চৈতু। কাছে আসে না। গাড়িতে ওঠার আগে যোহান শুধু ওর পিঠে আলতো হাত রেখে কিছু বলে যায়। সেই স্পর্শে চৈতুর ভেতরের জ্বালা যে তিলমাত্র প্রশমিত হয় না সেটা ওর শরীরী ভাষায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

                  (৪) 

ভোটে জিতে বিনিতা এখন পঞ্চায়েত প্রধান। বাগানের কাজে ইস্তফা দিয়ে সারাদিন মৌয়াবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের গদিআঁটা চেয়ারে বসে মানুষের অভাব অভিযোগ শোনে। আজ কার্মাহাটার বিডিও অফিস তো কাল সদরে জেলা পরিষদের অফিস… মিটিং মিছিল… সব মিলিয়ে ফুরসত মেলে না বিনীর। হালে পানি না পেয়ে চৈতু ভোটের অনেক আগেই কাজ জুটিয়ে সটকে পড়েছিল ভিন রাজ্যে। অন্যদিকে ডিপালাইনে নতুন কল বসে গেল। পাকা সড়ক থেকে সি. সি রোড ঢুকে পড়ল লাইনে। অশ্বত্থতলার কুয়োতলায় এখন সারাদিন মানুষ জল তোলে। একশো দিনের কাজ হয়। বিজলি বাতি আগেই ছিল। এখন বাড়িতে কম্পিউটার বসিয়ে আধার লিংকে টাকা তোলা, অনলাইনে বিজলি-বিল, বিমার-প্রিমিয়াম, মোবাইল, ডিশ টিভি রিচার্জ, অনলাইন ফর্ম ভর্তির ব্যাবসা খুলেছে বিনীতার ছেলে। আধার লিংকে আঙুল ছুঁইয়ে লাইনের মানুষ তলবের (বেতন) টাকা তুলে নিয়ে যায়। হাজারে দশ, বিল পেমেন্টে কুড়ি, রিচার্জে কমিশন, ইনকাম মেরে কেটে মন্দ হয় না। মৌয়াবাড়ি হাটে দোকান সমেত একটা ঘর কিনেছে বিনী। দিনদেখে ছেলেটা সেখানে শিফট করে গেলেই নিশ্চিন্তি। তারপর আস্তে আস্তে পুরনো ঘর ভেঙে মাথা তুলবে দোতলা। ছেলের বিয়ে হবে। মৃত স্বামীর নামে ফলক বসবে বাড়িটার সামনে। স্বপ্নচারায় মাঝে মাঝেই জল ছেটায় বিনীতা।

কেবলমাত্র রোজির জীবনটাই শুধু সেই একই তারে বেজে চলেছে এখনো। অশ্বথতলার কুয়োটায় এখনো ও জল আনতে যায় না। সেখানে গেলেই স্টিফানকে জড়িয়ে বৌগুলো ওকে বাঁকা কথায় বিঁধতে ছাড়ে না। স্বামী ছেড়ে গেলেও তার বদনামটুকু এঁটুলির মতো গায়ে সেঁটে রয়েছে এখনও। ইদানিং কেউ আর খোঁজও করে না রোজির। বর্ষায় ছেলেটা শূলঝাড়ায় (রক্ত-আমাশায়) মরতে মরতে বেঁচে গেল। অনেকে মানা করেছিল ঢিলার নিচের কাঁচা কুয়োর জল খেতে। রোজি শোনেনি। মানুষের বাক্যবাণের চাইতে ওই বিষ জল হজম করা বোধহয় সহজ। চৈত্রের ঝড়ে গামার গাছ উপড়ে রোজির শোবার ঘরটা ভেঙে গেছে। পাশের রান্নাঘরে দুটো ছেগরি আর লাকড়ি (ছাগল আর জ্বালানি কাঠ)র পাশে মা-ছেলে কোনোমতে চারপাইতে ঘুমোয়। বাগানের ম্যানেজারকে অনেকবার জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এখন আশায় শুধু দিন গোনা, বোনাসের টাকাটা কবে হাতে আসবে। হাতে এলে তবেই সারিয়ে তুলতে পারবে ঘরটা।

সেদিন লাইন-মিটিং এ এসে ভাঙা চালাটা হঠাৎ চোখে পড়ে বিনীতার। রাস্তা থেকে সে উঁচু গলায় ডাক পাড়ে রোজিকে। ডাক শুনে উঠোনে এসে দাঁড়ায় রোজি। পেছন পেছন ছায়ার মত ওকে অনুসরন করে ছেলেটা। বিনীতা বেশ জোর দিয়ে শোনায়, “ঘর টুটলাক মোকে কালে নি বাতালে ভৌজি? একদিন পাঞ্চায়েত বাটে আয়কে আপ্লিকেশান মে ঠেপা দেইকে আবে। তোহিন লে পাক্কাঘর বানায় দেবু, সরকার বাট সে।”
ঘর ভাঙার খবরটা না জানানোয় অনুযোগ করে বিনীতা। সেই সাথে সরকারি ঘর পাওয়ার ঘোষণাটা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে আড়চোখে চারপাশটা একবার দেখে নেয়। দু’চারটে চেনা মুখ চোখে পড়ায় উৎসাহিত হয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল বিনীতা ঘটা করে। কিন্তু রোজির নিরুৎসাহিত অভিব্যক্তি ওকে যেন অবাক করে। রোজির ঠোঁটে ম্লান হাসি। কোনো কথা নেই। পেছনে মায়ের শরীর আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বড় বড় চোখ করে বিনীকে দেখে। ঠোঁট দিয়ে লালা গড়ায়। মুখ বেঁকিয়ে সে-ও কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে হাসে। সে হাসির অর্থ বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করে বিনীতা। অদ্ভুত একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিবেকের শেকড়বাকড়ে। হাসি মুছে গিয়ে ছেলেটার খর চোখ আপাদমস্তক জরিপ করতে থাকে বিনীতাকে। মনে হয় চাহনিটা যেন সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। অব্যক্ত হিমশীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীর জুড়ে। দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত সরে আসে বিনী। মাটির সরু পথ ছেড়ে নতুন সি. সি রোডটায় ওঠে পড়ে। অদূরে হাইওয়েটা দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পা চালায় বিনিতা লোহার। থামলে চলবে না। সামনে আরো অ-নে-ক, অ-নে-ক, অনেকটা পথ যে যেতে হবে তাকে।

Author: admin_plipi