
বসুন্ধরার নবজাগরণ (পর্ব ৮ )
শিপ্রা মজুমদার তরফদার
পরিমল ওদের সাথে এসে ট্রেনে তুলে দেয়। এ ক’দিনে আকবর যেন ওর ছোট ভাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট মেহের এই নিঃসন্তান দম্পতির মন জয় করে নিয়েছিল। বেরোবার সময় মুক্তি কেঁদেই ফেলে। আকবর পরিমলদার ব্যবহারে শুধু কৃতজ্ঞ নয়, অভিভূত হয়ে যায়। রাস্তার দাদা ওদের যেন নিজের দাদা হয়ে উঠেছিল এই কদিনে। ট্রেন ছেড়ে দেয়… আকবরের গন্তব্য পূর্ব মেদিনীপুর। সেখানকার গ্রামের ছেলে আকবর।
আকবরের পরিস্থিতি রামুর মতো খারাপ নয়। গাঁয়ে নিজস্ব জমি আছে, ঘর আছে, সেখানে আকবরের আম্মি থাকে। ঘরে ফেরার আনন্দে ওরা খুব খুশি। মাঝে মাঝে বন্ধুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কাল ফোনে রামুর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। সন্ধ্যা ভাবীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শাবানার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। ওদের দুটো পরিবার খুব কাছের ছিল। ট্রেন ছুটে চলেছে… কামরায় ওরা ছাড়া আরও একটা পরিবার আছে। এরাও ঘর ছেড়েছে রোগের কারণে সব কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। ট্রেনেই পরিচিতি বাড়ে। সরকার থেকে ওদের মত ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরার জন্য এই বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। ট্রেনটা ফাঁকা ফাঁকা, সবাই সবার থেকে দূরে দূরে বসে আছে। আবার মনে পড়ে সন্ধ্যা ভাবীর কথা। সরকার যদি প্রথম থেকেই ব্যবস্থা নিত তাহলে হয়তো ভাবীকে এত পথ হাঁটতে হ’ত না, আর বিশ্বটা মা-হারা হ’ত না।
অনেকদিন পর সবাইকে পেয়ে আকবরের আম্মি খুব খুশি হয়। ওরা চলে যাওয়ায় আম্মি খুব একলা হয়ে পড়েছিল, আর সেজন্যই হয়তো আল্লাহ আবার ওদের আম্মির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আকবর মনে মনে ঠিক করে আর যাবেনা ভিন রাজ্যে, বাকি জীবনটা ক্ষেতে দেখাশোনা করে চলে যাবে।
এদিকে রোগের প্রকোপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। যত বাড়ছে অসুখ প্রচারের আলোতে মানুষে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে, মানসিক দূরত্বও বেড়ে চলেছে। সব মানুষ যেন সব মানুষকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। এ কেমন রোগ যে মানুষকে পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা করে তুলছে?
আকবর যে দিল্লি থেকে পরিবার নিয়ে বাড়িতে এসেছে এখবর গ্রামে ঘরে ঘরে আলোচনা হতে থাকে। ওদের সাথে এখন একদম মেশা যাবে না, এমনকি ও বাড়ির আশেপাশে ও যাওয়া চলবে না। গ্রামের মাতব্বর কয়েকজন বিকেলে এসে বাড়ির বাইরে থেকে আম্মাকে বলে যায় ওরা যেন ঘরের বাইরে একদম বের না হয়।
আকবরের বাবা শাহিন মোল্লা ছিল সে সময়ের লেখাপড়া জানা মানুষ। তাই ছোটবেলা থেকে একটু পড়াশোনার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে আকবর। সে টেন পাশ করতেই শাহিন ক্যান্সারে মারা যায়, তারপর আকবরের আর তেমন পড়াশোনা হয় না। আকবরের গ্রামের প্রায় ২০-২৫ জন ছেলে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে কাজের জন্য। গ্রামে থাকলে চাষবাস ছাড়া উপায় নেই, তাই একটু বেশি পয়সা রোজগারের আশায় এরা পাড়ি দিয়েছিল ভিন রাজ্যে। অন্য রাজ্যে দিনমজুর এর কাজ করে কিছু পয়সা জমাতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু বিধাতার হয়তো এমনই লিখন তাই আজ সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে, রওনা দিয়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই এসে এখনো পৌঁছায়নি, ওদের আসার পথ চেয়ে বসে আছে ওদের পরিবার। গ্রামের সজাগ মানুষদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। একে একে সবাই এসে পৌঁছবে, আর সেটাই ওদের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ। সাথে করে আবার রোগ নিয়ে আসছে না তো ওরা? ওদিকে শোনা যাচ্ছে পাশের গাঁয়ে বিহার থেকে কিছু ছেলে বাড়ী ফিরেছে, সবারই জ্বর। এ ভাইরাস শরীরে ঢুকলে নাকি জ্বর হয় প্রথমে তারপর লোকে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। আকবর বাড়ি ফেরার থেকে দেখছে গ্রামটায় কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, যেন মানুষজন নেই এই গ্রামে।
বিকেলে ওরা তিনজন উঠোনে বসে গল্প করছিল। মেহেরকে দাওয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে ও হাত-পা নেড়ে খেলছে। এমন সময় কানে এল কান্নার রোল এত কান্নাকাটি কিসের বুঝতে আকবরের আম্মা এগিয়ে যায়। শাবানার বুক কেঁপে ওঠে মনটা সকাল থেকে কেমন অস্থির লাগছে ওর। কি হ’ল কে জানে? আম্মা না এলে তো কিছু জানা যাবে না। রহিম চাচার বাড়ি থেকে যেন কান্নার শব্দ আসছে। রহিম চাচার ছেলে আব্দুল ভাই বাইরে গিয়েছিল কাজে ওদের আবার কিছু হ’ল না তো? কিছুক্ষণ বাদে সমস্ত বিষয়টি জানা গেল আম্মা ফেরার পর। আব্দুল ভাইরা দল বেঁধে ফিরছিল রেললাইন ধরে অনেক রাস্তা হেঁটে ওরা ক্লান্ত হয়ে রেল লাইনের উপরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ খবর এসেছে ১৬ জনের ওই দলের উপর দিয়ে রাতে মালগাড়ি চলে গেছে। সবাই রেলে কাটা পড়ে মারা গিয়েছে। আম্মা বলছিল আব্দুল ভাইয়ের বউ ছিল পাঁচ মাসের পোয়াতি। ওরা যেভাবে মারা গেল এ যে ভাবাই যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন বাদে নিজের গ্রামে ফিরে এসে চারদিকের এত দুঃসংবাদ আকবরকে উদাস করে দেয়। এ ক’দিনে কত কি যে হয়ে গেল… যেন মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্নের মত। পরিমলদা আর মুক্তি বৌদিকে কোনদিন ভুলতে পারবে না ওরা। এ যেন পৃথিবীতে একদিক থেকে ভাঙ্গা আরেকদিক থেকে গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। সবই আল্লার ইচ্ছে কারো হাত নেই এতে।
চলবে …
বর্তমান পরিস্থিতিকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে…..
খুব ভালো হচ্ছে ।
ধন্যবাদ সবাইকে
বাহ! সব কটি গল্পো ভীষণ জীবন্ত। এই তো সেদিন এমনি একটি ঘটনা ঘটে। বাবা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
Thank you
গল্প গুলো আরো জীবন্ত লাগে আপনার কারণ বাস্তবের সত্যে মিল রয়েছে। নতুন ধারার লেখা। ধন্যবাদ লেখিকা কে।
ধন্যবাদ
Wow.. heart touching
ধন্যবাদ
সত্য ঘটনা অবলম্বনে? দারুন । হৃদয় স্পর্ষি।
ধন্যবাদ
করোনা নিয়ে ও পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে লেখা আপনার এই প্রবন্দের সবকটি পড়লাম। দারুন। বই লিখুন। খুব জীবন্ত প্রতিবেদন।।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনা কে… অনুপ্রাণিত হলাম
Khub bhalo laagchhe…. bortoman somoy ke sundor bhabe uposthapon kora hochhe
👍👍👍
Thank you